নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
উদাস হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে প্রমত্তা পদ্মার পাড়ে ঘাষের নরম গালিচায় শুয়ে ঘাষের ডগা চিবুতে চিবুতে গভীর ভাবনায় ডুবে থাকতে দেখা যায় তাকে। যদিও বেশীরভাগ ভাবনাই দেশকে ঘিরে। পুর্ব পাকিস্থান ক্রমশই বেপরোয়া হয়ে উঠছে। দূরে জমে ওঠা কালো মেঘ দেখে ভ্রু কুচকে ওঠে, এ যেন আগত ঝড়েরই পুর্বাভাস। ছেলেটা উঠে পড়ে, মাথার নীচে রাখা মেশিন গানটা নিয়ে হাটতে থাকে গ্রামের দিকে। ঘাষের ডগাটা তখনো দাতের নিচে পড়ে পিষে যাচ্ছে। আর একরাশ ঘনো কালো চুলে ঢাকা মাথার ভেতরে দানা বাধতে থাকে ক্ষোভ। তার অসম্ভব শান্ত চলার ভাবভঙ্গীই বুঝিয়ে দেয়, এত সহজে কাবু হবার ছেলে সে নয়।
ছেলেটার জন্ম হয়েছিল বড় অশান্ত সময়ে। দেশ ভাগের ঠিকপুর্বে। বিশাল ভারতবর্ষের বুকে ছুরি চালাবার পুর্বেই যখন এক ধর্মালম্বী আরেক ধর্মালম্বির বুকে তলোয়ার চালাচ্ছে, ঠিক সেই সময়েই পৃথিবীতে আসে ছেলেটি। এসেই দেখতে পায় চারপাশে ধ্বংসলীলা। আকাশ ভারী হয়ে থাকে শকুনের উল্লাসে আর বাতাসে ভারী হয়ে থাকে স্বজন হারার আর্তনাদ। তবে ছেলেটা বুঝে যায়, দুনিয়াটা তার জন্য ফুলেল বিছানা নয়। বেচে থাকতে হলে নিজেকেই ফুল ছিড়ে সেটাকেই বিছিয়ে দিতে হবে জীবনের পথে। সে পেরেছিল, যদিও ইতিহাস তাকে একজন খুনী বলেই জানে। কিন্তু ছেলেটার হাতে অস্ত্র উঠেছিল শৈশবেই, তারপর শুধু নিজের জায়গা করে নেবার জন্য সংগ্রা ম করতে হয়েছে। সেই সংগ্রামে কখনো তার হাতে উঠেছে, তলোয়ার, কখনো কলম। সব জায়গাতেই সে ছিল দুর্নিবার।
তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের ভেদারগঞ্জ নামক গ্রামে ২৭শ অক্টোবর, ১৯৪৪ সালে একটি সাধারন গৃহস্থ পরিবারে জন্মগ্রন করে সিরাজ সিকদার। ছেলেটা যেহেতু মুসলমান, সুতরাং দেশ ভাগের পর সে পুর্ব পাকিস্থানের(বর্তমান বাংলাদেশ) বাসিন্দা। ভেবে নেন সমস্যা বুঝি মিটে গেল। এখন তার জীবনে আর কোন বাধা নেই। সে মনযোগ দেয় মানুষ হবার। তার দরিদ্র পিতা-মাতাকে সুখী করবার ব্রত নেন। সেই পথের প্রথম স্বীকৃতি পান, বরিশাল জেলা স্কুল থেকে ১৯৫৯ সালে প্রথম শ্রেনীতে ম্যাট্রিকুলেশন(বর্তমান মাধ্যমিক) পাশ করে। পদ্মা পাড়ের ছোট্ট মহকুমা শরীয়তপুরের বদরগঞ্জ গ্রামের দরিদ্র কৃষক পরীবের কাছে সেই অনেক। কিন্তু ছেলেটা যে অন্য ধাতুতে গড়া। সে ভর্তি হয় ব্রজমোহন কলেজে। সেখান থেকে ১৯৬১ সালে পাশ করেন আইএসসি (বর্তমান উচ্চমাধ্যমিক)। সেটাও কম মনে হলে, সে ঢাকায় আসে। ভর্তি হন পুর্ব পাকিস্থান প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বর্তমান বুয়েট)। তারপর শুধু সামনে এগিয়ে যাওয়া। কিন্তু ততদিনে, পশ্চিম পাকিস্থানের সাথে পুর্ব পাকিস্থানের সম্পর্ক তলানীতে এসে ঠেকেছে। পদ্মা পাড়ের ছেলে হওয়ায় বাতাসের বেগ দেখেই বলে দিতে পারে ঝড় হবে কিনা, সেখানে তো বাংলাদেশের বাতাসে তো বারুদের গন্ধ। রাজপথের রক্ত, থমথমে জনজীবন তার কাছে অচেনা নয়। সে পাকিস্থানের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়, যোগ দেয় “পুর্ব পাকিস্থান ছাত্র ইউনিয়ন”। এবং রাজপথের সৈনিক হয়ে অংশ নেন সকল ছাত্র আন্দোলনে। এই ডামাডোলে নিজের স্বপ্নকে ভেসে যেতে দেননি। ১৯৬৭ সালে তিনি প্রকৌশলী ডিগ্রী অর্জন করেন সম্মানের সাথেই। একই সালে ছাত্র ইউনিয়নের (মেনন গ্রুপ) সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। এবং বুয়েট থেকে পাশ করে সেই বছরেই যোগ দেন সরকারের সি এন্ড বি ডিপার্টমেন্টে। এতদিনে সে তার দরিদ্র পিতা-মাতার স্বপ্ন পুরন করতে পেরেছে। এবার নিজের স্বপ্ন পুরনের পালা।
১৯৬৮ সাল, পুর্ব পাকিস্থানের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক ছুরি হাতে বন্ধুর মত। সুযোগ পেলেই মেরে দেবে। সারাজীবনের সংবেদনশীলতা এবারও তাকে সাবধান করে দেয়, ভবিষ্যতের কথা। অন্য সকলের মত সেও একটি দল গঠন করে “পুর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন” নামে। যারা তৎকালীন সাম্যবাদী সংস্থাগুলোকে বৈপ্লবিক সাম্যবাদে রুপান্তরিত করার পথ অবলম্বন করে। কিন্তু তখনো তারা বাঙ্গালীকে চিনে নাই। সেই সময় বাঙ্গালী তখন একটি আলাদা দেশ চায়। যেটাকে তারা নিজেদের বলে দাবী করতে পারবে। একারনেই তার মতবাদে অনেকেই সাড়া দেয়। একবছর পরে, ১৯৬৮ সালে সে চাকুরি ত্যাগ করে। সিদ্ধান্ত নেন বাংলাদেশে মাও সে তুং গবেষনাগার প্রতিষ্ঠার। কিন্তু তৎকালীন পাকিস্থান সরকার ১৯৭০ সালে সেটি বন্ধ করে দিলে, তিনি যোগদান করেন কারিগরী প্রশিক্ষন মহাবিদ্যালয়ে লেকচারার হিসেবে। কিন্তু সেটাও টেকে না। মুক্তিযুদ্ধের কারনে। বাংলাদেশ উন্মত্ত স্বাধীন ভাবে পৃথিবীর বুকে নিজের একটুকু জায়গা করে নিতে। আর সেই উন্মাতাল অবস্থার চক্করে সিরাজের জীবনও কাটতে থাকে অস্থিরতায়।
অবশেষে যুদ্ধ শুরু হলে সে ফিরে যায় বরিশাল। ৩রা জানুয়ারী। ১৯৭১ সালে প্রতিষ্ঠা করেন “পুর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টি”। এবং বরিশালকে তিনি স্বাধীন ঘোষনা করে তার ঘাটি স্থপন করেন। এখান থেকেই সে এবং তার দল মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করে। এবং আসপাশের কয়েকটি জেলায় সে এবং তার দল মুক্তিযুদ্ধের সকল কার্য্যক্রম পরিচালনা করে। অবশেষে রক্তক্ষয়ী এক স্বাধীনতা যুদ্ধের পর বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে নতুন একটি দেশ জায়গা করে নেয়। কিন্তু দেশ স্বাধীন হলেও যুদ্ধ শেষ হয় না। হানাদার বাহিনীর অত্যাচার এবং নির্মম আক্রমনে ধ্বংসপ্রায় একটি দেশকে নতুন রুপে সাজিয়ে তোলার চিন্তায় সে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু এই স্বপ্নও অচিরেই ধুলিস্যাৎ হয়ে যায়। কারন দেশের পরিস্থিতি তখনো টালমাটাল অন্তর্দলীয় কোন্দল এবং ক্ষমতার লোভে।
যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে দুর্ভিক্ষ নতুন কিছু না। এটি প্রায় স্বাভাবিক ঘটনা, কিন্তু এই পরিস্থিতিতে মুজিব সরকারের উদাসীনতা এবং অব্যাবস্থাপনা দেখে তার ভেতরের বিদ্রোহী মন আবার জেগে ওঠে। ১৯৭৩ এর এপ্রিল মাসে সে “পুর্ব বাঙলার জাতীয় মুক্তি ফ্রন্ট” নামে নতুন একটি দল গঠন করে তৎকালীন সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করে। কিন্তু একটি দেশের সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়ী হবার মত কোন সম্ভাবনাই ছিলো না। তারপরও তার নেতৃত্বে তার দলের কর্মিরা সমাজে লুকিয়ে থাকা শোষক জমিদার এবং সুদের কারবারীদের উপর হামলা চালায়। এক পর্যায় তাদের এই উৎপাত সহ্য করতে না পেরে তৎকালীন সরকার তার এবং তার দলের বিরুদ্ধে পরোয়ানা জারি করে।
দীর্ঘ দুই বছরের অভিযান শেষে ১৯৭৫ সালে সিরাজ সিকদার চট্টগ্রামের হালি শহর থেকে গোয়েন্দা কর্মকর্তার দ্বারা গ্রেফতার হয়। এবং ২রা জানুয়ারী, ১৯৭৫ সালে ঢাকা এয়ারপোর্ট থেকে সাভারে রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্পে নিয়ে যাবার সময় রক্ষী বাহিনী তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। কোন ধরনের বিচার ছাড়াই, একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে শুধুমাত্র কয়েকজন আমলা সুবিধা আদায়ের জন্য হত্যা করার ঘটনা ইতিহাসে কম নেই। সে সাধারন কোন সন্ত্রাসী ছিলো না। সে ছিলো বুয়েট থেকে পাশকরা একজন উদীয়মান প্রকৌশলি, সেই পরিচয় আজ প্রায় অনেকেই জানে না। তাকে শুধুমাত্র এক দুধ্বর্ষ সন্ত্রসী রুপেই চিনি আমরা।
হায় সেলুকাস, কি বিচিত্র এই দেশ!
১৭ ই এপ্রিল, ২০২০ রাত ১১:১১
বাঙালী ঋষি বলেছেন: গণতান্ত্রিক দেশে গণতন্ত্রই নেই
২| ০৭ ই এপ্রিল, ২০২০ দুপুর ১২:৫৮
সাড়ে চুয়াত্তর বলেছেন: লেখাটা এক তরফা ও আবেগ নির্ভর হয়েছে।
১৭ ই এপ্রিল, ২০২০ রাত ১১:১১
বাঙালী ঋষি বলেছেন: একটু আবেগ দিয়েই লিখেছি। কারন তাকে শুধু সন্ত্রাসী হিসেবেই ইতিহাসে তুলে ধরা হয়েছে বেশী। আমি একটু অন্যভাবে তুলে ধরতে চাইলাম। অতিরঞ্জিত মনে হলে ক্ষমা চাইছি।
৩| ০৭ ই এপ্রিল, ২০২০ বিকাল ৩:২৩
রাজীব নুর বলেছেন: বিস্ময়!!!!
১৭ ই এপ্রিল, ২০২০ রাত ১১:১৩
বাঙালী ঋষি বলেছেন: ধন্যযোগ ভাইয়া
৪| ০৮ ই এপ্রিল, ২০২০ সকাল ১১:৩৯
নীল আকাশ বলেছেন: অনেক কিছুই বলতে ইচ্ছে করছে আমাদের ভার্সিটির এই অগ্রজ ছাত্র নিয়ে। কিন্তু মনে হচ্ছে এটা নিয়ে উচ্চবাচ্চ না করাই ভালও!!!
মানুষ অপরাধ করতেই পারে কিন্ত তাই বলে একজন মুক্তিযোদ্ধাকে ধরে এভাবে ধরে নিয়ে এসে নির্মমভাবে মেরে ফেলে এবং দম্ভভরে জনগন'কে কোথায় সে জানতে চাওয়াটা মনে হয় শোভন কাজ ছিল না।
১৭ ই এপ্রিল, ২০২০ রাত ১১:১৯
বাঙালী ঋষি বলেছেন: যেখানে প্রকৃত ইতিহাস লুকিয়ে স্বার্থান্বেষী ইতিহাস শিক্ষা দেয়া হয়। আবার এই ব্যাবস্থা নিয়ে গর্বভরে জয়গান গাওয়া হয় সেখানে আমাদের মত দুএকজনে কন্ঠস্বর চাপা পড়ে যাবেই। আশারাখি, একদিন হয়তো তাদের এই ভণ্ডামি চুর্ন হবে।
৫| ১৭ ই এপ্রিল, ২০২০ রাত ১১:২৩
সাড়ে চুয়াত্তর বলেছেন: জুয়েল আইচ কি এই দলে ছিলেন?
©somewhere in net ltd.
১| ০৭ ই এপ্রিল, ২০২০ রাত ২:৪১
নেওয়াজ আলি বলেছেন: বিনা বিচারে মেরে ফেলার কাজ এখনো চালু আছে।