নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি কেউ নই, আমি আমার নই, আমি তোমার নই, আমি তুমিও নই

বেচারা

Walid

বেচারা › বিস্তারিত পোস্টঃ

জাতি হিসেবে আমাদের শতধা বিভক্তি, কূ-তর্ক আসক্তি, ভিন্নমতের প্রতি আক্রমন ও আপেক্ষিকতা

২৪ শে আগস্ট, ২০১৭ সকাল ৯:২৬

আমার সহযাত্রীদের সাথে স্রেফ মজা করার জন্য প্রায়ই আমরা দু’ই রাজনৈতিক দলে নিজেদের ভাগ করি। কোন দল কেমন ভাল আর কেমন খারাপ এই নিয়ে কাল্পনিক তর্ক ও যুক্তি সাজাই। কে কোন দলের সাপোর্টার সেই নিয়ে তুমুল যুক্তি দেখাই। যদিও আমি ব্যক্তিগতভাবে রাজনীতি, রাজনৈতিক দল ও রাজনৈতিক কর্মপদ্ধতির ব্যাপারে একেবারেই নিস্পৃহ। নিজের কোনো রাজনৈতিক পছন্দ নেই। রাজনীতির প্রতি কোনো রকম আগ্রহ বোধ করি না, বিরোধও অনুভব করিনা। স্বাধীনতা প্রাপ্তি হতে বিগত ৪৫ বছরে আমাদের যা কিছু অর্জন তার জন্য মূল ক্রেডিট কার প্রাপ্য? আমার সচেতন সহযাত্রীদের একটা বড় অংশ মনে করেন, আমাদের রাজনীতিকবৃন্দ এই অর্জনের প্রধান নির্মাতা। আপনাদের কাছে একই প্রশ্ন রইল।

এরপরে আমি একটি বিপরীত প্রশ্ন করি। বিগত ৪৫ বছরে আমাদের রাজনীতিকরা সফলতার সাথে কী কী করতে পেরেছেন? আপনার কাছে নিশ্চই অনেকগুলো উত্তর আছে। আমি শুধু একটা নাম বলব-বিভাজন। হ্যা, আমাদের রাজনীতিক ও সুশীলসমাজ আমাদের ১৭ কোটি মানুষকে খুব সফলতার সাথে বিভাজিত করতে সক্ষম হয়েছেন যা বৃটিশরাও পারে নি। নানা মত, হাজার পথ, নানা শিক্ষা, নানা পছন্দ, মতামত, নীতি, দর্শন, ধর্মবিশ্বাস, রাজনৈতিক দর্শনে আমাদের শতধা বিভক্ত করতে তারা পারঙ্গমতা দেখিয়েছেন। মতের ভিন্নতা এ নয়, আমি বলছি জাতির দর্শন ও ডিসকোর্সের বিভক্তি। বিভক্তির মাত্রাটা কখনো কখনো শিষ্টতার মাত্রাও ছাড়ায় এবং যুক্তিপূর্ণ বিতর্কে পরিশ্রম বেশি বলে সেটাকে খুব দ্রূত ব্যক্তিগত আক্রমনে রূপ দেয়া হয়। আমি সম্প্রতি লিঙ্কডইনে একটি ছোট্ট প্রোফেশনাল পোষ্ট দিই যেখানে বেড়ালকে মরিচ খাওয়ানোর সেই বিখ্যাত মেটাফোর গল্পটি ছিল। একজন প্রতিষ্ঠিত সিনিয়র কর্পোরেট সেটার মন্তব্যে লিখেছেন, “আপনার পা......য় মরিচ ডলে দিলে আপনার কেমন লাগবে?” অপরের বেডরুমে উঁকি মারাকে যেমন গর্হিত কাজ মনে করেন তেমনি অপরের পোষ্ট, মেসেজ, ছবিতে অনাহুত ব্যক্তিগত আক্রমনকেও আমি তেমন গর্হিত কাজ মনে করি।

আপনি যদি কারো যেকোনো পাবলিক পোষ্টে দ্বিমত পোষণ করেন, তবে তার বক্তব্যের বিপক্ষে যুক্তি দেখান সংযতভাবে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখছি, মূল লেখা না বুঝেই, যুক্তি না খুঁজেই, সম্পূর্ন ভিন্ন ইস্যু নিয়ে কাদা ছোড়াছুড়ি, ব্যক্তিগত আক্রমন শুরু করে। যে কথা বলছিলাম, বিভাজন এমন তীব্র রূপ নিয়েছে যে, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী পশুরা আর তাদের কুলাঙ্গার বাঙালী দোসর দালাল রাজাকাররা আদৌ কোনো অন্যায় করেছেন, নাকি তারা সঠিক কাজ করেছেন-এই নিয়েও বিতর্ক করার মতো একটি দল এদেশে জন্ম ও বিকাশ লাভ করেছে। ১৯৪৭ হতেই আমাদের প্রাণ দেয়া শুরু তবু ১৯৭১ সালে আমাদের কতজন মানুষ শহীদ হয়েছেন আর কতজন মা সম্ভ্রম হারিয়েছেন সেটা নিয়েও কু-তর্ক করার মত, ধৃষ্ঠতা দেখানোর মতো একটি প্রজন্মও এদেশে পয়দা হয়েছে খুব কার্যকরভাবে। বঙ্গবন্ধু জাতির পিতা নাকি আমাদের জাতির পিতা হযরত.......... এই অদ্ভূৎ বিতর্কও বেশ প্রচলিত আছে এদেশে। স্বাধীনতার ঘোষক, স্বাধীনতার পাঠক, স্বাধীনতার রূপকার, মুক্তিযোদ্ধা/অ-মুক্তিযোদ্ধা, যুদ্ধাপরাধ/অ-যুদ্ধাপরাধ, বাঙালী জাতীয়তাবাদ/বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ, মধ্যম আয়ের দেশ/গরীব দেশ, ভাস্কর্য ভাল/ভাস্কর্য শিরক, ইউএনও সালমন দেশপ্রেমিক/ইউএনও সালমন দেশদ্রোহী, আদালত অবমাননা/আদালতকে শ্রদ্ধা, ভয়াল বন্যা/যাস্ট নরমাল বন্যা, ত্রাণ কার্য/কোরবানী........................................উহ! প্রতিটি ইঞ্চি ইঞ্চিতে বিতর্ক ছাড়া কোনো কথা নেই। কোনো একটা ইস্যুতে এই জাতি একমত নয়। অবস্থা এমন দাড়িয়েছে, আমার ভয় হয়, আমি যদি ফেসবুকে প্রশ্ন করি, আমাদের দেশের নাম কি বাংলাদেশ? মনে হয়, অন্তত ডজনখানেক মানুষ এখানেও হামলে পড়বে কনফিউশন নিয়ে, বিতর্ক নিয়ে, বিরুপ যুক্তি নিয়ে। আমাদের রাজনীতিকরা আর টকশো সুশীল সমাজ অত্যন্ত সুচারুভাবে, দক্ষতার সাথে, পরিকল্পিতভাবে, সফলতার সাথে আমাদের এই একদা ঐক্যবদ্ধ একপ্রাণ জাতিকে শতধা বিভক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন। আর শুধু মতদ্বৈততা নয়, বিরুদ্ধ মতকে পিটিয়ে কাত করে ফেলার সংস্কৃতি বেশ প্রতিষ্ঠা পেয়েছে এদেশে।

আমার আজকের লেখার মুল বিষয় দু’টি-আপেক্ষিকতা এবং বিতর্ক। সাম্প্রতিক সময়ে বেশকিছু প্রফেশনাল ইস্যুতে বিতর্কে ফেসবুক লিঙ্কডইন প্রচন্ড সরগরম। তার মধ্যে একটা হল মোটিভেশনাল এইড আর সিভি রাইটিং এইড। বাংলাদেশে এই দু’টি বিষয়ে কাজ করার ক্ষেত্রটি বেশ ইনস্টিটিউশনালাইজড হয়েছে বিগত বছরগুলোতে। মানুষ এর কাষ্টমারও হচ্ছেন। নিশ্চই চাহিদা ও ‍উপযোগ আছে বলেই বিষয় দুটো মার্কেট পাচ্ছে। তবে সম্প্রতি এই দু’টো বিষয়ে বেশ তীব্র বিরোধিতাও হচ্ছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে হিংস্র বিতর্কও হতে দেখেছি। যদিও এই হিংস্রতা কাম্য নয়। অনেক আগে একটা লেখা লিখেছিলাম পপুলার মেজরিটি নিয়ে যার বিষয়বস্তু ছিল, কিভাবে মেজরিটির মতামত, দৃষ্টিভঙ্গি মাইনরিটির বা আইসোলেটেড মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিকে ডমিনেট করছে, কিভাবে তাকে আঘাত করছে, কোণঠাসা করছে। ভিন্নমতকে কিভাবে আক্রমন করা হচ্ছে তা নিয়ে। এই লেখাটা বুঝতে হলে ওই লেখাটায়ও একটু ঘুরে আসবেন Click This Link এই লিঙ্ক এ। যাহোক, উপরে বলা দু’টো বিষয়ে বিতর্ক এড়িয়ে কিভাবে পজিটিভলি বিষয়গুলোকে নেয়া যায় সেটা বলার চেষ্টা করব। কেন মটিভেশনাল স্পিচ ও সিভি রাইটিং এইড খারাপ, কেন তারা পরিত্যাজ্য, কেন তারা ধান্দাবাজ ও ফালতু (!) সে নিয়েতো অনেক ‍যুক্তি শোনা হয়ে গেছে। তাই বিপক্ষের যুক্তিগুলো আর রিপিট করছি না। আমি শুধু পক্ষের কয়েকটি যুক্তি দেব। তবে ভাববেন না, আমি কোনো নির্দিষ্ট পক্ষকে সাপোর্ট করছি। আমি সব মতকে শ্রদ্ধা করি (রাজাকার ও ধর্মান্ধদের ব্যাতিত)। আমি শুধু কমপারেটিভ এনালিসিস করে দেখাচ্ছি। কোনটার পক্ষ আপনি নেবেন সেটা আপনার চয়েস।
১.মোটিভেশনাল স্পিচ ও সিভি রাইটিং এইডের সাহায্য নিলে আপনার ক্যারিয়ার ধ্বংস হবার কোনো সুযোগ দেখি না। সাহায্য হতে পারে। তবে ক্ষতির সম্ভবনা আমি দেখি না। পরনির্ভরশীল হয়ে যাবেন-ভয় পাচ্ছেন? ওকে, যদি নিজেই বোঝেন পরনির্ভরশীল হয়ে যাচ্ছেন সাথে সাথে স্টপ করুন না। ব্যাস।

২.বলতে পারেন, নিজের মোটিভেশনতো আমি নিজে। অন্য মানুষের আমাকে মোটিভেট করতে হবে কেন? ওয়েল, আপনার ডাক্তার আপনি নিজে নন, আপনার বাচ্চার অংকের টিচার নিজে নন, আপনার বাবার মৃত্যুতে তার দোয়া খতমকারী আপনি নন। আজকালতো মানুষ মারা গেলে তার জানাজা পড়াতে, কবর খোড়াতে, গোসল দিতেও প্রোফেশনাল লোককে ভাড়া করতে হয়। তাহলে মোটিভেশনকে একটি কমোডিটি বা সার্ভিস হিসেবে দেখে ওটাকে কিনতে অসুবিধা কোথায়?

৩.”সিভি নিজে যে লিখতে পারে না তারতো এমনিতেই চাকরী করার অন্যান্য যোগ্যতা নড়বড়ে হতে বাধ্য” কিংবা ’যে নিজের সিভি নিজে লিখতে পারে না, সে কেমন করে নিজের চাকরী নিজে করবে’ কিংবা ‘নিজের সিভি লিখতে পারে না এমন লোক মাস্টার্স পাশ করল কী করে’-এসব হল সিভি রাইটিং এইড না নেবার পক্ষে যুক্তি। ওয়েল, আপনি ম্যাট্রিক ইন্টারে ভাল ফল করার পরও কি ছেলেকে এ্যাডমিশন কোচিং পাঠাচ্ছেন না? অনার্স মাস্টার্স পাশের পরও কি বিসিএস দিতে আলাদা করে কোচিং করছেন না? অনলাইনে বিদেশে এডমিশনের সব ব্যবস্থা থাকলেও কেন মানুষ বিভিন্ন ফার্মের সাহায্য নিচ্ছে? অথবা ভাবুন, ট্রিমার দিয়ে নিজেই তো মনমতো শেভ হওয়া যায় তবু মানুষ কেন সেলুনে যায়? কেন যায়? ভেরিয়েশন, কমফোর্ট ও এক্সপার্টিজ এর জন্য। সিভি রাইটিং এইড যাস্ট একটি এইড যারা আপনাকে হেল্প করবে, মতামত দেবে, ত্রূটি শুধরে দেবে, আপনার জন্য সিভির উপস্থাপন আকর্ষনীয় করে দেবে। আপনি নিজে যদি এক্সপার্ট হন তবে যাবেন না কারো কাছে। তবে সবাই তো এক্সপার্ট নন। তাছাড়া আমি ফার্স্ট ক্লাস হোল্ডার ও ১০ বছরের অভিজ্ঞ হতেই পারি তার মানে এই নয়, ক্যারিয়ার রিলেটেড সব বিষয়ে আমি সেরা হব। যেমন, আমি ১২ বছর এইচআরে কাজ করি। বাট তবু আমি লেবার ল সম্পর্কে সুপার এক্সপার্ট না। ওটার জন্য আজও আইনজীবির সাহায্য লাগে।

৪.আধুনিক যুগে আমাদের কোন কাজটার জন্য থার্ড পার্টি নেই বলুন। আমরা নিজেরা পারি এমন সব সার্ভিস দেখুন প্রোফেশনাল সার্ভিসের ব্যানারে দেবার ব্যবস্থাও আছে যেমন:-খাদ্য নিজে বানাতে পারি তবু ফার্স্ট ফুড শপ আছে। জামা রেডিমেড কিনতে পারি তবু দর্জি দোকানও আছে। আয়রন নিজে করতে পারি তবু লন্ড্রি আছে। জুতা নিজে কালি করতে পারি তবু মুচি আছে। পরীক্ষার রেজাল্ট নিজের মোবাইলে দেখা যায় তবু দোকানেও ব্যবস্থা আছে। অনলাইনে বই পড়া, কেনা যায় তবু বইয়ের দোকান আছে, বই মেলা আছে। দলিল লেখক আছে, কাবিন লেখক আছে, নোটারি আছে। সিভি রাইটিং সার্ভিস কিংবা মোটিভেশনাল স্পিচ তেমনি একটি সার্ভিস। হ্যা পেইড সার্ভিস। আপনার লাগলে নেবেন, না লাগলে নেবেন না। তাই বলে সার্ভিসটা কি থাকতে হবে না?

৫.কিছু কিছু দুরাচার সব পেশাতেই সব সার্ভিস ইন্ডাস্ট্রিতেই থাকে। বদ এইচআর, ধান্দাবাজ কমপ্লায়েন্স, ভন্ড অডিটর কি নেই? সেরকম ধান্দাবাজ মোটিভেশনাল স্পিকার বা সিভি রাইটার থাকতে পারে। আমরা তাকে নিয়ে মানুষকে সতর্ক করতে পারি, তার কাছ হতে দূরে থাকতে পারি। কিন্তু তার পেশাটার প্রয়োজনীতা তাতে শেষ হয়ে যাবে না। অল্পদিন কোথাও কাজ করে কেউ মোটিভেশনার স্পিকার হয়েছেন কিংবা তার নিজের চাকরী/পেশাক্ষেত্রে তিনি (হয়তো) সফল ছিলেন না কিংবা তিনি সংশ্লিষ্ট সেক্টর বা পেশায় কখনো কাজ করেননি এমন অভিযোগের তীর ছুড়তে দেখেছি। তার উত্তরে বলব, মোটিভেশনাল স্পিকার হতে তাকে নিজেকে জীবনে প্রচন্ড সফল হতে হবে-কে বলল? মোটিভেট করা যদি তার সার্ভিস হয়, সেটাতে তিনি সক্ষম কিনা সেটা দেখুন। তিনি তার পূর্বের পেশায় সফল হলেও ভাল মোটিভেটর নাও হতে পারেন আবার সেটাতে ভাল না হলেও ভাল মোটিভেটর হতে পারেন। জানেন কি, ভাল ছাত্র সবসময় ভাল শিক্ষক হয় না।

৬.মোটিভেশন স্পিকিং ও সিভি রাইটিংকে শ্রেফ একটা পেশা বা বিক্রয়যোগ্য সার্ভিস হিসেবে দেখুন। ঠিক যেমন কনসালটেন্সি একটি সেবা বা সার্ভিস যেটা মানুষ পয়সা দিয়ে কেনে। বহুদিন ধরেই তো এইচআর কনসালটেন্সি এমনকি থার্ড পার্টি ট্যালেন্ট সোর্সিং তো চোখের সামনেই গড়ে উঠছে। কেউ কি কনসালট্যান্সিকে নিয়ে বিরোধিতা করছেন? সিভি নিজেই লেখা যায়। নিজেকে নিজে বা সুমহান ব্যক্তিত্বদের জীবনি পড়ে নিজেকে নিজে মটিভেট করা অবশ্যই যায়। পাশাপাশি এই প্রফেশনাল পেইড সার্ভিসও থাকল। কেউ যদি নিজে না পারে তবে সে তাদের কাছে যাবে।
৭.মোটিভেশনাল স্পিকার/সিভি রাইটাররা কেন মেইল দিয়ে, সার্কুলার দিয়ে, ফেসবুকে বক্তব্য দিয়ে, পোষ্ট দিয়ে লোক আকৃষ্ট করছেন? কারন ওটা তার পেশা বা ব্যবসা যাই বলেন। তো সব পেশার মানুষ যদি তার প্রোডাক্ট বা সার্ভিস বিক্রি বা মার্কেটিং করতে বিজ্ঞাপন দিতে পারেন, ব্রান্ড প্রোমোশন করতে পারেন এমনকি আজকাল বিদেশে এসকর্ট গার্ল সার্ভিসের জন্য, সারোগেসির মায়েরা পর্যন্ত বিজ্ঞাপন দেন। তো একজন মোটিভেশনাল স্পিকার বা সিভি রাইটার তার বিজ্ঞাপন করবেন না?

৮.ওরা বাঘা বাঘা প্রোফেশনালকেও ঘোল খাওয়াচ্ছে, ওভার এ্যাক্ট করছে, মানুষকে ভয় দেখাচ্ছে, মেকি সমস্যার আবহ তৈরী করছে, মানুষকে নিজের যোগ্যতা সম্পর্কে সন্দেহপ্রবন করে তুলছে, সেল্ফ কনফিডেন্স ডাউন করছে। হ্যা, আমার নিজেরও মাঝে মধ্যে ওনাদের কথা শুনে নিজের যোগ্যতা বা স্টাটাস নিয়ে হীনমন্যতা জাগে। তবে সেটা সাময়িক যা সামান্যতেই আবার রিকভার হয়। কিন্তু তার বিপরীতে হাজার হাজার মানুষ সার্ভিস পাচ্ছে-এটা ভাবলে আমার নিজের লাভ বা ক্ষতির হিসাবটা খুব বড় মনে হয় না।

৯.সিভি রাইটারকে বিউটি পার্লারের মতো দেখুন যাদের কাজ হল আপনার নিজস্ব সৌন্দর্যকে ফুটিয়ে তোলা। আপনার অনেক যোগ্যতা আছে। সেটাকে সিভিতে ফুটিয়ে তোলার কাজটা নিজেও করতে পারেন আবার সিভি রাইটারের মতো প্রফেশনালকেও দিতে পারেন। আরে ভাই, আমাদের ঘরে নাস্তা থাকলেও মাঝে মধ্যে বাইরে রেষ্টুরেন্টে খাই না? নাকি বলি, আমার ঘরে খাবার ও রান্নার জন্য বউ-দু’টোই থাকতে কেন বাইরে খাব? কিংবা এটা বলি, যে বউ নিজের ঘরের খাবার নিজে রাঁধতে পারেনা সে কেমন বউ?

১০.কেউ কেউ মনে করছেন, মোটিভেশনাল স্পিকার হলে তাকে অবশ্যই নিজের সফল হয়ে থাকতে হবে, নিজের ট্রাক রেকর্ড উজ্জল হতে হবে, তাকে অবশ্যই নিজে বড় মাপের কোনো ব্যক্তিত্ব হতে হবে, সবার কাছে গ্রহনযোগ্য হতে হবে। আপনি জানেন কি, কোয়ান্টাম মেথডের গুরু যাকে একটা বিশাল সংখ্যক মানুষ মোটিভেশনের জন্য দীক্ষাগুরু মানে, তার নিজের পূর্ব পেশায় সফলতা ছিল না? বিষয়টাকে এভাবে দেখুন, কেউ কেউ হয়তো ক্লাসের রেজাল্টে ফেলটুস কিন্তু তারপরও পরবর্তি জীবনে সে ব্যবসায় বা ক্যারিয়ারে মারাত্মক সফল। থ্রি ইডিয়টসের কাহিনী মনে নেই। তাই হয়তো তিনি কেরানী চাকরীতে সফল হননি কিন্তু মোটিভেশনাল স্পিকার হিসেবে দারুন সফল হতেও তো পারেন। আরে ভাই এটাও তো একটা পেশা। তাছাড়া, হ্যা, স্পিকার হিসেবে সফল হওয়া খুব কঠিন একটা পেশা। জানেন কি, বিল ক্লিনটনের বক্তৃতা শুনতে পয়সা দিয়ে লোক আসে? তো প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের কথা শুনতে যদি পয়সা দেয়াটা হালাল হয়, তবে আমার আপনার বড় ভাই কেউ যদি সেই একই কাজ করে তবে দোষ কী? বলবেন ক্লিনটন নিজে সফল আর সে বিরাট মানুষ। এউ ব্যাটা কোন আব্দুল্লাহ যে তার কথা পয়সা দিয়ে শুনব? ভাই আপনি তো ওনার কথাগুলো মূল্যায়ন করবেন, তাকে না। আর সফলতার কোনো মানদন্ড নেই। কে সফল আর কে নয় তার নির্দিষ্ট কোনো মানদন্ড আছে কি?

১১.কোনো কোনো সিভি রাইটার বা মোটিভেশনাল স্পিকার বাড়াবাড়ি করেছেন, করছেন এবং ভবিষ্যতেও করবেন। সেটা তার ব্যক্তিগত দোষ। তাতে পেশাটির দোষ দেয়া ভুল। আর হ্যা, কাউকে বা কারো কাজকে আমাদের যদি ভাল না লাগে, কারো কথার সাথে যদি আমি দ্বিমত হই, কারো দৃষ্টিভঙ্গির সাথে একমত না হই, তারপরও তো পরমতকে, অপরের মুক্তচিন্তার অধিকারকে, অপরের দৃষ্টিভঙ্গিকে সম্মান দিতে হবে। ভায়োলেন্টলী অন্যের মতামতকে আক্রমন করলে, গোয়াড়ের মতো বিরোধিতা করলে, যুক্তিহীনভাবে ব্যক্তিগত আক্রমন করলে আমার নিজেরই ব্যক্তিত্ব নষ্ট হবে। গণতন্ত্র গণতন্ত্র শুধু তো সংসদে বা পল্টনে বললে হবে না। নিজের জীবনেও সেটা বাস্তবায়ন করতে হবে।

১২.আমি না চাইতেও আমাকে ওরা ইনভাইটেশন পাঠাচ্ছে, অফার পাঠাচ্ছে-এমন কমপ্লেইন আছে। হ্যা, “ওরা” সেটা করছেন। তবে বিষয়টাকে এভাবে দেখি, প্রতিদিন আমার মোবাইলে ৫০ টা অফার মেসেজ আসে মোবাইল বা নানা কোম্পানী হতে আমি না চাইলেও। যুগটাই হয়েছে বিজ্ঞাপন আর প্রচারের। প্রচারে প্রসার। প্রচুর প্রচারনা ছাড়া আজকাল বাঘের দুধও বিক্রি হয়না (আমি আমার কয়েকটা লেখা দিয়ে সেটা বুঝেছি)।

১৩.শেষ কথাটা হল, যাকে ভূতে পায় সে নিজে কি নিজের ভূত ছাড়াতে পারে? বা যে সাইকিয়াট্রিক পেশেন্ট সে কি কখনো বুঝতে পারে নিজের সমস্যা আছে? কিংবা যে লেখক সে নিজে কি কখনো সম্পাদনা করে নাকি সব প্রকাশনীতে একজন প্রোফেশনাল সম্পাদনার লোক থাকে? ভাই জীবনে সব কাজের জন্য আমরা তৃতীয় ব্যাক্তির সাহায্যকে স্বাগত জানাই। তবে মোটিভেশন বা সিভি রাইটিংকেও একটি যাস্ট পণ্য বা সেবা ভেবে নিই। যখন লাগবে মনে হবে, কিনব। যখন লাগবে না, কিনব না।

ওয়েল, এতক্ষন এই লেখা পড়ে যদি মনে করেন, আমি মোটিভেশনাল স্পিকার বা সিভি রাইটারদের সমর্থন করছি বা আমি তাদের পক্ষে, তাহলে ভুল করবেন। আমি কখনো কারো পক্ষ নিই না। শুধু এই ইস্যুতে না, কোনো ইস্যুতে আমি কখনো পক্ষ নিই না (শুধু মুক্তিযুদ্ধ, ‍যুদ্ধাপরাধ, রাজাকার, বাংলাদেশ ইস্যু বাদে, যেগুলোতে আমি চরমভাবে পক্ষপাতদুষ্ট)। আমি শুধূ ইস্যুটার বিপরীত দিকটি বললাম। কারন বিরোধী যুক্তিগুলো অনলাইনে প্রচুর পাবেন। বিরোধী যারা তাদের যুক্তিকে পূর্ণ সম্মান রেখেই এই লেখা লিখেছি। কেউ ব্যাক্তিগতভাবে দুঃখ পাবেন না। এবার আপনি আপনার নিজের ডিসকোর্স ঠিক করুন। তবে অন্ধ অনুকরন করবেন না। সেটা কিভাবে ক্ষতি করবে সেটা দেখুন এই লিঙ্কে: Click This Link আমি এই চরম মেজরিটি প্রায়োরিটা্জড জগতে সবসময় নিজের ডিসকোর্স নির্ধারন করি এভাবে, পৃথিবীতে মানব দানব ফেরেশতা ইবলিস সব থাকবে। আমাকে তাদের সবাইকে নিয়েই বাঁচতে হবে। কারন ওঁদের সবাইকেই বিধাতা কোনো না কোনো কারন সৃষ্টি করেছেন। আমার যেটা ভাল মনে হয় সেটাকে কোলে নেব। যেটাকে খারাপ মনে হয় সেটা হতে নিজেকে দুরে রাখব। যদি আমার মটিভেশন দরকার মনে হয় তবে সেটা পয়সা দিয়ে কিনব। ওইযে, আমরা পয়সা দিয়ে ম্যাসাজ করাই না। তো শরীরের ম্যাসাজ যেমন কিনি তেমনি মনের ম্যাসাজও না হয় কিনলাম। আমার প্রথম পর্বের লেখার মূল উদ্দেশ্য কিন্তু মোটিভেশনাল স্পিকার বা সিভি রাইটিং নয়। মূল লক্ষ্য ছিল আমাদের সমাজে বিতর্ক তথা কুতর্ক করার মানসিকতা।

জানেন নিশ্চই, পৃথিবী কাঁপিয়ে দিয়েছে যেসব বিষয় তার মধ্যে নিউটনের ল অব গ্রাভিটি একটা, আর আরেকটা হল, আইনস্টাইনের ’থিওরী অব রিলেটিভিটি’ মানে আপেক্ষিকতাবাদ।’ আমি এমন একটা কাটখোট্টা বিষয় নিয়ে কেন পড়লাম সেটা ভেবে নিশ্চই আপনার কৌতুহল হচ্ছে। নাহ, আমি বিজ্ঞানের ছাত্র এককালে থাকলেও এখন আর নই। তাই এই নিঁখাদ বৈজ্ঞানিক বিষয়টির বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায় যাব না। আমাদের বাস্তব জীবনে আপেক্ষিকতার উপস্থিতি নিয়ে কথা বলব। এখুনি রণেভঙ্গ দেবেন না। কষ্ট করে পড়াটা চালিয়ে যান। আপেক্ষিকতার উপর নিচের লাইনগুলো ধার করেছি অনুজ বন্ধু শুভ’র ওয়াল হতে। মুল লেখাটি কার বলতে পারব না।

প্রিয় রং বলে অাসলে কিছু নেই।
বিয়ের কনের কাছে লাল শাড়ী ভাল লাগলেও লাল রক্ত ভাল লাগবে না ।
লাল শাড়ি স্বপ্নের প্রতিক হলেও লাল রক্ত ভয়ের প্রতীক।
কেউ হয়তো দোকানে গিয়ে একটা হলুদ শার্ট পছন্দ করবেন কিন্তু গাড়ি কেনার সময় এই রঙটাই অসহ্য লাগবে।

বুৃঝতে পারছেন না তাই তো?

প্রিয় রঙের ঝামেলা থেকে বাঁচতে অনেকেই কালো রঙ বাঁছে। কিন্তু এই রঙ যদি তার ঘরের দেয়ালে লাগাতে বলা হয় তাহলে অবশ্যই সে নিষেধ করবে। প্রিয় রঙ বলে অাসলেই কিছু নেই। ব্যাপারটা ক্ষেত্রবিশেষ।

প্রিয় মানুষ বলেও অাসলে কিছুই নেই।এই ব্যাপারটাও কিন্তু ক্ষেত্র-বিশেষ। অাজ যাকে অাপনার খুব ভাল লাগে। তার সাথে পরিচয় না হলে অাজ কিন্তু এমনটা হতো না । যেমন ধরুন, আজ আপনি বাংলাদেশের মানুষকে নিয়ে গদগদ আবার অাপনার জন্ম অামেরিকা বা জাপানে হলে অাপনি সেই দেশের মানুষকেই বেশি ভালবাসতেন।

পেটওয়ালা ট্রাক ড্রাইভার মনসুর পেট চুলকাতে চুলকাতে পানের পিক ফেললেন। ওউ দৃশ্য দেখে কোন সুন্দরী "ইয়াক" করে উঠল। ঠিক এই মেয়েটিই যদি মনসুরের ঘরে জন্ম হতো। তাহলে বিশ্রী ভাবে পেট চুলকানো ড্রাইভারটাকেই মনে হতো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবা।

প্রিয় মানুষ ব্যাপারটা অাপেক্ষিক, ক্ষেত্র বিশেষ।জন্মের পরই কেউ প্রিয় এবং অপ্রিয় থাকে না । অামরা নিজেই কাউকে প্রিয় এবং অপ্রিয় বানিয়ে ফেলি। অাপনার সবচেয়ে প্রিয় মানুষটিকে অাপনার ভালো লাগতে পারে। তবে কাল ঝগড়া হয়ে অাপনার কেই মানুষটিকেই শত্রু মনে হবে।

উপরের গল্পটি পড়ে নিশ্চই একটা ধারনা জন্মেছে, কী ধরনের আপেক্ষিকতাকে বোঝাতে চাওয়া হচ্ছে। আরেকটা গল্প বলি যেটা পড়েছিলাম ক্লাস সেভেনের র‌্যাপিড রিডারে। একবার এক পশ্চিমা শহরে। দুই দিকে দুটি পাহাড়। দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তি পাদদেশে একটি Pub। তো একদিন সেই দুই পাহাড় হতে দু’জন ঘোড়সওয়ার পাহাড় হতে নেমে Pubটির কাছাকাছি এলেন। একজন পাবের ডানদিক হতে আরেকজন বাম হতে। বামের ঘোড়সওয়ার বললেন, “কী সুন্দর এই রুপালী সেলুনটি”। কিন্তু ডানের ঘোড়সওয়ার বললেন, “এই স্বর্নালী সেলুনটি অত্যন্ত সুন্দর”। প্রথম ঘোড়সওয়ার দ্বিতীয় জনকে উদ্দেশ্য করে বলল, ওহে ভাই, ওই সাইনবোর্ডে পরিষ্কার লেখা আছে এটা সিলভার সেলুন। তুমি কেন এটাকে গোল্ডেন বলছ? দ্বিতীয়জন বলল, কই, আমি তো পরিষ্কার লেখা দেখছি গোল্ডেন সেলুনে স্বাগত। ব্যাস আস্তে ধীরে এই নিয়ে তর্কে জড়াল দু’জন। সেলুনের নাম সিলভার সেলুন নাকি গোল্ডেন সেলুন। দু’জনের ঝগড়া এক পর্যায়ে বন্দুক যুদ্ধের উপক্রম করল। এমন সময় সেলুনের ব্যাটউউংডোর ঠেলে এক বৃদ্ধ বের হলেন। তিনি দু’জন ঘোড়সওয়ারকে প্রায় যুদ্ধোদ্ধত দেখে তাদের ঝগড়ার কারন জানতে চাইলে দু’জনে বিচার দিলেন দ্বিতীয়জনের ভুলের ব্যাপারে। বৃদ্ধ একটু হেসে বামের ঘোড়সওয়ারকে ডানে নিয়ে গেলেন আর ডানের লোকটাকে বামে। এবার পড়তে বললেন সাইনবোর্ড। তারা দু’জনেই দু’জনের ভুল বুঝতে পারল। আসলে সেলুনের মালিক মজা করার জন্য সেলুনের সাইনবোর্ডের দু’পাশে দু’রকম নাম দিয়েছে-গোল্ডেন ও সিলভার। তার মানে দাড়াল কেউই ভুল না। শুধুমাত্র আপেক্ষিকভাবে তাদের দু’জনের ধারনা ভুল আবার সঠিক দুটোই। আমাদের ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে এমনি হাজারো আপেক্ষিক সত্য-মিথ্যা বিদ্যমান। লালন শাহ’র সেই গানটা মনে আছে-”পাপ পূন্যের কথা আমি কারে বা শুধাই? এই দেশে যা পাপ গন্য আরেক দেশে পূন্য তাই”। আসলেই। আমাদের পৃথিবীতে পাপ-পূণ্য, সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায়, পূর্ব-পশ্চিম, উচিৎ-অনুচিতের ব্যাপারটি শুধুই আপেক্ষিকতার। নিখাঁদ সত্য ও মিথ্যা বলে কিছু নেই। সলিড ন্যায় ও সলিড অন্যায় বলে কিছু হয় না। দু’টোই আপেক্ষিকতার ব্যাপার। এক দেশে যা বেঠিক সেটাই অন্য দেশে চরম ঠিক। এক সময়ে যেটা সঠিক সেটাই অন্য কোনো সময়ে বেঠিক। জানেন কিনা, কেরালায় মাথা দু’পাশে হেলানো মানে হল ’হ্যা’ আবার সেটাই আমাদের দেশে করলে বোঝায় ’না‘। ভাষার ক্ষেত্রেও তাই। এক দেশের বুলি আরেক দেশের গালি। ঢাকায় বা যেকোনো শহরে পুরী খুব প্রিয় খাবার আবার সেই পুরীই সিলেটে গিয়ে কারো কাছে চাইলে আপনাকে মার খেতে হবে। আমি যেটা বলতে চাই তা হল, জগতের সকল এডজেকটিভ বা এ্যাডভার্বই আপেক্ষিকতার মুরীদ। আপনি আপনার গার্লফ্রেন্ডের অপেক্ষায় বসে আছেন। সময় মনে হয় যেন প্রতিটি মিনিট ঘন্টার সমান। আবার সেই প্রিয়া যখন এসে বসে, আপনি তার সাথে বসে গল্প করেন তখন কোথা থেকে ঘন্টা কেটে যায় মনে হয় যেন এই তো কয়েক মিনিট হল। আপনি অফিসের বড় বস। মিটিং হবে ৫ টায়। আপনি এলেন ৬টায়। এসে ভাবলেন, আরে, ৬০ মিনিটইতো মাত্র লেট। সেই আপনিই যখন পিয়নকে পানি দিতে বলেন, সে ১ মিনিটে আনলেও মনে হয় অনেক লেট করেছে। রিক্সা চড়েছেন, ভাড়া ঠিক করেছেন ১০ টাকা। নামার পর বৃদ্ধ রিক্সাওয়ালা ৫টি টাকা বেশি চাইলে মনে হয় ও জুলুম করছে। আবার এই আপনিই কফি শপে প্রিয়াকে আরো ১৫ মিনিট ধরে রাখতে মিছিমিছি আরেকটা ৫০ টাকার কফির অর্ডার করেন অথচ আপনি আগেরটাই খাননি। আপেক্ষিকতার ‍প্রভাব। যেই রোদে আপনার চামড়া পুড়ে যায়, রোদ হতে বাঁচবার জন্য সুন্দরীদের হাজার চেষ্টা, সেই সুন্দরীই আবার মা হলে তার পিচ্চিকে রোদে শুইয়ে ভিটামিন ডি খাওয়ান। আপনার কাছে প্রিয়ার দেয়া গোলাপের স্টিকটি ভালবাসার জলজ্বলে নিদর্শন সেটাই আবার ফুল বিক্রেতা মেয়েটার কাছে দু’টি ভাতের হাতছানি। সকালে অফিসে রওনা হবেন। বৃষ্টি নামল। মেজাজ খারাপ। বৃষ্টিকে শাপশাপান্ত করেন। বৃষ্টি পঁচা। আবার রাতে বাসায় আছেন, বৃষ্টি নামল, বউ এককাপ ধোঁয়া ওঠা কফি হাতে দিয়ে পাশে বসল বারান্দায়। তখন বৃষ্টির মতো রোমান্টিক আর কিছু হয় না।

এবার একটু সিরিয়াস দিকে যাই। সন ১৯৪৭। উপমহাদেশ তথা বৃটিশ ভেঙে যখন ভারত, পাকিস্তান হয় তখন আমরা পাকিস্তান নিয়ে উচ্ছসিত, ভারত শত্রূদেশ। আবার ২৪ বছর পরে পাকিস্তান আমাদের শত্রূ আর ভারত পরম বন্ধু। আবার আজ ৪৫ বছর পরে ভারত আমাদের জাত শত্রূ (পাবলিক চয়েসে)। মানে হল, বন্ধুত্বের কোনো ইউনিভার্সাল রূপ নেই। সেটা রূপ পরিগ্রহ করে সময়ে সময়ে, অবস্থাভেদে। আমরা যখন স্কুলে পড়ি তখন আমাদের মন মগজে পাখি পড়ার মতো ঢুকিয়ে দেয়া হত-ফার্স্ট হতেই হবে, স্টার পেতেই হবে, বোর্ড স্ট্যান্ড না করলে সে কোনো ছাত্রই না। আমরাও বুঝি না বুঝি, সম্ভব বা অসম্ভব যাই হোক-যেকোনো মূল্যে ক্লাসে ফার্স্ট হবার পেছনে জানপড়ান লাগিয়ে দিতাম। সেই ছাত্র বয়সে মনে হত ক্লাসে ফার্স্ট হতে পারাটাই সফলতার নিদর্শন। সেকেন্ড হওয়াটাই ব্যর্থতা।আবার এর মাঝেই কেউ কেউ ছিল স্বেচ্ছা বৈরাগী। ওদের দেখে মনে হত শুধু ভাল রেজাল্ট করা ব্যতিত আর সব কাজেই ওদের অসীম আগ্রহ। গার্লস স্কুলের সামনে দাড়ানো হতে মাঝে মধ্যে একটু আধটু বিড়ির টান-সবই চলত। আমরা ওদের বলতাম দুষ্টু ছেলে। বাবা-মায়েরা ওদের সঙ্গ হতে দুরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করতেন। ওদের সাথে মিশলে জীবন ঝড়ঝড়া। তবে রুঢ় বাস্তবতা হল, সেইসব দুষ্টু ছেলেদের একটা বড় অংশকেই দেখেছি পরের জীবনে উপরে উঠে আসতে। সমাজের কাঙ্খিত যত স্ট্যাটাস, নর্মস, স্বীকৃতি-তার প্রায় সবটাতেই রেকর্ড মার্কস পেয়ে পাশ করতে। ইউনিভার্সিটিতে প্রথম দিন হতে সবার চেষ্টা থাকে সবচেয়ে সুন্দরী ব্যাচমেটকে জিএফ হিসেবে দখল নেয়া। যে যতটা চোস্ত ততটাই তার জিএফ ভাগ্য। তখন মনে হত, জিএফ বাগাতে যে যতটা কার্যকর সে ততটাই সফল। যাদের জিএফ নেই, থাকলেও তেমন মার্কা নেই, তারা ব্যর্থ। ইউনিভার্সিটি শেষ করলাম। হাঁচড়ে পাঁচড়ে একটা চাকরীও বাগিয়ে নিলাম। মনে হল সফল হলাম। আমাদের সহপাঠিরাও যে যার মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল। কেউ চাকরী, কেউ ব্যবসা, কেউ ধান্দা, কেউ রাজনীতি, কেউ শশুরের আদরের মনি! যারা ”বিসিএস ক্যাডার” হল তারা ভাবল চাঁদ হাতে পাওয়া গেল। যারা পেল না, তারা ভাগ্যকে মেনে নিল আর ঢুকল নানান প্রাইভেট জবে-উচ্চ মাহিনায়। ভাবল, যাক বেতনে পুষিয়ে যাবে-আমিও সফল। ওদিকে বিসিএস ক্যাডারের মন খারাপ-সিল-সিগনেচার ছাড়া আর কী পেলাম জীবনে। হালে এসে আবার সরকার বাবাজি দিল সরকারী কামলাদের মজুরী আকাশ ছোঁয়া করে। বিসিএসদের পোয়া বারো আর প্রাইভেটারদের মাথায় হাত। কালে কালে বহু বছর পার হল। মধ্যবয়সে এসে পড়ল জীবন। মাঝে মধ্যে ন্যাংটো কালের জীবন হতে এই মধ্য বয়সের জীবনের ট্যালি করতে বসি। জীবন সফল নাকি বিফল? বাস্তব অভিজ্ঞতায় যতটা দেখেছি, মধ্যম বা পরের সারিতে যারা ছিল একাডেমিতে, তুলনামুলক তারাই এখন এগিয়ে আছে সোস্যাল স্ট্যাটাসে কিংবা আপেক্ষিক স্ট্যাটাসে। তথাকথিত ভাল ছাত্ররা মোটামুটি কেরানী কিংবা কর্পোরেট দাস হয়ে একটা টাইপড নাগরিক জীবন ধুঁকে ধুঁকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। আর তাদের মিডিয়াম বা থার্ড ক্লাস সহপাঠিরা প্রতিনিয়ত নতুন নতুন স্ট্যাটাসের ছক্কা মারছে। নিত্যনতুন গাড়ি, বারিধারার ফ্ল্যাট, পূর্বাচলের প্লট, সুইস ব্যাংকে ব্যালেন্স, সেলফী কুইন শশুর-কন্যা (মানে বউ), কিউটের ডিব্বা দু”খানা মানব ছানা, চেকইন, ট্রাভেল, ট্যুর, সোস্যাল মিডিয়া, স্ট্যাটাস আপডেট, ক্রীকেট মাঠের দর্শক, তৃপ্ত আয়েশি সামাজিক সুখের ঢেকুর-অনেকটাই দিয়েছে জীবন তাদের। এখন মনে হয়, ওরাই সফল। সফলতার মিটার বয়সে বয়সে বারবার বদলেছে। কখনো সেটার নিয়ামক ছিল ভাল রেজাল্ট, কখনো ভাল জিএফ, কখনো বা বিসিএস, কখনো প্লট, কখনো ফ্ল্যাট, কখনো আবার অন্যকিছু। সফল হলাম কি ব্যর্থ হলাম সেটার বিচার করে শেষ করতে পারি না। ঠিক করেছি না বেঠিক, ঠিক রাস্তায় হেঁটেছি নাকি ভুল, ভবিষ্যত আলোকিত নাকি ঝরঝরা-সেটা একটা বিরাট প্রশ্ন।

এক রাজার এক চাকর ছিল যে বলত, খোদা যা করে বান্দার মঙ্গলের জন্যই। রাজা তা বিশ্বাস করত না। একদিন জঙ্গলে ঘুরে বেড়াবার সময় রাজার পা কেঁটে গেল। রাজা খোদার দোষ দিতে লাগল। চাকর বলল, খোদা আপনার ভাল’র জন্য করেছে। রাজা বিশ্বাস করল না। একটু পরেই একদল জঙলী তাদের বন্দী করে তাদের রাজ্যে দেবতার উদ্দেশ্যে বলি দিতে নিয়ে গেল। কিন্তু বলি দিতে গিয়ে দেখল রাজার পায়ে ক্ষত। কিন্তু তাদের বলি দিতে নিখুত হতে হবে। রাজাকে ছেড়ে দিল আর রাজা বেঁচে গেল। চাকর এসে বলল, দেখলেন, খোদা যে সবকিছু ভাল’র জন্য করে? তখন যদি আপনার পা না কাঁটত তবে আজ গলাটা কাঁটা পড়ত। সৌভাগ্য আর দুর্ভাগ্য দু’টোই যে আপেক্ষিক সেটা কি বুঝতে পারছেন?

আপেক্ষিকতার আনুসঙ্গিক দিক হল মার্জিনালাইজেশন ও জেনারেলাইজেশন। এক মহল্লায় এক তাহাজ্জুদ গুজার বুজুর্গ আর এক সিঁদেল চোর থাকত। একদিন ফজরের ওয়াক্তে তাহাজ্জুদ গুজার লোকটা পুকুরঘাটে ওজু করতে বসল। একই সময় সিঁদেল চোর সারারাত চুরি করে হাতমুখ ধোয়ার জন্য পুকুরের অপর পাড়ের ঘাটে নামল। বুজুর্গ লোকটা চোরকে দেখে ভাবল, আহা, ওই লোকটাও মনে হয় আমার মতো সারারাত তাহাজ্জুদ পড়ে এখন ফজর পড়তে মসজিদে এসেছে। আর চোর তাহাজ্জুদ পড়া বুজুর্গকে দেখে ভাবল, বেটা নিশ্চই আমার মতো চোর। সারারাত চুরি করে এখন বাসায় যাচ্ছে। এই দৃষ্টিভঙ্গির নাম হল মার্জিনালাইজেশন ও জাজমেন্টাল এটিচুড। আমরা বাঙালীরা প্রচন্ড রকম জাজমেন্টাল। চোখের দেখাতেই কাউকে রাজা উজির বানিয়ে ফেলি। কোনো বিষয়ের তলানীতে যাবার প্রবণতা খুব কম। আপেক্ষিকতাকে হৃদয়ঙ্গম করতে পারলে জীবন সহজ হয়, সাবলীল হয়। জটিলতামুক্ত হয়। আপনি যদি জানেন জগতে দৃশ্যমান ঘটনাবলি ও সত্যাসত্য সবই আপেক্ষিক তাহলে মনের টানাপোড়েনটা কম হয়, পাওয়া না পাওয়ার কষ্টটা কমে যায়। বঞ্চনার আগুনটা ফিকে হয়ে যায়। যখন আপনি জানেন, আজ যেটা আপনাকে পোড়াচ্ছে সেটাই হয়তো কাল হয়তো সেটাই আপনার আনন্দের কারন হবে। আজকে যার জন্য আপনি কেঁদে বুক ভাসাচ্ছেন কাল তার অনুপস্থিতিই হয়তো আপনাকে সুখের সাগরে ডোবাবে। তাই কোনো কিছুতে আনন্দ আবেগে আপ্লূত হওয়াও ভুল আবার মনের দুঃখে আত্মহারা হওয়াও ভুল। সুখ ও দুঃখ বড্ড সাময়িক ও আপেক্ষিক। দু’য়ের অস্তিত্বই ইগনোরেবল।

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ২৪ শে আগস্ট, ২০১৭ সকাল ১০:২৭

আজাবুল মরফুদ বলেছেন: চমৎকার একটা লেখা। দুঃখের বিষয়, মহান স্বাধীনতা অর্জন করতে যেয়েও আমরা ঐক্যবদ্ধ ছিলাম না। ১৯৭০-এ নৌকায় ভোট দেয় নাই ২৩%। ৭৫-এ নিষ্ঠুর পট পরিবর্তনের পর সুকৌশলে এই বিভাজনকে আরও বেগবান করা হয়। ২৩% আগে থেকেই একপক্ষ কিন্তু ৭৫-এর পর বিভাজনের ভেলকিবাজি না বুঝে মুক্তিযুদ্ধ পন্থী ৯% যেয়ে ২৩%-এ যোগ হয়। তাইতো পচে দূর্গন্ধ হওয়া সত্বেও ২০০৮ সালে ওরা ৩২% ভোট পায়।

২৪ শে আগস্ট, ২০১৭ সকাল ১১:১৩

বেচারা বলেছেন: আফসোস। বাকিটুকু শুধু দীর্ঘশ্বাস।

২| ২৪ শে আগস্ট, ২০১৭ দুপুর ২:২৬

ak ahad বলেছেন: খুব ভাল লাগল লেখাটা পরে__

২৪ শে আগস্ট, ২০১৭ বিকাল ৫:৫৪

বেচারা বলেছেন: ধন্যবাদ। আপনার উপস্থিতি আনন্দ দিল।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.