নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ঋষিলিপি

বাঙালী ঋষি

Cogito, Ergo Sum

বাঙালী ঋষি › বিস্তারিত পোস্টঃ

অনিৎয়তা

০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৩২

১.
লোকটাকে বসে থাকতে দেখা যায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গেটে। গেটের ঠিক ডান পাশেই একটা জীর্ন চটের উপরে আসন পেতে বসে থাকেন। রোদ, ঝড়, বৃষ্টিতে তাকে ওখানেই বসে থাকতে দেখা যায়। ধুসর রঙের চুল-দাড়িতে ঢেকে যাওয়া চেহারার মাঝে উজ্জ্বল দুটো চোখ আর গায়ে থাকা সাদা পাঞ্জাবীটা কালের বিবর্তনে হলদে রঙ ধারন করেছে। তার জীর্ন একখানা চটের ঝোলা, একটা ব্রিফকেস সেটাও মান্ধাতা আমলের। ঠিক সকাল হলেই বহুদিন ব্যাবহার করা চকচকে নলি বাঁশের লাঠি নিয়ে ঠক ঠক করতে করতে এগিয়ে এসে বসেন তার পরিচিত স্থানে। দৃষ্টিশক্তিহীন চোখ দুটো দিয়ে কি করে চেনেন তা বাকী সবার কাছে রহস্যই থেকে যায়। কিন্তু কেউ জিজ্ঞেস করে না। তিনিও কারও সাথে সচরাচর কথা বলেন না। কারও কাছে কিছু চাইতে দেখা যায় না। কাওকে কিছু বলেনও না। কেউ কিছু দিলে সেদিকে খেয়ালও করেন বলে মনে হয় না। তবে মাঝে মাঝে তার ব্রিফকেস খুলে একটা জীর্ন কাগজ হাতে নিয়ে চুপচাপ বসে থাকেন। কি সেটা, কি লেখা আছে তা কেউই জানে না। কোন কোন সময় তাকে উত্তেজিত হতে দেখে আশে পাশের মানুষজন কিছুটা ভীত চোখে তাকিয়ে থাকে, অবশ্যই নিরাপদ দুরত্বে দাঁড়িয়ে। পাগলকে কেই বা বিশ্বাস করে বলুন। যদিও তিনি পাগল নন। উদ্যানের কিছু পথ শিশুদের কাছে খুবই চমৎকার চরিত্র সেটা কারও বলে না দিলেও চলে। প্রায়ই দেখা যায় দেখা তার দিকে কাগজের বল ছুড়তেই তিনি তার লাঠিটা মাথার উপরে এক পাক ঘুরিয়ে হাঁক ছাড়েন, “বেত্তমিজ শালার ঘায়ো মাছির দল, গেলি ইহাতন”। কিন্তু পোলা-পানগুলান বৈশাখের ঘেয়ো মাছির মত ঘুরে ফিরে আবার একই কাজ করে, তিনিও বিরামহীন ভাবে লাঠি ঘুরিয়ে সেই মাছি তাড়াতে থাকেন। কিন্তু সন্ধ্যা নামলেই দেখা যায় তাকে ঘিরে জটলা পাকে। জটলার ভেতরে দেখা যায় সকালের পোলাপানগুলাই তাকে ঘিরে বসে তন্ময় হয়ে গল্প শুনতে। সারা দিনের মধ্যে এটাই যে তার সেরা সময় সেটা তার গল্প বলার ভঙ্গী দেখেই বোঝা যায়। কয়েকজন উদ্দেশ্যহীন মানুষকেও দেখা যায় তাকে ঘিরে থাকতে। কিছুক্ষন অবাক হয়ে শোনে তার গল্প, কিসের এত গল্প করেন তিনি জানা যায় না। তাকে নিয়ে কারো মাথা ব্যাথা নেই। চারপাশের গতিশীল পরিবেশে তিনিই একমাত্র স্থির। তার কোন নাম নেই, কোন পরিচয় তিনি বহন করেন না। তার বাহ্যিক রুপটাই তার পরিচিতি। আশে-পাশের লোকজন তাকে দাদু বলে ডাকে। মুলত ছোটদেরই নামকরনের পেছনে বড় অবদান। কবে থেকে তিনি দাদু হলেন তাও এখন কেউ বলতে পারে না। উদ্যানের নিয়মিত আগন্তুকদের কাছেও তিনি ঐ নামেই পরিচিত।

২.
আমি..., প্রহর। বাবা মায়ের অনেক আশার ফলস্বরুপ ১৯৯১ সাল ২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে আমার পৃথিবীতে আগমন। সেই সুবাদেই পরিবারসহ আর সকলের কাছে আমি প্রহর নামেই বেশী পরিচিত। যদিও প্রাতিষ্ঠানিক নাম আরন্যক হাসান। বুদ্ধি হবার আগেই বাবা মারা যান। তিনি সরকারী কর্মকর্তা ছিলেন। তার মৃত্যুর সময়কার স্মৃতি নেই বললেই চলে। যতটুকুও বা আছে সেটা মায়ের মুখেই শোনা। সেটুকুও প্রায় ২৩ বছর ধরে একই রকম। দাদার দিকের আত্মীয়দের সাথেও সম্পর্ক শিতল। শুধুমাত্র ছোট চাচার ছেলে মইন ভাই বিশাল এক ক্যাম্প ব্যাগ নিয়ে হঠাত খবর না দিয়েই অতিথি পাখির মত আসেন। দু-একদিন থেকেই কাওকে কিছু না বলে চলে যান। চলে যাবার পরে দেখা যায় তার ব্যাগ ভর্তি বই। আর মায়ের দিকের নাকি কোন আত্মীয়ই নেই। তাই কর্মজিবী মায়ের আচলের নীচে বড় হতে হতে ছোটো বেলা থেকেই আমি একটু চাপা স্বভাবের। আমার ব্যাথা গুলো ভুলে থাকার জন্য শৈশব থেকেই বইয়ের পোকা আমি। এই অভ্যাস সেই স্কুল থেকেই পড়ার বইয়ের সীমানা অতিক্রম করেছে। আর মইন ভাইয়ের বইগুলো পেয়ে শৈশব থেকেই একটু একটু জানতে থাকি আমাদের ইতিহাস। এই কারনেই প্রাতিষ্ঠানিক জীবন প্রায় বন্ধুহীন ভাবেই কাটিয়ে দেই। জীবন চালুনির ফুটো দিয়ে ঝরে পড়া হাতে গোনা কয়েকজন বন্ধুই এখনও আছে। মঈন, বদি, রুমি, প্রীতিলতা, ইয়ামিন এদেরকেই আমি কাছের বন্ধু বলি। তারা থেকে যাবে। আমিই হয়তো থাকব না। এই বন্ধুদের সাথেই আড্ডা দেওয়া হয় ভার্সিটির পরে। শাহবাগ, টি.এস.সি, হাকিম চত্বর ঘুরে ঘুরে শেষ পর্যন্ত সোরাওয়ার্দীতেই আড্ডাস্থল হয়ে ওঠে আমাদের। প্রথম দিন থেকেই আমি দাদুকে অনুসরন করে চলি। তার বেশভূষা দেখে কিছুটা কৌতূহল নিয়ে তার কাছে যাই। কয়েকদিন ঘোরাঘুরী করি তাকে ঘিরে। দাঁড়িয়ে দাড়িয়ে শুনি তার গল্প। যতই শুনতে থাকি ততই আগ্রহী হয়ে উঠি। এভাবেই ধীরে ধীরে আমি নিয়মিত স্রোতা হয়ে পড়ি। তার গল্প আমার প্রিয় বিষয়। তার গল্প বলার ভঙ্গী আমার আকর্ষন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলেন। তিনি যুদ্ধের ইতিহাস বলেন। তিনি বাংলাদেশের জন্মের কথা বলেন। আমি শুনে যাই তার কথা। তার প্রতিটি ঘটনা আমাকে আন্দোলিত করে। মহান মুক্তিযুদ্ধের একেকটি অপারেশনের গল্প শুনে গায়ে কাটা দিয়ে ওঠে উত্তেজনায়। আমি উত্তেজিত হই। ধীরে ধীরে একটা ঘোরের ভীতরে চলে যাই আমি। আশেপাশে সবকিছু কেমন যেন অচেনা লাগে। কানের কাছে দাদুর কন্ঠে বাজতে থাকে, “জয় বাংলা”। ঘোরের ভেতরেই বাসায় ফিরি। সারারাত বুকের ভেতরে এক ধরনের অস্থিরতায় কেটে যায়। সকাল হলেই সব স্বভাবিক। কিন্তু দিন যত বাড়তে থাকে শরীরে এক ধরনের উত্তেজনাও বাড়তে থাকে। বিকাল হলেই ছুটে যাই দাদুর কাছে। ডুবে যাই মুক্তিযুদ্ধে।

তিনি যুদ্ধ পরবর্তী ইতিহাসও বলেন। তিনি শুধু বলে যান, আমি শুনে যাই। তিনি উত্তেজনার হাওয়া বইয়ে দেন, আমি উত্তেজিত গাছের মতই আন্দোলিত হই। বুকে জমে থাকা দেশ প্রেম আরো বেশী করে জমাট বাধে। বুকের ভেতরে বাষ্প জমে ওঠে। আমি ভালবাসি আমার মাতৃভুমিকে। আমি ভালবাসি বাঙালীর বীর বাঙালী হয়ে ওঠার ইতিহাসকে। আমি ঘুরে বেড়াই, খুঁজে বেড়াই বাংলাদেশকে। আমার সোনার বাংলাকে। শরীরে জ্বালা ধরে যায় যখন দেখি দাদুর গল্প গল্পই থেকে যায়। দাদু জ্যোতিহীন চোখে স্বপ্ন দেখে সোনার বাংলার। আমি দেখতে পাই সোনার খনি দুবৃত্তদের হাতে লুঠ হতে। দাদু স্বপ্ন দেখে শান্তিময় একটা রাষ্ট্রের, আমি দেখতে পাই অশান্তির আগুনে জ্বলন্ত রাষ্ট্রকে। মাঝে মাঝে মনে হয় সবকিছু জ্বালিয়ে দেই। সবকিছু ভেঙ্গে ফেলি। পারি না, পারা হয়ে ওঠে না। আমরা আলোচনা করি, চায়ের দোকানে, বাসের মধ্যে বসে দেশকে নিয়ে যাই সমৃদ্ধির শিখরে। বাড়ি ফিরে দেশের রাগ ঝাড়ি বউয়ের উপরে। আমরা নারীদের উপরে নির্যাতন করে পুরুষত্বের পরিচয় দেই, কিন্তু দেশকে বাচানোর সময় দেখাই মেহেদী পরা হাত।

৩.
তাড়াহুড়ো করে ব্যাগ গোছাতে গোছাতে হঠাত জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই হাত থেমে যায় প্রহরের। রৌদ্রজ্বল একটা দিন, তবে রোদটা ছ্যাকা দেবার মত না, কেমন যেন গায়ে পরশ বুলিয়ে পিছলে নেমে যাবার মত। এইরকম রোদ দেখেই বুঝি রবীন্দ্রনাথ, “প্রহর শেষের আলোয় রাঙা” লিখেছিলেন। মনে মনে বলে, আজকের দিনটাই প্রেমে পড়ার মত। তাড়াতাড়ি ব্যাগ গুছিয়ে বের হয় ও। রবীঠাকুরের কবিতাটা গুন গুন করতে করতে সদর দরজায় তালা দিয়ে সিড়ি দিয়ে নামতে থাকে। এই সময় মা অফিসে থাকে বলেই এই ব্যাবস্থা। গেট দিয়ে বের হতেই বুক ভরে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে হাটা শুরু করে। গন্তব্য নীলক্ষেত হয়ে শাহবাগ। রাস্তায় এসে দেখে রাস্তা প্রায় ফাঁকা। চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার মাঝে এক রাজণৈতিক দলের ডাকা হরতালের কল্যানে রাস্তার এই সুশ্রী অবস্থা। মোবাইলের প্লে লিস্ট থেকে জন লেননের ইমাজিন গানটা ছেড়ে হেড কান লাগিয়ে আবার কিছুক্ষন এদিক ওদিক তাকায় বাসের জন্য। কোন কিছু না দেখে কাঁধ ঝাকিয়ে হাটা দেয় মগবাজার চৌরাস্তার দিকে। হাটতে হাটতে ডুবে যায় গানের মাঝে। মিষ্টি রোদে চারপাশকে ভালবাসতে ভালোবাসতে এগিয়ে যায়।

মগবাজার চৌরাস্তার একটু আগে। নাটকের গলির মুখে কয়েকটা ছেলেরা দাঁড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছে। তবে আড্ডা যে জমছে না তা এদের চোখেমুখে স্পষ্ট। কিছু একটা নিয়ে তারা খুব চিন্তিত। খুব অস্থিরতার সাথে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। একজন শুকনা মুখে পায়চারি করতে করতে সিগারেট টানছে। দুইজন বুকের কাছে ব্যাগ ধরে দাঁড়িয়ে আছে দুইপাশে। এই কোমল রোদেও দুজন দর দর করে ঘামছে। তাদের উল্টো দিকের রাস্তায় কিছুদূর পরেই আরো কয়েকটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। তারাও একই রকম আচরন করছে। প্রহর এসবের কিছুই খেয়াল না করে ওর মত এগিয়ে যায়। হঠাত গলি থেকে একটা মিছিল বের হয়ে আসে ঠিক ওরই দিকে। দুইপক্ষের মাঝখানে থাকা ছেলেগুলো সতর্ক হয়ে ওঠে। পায়চারী করা থামিয়ে ছেলেটি ব্যাগধরা ছেলে দুটোকে কিছু বলেই দ্রুতপায়ে রাস্তা পার হয়ে অন্য ছেলেদের সাথে চলে যায়। প্রহর কিছু দেখে না, অথবা দেখেও গুরুত্ব দেয় না। ও ওর মত এগোতে থাকে আর ক্রমশই ওদের মাঝে দুরত্ব একটু করে কমতে থাকে। মিছিলটাও প্রায় চলে আসে কাছে। একেবারে শেষ মুহুর্তে, প্রহর আর মিছিল যখন প্রায় মুখোমুখি। ব্যাগধরা ছেলে দুটো ব্যাগ থেকে কিছু বের করে সামনে এগিয়ে আসে। প্রহর কিছু বোঝার আগেই হেডফোনের শব্দ ছাপিয়ে একটা বিস্ফোরনের শব্দ কানে এসে লাগে। ও থমকে দাঁড়িয়ে চারপাশে তাকায়। চোখের কোনা দিয়ে ছেলেগুলোকে পালাতে দেখে ও। দ্বিতীয় বিস্ফোরনের শব্দ হতেই অসহ্য যন্ত্রনায় মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। বুকের ভেতর কেমন যেন খালি খালি লাগছে। তৃষ্ণায় বুক ফেটে যাচ্ছে কিন্তু পানি চাইতে পারছে না। ধীরে ধীরে নেমে আসা চোখের পাতার ফাক দিয়ে শেষ বারের মত দেখে নেয় দিনটা। তারপরই নেমে আসে অন্ধকার, এক কানে বাজতে থাকে...
Imagine no possessions
I wonder if you can
No need for greed or hunger
A brotherhood of man
Imagine all the people
Sharing all the world...
আরেক কানের হেডফোন ডুবে থাকে জমে থাকা রক্তের মাঝে। বসন্তের কোমল রোদে গাড় লাল কালো পিচের উপরে আলপনা করে মিশে যায় আশেপাশে কাতরাতে থাকা আহতদের সাথে। আকাশে জুড়ে কা কা করে উড়তে থাকা কাকগুলো স্থির হয়ে বসার সাহস পায় না। মানুষের আর্তনাদ, অনুরোধ কিছুই প্রহরের কানে যায়। নিথর হয়ে পড়ে থাকে। শাহবাগে আড্ডারত বুন্ধুরা হয়তো কল্পনাও করেনি কখোন ও পড়ে আছে এখানে। ওরা খবর পায় অনেক পরে। যখন প্রহর চলে অনেক দূরে। ভেঙ্গে পড়ে কান্নায়, নিথর হয়ে পড়ে কেউ কেউ শোকে। তবু আসে বন্ধুকে শেষ বারের মত বিদায় জানাতে।

৪.
হটাত জ্ঞান ফিরতেই প্রহর নিজেকে আবিষ্কার করে বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতিতে ভরা সাদা একটা রুমে। এদিক ওদিক তাকিয়ে মুখ দিয়ে শব্দ করতেই এপ্রন পরা একজন মহিলা এসে সিডেটিভ দেয় ওর স্যালাইনে। ও জিজ্ঞেস করতেই একটু হেসে মহিলাটি ওকে স্থির থাকতে বলে। আবারো ওর চোখের পাতা ভারী হয়ে আসে। ও তলিয়ে যায় গভীর ঘুমে।

ওর বন্ধুরা তখনো জানে না ওর খবর। কয়েকবার মোবাইলে চেষ্টা করেও ওকে না পেয়ে নিজেদের ভেতরেই বলাবলি করতে থাকে। হঠাত রুমির মোবাইল বেজে উঠতেই ব্যাস্ত হয়ে মোবাইলটা কানে ধরে। ওপাশ থেকে কিছু বলতে রমু দাঁড়িয়ে পড়ে ঘুরে তাকায় ওর বন্ধুদের দিকে। প্রীতিলতা রুমির চোখমুখ দেখেই আন্দাজ করে নেয় কোন খারাপ খবর। জিজ্ঞেস করে কোন সদুত্তর না পেয়ে রুমির কাছে থেকে মোবাইলটা কেড়ে নেয়। কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই ওপাশ থেকে জানানো হয় প্রহরের মৃত্যু সংবাদ। প্রীতিলতা মুখে হাত চেপে বসে পড়ে ডুকরে কেদে ওঠে। বদি যেয়ে ওর কাধে হাত রাখতেই ও আর্তনাদ করে ওঠে।

প্রহর মারা যায় রোজ শনিবার দুপুর ১.৪৫ মিনিট ৭ই মার্চ, ২০১৫। মৃত্যুর ঠিক আগে কিছুক্ষনের জন্য ওর জ্ঞান ফেরে। পাশে থাকা সিস্টারকে ডেকে জড়ানো গলায় কিছু বলে।সিস্টার অনেক কস্টে মর্ম উদ্ধার করে বোঝেন ও কাগজ কলম নিয়ে তাকে কিছু লিখতে বলছে। তিনি তার এপ্রনের পকেট থেকে প্যাড বের করে ওর মুখের কাছে কান লাগিয়ে অনেক কষ্টে শুনে লিখতে থাকেন। লেখা হয়ে গেলে তাকে দেখালে ও খুশী হয়ে ধন্যবাদ দেয়। আর জানায় ওর কিছু হয়ে গেলে লেখাটি ওর ব্যাগের ভেতরে থাকা The Black Coat বইয়ের ভেতরে রাখতে বলেই চোখ বুজে শুয়ে পড়ে। ও মারা যায় ঘুমের মাঝেই। ওর কোন প্রিয় মুখই দেখতে পারে না মৃত্যুর আগে। কাপড় দিয়ে ঢেকে দেবার আগে, ঠোঁটের কোনায় লেগে থাকা হাসিই বলে দেয় যাবার সময় আর কোন কষ্টই ওকে স্পর্শ করেনি।

বন্ধুরা এসে কান্নাকাটির মাঝেই ডেডবডি নিয়ে যায়। ছোটো এক পিক আপ ভ্যানে চড়ে বাড়ী আসে প্রহর সাদা চাদরে ঘিরে। ওর মাকে বসে থাকে দেখা যায় গেটের কাছে। মহিলাটি জীবনে অনেক আঘাত পেয়েছেন। কিন্তু ছেলের শোকে তার চোখে এক ফোটা পানিও আসে নি। ওর বন্ধুরা তাকে জড়িয়ে ধরে কাদতে থাকলেই তিনি পাথরের মত চেয়ে থাকেন ছেলে খাটিয়ার দিকে। লাশ নিয়ে চলে যাবার সময়ও তিনি কিছুই বলেন না। শুধু চেয়ে তাকেন চলে যাওয়া পথের দিকে। কি ভাবছেন কেউ জানেন না। প্রীতিলতা আর ইয়ামিন তাকে এক সেকন্ডের জন্যও চোখের আড়াল করে না। বন্ধুকে চিরনিদ্রায় রেখে বদি, রুমি, মঈনরা ফিরে আসে। রাতে ওরা এখানেই থেকে যায়। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী পরহরের মাকে ঘুম পাড়িয়ে ওরা বারান্দায় এসে বসে। হটাত প্রীতিলতা প্রহরের ব্যাগটা বের করে। ব্যাগের গায়ে এখনো রক্ত লেগে চাহে। ব্যাগটা খুলে বের করে ওর নোটবুক আর বইটা। দুটোতেই কিছুটা রক্ত লেগে আছে। শুকিয়ে যাওয়া রক্তের দাগের উপর হাত বুলিয়ে বইটা খুলতেই একটুকরো কাগজ গড়িয়ে পড়ে মাটিতে। কাগজটা তুলে পড়তেই আবার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে প্রীতির।

৫.
কিছুদিন পরের কথা। জনগনের মন থেকে মগবাজারের ঘটনা হারিয়ে গিয়েছে। তাদের তখন বেচে থাকার চিন্তা, কে মারা গেল সেটা নিয়ে তাদের মাথাব্যাথা নেই। প্রহরের মাও যথারীতি কাজে যোগ দেন। সহকর্মীরাও তাদের সমবেদনা জানানো শেষে সহজ হয়ে গিয়েছে। শুধু মাঝে মাঝে যখন অন্যমনস্ক হয়ে প্রহরের মাকে তাকিয়ে থাকতে দেখেন, তখন তাদের বুকের মাঝেও একটা মোচড় দেয়। কিন্তু বলতে পারেননা কিছুই। কি বলবেন, যে মহিলা তার একমাত্র সম্বল ছেলেকে কবর দিয়ে এসেছেন তাকে সমবেদনা জানানোর কোন ভাষা কি আছে? নেই। থাকবেও না। যারা এসব কাজ করে তারা কি কেউ শান্তিতে আছে? নেই। ঐসব মৃতদের আর্তনাদ কি বাজে না তাদের কানে? পুড়ে যাওয়া মুখগুলো কি ভাসে না তাদের চোখের সামনে? জানিনা, কেউ জানে না।

প্রহরের মৃত্যুর এক সপ্তাহ পরে, বদি আসে সোহরাওয়ার্দিতে। রুমি, ইয়ামিনরাও পথে আছে। মঈন আসতে পারে নি। তবে ও আসবে, এটা জানে। প্রিতির কোন খোঁজ নেই। বদি এসে দাদুকে খুজতে থাকে। কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করতেই বলে পুল পাড়ে। পুল পাড়ে এসে দেখে দাদু লাইট টাওয়ারের দিকে তাকিয়ে আছে। ও অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, কি দেখেন? দাদু বদির গলা চিনতে পেরে হেসে বলেন, কি আর দেখুম কও। মন দিয়া আর কতটুকুই বা দেখা যায়। তা এতদিন কই আছিলা। বদি একটা দির্ঘশ্বাস ফেলে দাদুকে জানায় সব ঘটনা। দাদু কিছু বলেন না। খুব ধীরে ধীরে তার লাঠি আর ব্রিফকেসটা নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। বদিকে কিছু না বলেই হাটতে থাকে। পড়ে যেতে গেলে বদি দৌড়ে গিয়ে তাকে ধরে জিজ্ঞেস কই যান? তিনি কিছু বলেননা, নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে হাটতে থাকেন। বদি কি করবে বুঝতে না পেরে পিছু নেয়। মুক্তমঞ্চের পাশে আসতেই দেখে মঈন আর প্রীতি দাড়িয়ে এদিক ওদিক কাকে খুঁজছে। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে প্রীতিকে কোথায় পেল? মঈন জানায় ওকে বাসা থেকে উদ্ধার করে নিয়ে এসেছে। ওর বাবা মা, প্রহরের কথা শুনে ঘরে আটকে রেখেছিল। বদি হেসে তাকায় প্রীতির দিকে, কিন্তু প্রীতির মুখখানা দেখে হাসি মিলিয়ে যায়। দাদুকে অনুসরন করতে করতে ওরা গল্প করতে থাকে। এর মাঝে রুমিরা এলে প্রীতি কাগজটা বের করে দেয় বদির হাতে। দাদু তখন চাদের পাহাড়ে বসে আছে। প্রহরের খুব প্রিয় জায়গা এটা। মেঘলা আকাশে লাইট টাওয়ারের আলোয় নাকি জায়গাটাকে জোছনা রাতের মত লাগত। ওরা গিয়ে একে একে ঘিরে বসে দাদুকে। বদি কাগজটার কথা পড়ে শোনায় দাদুকে। ওরা বলে প্রহরের শেষ ইচ্ছার কথা। দাদু কিছুই বলেন না। সেই তখন থেকেই তিনি চুপ করে আছেন। অনেক বোঝানোর পরেও তিনি মুখ খোলেন না। আরো কিছুক্ষন চুপ করে থাকার পরে একটু একা থাকতে চান বলে কাগজটা বদির কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে ছবির হাটের গেটের দিকে ক্লান্ত পায়ে হেটে যান।

প্রহরে মৃত্যুর একবছর পরে, মরণোত্তর চক্ষুদানের ফলে সেই দাদু তার দৃষ্টি ফিরে পান। সাথে প্রহরের বন্ধুদের একটা চিঠি। এরপর কয়েকটা দিন তাকে ঘুরতে দেখা যায় শহরের বিভিন্ন জায়গায়। তিনি যতই দেখেন ততই অবাক হন, এটা কি বাংলাদেশ? এটার জন্যই কি তারা যুদ্ধ করেছিলেন? তিনি হতাশ হয়ে ঘুরতে থাকেন শহরের অলি-গলি। সেই হতাশা ধীরে ধীরে তার চোখ মুখ ছাপিয়ে পা দুটোকে অবশ করে তোলে। তিনি ক্লান্ত হয়ে ফুটপাতের উপর বসে মুখতুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে কিছু খুজতে থাকেন। সাথে থাকে তার ঝোলা আর ব্রিফকেস। লাঠিটা বহুদিনের সঙ্গী হিসেবে রেখেই দিয়েছেন। সোনার বাংলার এই দুর্বিষহ রুপ দেখে তার হাতের মুষ্টি শক্ত হয়ে ওঠে। তিনি ভাবতে থাকেন প্রহরের কথা। ভাবতে থাকেন দুই দলের চলমান সহিংসতায় মৃত্যুবরন করা সকল মানুষের কথা। তিনি ভাবতে থাকেন যুদ্ধের কথা। ভাবতে থাকেন তার আত্মত্যাগের কথা। হতাশা আর গ্লানিতে নুয়ে পড়ে শরীর নিয়ে ধীর পায়ে হেটে যান অজানাতে।

২৬ শে মার্চ, ২০১৫। দাদুকে দেখা যায় শাহবাগের দিকে এগিয়ে আসতে। হাতে একটা টিনের বড়ো ক্যানে কি আছে বোঝা যায় না। ব্যাস্ত ট্রাফিককে তোয়াক্কা না করেই মোড়ের ঠিক মাঝখানে চলে আসেন। সবাই অবাক হয়ে তাকে দেখতে থাকলেও চারপাশে গতিশীলতা একটুও কমে না। তিনি মাঝখানে তার আসন নেন। খুব ধীরে ধীরে তার সম্পত্তি ঝোলা আর ব্রিফকেস পাশে রাখেন। পাশে রাখা টিনের ক্যানের ভেতরে রাখা পুরোটা পেট্রোল ঢেলে নেন নিজের গায়ে। ততক্ষনে উৎসুক দর্শকদের কয়েকজন ঘটনা বুঝতে পেরে চীতকার করতে থাকে। কিন্তু তিনি নির্বিকার। তিনি দেয়াশলাই কাঠিটা জ্বালিয়ে কিছুক্ষন তাকিয়ে দেখে নেন চারপাশ। তারপর হঠাতই, ‘জয় বাংলা’ বলে আগুন ধরিয়ে দেন তার গায়ে। চারপাশ থেকে ছুটে আসা মানুষের স্রোত কিছু করার আগেই তিনি জ্বলে ওঠেন অনির্বানে মত, জ্বলতেই থাকেন।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.