নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

পড়াশোনা করি। লেখালেখি করি। চাকরি করি। লেখালেখি করে পেয়েছি ৩টি পুরস্কার। জাতিসংঘের (ইউনিসেফ) মীনা মিডিয়া এ্যাওয়ার্ড ২০১১ ও ২০১৬ প্রথম পুরস্কার। জাদুর ঘুড়ি ও আকাশ ছোঁয়ার গল্পগ্রন্থের জন্য অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ শিশুসাহিত্য পুরস্কার ২০১৬।

বিএম বরকতউল্লাহ

জানতে চাই।

বিএম বরকতউল্লাহ › বিস্তারিত পোস্টঃ

গ্যাসকামাল

২৮ শে জুলাই, ২০২০ সন্ধ্যা ৬:৪১

কামাল ভাই গতবার পরীক্ষায় ফেল করে শিক্ষকদের বেত্রাঘাত, পরিবারের সদস্যদের গণপিটুনি আর সহপাঠীদের টিটকারী-তিরস্কারে অতিষ্ঠ হয়ে কানে ধরে শপথ করে বলেছিল, ‘সামনের বার দেখে দেব, পরীক্ষায় আমাকে ফেল করায় কীভাবে। যদি খালি বইয়ের পাতা থেকে প্রশ্ন আসে, আমার কলমের কালি বিট্র্রে না করে আর স্যারেরা যদি ঠিকমত কাগজ সাপ্লাই দিতে পারেন তাইলে আমাকে পরীক্ষায় ফেল করায় কে? বইয়ের আগা-গোড়া খাড়া মুখস্ত করে ফেলব না!
একই ক্লাশে পড়লেও আমরা কামাল ভাইকে শুধু ‘ভাই‘ বলে যে ডাকি তাই নয়; সম্মানও করি। কারণ তিনি আমাদের অনেক সিনিয়র। বোসকা-মোটা, রাসভারি ধরনের লোক। কম কথা বলেন। সবার সাথে মিশেন না। কখনোই তিনি সামনের বেঞ্চে বসেন না। পড়া না পারার জন্য স্যার যখন তাকে বেত মারেন, তিনি মুখটা খানিক বিকৃত করে নীরবে সুবোধ বালকের মত তা হজম করেন। বেত্রাঘাতের সময় বাধা প্রদান করে কোনো সমস্যা সৃষ্টি করছেনÑএমন অভিযোগ কেউ করতে পারবে না। এবারের পিটুনি আর সাঁটাসাঁটিতে কামাল ভাইয়ের মধ্যে কেমন জানি একটা বিরাট পরিবর্তন লক্ষ করা গেল। ভেতরে ভেতরে কামাল ভাই লেখাপড়ার ব্যাপারে ক্লাসের সব ভালো ছাত্রকে ডিঙ্গিয়ে যাবার জন্য যে কিছু একটা করছেন তা অবশ্য ঠাওর করা গেছে।
কামাল ভাই দুলালপুর স্কুলে পড়ে; ক্লাস এইট থেকে নাইন-এ উঠবে।
পরীক্ষা হয়ে গেছে।
আজ ফল ঘোষণার দিন।
মাথায় তেল দিয়ে সিতা করে ই¯িত্র করা জামা পরে মনের আনন্দে ক্লাসে গিয়ে বসল কামাল। চানমিয়া স্যার রেজাল্ট শিট নিয়ে এলেন ক্লাসে। কামাল ভাই অনেকটা নিশ্চিন্ত মনে ফলের জন্য অধীর আগ্রহে বসে টগবগ করতে লাগল।
পরীক্ষার ফল ঘোষণা করা হলো। কামাল ভাইয়ের নাম-গন্ধ নেই। সে ভাবল, স্যার বোধ হয় তার রেজাল্ট নিয়ে রহস্য করছেন। কামাল ভাইয়ের আর তর সয় না। হুট করে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, ’স্যার আমার রেজাল্টটা!‘
স্যার কামাল ভাইয়ের দিকে খানিক ঝিমধরে তাকিয়ে থেকে বল্লে¬ন, ’অ, তাই তো! আসল খবরটাই বাদ পড়ে গেল, আমাদের কামাল মিয়ার রেজাল্টের খবর। আচছা, তুই এদিকে আয় তো বাছা।’ স্যার এ কথা বলতেই কামাল ভাই ডান বাও তাকিয়ে বেঞ্চ ডিঙ্গিয়ে লম্বা পা ফেলে দ্রুত স্যারের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। এবং স্যারের হাতের রেজাল্ট সীটটা মাথা কাৎ করে আগা গোড়া পড়ার চেষ্টা করল।
স্যার কামাল ভাইকে বললেন, ’আচ্ছা কামাল, তোর ফলাফলটা কী হতে পারে একটু অনুমান করে বল তো, শুনি!’ কামাল উত্তেজিত হয়ে বলল¬, ’রেজাল্প কী হতে পারে মানে! রুল নাম্বার থাকবে এক দুইয়ের মধ্যে!’
স্যার মাথা নেড়ে বললে¬ন, ’অ তোর রুল নম্বর এক দুয়ের মধ্যে থাকবে, নাহ? কামাল প্রচন্ড আতœবিশ্বাসে মাথা ঝাকিয়ে বলল, জোর দিয়ে বলল, জি স্যার।
তার কথা আর মাথা ঝাকানি শেষ হতে না হতেই চানমিয়া স্যার বিছার মত লাফিয়ে উঠে কামাল ভাইয়ের কান প্যাঁচিয়ে ধরলেন। তারপর যে গতিতে ক্লাস রুম থেকে টেনে নিয়ে গেলেন এতে তার পা মাটি ®পর্শ করেছিল কি না সন্দেহ। স্যার তাকে সোঝা হেড স্যারের কামরায় নিয়ে স্যারের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে হাঁপাতে লাগলেন। আমরা ভয়ে ভয়ে দূর থেকে ফুচকি দিয়ে আমাদের মুরুব্বির এ ভয়াবহ বিপদ দেখার চেষ্টা করছি। দেখি, কামাল ভাইয়ের অবস্থা বড় খারাপ। বাঘের খপ্পরে পড়া অসহায় হরিণের মত অবস্থা তার। হেড মাস্টার হাফিজ উদ্দিন স্যার গভীর মনযোগে কি একটা কাগজ পড়ছিলেন তখন। তিনি মজিদ স্যারের হাঁপানির শব্দ পেয়ে চশমার উপর দিয়ে তাকিয়ে বললেন, ’ব্যাপার কী চানমিয়া সাব?’ স্যার রাগে কাঁপতে কাঁপতে বললে¬ন, ’গাধাটা এবারও ফেল করেছে, খাড়া ফেল। তার মত ছাত্রের কোনো দরকার নেই আমাদের। একটার জন্য দশটার বদনাম। এইবার নিয়ে তিনবার ফেল করেছে! তাকে এখনই টি সি দিয়ে বের করে দিতে হবে স্যার।’
স্যার এ কথা বলে কামাল ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রাগে কটমট করতে লাগলেন।
স্যারের মুখে এ কথা শোনামাত্র কামাল ভাইয়ের হাত-পা কাঁপাকাঁপি শুরু হয়ে গেল, সাথে তালে-বেতালে বুক ধড়ফড়ানি। কামাল ভাইকে খুব অসহায়ের মত দেখাচেছ। যে-ই কথা বলেন, তাঁর দিকেই কামাল ভাই ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। তার প্রসন্ন মুখটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। জিহ্বাটা বের করে বারবার শুকনো ঠোঁট ভেজাবার চেষ্টা করছে কিন্তু তার জিহ্বাটাও শুকিয়ে ঠন্ঠনা।
হেড স্যার প্রচন্ড মেজাজি মানুষ। কখনো বেশি কথা বলেন না। স্যারের চাহনির মধ্যে বিরাট ভয় ও রহস্য লুকিয়ে থাকে। তিনি ক্লাসে রুমের সামনে দিয়ে একবার হেঁটে গেলেই খবর হয়ে যায়। শিক্ষকসহ গোটা ক্লাস রুম ঠান্ডা। বেয়াদবি, পড়ায় অমনোযোগিতা ইত্যাদি কারণে যাকে একবার ধরেছেন তো তার দফা রফা করে ছেড়েছেন। হয় সে স্কুল ছেড়েছে, নয় তো মানুষের মত মানুষ হয়েছে। স্যারের এসব ভয়ংকর ঘটনা তার মনে যখন বিদ্যুৎ বেগে আসা যাওয়া করছিল, তখন হেড স্যার চোখের চশমাটা টেবিলে রেখে চেয়ারটা গড়গড় আওয়াজ করে সরিয়ে উঠে বললেন, ’টি সি তো পরের কথা, আগে ফেল করার হিসেবটা লই।’
কামাল ভাই তখন শুকনো মুখে ঘনঘন লা ইলাহা ইল¬া আন্তা পড়তে লাগল। তারপর হড়ড়ৎ হড়-গড়ড়ৎ গড় শব্দ করে পেটটা মোচড় দিয়ে উঠল তার।
হেড স্যার গম্ভীর স্বরে বললেন, ’তিনটা বেত লন।’ চানমিয়া স্যার তাড়াতাড়ি তিনটা বেত একত্র করে এনে হেড স্যারের হাতে দিলেন। ভয়ে শরীরটা প্রচন্ড ঝাড়া দিয়ে কেমন জানি আবার ঠান্ডা হয়ে গেল কামাল ভাইয়ের।
হেড স্যার বেত নাচাতে নাচাতে কামাল ভাইয়ের সামনে এসে বললে¬ন, ’বাংলাদেশের রাজধানীর নাম কি রে, বল।’ থতমত খেয়ে তড়িঘড়ি জবাব দিল, ’নসিন্দী, না, না, পলাশ, না, ঢাকা স্যার ঢাকা।’
জবাব শুনেই স্যার এক সেকেন্ডও দেরি করলেন না, পাঞ্জাবির হাতা গুটাতে গুটাতে বলে¬ন, ’সোঝা হয়ে দাঁড়া।’
কামাল সোঝা হয়ে দাঁড়াল। মনে হলো এলোমেলো হাড়গোড় একত্র করে কোনোমতে খাড়া করল সে। হেড স্যার মার শুরু করার আগে যাকে মারবেন তার আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করে নেন, এটা তাঁর রাগন্ত স্বভাব। স্যার রাগে দাঁত কটমটিয়ে কামালের মাথা থেকে চোখ বুলাতে বুলাতে পায়ের পাতা পর্যšত গিয়ে হঠাৎ থমকে দাঁড়ালেন। চোখ কপালে তুলে বিস্ময়ে বললে¬ন, ঘটনা কি! কামাল, তোর চোখে এক ফোঁটা পানি নেই, অথচ প্যান্টের নিচ দিয়ে কলকলিয়ে পানি বেরোচেছ যে!
‘পিশাব করে দিছি স্যার‘ - নির্বোধ বালকের মত এ কথা বলে কামাল ভাই স্যারের চোখের দিকে অপলক তাকিয়ে রইল।
স্যার আঁৎকে উঠে দু’হাত পিছিয়ে গিয়ে বললেন, ’কিহ, পিশাব করে দিয়েছিস!’
জি স্যার বলে কামাল পেছনে হাত চেপে ধরে চিঁ চিঁ করে কান্না জুড়ে দিল। তার কথা আর কান্না শুনে হেড স্যার প্রচন্ড বিরক্ত হলেন। তিনি ডান বাম তাকিয়ে অস্থিরভাবে চিৎকার করে চানমিয়া স্যারকে ডেকে বললেন- ’এদিকে আসেন। বদমাশটা তো সর্বনাশ করে ফেলবে দেখছি। দেখেন, সে আবার পেছনে হাতে কী চেপে রেখেছে তা সেই জানে। তাড়াতাড়ি ওকে আমার সামনে থেকে নিয়ে যান। তার গায়ে আমি একটা ফুলের টোকাও দিতে পারব না। আমার অফিস সর্বনাশ করে ফেলেছে সে। দেখেন, ফ্লে¬ারের অবস্থাটা, দেখেন!’
চানমিয়া স্যার ছুটে এসে ধনুকের মত বাঁকা হয়ে সুক্ষ্মভাবে ফ্লোরটা পর্যবেক্ষণ করলেন। তারপর ফট করে কামালের কান ধরে টেনে টুনে বাইরে নিয়ে যেতে লাগলেন। যাবার সময় পিশাবে ভেজা প্যান্টের খেস-ফেস শব্দের সাথে আরো যে কয়টা অবাঞ্ছিত শব্দ হলো। সবাই একবাক্যে বললেন, ’ওকে স্কুলের সীমানার বাইরে নিয়ে রেখে আসেন। বজ্জাতটা গ্যাস ছেড়েছে, ওয়াক থুঃ!’
চানমিয়া স্যার কামাল ভাইকে নিয়ে সাংঘাতিক বিপদে পড়ে গেলেন। স্যার কামাল ভাইয়ের কানে ধরে দ্রুতপায়ে স্কুল মাঠ পেরিয়ে সীমানার বাইরে গিয়ে বললেনন, ’তুই আজ বাঘের মুখ থেকে নিরাপদে ফিরে এলি। আর জ্বালাইস না। তুই এখন কী করবি কর আর কই যাবি যা।
কামাল চলে গেল, সে আর স্কুলের দিকে পা মাড়ায়নি।
পুত্রের ভবিষ্যৎ অমঙ্গল কল্পনা করে তার মা ও বাবা অস্থির হয়ে গেলেন। পরে তাদের নানা প্রতিশ্র“তি ও আবেদন-নিবেদনে হেড স্যার কামাল ভাইকে টিসি না দিয়ে এ স্কুলে পড়ার আরেকটা চান্স দিলেন।
কামাল ভাই নতুন উদ্যমে সুবোধ বালকের মতো স্কুলে যায়-আসে, লেখাপড়া করে।
কিন্তু সেদিনের সেই গ্যাস ছাড়ার ঘটনাটা পাইপমুক্ত গ্যাসের মত চারদিকে দ্রুত ছড়িয়ে গেল। ক্লাশে ছোট বড় সবাই কামাল ভাইয়ের পরিবর্তে তাকে ‘গ্যাসকামাল‘ বলে সম্বোধন করতে লাগল। সারা এলাকায় বাতাসের আগে আগে ঘটনাশুদ্ধ পৌঁছে গেল “গ্যাসকামাল“ নামটি।
অবশেষে কামাল ভাই চিন্তা করে দেখল, এ ‘গ্যাস বিড়ম্বনা‘ এড়াতে হলে ভাল রেজাল্ট করা ছাড়া উপায় নেই। অতপর সে নিজেই নিজের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে পুরোদমে পড়ালেখা চালিয়ে যেতে লাগল।
কামাল ভাই অবশ্য বহু চেষ্টা সাধনার বলে তার প্রতিজ্ঞা অক্ষরে অক্ষরে রক্ষা করে সবার মুখ উজ্জ্বল করেছিলেন।


মন্তব্য ৩ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (৩) মন্তব্য লিখুন

১| ২৮ শে জুলাই, ২০২০ সন্ধ্যা ৬:৫৪

চাঁদগাজী বলেছেন:



আপনাদের স্কুলের শিক্ষকগুলো বেকুব ছিলেন।

২| ২৮ শে জুলাই, ২০২০ রাত ১০:১৭

নেওয়াজ আলি বলেছেন: অভিনন্দন কামাল ভাইকে ।

৩| ২৮ শে জুলাই, ২০২০ রাত ১১:৩০

রাজীব নুর বলেছেন: হায় কামাল ভাই!

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.