নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

You are the light of lights, while I wait blind in darkness, You are great and unfettered, while I am enclosed by seas.

তানজিল মোহাম্মাদীন

হিলিয়াম এইচই

আমি জানি আমি একজন মানুষ। এছাড়া আমি নিজে কি, তা আমি জানি না। আমি নিজেকে প্রতিনিয়ত আবিষ্কার করছি এবং করেই যাচ্ছি। মানুষ মানেই রহস্য।

হিলিয়াম এইচই › বিস্তারিত পোস্টঃ

রবীন্দ্র গবেষণা : পর্ব ১ (ধর্ম কথা)

৩০ শে মার্চ, ২০১৫ সকাল ১০:৫৫

সেই ছোট্ট কাল থেকে শিশুরা যাদের কবিতা, ছড়া, গল্প পড়ে বড় হয় তারা হলেন কাজী নজরুল ইসলাম আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আমি সাহিত্য চর্চা করা হিসেবে নজরুল ইসলামকেই বেছে নিয়েছি। তারপরও কেন যেন মনে হল রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে একটু ঘাটাঘাটি করা যাক। যেহেতু দুইজনই আমাদের বাংলা সাহিত্য চর্চার গুরু। কুষ্টিয়ার শিলাইদহ থেকে ঘুড়ে এলাম। তার স্মৃতি বিজড়িত বিভিন্ন জিনিসপত্র দেখেছি সাথে একটু সাহিত্যচর্চা, মনে হচ্ছিল আমি বোধহয় রবীন্দ্রনাথের অনেক কাছাকাছি চলে এসেছি। ইচ্ছা আছে কলকাতায় গিয়ে তার জমিদারি দর্শন করবো, সে সুযোগ কয়েকবার এসেছিল বটে। কিন্তু দেশ ছেড়ে আমার বাইরে যেতে ইচ্ছে করে না। হোক সেটা ঘুরাঘুরি বা চিকিৎসার জন্য! সেই ছোটকাল থেকে তার ছড়া পড়ছি আর সাথে কবি পরিচিতি।  রবীন্দ্রনাথ জন্মেছিলেন কলকাতার একটি ব্রাহ্ম পরিবারে। ব্রাহ্মদের সংখ্যা ছিল খুবই কম ছিল তখন। এখনও কম তবে অতটা না। মতাদর্শ অনুযায়ী সেই ব্রাহ্মই আবার বিভক্ত ছিলো তিন ভাগে। এগুলোর মধ্যে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ ছিল সবচেয়ে আধুনি । আর নাম ও মতাদর্শ উভয় দিক দিয়েই আদি ব্রাহ্মসমাজ ছিল সবচেয়ে প্রাচীন। সেই আদি ব্রাহ্মসমাজেই তাঁর জন্ম হয়েছিল। ১৮৭০-এর দশকের গোড়ায় এই সমাজের সত্যিকার পরিচয় হলো: ‘উন্নত হিন্দু’ হিসেবে। কিন্তু, সাধারণ হিন্দুরা তাঁদের হিন্দু বলেই মানেন না। অপর পক্ষ্যে, ব্রাহ্মরা নিজেদের বিবেচনা করেন সাধারণ হিন্দুদের তুলনায় ‘উন্নত’ বলে। বস্তুত, ধর্মীয় পরিচয় নিয়ে তাঁদের গোঁড়ামি কারও তুলনায় আদৌ কম ছিল না। বছর চব্বিশ বয়সের তরুণ রবীন্দ্রনাথ ব্রাহ্মসমাজের কর্মকর্তা হিসেবে যেভাবে তাঁর পক্ষ
নিয়ে আর-একজন বিশুদ্ধ হিন্দু—বঙ্কিমচন্দ্রের সঙ্গে বিতর্কে জড়িয়ে যান, সে তাঁর নিজের ধর্মীয় স্বরূপ সম্পর্কে গোঁড়ামিরই প্রতিফলন।

প্রায় কয়েক শতাব্দী পূর্বে অলকানন্দার বিয়ে হয়েছিল ঠাকুর পরিবারের সাথে। বিভিন্ন গ্রন্থে তাকে অলকাসুন্দরী নামেও পাওয়া যায়। অলকানন্দা ছিলেন খুবই ধর্মশীলা। সরল মনের মানুষ ছিলেন। তবে তার পুত্র দ্বারকানাথের ওপর মোটামুটি কঠোর ছিলেন। তিনি ছিলেন মৃতবৎসা। দ্বারকানাথ কে তিনি দত্তক নিয়েছিলেন। তিনি সন্ন্যাসীদের প্রতি বিশ্বাস রাখতেন। দ্বারকানাথ যখন জমিদারি পেলেন তখন থেকেই ব্যাবসাবাণিজ্য করার জন্য ইংরেজদের সাথে মেলামেশা করতেন। দ্বারকানাথের ইংরেজদের সাথে ওঠাবসা অলকাসুন্দরী মোটেও পছন্দ করতেন না। তিনি প্রায়ই দ্বারকানাথ কে বাধাঁ দিতেন। একটু আধটু মদ পানের অনুমতি থাকলেও গোমাংস খাওয়ার ব্যাপারে একেবারেই না।
ঠাকুর বাড়িতে ধুমধাম করে জগদ্ধাত্রী আর স্বরসতী পূজা হত। জানা গেছে ঠাকুর পরিবারটি ছিল বৈষ্ণব ভক্ত। দ্বারকানাথ ঠাকুর পূর্বপুরুষের আচার অনুষ্ঠান আর এই বিশ্বাসে অটুট ছিলেন। তিনি নিজেই রোজ পূজা করতেন আর হোম দিতেন, সেখানে দুজন ব্রাহ্মণ চিল বটে, তবে তারা শুধুমাত্র পূজার ভোগ আর আরতি দিতেন। ইংরেজদের সাথে মেলামেশার দরুন সাহেব মেমরা বাড়িতে আমন্ত্রিত হতো। তবে তিনি তাদের সাথে খাবার খেতেন না। দুরে দাড়িঁয়ে তদারকি করতেন। ইংরেজদের সাথে কথাবার্তা শেষে তিনি কাপড়চোপড় পাল্টে ফেলতেন গঙ্গাজল ঢেলে শুদ্ধ হতেন। কন্তু তিনি তার এই পবিত্রতা ধরে রাখতে পারলেন না। ইংরেজদের সাথে আরও ঘনিষ্ঠ হতে হল। তাদের সাথে খেতে বসতে হল। তারপর থেকে তিনি আর মন্দিরে গেলেন না। ১৮ জন ব্রাহ্মণ পূজার সব দ্বায়িত্ব পালন করতেন। আর তিনি দূর থেকে গায়ত্রী মন্ত্র পড়তেন আর প্রণাম করতেন। বাড়িতে ইংরেজদের নিয়মিত আশা যাওয়া দ্বারকানাথের স্ত্রী দিগম্বরী দেবীর কাছে পছন্দের ঠেকলো না। নিয়মিত আশা যাওয়া হলেও তিনি তাদের সাথে ঘনিষ্ঠ হননি। দিগম্বরী দেবী ছিলেন শ্বাশুড়ী অলকাসুন্দরী থেকেও কঠোর। অন্যান্য জমিদারের স্ত্রীর মতো নিজেও সাজসজ্জা করতেন খুব। তার অনেকগুলো গহনা ছিল। গলভর্তি গহনা না পরে তিনি তার ঘড় থেকে বের হতেন না। ধর্মভীতি ছিলেন খুব। নিয়মিত লক্ষী নারায়ণের সেবা করতেন। তিনি দ্বারকানাথের ইংরেজদের সাথে মেলামেশা আর মদপান করা মোটেও পছন্দ করতেন না। তারপর একসময় তিনি স্বামীর সঙ্গ ছেড়ে দেন। তাবে দূর থেকে তার সেবাযত্নাদির খেয়াল রাখতেন। কখনো স্বামীর ছোঁয়া লাগলে স্নান করে শুদ্ধ হয়ে আসতেন। এভাবে ধর্মের কারণে দ্বারকানাথ দিগম্বরী সম্পর্ক হয়ে উঠেছিল ঝামেলাপূর্ন। তারপর একসময় রাজা রামমোহন রায়ের সাথে দেখা হলো। দ্বারকানাথ একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী হলেন। তবে দূর্গা পূজা, জগদ্ধাত্রী, স্বরসতী পূজা নিয়ম মেনেই অনুষ্ঠিত হতো কিন্তু তিনি পূজায় বসতেন না।

ব্যাবসায় ব্যাস্ততা আর স্বামী স্ত্রী ঝামেলাপূর্ন সম্পর্কের জন্য দেবেন্দ্রনাথ বাবা মার স্নেহ খুব একটা পান নি। ঠাকুরমা অলকাসুন্দরী দেবীর কাছে দ্বরকানাথের পুত্র দেবেন্দ্রনাথ মানুষ। সবসময়ই ঠাকুরমার সাথে থাকতেন। ঠামার শালগ্রাম শিলার জন্য তিনি মালা গেথেছেন। কালীঘাটে পূজা দিতেন। দেবেন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “ প্রথম বয়সে উপনয়নের পর প্রতিনিয়ত যখন গৃহেতে শালগ্রাম শিলার অর্চ্চনা দেখিতাম, প্রতি বৎসরে যখন দুর্গা পূজার উৎসবে উৎসাহিত হইতাম, প্রতিদিন যখন বিদ্যালয়ে যাইবার পথে ঠনঠনিয়ার সিদ্ধেশ্বরীকে প্রণাম করিয়া পাঠের পরীক্ষা হইতে উত্তীর্ণ হইবার জন্য বর প্রার্থনা করিতাম, তখন মনে এই বিশ্বাস ছিল যে, ঈশ্বরই শালগ্রামশিলা, ঈশ্বরই দশভুজা দুর্গা, ঈশ্বরই চতুর্ভুজা সিদ্ধেশ্বরী।" আস্তে আস্তে ছোট্ট দেবেন্দ্রনাথ যুবক হলেন। একসময় তিনি রাজা রামমোহন রায়ের সংস্পর্শে এলেন। প্রতিমা পূজার ঘোর বিরোধী হয়ে উঠলেন। দেবেন্দ্রনাথ সংকল্প করেছিলেন যে, কোন পূজার নিমন্ত্রণ পত্র গ্রহণ তো করবো নাই কোন প্রতিমাকে প্রনাম করবো না, পূজোও করবো না। দেবেন্দ্রনাথ একটা প্রতিমা বিরোধী দল গঠন করেছিলেন যার মুলমন্ত্র ছিল, কোন প্রতিমাকে প্রণাম করিব না, পূজো করিব না। দেবেন্দ্রনাথ পূজার সময় পুকুর পারে বসে থাকতেন। পরে তিনি কলকাতা ছেড়ে বাইরে ভ্রমণে বেড়িয়ে পরতেন। ১৮৩৯ সালে বাইশ বছর বয়সে বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে গড়ে তুলেন একেশ্বরবাদি তত্ত্ববোধিনী সভা গড়ে তুলেন। কিন্তু তিনি তার পুর্বপুরুষদের আচার উৎসব তুলে দিতে পারেন নি। তবে তিনি জগদ্ধাত্রী পূজা ঠাকুরবাড়ি থেকে তুলে দিতে পেরেছিলেন।

ব্রাহ্ম ধর্মকে আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রচার করেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি নিজেই ছিলেন ধর্মগ্রন্থের প্রনেতা। তিনি মনে করেছিলেন আড়াই হাজার বছর পূর্বের ঋষিদের প্রেসক্রিপশনে বর্তমান কালের প্যারা দূর হবে না। পারস্যের কবি হাফিজ তার ধর্মচিন্তা কে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল। তবে তিনি কিছু কিছু ব্যাপারে বেশ আধুনিক ছিলেন কিন্তু তার সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল গোড়মিতে ভরপুর। তার প্রভাব পরেছিল রবীন্দ্রনাথের ওপর। দেবেন্দ্রনাথ ১৯০৫ সালে মারা যান। দেবেন্দ্রনাথ মার যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ তার প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারেন নি। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তার পিতার ব্রাহ্মধর্মাদর্শের একনিষ্ঠ অনুসারী। তিনি কখনো প্রতিমা পূজা করতেন না। হিন্দুদের বড় উৎসব দূর্গা পূজায় তিনি কখনোই সামিল হননি। তবে তিনি দুর্গোৎসবের মাঝে যে সামাজিকতা, মানবিকতা খুজেঁ পেয়েছেন তার প্রশংসা করেছেন। ছিন্নপত্রে তিনি লিখেছেন,(পূজা উপলক্ষ্যে) বিদেশ থেকে যে লোকটি এইমাত্র গ্রামে ফিরে এল তার মনের ভাব, তার ঘরের লোকদের মিলনের আগ্রহ, এবং শরৎকালের এই আকাশ, এই পৃথিবী, সকালবেলাকার এই ঝিরঝিরে বাতাস এবং গাছপালা তৃণগুলা নদীর তরঙ্গ সকলের ভিতরকার একটি অবিশ্রাম সঘন কম্পন, সমস্ত মিশিয়ে বাতায়নবর্তী এই একক যুবকটিকে (রবীন্দ্রনাথ) সুখে দুঃখে একরকম চরম অভিভূত করে ফেরছিল।“

সত্যি বলতে রবীন্দ্রনাথ কোন কিছু নিয়েই স্থির ছিলেন না। গাছ যেমন প্রতি বসন্তে আবির্ভূত হয় নতুন পাতায়, তিনিও নব নব রূপে আবির্ভূত হয়েছেন। এক কথায়, ‘হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোনোখানে’ তিনি সত্যকেই খুঁজে বেড়িয়েছেন। তাই জীবনের শেষ প্রান্তে উপনীত হয়ে বলেছেন, "সৃষ্টির পথ সরল নয়, সে আকীর্ণ বিচিত্র ছলনাজালে। সেই ছলনার রহস্য উন্মোচন করা অসম্ভব।"রবীন্দ্রনাথ ব্রাহ্মধর্মের গন্ডিতে আবদ্ধ ছিলেন না। তার দৃষ্টিভঙ্গি ও ধর্মচিন্তা বদলে যেতে শুরু করলো তা পিতার মৃত্যুর পরই, যখন তিনি সমাজের মুখোমুখি হলেন। ১৮৯০ সালে জমিদারি দেখার জন্য শিলাইদহে বাস করা শুরু করলেন। সেখানে তিনি দেখলেন সেই সমাজ আর জোড়াসাঁকোর সমাজ একেবারেই আলাদা। মানুষেরা ধর্ম বলে যা পালন করে তা নাগরিক ধর্ম থেকে আলাদা। ধর্মমতের সুক্ষ্ম বৈশিষ্ট নিয়ে সেখানে কেও বিতর্কে লিপ্ত হয় না। মানুষেরা ধর্মগ্রন্থের বিধান অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন না। তাদের কাছে ধর্ম মানে পূর্বপুরুষদের বিধান অন্ধের মতো মেনে চলা। তিনি আরও যা বুঝতে পারলেন তা হল ভারতবর্ষে হিন্দুসমাজের ধর্ম ও আচারের অসদ্ব্যবহার । সেই অসদ্ব্যবহারের ফলে সমাজে অনৈক্যের সৃষ্টি হয়েছে । তিনি হেমন্তবালাকে (রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্যা , ব্যাক্তিত্বময়ী হেমন্তবালা ময়মনসিংহ জেলার গৌরীপুরের জমিদার ব্রজেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর কন্যা ও রংপুর ভিতরবঙ্গের জমিদার ব্রজেন্দ্রকান্ত রায়চৌধুরীর স্ত্রী , তিনি সংসার ত্যাগ করে বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন এবং ছদ্মনামে রবীন্দ্রনাথকে পত্র লিখে তাঁর ‘যোগাযোগ ’, ‘শেষের কবিতা’র জন্য অভিনন্দন জ্ঞাপন করেন এবং সেই সূত্রেই তাঁদের পত্র বিনিময় শুরু ।) পত্রে জানান, “-----সমস্ত পৃথিবীর মধ্যে একমাত্র ভারতবর্ষেই ভগবানকে পূজার ক্ষেত্রে জাতের বেড়ায় বিভক্ত করা হয়েছে অর্থাৎ যেখানে শত্রুরা মেলবার অধিকার রাখে,হিন্দুরা সেখানেও মিলতে পারে না । এই মর্মান্তিক বিচ্ছেদে হিন্দুরা পদে পদে পরাভূত । তারা সর্বজনের ঈশ্বরকে খর্ব করে নিজেদের পঙ্গু করেছে--- মানুষকে হিন্দু সমাজ অবমাননার দ্বারা দূর করে দিয়েছে,সকলের চেয়ে লজ্জার বিষয় এই যে,সেই অবমাননা ধর্মের নামেই ।”(চিঠিপত্র ৯,পৃঃ ৩১০-৩১১)
  তিনি দেখলেন, মুসলমানকে ছুঁলে ব্রাহ্মনকে  স্নান করতে হয়। তাদের ছোঁয়া লাগা পাত্র ফেলে দিতে হয়। শুচিতা রক্ষার জন্য মানুষকে দূরে ঠেকিয়ে রাখে । এই প্রসঙ্গে আমরা রায়কে লিখিত রবীন্দ্রনাথের একটি পত্রের কথা স্মরণ করতে পারি । তিনি সেখানে অস্পৃশ্যতা , ধর্মের অপপ্রয়োগের প্রতি ধিক্কারবাণী বর্ষণ করে বলেন “প্রবাদ আছে,কথায় চিড়েঁ ভেজে না । তেমনি কথার কৌশলে অসম্মান তা প্রমাণ হয়না । কুকুরকে স্পর্শ করি,মানুষের স্পর্শ বাঁচিয়ে চলি । বিড়াল ইঁদুর খায়, উচ্ছিষ্ট খেয়ে আসে , খেয়ে আচমন করে না , তদবস্থায় ব্রাহ্মণীর কোলে এসে বসলে গৃহকর্ম অশুচি হয় না । মাছ নানা মলিন দ্রব্য খেয়ে থাকে , সেই মাছকে উদরস্থ করেন বাঙালি ব্রাহ্মণ , তাতে দেহে দোষ স্পর্শ হয় না। উচ্চবর্ণের মানুষ যেসব দুষ্কৃতি করে থাকে তার দ্বারা তাদের চরিত্র কলুষিত হলেও দেবমন্দিরে তাদের অবাধ প্রবেশ ।” (রবীন্দ্রনাথের চিন্তাজগৎ ‘সমাজচিন্তা’-র অন্তর্গত মতিলাল রায়কে লিখিত পত্র,পৃঃ ২৫৬)। তিনি উপলব্ধি করেছেন হিন্দুদের মাঝে ঐক্যের অভাব। উচুঁ শ্রেণী নিচুদের দেখতে পারত না। ষষ্ট পত্রে তিনি বলেছেন হিন্দু সমাজের অনৈক্যের কথা । কিন্তু এই অনৈক্য মুসলমান , খ্রিষ্টান সমাজে নেই। তিনি বলেন- “মুসলমান,ধর্মে এক,আচারে এক, বাংলার মুসলমান , মাদ্রাজের মুসলমান , পাঞ্জাবের মুসলমান এবং ভারতবর্ষের বাইরের মুসলমান সমাজে সবাই এক , বিপদে আপদে সবাই এক হয়ে দাঁড়াতে পারে,এদের সঙ্গে ভাঙ্গাচুরো হিন্দু জাত পারবে না ।”(চিঠিপত্র ৯,পৃঃ২০৮-২০৯)। রবীন্দ্রনাথের মতে জাতি ধর্ম বর্ণ সবই এক। জাতের দোহাই দিয়ে কাওকে ছোট ভাবা অনুচিত। "সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই "-- এই মতে বিশ্বাসী কবির ধর্ম একাধারে বাস্তবের উপর ও ভাবের উপর প্রতিষ্ঠিত। এ ধর্ম মানবতার ধর্ম। সৌন্দর্যে সমন্বিত।


হেমন্তবালা দেবীর কাছ থেকে পূজার বর্ণনা শুনার পর তিনি উত্তরে বলেন- “ তোমার লেখায় তোমাদের পূজার বর্ণনা শুনে আমার মনে হয় এ সমস্তই অবরুদ্ধ অতৃপ্ত অসম্পূর্ণ জীবনের আত্মবিড়ম্বনা । আমার মানুষরূপী ভগবানের পূজাকে এত সহজ করে তুলে তাঁকে যারা প্রত্যহ বঞ্চিত করে তারা প্রত্যহ নিজে বঞ্চিত হয় । তাদের দেশে মানুষ একান্ত উপেক্ষিত,সেই উপেক্ষিত মানুষের দৈন্য ও দুঃখ সে দেশ ভারাক্রান্ত হয়ে পৃথিবীতে সকল দেশের পিছনে পড়ে আছে । এ সব কথা বলে’ তোমাকে ব্যথা দিতে আমার সহজে ইচ্ছা করে না কিন্তু যেখানে মন্দিরের দেবতা মানুষের দেবতার প্রতিদ্বন্দ্বী,যেখানে দেবতার নামে মানুষ প্রবঞ্চিত সেখানে আমার মন ধৈর্য্য মানে না। গোয়াতে যখন বেড়াতে গিয়েছিলেম তখন পশ্চিমের কোন্ এক পূজামুগ্ধা রাণী পাণ্ডার পা মোহরে ঢেকে দিয়েছিলেন ক্ষুধিত মানুষের অন্নের থালি থেকে কেড়ে নেওয়া অন্নের মূল্যে এই মোহর তৈরি । দেশের লোকের শিক্ষার জন্যে আরোগ্যের জন্যে এরা কিছু দিতে জানে না,অথচ নিজের অর্থ-সামর্থ্য সময় প্রীতি ভক্তি সমস্ত দিচ্ছে সেই বেদীমূলে যেখানে তা নিরর্থক হয়ে যাচ্ছে। মানুষের প্রতি মানুষের এত নিরৌৎসুক্য,এত ঔদাসীন্য অন্য কোনো দেশেই নেই,এর প্রধান কারণ এই যে,এ দেশে হতভাগা মানুষের সমস্ত প্রাপ্য দেবতা নিচ্চেন হরণ করে ।”(“রবীন্দ্রনাথের চিঠি অন্তরঙ্গ নারীকে”পৃঃ ১২৭)


১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে তিনি হিন্দু- গোঁড়ামির যথার্থ স্বরূপ, বিস্তার ও তীব্রতা উপলব্ধি করলেন। জাতিভেদ প্রথা হিন্দু-মুসলমান—এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে যে- বিভেদের প্রাচীর নির্মাণ করেছিল, তা যে চীনের প্রাচীরের মতো দুর্ভেদ্য ও দুর্লঙ্ঘ্য, তাও তিনি অনুভব করলেন। অনুভব করলেন, বাঙালি সমাজের অর্ধেকের বেশি গড়ে উঠেছে মুসলমানদের নিয়ে। তাঁর নতুন-পাওয়া উপলব্ধির ছাপ পড়ল তাঁর কবিতা, গান, প্রবন্ধ ও বক্তৃতায়। গানের দৃষ্টান্ত দিয়ে বলতে পারি, এর আগে পর্যন্ত তিনি আবদ্ধ ছিলেন প্রধানত ধ্রুপদী বলয়ে। কিন্তু বঙ্গভঙ্গের সময়ে তিনি স্বদেশি গান ধ্রুপদী সুরে নয়, টপ্পা চালে নয়, লিখলেন সহজ-সরল বাউল সুরে। জীবনের প্রথম ৪৪ বছর তিনি সাহিত্য, সংগীত, সমাজভাবনা ও ধর্মীয় পরিচয়ে যেখানে সীমাবদ্ধ ছিলেন, সেখান থেকে তিনি সরে এলেন। তার নতুন মনোজগতে ধর্মীয় পরিচয় হল গৌণ, বড় হয়ে দেখা দিল মনুষ্যত্ব। ধর্মীয় পরিচয় যে একমাত্র অথবা সবচেয়ে বড়ো পরিচয় নয়, তাঁর মনে এ ধারণা এর আগেই দানা বাঁধতে আরম্ভ করেছিল। গীতাঞ্জলি, গীতালি, গীতিমাল্যের গানেও তাঁর এই ধারণার প্রতিফলন লক্ষ করা যায়। নিজের এই বিশ্বাসের তিনি সমর্থন পেলেন বাউলদের গানে। বেশ কিছু বাউল গান সংগ্রহ করে ১৯১৫ সালে তিনি প্রবাসীতে প্রকাশ করেছিলেন। অন্যদেরও সংগ্রহ করার উৎসাহ দিয়েছিলেন। বোঝা যায় তার মনে যে নতুন ধারণার জন্ম হয়েছিল তারই সমর্থন তিনি খুজেঁ পাচ্ছিলেন বাউলদের গানে। তার ধর্মচিন্তা শাস্ত্রের ভূমি ছেড়ে প্রাণের আকাশে উধাও হলো। শেষ পর্যন্ত তিনি যে ধর্মে বিশ্বাস স্থাপন করতে পারলেন, তা মানুষের ধর্ম। কোনো আচার-অনুষ্ঠানের সীমানায় যাকে বাঁধা যায় না। শশিভূষণ দাশগুপ্ত তাঁকে বঙ্গদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ বাউল বলে আখ্যা দিয়েছেন। কিন্তু এ দিয়ে তাঁকে একটা তত্ত্বের মধ্যে ধরার চেষ্টা করা হয়, আসলে তিনি সকল ধর্মতত্ত্ব এবং ধর্মতন্ত্রের ঊর্ধ্বে উঠেছিলেন। 

সূত্র :
১) আত্মজীবনী--মহর্ষী দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর
২) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর--ছিন্নপত্রাবলী
৩) পূর্ণানন্দ চট্টোপাধ্যায়--রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ
৪) সমীর সেনগুপ্ত--রবীন্দ্রনাথের আত্মীয়স্জন
৫) উইকিপিডিয়া
৬) কুলদা রায়

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.