নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি কেউ নই, আমি আমার নই, আমি তোমার নই, আমি তুমিও নই

বেচারা

Walid

বেচারা › বিস্তারিত পোস্টঃ

ভূত ও আধাভৌতিক অভিজ্ঞতা: প্যারানরমাল নাকি প্যারাসাইকো?

১১ ই ডিসেম্বর, ২০১৭ দুপুর ১:৩১

পৃথিবীতে একটা জিনিস নেই সবাই জানে কিন্তু সবাই এই অস্তিত্বহীন জিনিসটিকে ভয় পায়।

সেটা কী বলতে পারেন? ভূত।

আপনি যাকেই জিজ্ঞেস করবেন, সে বলবে ভূত বলে কিছু নেই। আবার তাকেই বলেন, ভূত ভয় পান? তিনি বলবেন, পাই। যদি বলে পাই না, তবে তাকে একা একা ভুতূরে বাড়িতে রাত কাটাতে বলুন, পারবে না। আমার একজন বন্ধুর একটা ফান (বা সিরিয়াস) পোষ্টে একটা অশরীরি ঘটনা পড়ে কিছু লজিক্যাল মন্তব্য করেছিলাম।

তা দেখে আমার দু’জন সুহৃদ আমাকে একটা আলাদা গল্প লিখতে বলল এই বিষয়ে। ওনাদের উৎসাহে ওইদিন রাতেই লিখতে বসলাম। একটানে লিখে শেষ করলাম। আমি আমার নিজের প্রত্যক্ষ করা বা একদম কাছের মানুষের চাক্ষুস কিছু আধাভেীতিক অভিজ্ঞতার কথা বলব। চেষ্টা করবো আমার নিজস্ব লজিকে ওগুলোর একটা ব্যাখ্যা দাঁড়া করাতে।

প্রথমেই বলি আমি প্যারাসাইকোলজির বিশেষজ্ঞ নই। ওগুলো কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যখ্যা নয় বরং আমার নিজস্ব একটা ব্যাখ্যা।
তবে একটা কথা প্রথমেই বলে নিই। জ্বীন নামক এক ধরনের স্বত্ত্বার কথা মুসলিম মহাগ্রন্থ আল কুরআনে এসেছে। আমি জ্বীনের অস্তিত্ব নিয়ে কোনো প্রশ্ন করবো না বা দ্বিমত নিয়েও কোনো কথা বলব না। এটা করার কারনও বলব না।

অশরীরি-১: মিরপুর মনিপুরে প্রথম যে বাড়িটাতে আমি ও আমার সহধর্মিনী থাকা শুরু করি, ওই বাড়িটার এ্যাটিকের মানে ছাদের ঘরে ৭ তলায় আমরা ঘর পাই। ওই ঘরটা তার জন্মলগ্ন হতে কোনোদিন ভাড়া হয়নি। প্রায় ১০ বছর যাবৎ ওটা খালি পড়ে ছিল। ঘরটার ভেতর হতে ছাদে যাওয়ার রাস্তা। মানে হল ছাদের মাঝখানে ঘর, চারপাশে ছাদ। বাড়ির বাকি ভাড়াটিয়ারা ছাদে যেতে পারত না, তার মানে ছাদটাও অস্পর্শিত। তো আমরা দু’জন সেই দীর্ঘ ১০ বছর পরিত্যাক্ত ঘরটি ভাড়া নিই। সাথে আমার ছোটো ভাই। প্রথম কিছুদিন ভালই ছিল। আমরা অসামান্য ‍সুন্দর সেই ঘরটি আস্ত ছাদসহ পেয়ে যারপরনাই উদ্বেলিত। কিন্তু হঠাৎ একদিন আমার স্ত্রী তার একটা অদ্ভূত অনুভূতির কথা বলল।
রাত নামার পরে আমরা ফিরতাম অফিস হতে। তো ওর নাকি এমন একটা অনুভূতি হয় যে, ঘরে আরো কেউ আছে। কোনো শব্দ, ছায়া, চিহ্ন-কোনো কিছুই না। স্রেফ ওর মনে হত ঘরে আরো কিছু বা কেউ আছে। যথারীতি আমরা প্রথমে কেউই পাত্তা দিইনি। কিন্তু ওই অনুভূতিটি বাড়তে থাকে। কিছুদিন পরে ওর মনে হতে থাকে, ঘরের জিনিসপত্র কে যেন এলোমেলো করে রাখে। এটা চোখে পড়ে কারন বউ ও আমি প্রচন্ড গোছালো, ফলে পরিবর্তনটা চোখে পড়ে।

একটা পর্যায়ে অন্যরকম অনুভূতির স্থানে ভয় জায়গা করে নিল। একটা সময়ে আমরা অনুভব করতে পারলাম, প্রায়ই বাসায় একটা ফুলের গন্ধ পাওয়া যায় যেটা অপরিচীত। বাসাটা যে জায়গায় সেখানে ফুলের গন্ধ থাকাটা সম্ভব না। ভয়টা এমন হল, ওপরে চিলেকোঠায় ওয়াশরুমে যেতেও আমাকে ডেকে উঠিয়ে নিতে লাগল। সন্ধ্যা নামলেই নিটোল আমাকে ঘরে ফেরার তাড়া দিতে থাকত। এমনও হয়েছে, আমি বাসা হতে প্রায় ঘন্টাখানিকের দূরত্বে। পুরো রাস্তা ওকে ফোনে ধরে রেখে বাসায় ফিরেছি।
একদিন এমন হল, আমরা দু’জন নিচে হাঁটতে গেছি। ভাই বাসায় একা। আনুমানিক মিনিট ৩৫ পরে ওর ফোন। ফোন ধরতেই ভাইয়ের ফ্যাঁসফেসে গলায় চিৎকার, ”তোরা কোথায়? কোথায়?” আমরা যা বোঝার বুঝলাম। দৌড় লাগালাম। আমরা পাশেই ছিলাম। বাসার নিচে চলে এলাম। ও পায়ে স্যান্ডেল না পড়ে, দরজা খোলা রেখেই নিচে নেমে পড়েছিল। ঘরে ফিরলাম।

ও যা বলল, তা রীতিমতো গা শিউড়ে ওঠার মতো।

আমরা নেমে যাবার পরও ও ছবি আকঁছিল। হঠাৎ ওর মনে হল, ওর ঘরে কেউ ঢুকেছে। ও ইগনোর করে। হঠাৎ ওর মনে হল, কেউ ওর পিঠে হাত রাখল। ব্যাস। আর কে পায় ওকে। একলাফে বাসার নিচে। এরপরও আমরা ওই বাসায় মাস ছয়েক ছিলাম। ওইসব প্যানিক ও প্যারানরমাল অনুভূতি নিয়েই। বিশেষ কারনে ওই বাসা ছাড়তে হয় একসময়। তবু দীর্ঘদিন আমরা দু’জন ওই বাসার সমস্যা নিয়ে কোনো কথা মনে করতাম না। প্যানিক নতুন করে ভর করবার ভয়ে। আমি এই ঘটনাটার একটা নিজস্ব ব্যাখ্যা পরে দিচ্ছি।

অশরীরি-২: ছোটবেলায় আমরা একটা বিদ্যুত অফিসের কলোনীতে থাকতাম। মাঝে মধ্যে সন্ধ্যার আকাশে আগুনের একটা গোলার মতো ছুটে যাবার ঘটনা দেখেছিল আমার কিছু বন্ধু। ভয়ে ভয়ে থাকতাম কখন যেন ওই ভূতের কবলে পড়ি। একদিন সত্যি সত্যিই মাগরিবের আজান হচ্ছে। আমি পুকুরে হাত-পা ধুয়ে বাসায় ফিরবার সময় বাসার গেটে দাড়িয়ে হঠাৎ আকাশে তাকালাম। তখনি একটা আগুনের গোলাকে ছুটে যেতে দেখে জ্বিনের ভয়ে অজ্ঞান হবার যোগাড় হল। আমার চিৎকার শুনে মা, আপা দৌড়ে এলো। ওরা আসতে আসতেই ওই আগুন গায়েব। ওই ঘটনার অভিজ্ঞতা আমাদের অনেকেরই হয়েছিল।
ভয় তাড়াতে মা একটা অদ্ভূৎ কাজ করত। লোহার দা আগুনে লাল করে পুড়ে ওটা একটা লবন পানির পাত্রে ঠেসে ধরত। সেই তাপে লবন পানি গরম হত। সেই পানি খাইয়ে দিত। ভাবা হত, এতে ভূত ধরবে না।

অশরীরি-৩: আমার এক বন্ধু বরিশাল লঞ্চ ঘাটের মসজিদের ২০-৩০ হাত দূরে একটা পাতাহীন গাছের গল্প লিখেছিলেন। গাছটার কোন সময়ই কেউ পাতা দেখে নাই এমন কি কোন ফল হয় না। অথচ গাছটা দীঘদিন বেঁচে আছে। সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হলো আমাবস্যা রাতে গাছটিতে হাজার হাজার বাঁদুড় এসে পড়ে। অনেকে বলেন, এ গাছের নীচ দিয়ে কেউ চলাচল করলে জ্বর সহ
নানাবিধ রোগ হয়।

অশরীরি-৪: আমার একজন সহকর্মী মিরপুরে থাকতেন। তার প্রথমা স্ত্রী সন্তানসম্ভবা অবস্থায় মারা যান। তার শক্ত বিশ্বাস, ভাবীকে জ্বীন বা খারাপ আত্মার আক্রমণে প্রাণ দিতে হয়েছিল। এমনটা ভাবার বেশকিছু বিশ্বাসযোগ্য কারনও ছিল অন্তত আমার মতো লজিক বেজড মানুষেরও তাই মনে হয়েছিল।
যাহোক, তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করেন। ওই ভাবিকে নিয়ে তিনি আরেকটা বাসায় ওঠেন। ওই বাসার কিছু ভেীতিক ঘটনা বলি। রান্নাঘরে কাজ করছেন, হঠাৎ খুব ভালভাবে তাকে তুলে রাখা একটা ভারি বাসন ঝনঝন করে পড়ে গেল যেটা খুব জোরে ধাক্কা না খেলে পড়বে না। চুলা বন্ধ। হঠাৎ করে দপ করে জলে ওঠে। বন্ধ করে রাখার পরও আবার কতক্ষণ পড়ে দপ করে জলে ওঠে। এমনকি রাতে বাথরুমে পানি পড়া, কাপড় কাঁচার শব্দ, পায়ের শব্দ, তীব্র দুর্গন্ধ, গরম তরকারী পঁচে যাওয়া ইত্যাদি। এমনকি তিনি বলেছেন, ভাবীকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেবার চেষ্টাও হয়।

শেষ পর্যন্ত তিনি ওঝা, পীর, হুজুর, ডাক্তার অনেকের শরনাপন্ন হন। একজন হুজুর তাকে জানান, ওই বাসায় এক অতৃপ্ত আত্মা (তার ভাষায় পিশাচ) থাকে। সে ওই বাসায় যেকোনো স্ত্রীলোক থাকতে দিতে চায়না। শেষতক উনি বাসা বদল করেন। হ্যা, তিনি ওই বাসা বদল করার কালে খোঁজ নেন। জানতে পারেন, ওই বাসার ৪র্থ তলায় বাড়িওলার মেয়ে থাকত যে গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যা করেছিল।
অশরীরি-৫: গ্রামে থাকা মানুষদের কাছে সবচেয়ে কমোন ভূতে ধরার যে গল্প বা সত্যঘটনা আমরা শুনি তা হল মেয়েদের (কখনো ছেলেদেরও) জ্বীনে পাওয়া যার প্রভাবে সে চিল্লাচিল্লি, খিঁচুনী, যেকোনোরকম পাগলাটে আচরন, উন্মাদনা, কামড়াতে আসা, আক্রমনাত্মক কাজ, অদ্ভূৎ কথাবার্তা এসব কাজ করে। সবচেয়ে ভয়ানক ও সত্যি ঘটনা ছিল, ওই ব্যক্তির গাছে উঠে যাওয়া। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তালগাছে। যারা গ্রামে থাকেন, তারা জানেন, তালগাছের মাথায় ওঠা এমনকি দক্ষ গাছির পক্ষেও কঠিন কাজ। সেখানে একজন নারীর পক্ষে ওখানে ওঠা কিভাবে সম্ভব যদি তাকে কোনো অশরীরি কিছুতে না করায়।

এমনকি কিছু কিছু হুজুর বা কামেল ব্যক্তি ছিলেন যারা জ্বীন আনতে পারতেন বলে সবাই জানতেন। তো অনেকের কাছেই সেই জ্বীন নামানোর ঘটনা আমি শুনেছি। আমার মতো যুক্তিনির্ভর মানুষও তাকে পুরোপুরি ফেলে দিতে পারেননি। এমনও হয়েছে, জ্বীন নেমেছে। ভীম স্বরে জ্বীনের কথা বলাও অনেকে শুনেছেন। বাড়ির চালে ঢিল ছোড়াতো কমোন।
সে এমন কিছু অজানা ঘটনা বর্ননা করেছে যা সত্য অথচ সবার জানার কথা না। সে এমন কিছু রেখে গেছে যা ওখানে থাকার কথা না যেমন মৌসুম ছাড়া কদম ফূল (হুমায়ুনের একটা নাটকেও এমন ছিল। সুবর্ণা ও বুলবুল অভিনীত।) কিংবা টাঙাইলের চমচম। এমনকি চলে যাবার সময় গাছের ডাল ভেঙে রেখে যাবার ঘটনা আমি খুব কাছের মানুষের কাছে শুনেছি যারা নিজেরা দেখেছেন।

অশরীরি-৬: এই আমি ছোটবেলায় অন্ততপক্ষে ৮-১০ বার ভূতের/জ্বীনের/অশরীরি কিছুর উপস্থিতি বা স্বপ্ন দেখে বা আধোঘুম আধো জাগরনে দেখে আতঙ্কে অসুস্থ হয়ে গিয়েছিলাম। নার্ভাস ব্রেকডাউনের কারনে আমাকে অনেক রকম চিকিৎসা নিতে হয়েছিল।
আমার স্পষ্ট মনে আছে, ওগুলোর কোনো কোনোটা পুরোপুরি কাল্পনিক বা অমূলক না। যেই স্বত্বাটাকে (একই স্বত্বাকে দেখতাম) দেখতাম সে এসে দাঁড়াত। খুব লম্বা, সাদা আলখাল্লা। সে শুধু জোরে জোরে হাসত আর আমাকে কোথাও নিয়ে যেতে চাইত। আমি ওইটাকে নিয়ে এত কথা বলছি, কারন অনুভূতিটা ঠিক স্বপ্ন ছিল না। আমি এই বুড়ো বয়সেও ওই আতঙ্কটার কিছুটা ফিল করছি।
যদি বিশ্বাস করেন তবে বলি, আমাদের বাসার ৪ তলার ছাদে একা গিয়েছি একবার। ওই স্বত্বাটাই ছাঁদে দাড়ানো। একজন বৃদ্ধ। তিনি আমাকে নাম জানতে চাইলেন। আমি নাম বলে অন্যদিকে তাকালাম। আমার সাথে সাথে মনে পড়ল, আমিতো এই স্বত্বাটাকেই দেখি। আমি ঝট করে তার দিকে ফিরলাম। লোকটা হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে যেন। মাকে বলেছিলাম। তিনি বিশ্বাস করেননি।

অশরীরি-৭: আমার এক খালা ছিলেন গ্রামে যার মেয়ের নাম লাইজু। তো লাইজু আপার বিয়ের হল দিনের বেলায়। বরসহ সবাই চলে গেল সন্ধ্যা নাগাদ। আমার খালা রাতের খাবার খেয়ে ঘুমাতে গেছেন। সারাদিনের ধকল শেষে শরীর প্রচন্ড ক্লান্ত। তিনি ঘরে গেলেন।
মশারী খাটানো ছিল। পাশেই একটা কূপি জ্বলছে। তো কূপির আলোয় তিনি দেখেন মশারীর ভিতরে লাইজু আপা বসা। চুল ছড়িয়ে। একটু অন্ধকার বলে মুখটা চেনা যাচ্ছেনা পুরোপুরি।
খালা মৃদু আতঙ্ক নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
“কে, লাইজু?”
ওই স্বত্বাটি হালকা স্বরে বলল, সে লাইজু।
খালা তবু সাহস করে আবার জিজ্ঞেস করলেন, “তুই কী করে এখানে?
সত্যি করে বল, তুই কে?”
ওই স্বত্বাটি তখন বলল, “মা, আমি আরেক লাইজু।”
খালা সেখানেই চিৎকার করে জ্ঞান হারালেন। দিন পনেরো তিনি আধমরা ছিলেন জ্বর ও অন্যান্য জটিলতায়।

অশরীরি-৮: আমার মা প্রায়ই বলতেন, আগের দিনে নানী-দাদীরা রাতে বাইরের রান্নাঘরে (বরিশালে ওটাকে ওঢ়শা বলে) পিঠা বানাতেন বা সন্ধ্যায় আনা মাছ ভাঁজতেন। পাতার বেড়ার ফাঁক দিয়ে হঠাৎ কে যেন হাত বাড়িয়ে দিত। পিঠা বা মাছ চাইত। নানীরা বুদ্ধি করে খুন্তি গরম করে ওই হাতে চেপে ধরতেন। সকালে উঠে দেখতেন বেড়ার পাশে একটা মরা বাঁদুড় পড়ে আছে।
নির্জন বিকেলে বা গোধূলীলগ্নে বা সন্ধ্যার পরে গাঁয়ের পথে মাছ নিয়ে ফেরার সময় মেছো পেত্নি পিছু নিয়ে মাছ চাইবার অভিজ্ঞতা আমার মামা বা চাচাদেরই বলতে শুনতাম। রাতে গাঁয়ের পথে দিয়ে যাবার সময় গাছের ওপর জ্বলজ্বলে চোখে কে ‍যেন তাকিয়ে আছে যার পা গাছে আর মাথা আকাশে।

হঠাৎ পথে দিয়ে যাবার সময় কে যেন পেশাব করে দিত গায়ে আর হাসত বিকট স্বরে। এসবই আমি শুনেছি মুরব্বীদের মুখে।
অশরীরি-৯: গ্রামে থাকতে আমাদের কলোনীর পাশে একটি পদ্ম পুকুর ছিল। নামে পদ্মপুকুর হলেও ওটা আসলে লাল শাপলার পুকুর। ওই পুকুরে আমাদের নামতে নিষেধ করা হত। মনে করা হত, ওই পুকুরে “মাইট” বা “জলদেবী” নামক পেত্নির বাস। পুকুরে বাচ্চারা নামলে তাদের ধরে মাটির নিচে নিয়ে পূঁতে রাখে।

একবার সত্যি সত্যিই এরকম একটি পুকুরে শাপলা তুলতে নামলে একটি ছেলে ডুবে মরে। তার লাশ পাওয়া যায় শাপলা গাছের সাথে পেঁচানো। অথচ সে খুব ভাল সাঁতার জানত।

এমনকি গ্রামের জোয়ার ভাটার পুুকুরে “নঈদার চাঁদ” নামে প্রেতের অস্তিত্ব আছে এমনটাও বিশ্বাস করা হত। সে নাকি পুকুর/দিঘীর পাড়ে একরকম গর্তে (যাকে স্থানীয়ভাবে চ্যালা বলে) বাস করত। কেউ নিরিবিলি নামলে তাকে টেনে ওই গর্তে মেরে রাখত। এমন ঘটনারও সাক্ষি দেখেছি আমি।

এরকম অসংখ্য গল্প বা ঘটনা আমি শুনেছি/দেখেছি। এবার চেষ্টা করি লজিক্যালী উপরে ঘটনাগুলো ব্যাখ্যা করতে:

লজিক-১: আমরা যে বাসাটায় থাকতাম, ওটা নেবার সময়ই আমরা জানতাম ওই বাসাটা ১০ বছর পরিত্যাক্ত ছিল। পোড়োবাড়ি/Hunted house বা পরিত্যাক্ত বাসা নিয়ে ছোটবেলা হতেই আমাদের মনমগজে একরকম প্যানিক নানি-চাচির গল্পের মধ্যে দিয়ে ঢুকিয়ে দেয়া হত। ওই মজ্জাগত প্যানিক বা সংস্কারই ভয়ের উৎস। আমাদের মনের মধ্যে অবচেতনভাবেই একটা কূ-ডাক ছিল।

তাছাড়া বউ সারাদিন ওই বাসায় একা থাকত। সন্ধ্যার অনেকটা পর পর্যন্ত। একা অমন একটা আইসোলেটেড বাসা (ছাদে) যেখানে মানুষের অস্তিত্ব নেই-একটা মেয়ের এমনিতেই ভয় পাবার কথা। একবার মানুষ ভয় পেয়ে গেলে বা ভয়টা মাথায় ঢুকে গেলে নার্ভাস ব্রেকডাউন হয়। তখন অনেক অদেখা জিনিসও বা অসম্ভব জিনিসও ব্রেন দেখাতে থাকে। ম্যানিয়াতে গড়ায় ওটা। তখন ব্রেন হিলুসিনেশনে ভোগে। এক পর্যায়ে ওটা স্কিৎজোফ্রেনিয়া নামক ব্যাখ্যাযোগ্য মনোঃরোগে দাড়ায়।

লজিক-২: ওই বাসাটা ছিল ইটালিয়ান স্টাইলের এ্যাটিকের ঘর। ঘরে কাঠের ফলস সিলিং ও পাটাতনও ছিল। ওই পাটাতনে বা সিলিঙে ছাদের খোলা বাতাস ঢুকে অদ্ভূৎ শব্দ করত। ইঁদুর থাকাও বিচিত্র না। আমি নিজে ওঠার সময় পাখির বাসা নামিয়েছিলাম। ওই প্রানীগুলোর করা শব্দ এবং খোলা ছাদের হাওয়া মিলিয়ে ফিসফাস, অদ্ভূৎ শব্দ বা পায়ের শব্দ, রাতে অন্যরকম শব্দ (অপরিচীত হবার কারনে) এসব হবার সুযোগ ছিল। পাশাপাশি, ওই বাসার কাছাকাছি কোনো সমান উঁচু দালান ছিল না। ফলে ছাদটা একটু বেশি নির্জন মনে হত। কাছেই স্টেডিয়াম (ও তার ফ্লাড লাইট) ও অারেকটা বাসার ছাদে কবুতর থাকার কারনে লাইট জ্বলত। ওই লাইটের ফলে প্রতিবিম্ব হত আমাদের ছাদে বা ঘরে। প্রতিবিম্ব’র সাথে অদ্ভূৎ শব্দ-সব মিলিয়ে একটা ভয়ের উপস্থিতি অসম্ভব না।

পাশাপাশি ওই কবুতরগুলোও সময় অসময় ছাঁদে চলে আসত। লাইটের শ্যাডো পড়ে একরকম প্রাণের উপস্থিতির ধোঁয়াশা তৈরী হওয়া আর কবুতরের অদ্ভুৎ ডাক মিলিয়ে ভয় পাওয়াটা বিচিত্র না। মূলত প্যারানরমাল নানা গল্প শোনা, প্যারানরমাল বিষয়ের মুভি দেখা, বই পড়া, ভাবা-এগুলো অবচেতনভাবেই মনের মধ্যে চাপ ও ভয় তৈরী করে। মুভিতে বিভিন্ন সুপার ন্যাচারাল দৃশ্য দেখলে ওগুলো অবচেতনেই মনের গহীনে ভয়ের স্মৃতি জমা করে রাখে যেটা বিভিন্ন উপলক্ষ্যে ফ্লাশ করে নিজে না চাইলেও।

লজিক-৩: ছোটভাই’র ভয়ের কারনটা একেবারেই সাইকোপ্যানিক। আমরা তিনজনেই প্যানিকড ছিলাম। তার মধ্যে ঘরে সে একা ছিল। একটা আতঙ্ক ধীরে ধীরে তাকে দিয়ে অশরীরি কিছুর অস্তিত্বের বিষয় মনে ঢুকিয়েছে। তারপর সেটাকে কিছুটা অস্তিত্বশীল করেছে। জানেন কিনা জানি না, মানুষের মন খুব শক্তিশালী টেলিপ্যাথি পারে (অপ্রমানিত) বলে মনে করা হয়। সে মনে মনে কিছু নিয়ে দীর্ঘ প্যানিক বা সাইকোলজিক্যাল ডিসঅর্ডারে ভুগলে তার কল্পনার বিষয় কখনো কখনো বাস্তবে সামনে দেখতে পায়। স্কিৎজোফ্রেনিয়ার খুব মাইল্ড ডোজ ওটা যার শুরু হিলুসিনেশন দিয়ে।

লজিক-৪: ওই আগুনের ছুটে যাবার ঘটনাটি হত বেশিরভাগ সময় সন্ধ্যায়। সন্ধ্যার আযান আর ওই আগুন মিলিয়ে আমরা ভাবতাম, ওটা জ্বীন। আযান দিলে নামাজে যায়। আসলে ওই আগুনটা ছিল স্রেফ মিথেন গ্যাস। ঠিক সন্ধ্যায় কেন দেখা যেত? কারন: ১.সারাদিনের সূর্যের তাপে মিথেন গ্যাস পাশের এঁদো ডোবার নোংরা জলে তৈরী হত। সন্ধ্যা নামলে হালকা হয়ে উড়তে শুরু করে আর বাতাসের সংস্পর্শে জ্বলে ওঠে। আলো কমে যাওয়ায় তা চোখে পড়ে যা দিনে পড়বে না। ২.পূর্ব হতেই এমন একটি কুসংস্কার মাথায় থাকার কারনে মাগরিবের সময়টাতে মানুষ ইচ্ছে করে বা অবচেতনভাবেই আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকত বিধায় ওইরকম আগুনের উড়ে যাওয়াটা চোখে পড়ত বেশি যা অন্য সময় পড়ত না। গতকাল যা ভূত, আজ তা ছেলেখেলার বিজ্ঞান।

লজিক-৫: এই ব্যাখ্যাটি জুয়েলের লেখাতেও বলেছি। পাতা ও ফলবিহীন দীর্ঘকাল বেঁচে থাকা গাছ আফ্রিকাতে প্রচুর আছে যেমন বাওবাব। আর বাদুড় বসার কারন সম্ভবত ওই গাছের বিশেষ কোনো বৈশিষ্ট যেমন গাছে পাওয়া যায় এমন পোকার অস্তিত্ব, গাছের গায়ের খোড়ল বা ফাপা গর্ত যা বাদুড়দের থাকার স্থান (বাওবাব গাছের বিশাল কোটরে অবশ্বম্ভাবিভাবে বাঁদুড় থাকে), নিকটস্থ খাদ্যের সহজ উৎসের সাথে গাছটির অবস্থানিক সুবিধা বা ওই গাছের কাছাকাছি সহজলভ্য খাদ্য যেমন উঁইঢিবি ইত্যাদি যেটা হয়তো অমাবস্যাতেই পাওয়া যায়।

অশরীরি বলে কিছু নেই। ওই গাছের নিচে দিয়ে গেলে জ্বর হবার সর্বোচ্চ ভৌতিক কিন্তু সত্যি কারন হতে পারে যেটা তা হল, ওই গাছের নিচে পড়ে থাকা বাঁদুড়ের মল আর ওই মলের জন্য ভীড় করা মশার কামড়ে রোগ বিশেষত জ্বর হয়। তাছাড়া মানসিক ভীতি মানুষের মাথায় সাইকোলজিক্যাল ফোবিয়া তৈরী করে। ফোবিয়া হতে মানসিক চাপে জ্বর হওয়া সায়েন্সে প্রমানিত।
লজিক-৬: আমার সহকর্মীর প্রথমা স্ত্রীর মৃত্যুর কারন হিসেবে মনে করা হয় ভূতের/পরীর/অশরীরির কাজ। আগেও বলেছি, কিছু লক্ষণ ছিল বিশ্বাস করবার মতোই। তবে আমার ব্যাখ্যা হল, গর্ভবতী মায়েদের কখনো কখনো হরমোনাল প্রবলেমের জন্য মানসিক চাপ/আতঙ্ক/দুঃশ্চিন্তা ইত্যাদি সব মিলিয়ে একরকম ডিসঅর্ডার গ্রো করে।

মেয়েরা স্বপ্ন দেখে, কেউ একজন তার বাচ্চাকে মেরে ফেলতে চায়। যেটা কখনো কখনো তার নিজের বাচ্চাকে নিজে মেরে ফেলা বা নিজে আত্মহত্যা পর্যন্ত দাড়ায়। আমাদের দেশে এমন হাজার খানিক ডাক্তারি কেস আছে। হুমায়ুনের অনেক গল্পে এমন ঘটনার অস্তিত্ব আছে। ঢাকায় বা বগুড়াতে এই কিছুদিন আগেও মা স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে বাচ্চাকে মেরে ফেলেছে। এর কারন ওই হরমোনাল প্রবলেমজনিত মেন্টাল প্যানিক ও ডিসঅর্ডার।

আমার ধারনা ভাবি ওরকম কিছুতে আক্রান্ত হন। ভাইও একটা পর্যায়ে স্ত্রীর দ্বারা কনটামিনেটেড হন। ভয় বা ম্যানিয়া সংক্রামক। সুস্থ্য মানুষও ধীরে ধীরে আক্রান্ত হন।

পরের সংসারে এবং বাসাতেও ওই পুরোনো ঘটনার রিপিট। বাসন পড়ে যাবার কারন হতে পারে ঠিক ওই সময় একটা ছোট ভূমিকম্প হয়ে যায়। ফলে বাসন পড়ার ঘটনা ঘটতে পারে। তবে ওই বাসার ৪ তলায় একটি মেয়ে গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যা করে যেটা তারা বাসা বদলের সময় জানেন বলে আমাকে বললেও, আমার ধারনা ভাই ওই ঘটনা বাসা নেবার সময়ই জানতেন। হয়তো সেটা অবচেতনভাবে ভুলে গেছেন। মানুষ প্যানিকড থাকলে সে দড়িকেও সাপ বলে ভুল করে।

লজিক-৭: গ্রামের মানুষের জ্বীনে ধরা, অদ্ভুৎ আচরন, পাগলামী, আক্রমনাত্মক কাজ-সবকিছুর খুব সহজ ব্যাখ্যা মনোঃবিজ্ঞানীরা বলেছেন। ওগুলোর মূলে আছে মৃগী আর স্কিৎজোফ্রেনিয়ার নানান ফর্ম। আরেকটা কারন দায়ী, যেটার নাম সমনমবলিজম। ওই যে ঘুমের মধ্যে হাঁটা, কথা বলা, বাইরে চলে যাওয়া। কখনো মাইল্ড কখনো সিভিয়ার লেভেল। গ্রামের মানুষ না বুঝেই রোগী বা রোগীনিকে নানা ঝারফুঁক, অত্যাচার, যাদুটোনা, মন্ত্র, ওঝা বৈদ্য করতে গিয়ে অসুখটিকে আরো বাড়িয়ে তোলে।

তবে গাছে ওঠার ঘটনাটা কিভাবে করে যদি জানতে চান, তবে আমি একটু দমে যাব। ওর একমাত্র ব্যাখ্যা যা আমার কাছে আছে তা হল, একজন মানুষ যখন মেন্টাল ডিসঅর্ডারে ভোগেন বা তীব্র মানসিক দ্বন্দ্বে থাকেন, বা স্কিৎজোফ্রেনিয়ায় ভোগেন তখন তার মধ্যে দানবীয় ও অতিমানবীয় শারিরীক শক্তি ভর করে। সমনমবলিজম বা স্কিৎজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত থাকার ওই সময়টাতে যেহেতু সে হুশে থাকে না, তাই সে আপাতত দেখতে অসম্ভব কিন্তু সত্যিকারে করা সম্ভব এমন কিছু কাজ করে বসে। কারন তার মধ্যে তখন অত্যুচ্চ কিছু দুঃসাহস ও দক্ষতা এসে যায়।

এর একটা উদাহরন আরো দেখতে পারেন, প্রচন্ড মানসিক শক্তিতে বলিয়ান যোদ্ধারা মৃত্যুর সময়ও হাতের অস্ত্র দিয়ে গুলি করতে থাকে যা সে অন্যসময় পারত না। ভূলভুলাইয়া মুুভীতে বিদ্যা’র আস্ত একটা বিশাল খাট তুলে ফেলার দৃশ্যটা মনে আছে? ওইরকমই হয়। রোগী নিজের অজান্তেই তার সুপার পাওয়ারড স্কিল বা দুঃসাহসে ভর করে গাছে উঠে যান যা স্বাভাবিক অবস্থায় সম্ভব না। আরেকটা ব্যাখ্যা আছে। ওইরকম গাছে উঠে পড়ার ঘটনার বেশিরভাগই আমি শুনেছি বাচ্চা মেয়ে বা বুড়ো মহিলাদের ক্ষেত্রে।

খেয়াল করে দেখুন, গ্রামের মেয়েদের মধ্যে অনেকেই গাছে ওঠায় পুরুষদের চেয়ে অনেক এক্সপার্ট। আমি নিজে আমার কাজিনকে তরতর করে সুপারী গাছে উঠতে দেখেছি। আমার ধারনা, ওইসব কেসে ওই মহিলারা গাছে ওঠায় এমনিতেই দক্ষ ছিলেন। গ্রামের মানুষ তো আর এত লজিক্যালী ভাবতে পারে না।
জ্বীনের গলার স্বর শোনা স্রেফ ধাপ্পা। ওটার মূলে আছে ওইসব ওঝার ভেন্টিলোকুইজমে সুপার দক্ষতা। আর দেখেছেন, বেশিরভাগ জ্বীন নামানোর ঘটনা হয় রাতে। দিনে না। ওঝা আর তার সাগরেদরা মিলে গাছের ডাল ভাঙা, ঘরে ঢিল ছোড়া, ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়া-এসব খুব প্লান করে করত ধোঁকা দিতে।

লজিক-৮: আমার ছোটবেলার আতঙ্কের মূলে বা দেখার মূলে ওই প্যানিক ও ম্যানিয়া। কিশোর বয়সী একটা মানুষ প্রায়ই ভূত প্রেতের গল্প শুনে থাকব সবার কাছে। তার প্রচন্ড চাপ পড়ত ব্রেনে। ফলাফল হিলুসিনেশন, সমনমবলিজম ও এসবের প্রভাবে অনেক অব্যখ্যাত বিষয় চোখে দেখতে পাওয়া।

তাছাড়া বিশেষত ঢাকা শহরে, আপনি কখনো কোনো ঢাকায় ছোট হতেই মানুষ হয়েছেন-এমন কাউকে ভূতের অভিজ্ঞতার শিকার হতে দেখেছেন। তাহলে কি ভূতরা সব গ্রামে থাকে? কবরস্থানে বা শ্মশানে বিচিত্র সব শব্দ, হাহাকার, কঙ্কালের জ্যান্ত হয়ে ধাওয়া করা, আতঙ্কজনক বাতাস-এসব নিয়ে শরত চন্দ্রের শ্রীকান্ত উপন্যাসে একটা চ্যাপ্টারই আছে। ওখানে পড়ে নেবেন।
কবরস্থান বা শ্মশানের ভূতের বর্ণনায় সবচেয়ে বেশি বর্ননা আছে সাদা আলখাল্লা পড়া ভূতের অস্তিত্ব। পুরো ব্যাপারটা মেন্টাল ফিয়ার হতে সৃষ্ট যা হিলুসিনেশন এমনকি কবরস্থানের পাশ দিয়ে নির্জনতায় পাস করার সময় মনে থাকা প্রচন্ড আতঙ্কে আলো আধারের লুকোচুরি, পলিথিন, গাছের লতা, শ্যাডো এসব দেখে আতঙ্কিত হবার ঘটনা ঘটে। তাছাড়া একবার ভয় মাথায় ঢুকে গেলে চারপাশের সবাই আরো নানাভাবে সতর্কতা, আরো ভূতের অভিজ্ঞতার গল্প বলতে বলতে ভয় ও প্যানিক আরো বাড়িয়ে তুলত। ফলে নানারকম অশরীরি, ভৌতিক বিষয়ের অস্তিত্ব তখন ব্রেন বানিয়ে দেখাত। বিষয়টার নাম হিলুসিনেশন।

লজিক-৯: আমার যেটা বিশ্বাস, আমার খালা গ্রামের মানুষ, মেয়ের বিদায়ে শকড ছিলেন বলে হিলুসিনেশনে ভুগে ওই স্বত্ত্বাটিকে কল্পনায় দেখেন। অথবা হতে পারে, বিয়ে বাড়িতে আসা কোনো ঠাট্টার সম্পর্কের আত্মীয়া তাকে ভয় দেখাতে অমনটা করেছিল।
লজিক-১০: বাঁদুড়কে এমনিতেই সারা পৃথিবীতে অশুভ, অশরীরির নজরে দেখা হয় (ভ্যাম্পায়ার বাদুড়ের কারনে)। গ্রামের বাড়িতে বাঁদুর রাতের আঁধারে রান্নাঘরের আগুনের আলোয় আকৃষ্ট হয়ে কাছে চলে আসা অস্বাভাবিক না। তাছাড়া ওই আলোয় কাছে আসা পোঁকা খেতেও ওরা এসে থাকতে পারে। কোনো কারনে সেটা মরে পড়ে থাকত। আর রাতের ঘটনার সাথে ওই ঘটনা মিলিয়ে একটা হাইপোথিসিস তৈরী হত।

বাকি ঘটনাগুলোর সবগুলোর পেছনেই আমার একটা কমোন যুক্তি আছে-প্যানিক। রক্তে থাকা প্যানিক, ফোবিয়া অনেক অব্যাখ্যাত ঘটনার জন্ম দেয়। তাছাড়া গাঁয়ের পথে যাবার সময় গাছের ওপরে ফল বা ছোট প্রাণী শিকারে ব্যস্ত থাকা ‘বাঘডাসা’ বা ‘শারিয়াল’ তার লেজসমেত বেশ বিরাট ও বিকটদর্শন একটি বিড়াল সদৃশ প্রাণী যে উঁচু গাছে উঠতে পারে। ওই প্রাণীটি ইন্সট্যান্ট পেশাব করে দেবার বদস্বভাব আছে যেটা তার আত্মরক্ষার ইন্সটিংকড।

তাছাড়া ফোবিয়া, রাতের নির্জনতা, প্রিজুডিস আর ওই বাগডাসার কুকর্ম, রাতে অন্ধকারে বিড়ালদের চোখে (tapetum lucidum নামক পদার্থের উপস্থিতির কারনে) জ্বলজ্বলে আলো-সবমিলিয়ে গ্রামের কুসংস্কারচ্ছন্ন মানুষ নানারকম ভৌতিক অভিজ্ঞতা নিজেরাই সৃষ্টি করে দেখত। হাসির শব্দটা বিভিন্ন প্রাণীদের করা। যেমন ওই বাগডাঁসা, তক্ষক, একরকম পেঁচা, হায়েনা-এরা প্রায় মানুষের হাসি, বাচ্চাদের কান্নার মতো শব্দ তৈরী করতে পারে। শ্মশানে থাকা নরমুন্ড’র ছিদ্রে বাতাস ঢুকে ভীতিকর শব্দ করার অস্তিত্ব শরতের বইয়েই পাবেন। খেয়াল করেছেন, ভৌতিক অভিজ্ঞতা নিয়ে যত কাহিনী সবই রাতের প্লট করা বা একদম নির্জন স্থানে চিত্রায়িত।

লজিক-১১: শাপলায় পেঁচিয়ে মরাটা সাঁতার জানা লোকের জন্য কঠিন মনে হলেও সম্ভব। বড় পুকুর/দিঘীতে শাপলা বেশ লম্বা হয়। শাপলাওলা পুকুরের পানি সাধারনত একটু দুষিত থাকে যা স্বাভাবিক দম হতে সক্ষমতা কমিয়ে দেয়। প্লাস পানির চাপ, গ্রাভিটি, দূষিত পানির প্রভাব, তলায় গিয়ে শাপলা তোলার সময় দম ফুরিয়ে যাওয়াও দায়ী।
পানির তলায় বেশ কিছুক্ষন দমবন্ধ করে থাকায় পানির তলেই হাইপোথার্মিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যেতে পারে। দম ফুরিয়ে গেলে সে তাড়াতাড়ি করে উপরে উঠতে চায়। তখন শাপলার লতা জড়িয়ে ধরে। যারা শাপলা তুলবার অভিজ্ঞতা আছে তারা জানেন, শাপলার লতা খুবে ঘন ও প্যাঁচালো হয়। ওই লতার ভিতর দিয়ে পানির তলা হতে তাড়াহুড়া করে উঠতে গেলে লতায় জড়িয়ে ও প্যানিকে লজিক ভূল হয়। ফলে জড়িয়ে মরার সুযোগ বাড়ে।

পুকুরে “নঈদার চাঁদের” মীথ আসলে একটি কাল্পনিক গল্পের উপর ভর করে গড়ে ওঠা যেখানে একটি লোক বাড়ির মানুষকে মজা করে কুমির সাঁজতে গিয়ে পরে আর মানুষ হতে পারে না ফলে পানিতে চলে যায়। সেই নাকি মানুষকে ধরে পুকুরে পূঁতে রাখত। আসলে ওই গর্তের অস্তিত্ব সব জোয়ার ভাটার পুুকুরে থাকে। পুকুরে কিছু মাছ থাকে যারা এমনিতেই পুকুরের পাড়ের দিকে গর্ত করে ডিম পাড়ে বা থাকে। ওসব গর্তে হাত দিয়ে মাছ ধরতে গেলে কিছু বিষকাঁটা মাছ আছে যাদের বিষ বেশ তীব্র। ইলেকট্রিক ঈলের কথাতো জানেনই যে কুমিরকে পর্যন্ত শক দিয়ে মেরে ফেলতে পারে। ফলে মাছের কাঁটা বা ইলেকট্রিক শকের আঘাতে মানুষের ওখানে মৃত্যু হতে পারে।
আর জোয়ার ভাটার পুকুরে জোয়ারের পানি যেখান দিয়ে পুকুরে ঢোকে, সেখানে একটা টানেলের মতো তৈরী হয়। ওখানে অনেক মাছ থাকে। মাছ শিকারের আশায় ডুব দিয়ে ওখানে মাছ ধরার সময় বহির্মূখী পানির টানে ওখানে আটকে গিয়ে মরার সুযোগ থাকে। আর সবচেয়ে কমোন কারন হল, গ্রাম্য মীথের কারনে আর প্রিসেট ফোবিয়ার কারনে পানির তলায় এমনিতেই সামান্য গন্ডগোল মনে হলে মানুষের প্রচন্ড আতঙ্কে প্যানিক এটাক হয়ে হার্ট এটাক করে। ফলে মৃত্যু ঘটে। এমনকি প্যানিক এটাকে লজিক ভুলে মানুষ প্রচন্ড আতঙ্কে পানির ওপরের দিকে না সাতরে উল্টো বারবার মাটির দিকে ধাক্কাতে থাকে। অসংখ্য উদাহরন আছে।

ভাল কথা, ভূত/প্রেত/অশরীরি/পেতাত্মা ইত্যাদি প্যারানরমাল অবজেক্ট বাস্তবে অব্যাখ্যাত, অসত্য কিন্তু বিশ্বাসে অস্তিত্বশীল জিনিস যা আমরা কেউ বিশ্বাস করি না, কিন্তু আবার অমাবশ্যার রাতে একা শ্মশানেও যেতে পারি না। কারনটা কিন্তু সত্যি ভূতের ভয় না। আমাদের জন্ম হতে মা-চাচীরা ভূতের ভয় দেখান বিধায় ছোট হতেই আমরা ভূতের ভয়ের অস্তিত্ব রক্তে নিয়ে বড় হই।

জেনেটিক্যালী ওটা প্রজন্ম হতে প্রজন্মান্তরে প্রবাহিতও হয়। ফলে ভূত নেই জানলেও জিনের ডিএনএতে থাকা ভয়ের ইন্সটিংকট আমাদের ভয় পাওয়ায়। খেয়াল করে দেখবেন, বিদেশে বাচ্চাদের কখনো ভূতের ভয় বা যেকোনো ভয় দেখাতে নিষেধ করা হয়। বাচ্চাদের ছোট হতেই পৃথক রুমে ঘুম পড়ানো হয় যার অন্যতম কারন তাদের একা থেকে ভয়কে জয় করতে শেখা। তাদের বাচ্চাদের হ্যালোইন করে ভূত দেখাতে হয়। আর আমাদের বাচ্চাদের শৈশবেই ভূতের ভয় দেখিয়ে বাধ্য ও শান্ত রাখার চেষ্টা হয়। ওই ভয়ই বড় হয়ে তার ব্রেনে পাকাপাকিভাবে জায়গা করে নেয়। ফলে চাইলেও সে ওই ভয়ের কবল হতে বেরোতে পারে না।
লোকলজ্জার ভয়ে মুখে ”ভয় পাইনা” বললেও, একা বাসায় থাকতে চায় না, রাতে শ্মশানে যায় না, কবরের পাশ দিয়ে যেতে ভয় পায়। তাই বাচ্চাদের ভয় দেখানো আর নয়।

তবে যাই বলেন, এই গল্প রাত জেগে লিখতে গিয়ে আমার নিজেরই ভয় লেগেছে। আমার পত্নি আরাম করে ঘুমিয়েছে। তাকে বলিনি এই গপ্পের কথা। তবে এখন কিন্তু আমার নিজেরই ভয় লাগছে।

আজ রাতে ভূত এসে তাদের রহস্য ফাঁস করার অপরাধে আমার ঘাড় মটকে না দিয়ে যায়।

মন্তব্য ১৩ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (১৩) মন্তব্য লিখুন

১| ১১ ই ডিসেম্বর, ২০১৭ দুপুর ২:২২

মোঃ মাইদুল সরকার বলেছেন: ঘটানাগুলো পড়লাম। দু'একটাতো অনেক ভয়ের।

ভূত বলে পৃথিবীতে কিছু নেই। জ্বীন আছে। এসব জ্বী্নেরই কারবার।

জ্বীনকেই ভূত, পরী, পেত্নী, পিশাস বলা হয় আকার আকৃতি, প্রকৃতি অনুযায়ী।

জ্বীনকে খালি চোখে দেখা যায়না কিন্তু তার অস্তিত্ব আছে।

যারা বিশ্বাস করেনা সেটা তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার।

১১ ই ডিসেম্বর, ২০১৭ দুপুর ২:৪১

বেচারা বলেছেন: জ্বীনের অস্তিত্ব নিয়ে আমি বলেইছি যে ডিবেট করব না। তবে ওই বিষয়গুলো জ্বীনের কাজ-এই নিয়ে ডিবেট আছে।

২| ১১ ই ডিসেম্বর, ২০১৭ বিকাল ৩:৪৭

রাজীব নুর বলেছেন: আপনি কি আপনার চিন্তা অস্থিরতা ভয় আর কুসংস্কার আমাদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চাচ্ছেন?

১৩ ই ডিসেম্বর, ২০১৭ সকাল ১০:২৭

বেচারা বলেছেন: না, চাচ্ছি না। ভয় ভাঙার চেষ্টা চেষ্টা করছি।

৩| ১১ ই ডিসেম্বর, ২০১৭ বিকাল ৩:৪৯

রূপক বিধৌত সাধু বলেছেন: ব্যাখ্যাগুলো যৌক্তিক মনে হয়েছে।

১৩ ই ডিসেম্বর, ২০১৭ সকাল ১০:২৮

বেচারা বলেছেন: ধন্যবাদ। আরো লজিক্যাল ব্যাখ্যা সাইকোলজিস্ট বা প্যারাসাইকোলজিস্টরা দিতে পারবেন। আমি স্রেফ আমার অনুমান নির্ভর কথা বললাম।

৪| ১১ ই ডিসেম্বর, ২০১৭ বিকাল ৫:২৬

শরীফুর রায়হান বলেছেন: চমৎকার

১৩ ই ডিসেম্বর, ২০১৭ সকাল ১০:৩১

বেচারা বলেছেন: ধন্যবাদ জনাব। আশা করি আর ভূতের ভয় পাবেন না।

৫| ১১ ই ডিসেম্বর, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:২০

ফেরদৌসা রুহী বলেছেন: যতই বলা হোক ভুত বলে কিছু নাই তারপরো ভয় পাই।

সবগুলিই পড়লাম এবং ভয় পেলাম। যুক্তি খন্ডন পড়েও ভয় কাটেনি।

আমি এমনিতেই সারাদিন একা থাকি, এখন তো এসব পড়ে ভয় আরো বেড়ে গেলো।

১৩ ই ডিসেম্বর, ২০১৭ সকাল ১০:৩০

বেচারা বলেছেন: ভয় পাবেন না। ভয় পেলেই ভয় ভর করবে। যখন ভয় পাবেন, তখন সমস্ত স্বত্ত্বা একত্র করে রুখে দাড়িয়ে দেখেন, যেটার ভয় পাচ্ছেন ওটা আদৌ আছে কিনা। আজ পর্যন্ত কেউ ভূত দেখল না অথচ তাকে ভয় পাই। হা হা হা।

আমিও কিন্তু ভয় পাই। হা হা হা।

৬| ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০১৭ রাত ১০:৩৭

চানাচুর বলেছেন: আমি ভূতের ভয় পাইনা। ভূত দেখার চেষ্টা করেও দেখতে পাইনি। আমি একা থাকি। কিন্তু মাঝেমাঝে কেমন যেন ভয় লাগে। ভূতের ভয় পাই তা না। কিন্তু মনেহয় কেউ থাকলে ভাল হত :(

১৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৭ সকাল ৯:৪৭

বেচারা বলেছেন: একদিন যদি ভূত দেখার অভিজ্ঞতা হয় তাতে দুইরকম লাভ। ভূত নিয়ে যে কনফিউশন সেটা কেটে যাবে। আর পৃথিবীতে প্রথমবারের মতো ভূত দেখার অভিজ্ঞতা লিখে কামাল হয়ে যাবেন। হা হা হা।

৭| ০৩ রা জানুয়ারি, ২০১৮ বিকাল ৩:০১

কিরণ সরকার রাজ বলেছেন: ভূত নামক জিনিসটা এখন আর নেই তবে হ্যা জ্বিন..অতৃপ্ত আত্মা এগুলোর অস্তিত্ব আছে এগুলো সম্মুখিন হওয়ার খুব সখ ছিল। আমার ইচ্ছা পূরণ করেছে এড়া তাই আমাকে বাস্তব প্রমান দিয়েছে...।আর এর ভয়টা এখনোও কাটাতে পারিনি....এখনও কিছু প্যারানরমাল ঘটনা মাঝে মাঝে আমার সাথে ঘটে।

আর আপনার লেখাটা পরে অনেক ভাল লাগল আর কিছুটা ভয়ও পেলাম।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.