নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি কেউ নই, আমি আমার নই, আমি তোমার নই, আমি তুমিও নই

বেচারা

Walid

বেচারা › বিস্তারিত পোস্টঃ

দায় নেবার দায়

১৫ ই জানুয়ারি, ২০১৮ রাত ৯:২৩

প্রেক্ষাপট-১: রাত ৯টা। অফিস ফেরত কামলা ও দায়ীত্বশীল পুরুষ আমি টিভিতে চোখ বুলাই। ফাঁকে ফাঁকে সখের লেখালিখি করতে থাকি। সনি টিভিতে একটা প্রোগ্রামে চোখ আঁটকে যায়।

ক্রাইম পেট্রোলের একটা পর্ব হচ্ছিল। একজন স্কিৎজোফ্রেনিয়া আক্রান্ত স্ত্রী কাম মা, আর সেই পরিবারের পুরুষ মানুষটির দু’টি বাচ্চাকে নিয়ে সংগ্রামের নাট্যরূপ। বাবাটা অসুস্থ স্ত্রী, সন্তান, কর্মস্থলের দায়ীত্বের বোঝা, সমাজের কাছে আদর্শ বাবা ও স্বামী হবার চোখরাঙানী-সবকিছুর চাপে এক পর্যায়ে ভেঙে পড়ে। সবার চোখের আড়ালে নিয়ে গিয়ে নিজ হাতে হত্যা করে বাচ্চা ‍দুটোকে। নিজেকেও শেষ করে দেবার চেষ্টা করে। অত্যন্ত হৃদয়বিদারক দৃশ্য।

দায়ীত্বশীল একজন মানুষের একা একা ভার বহনের করুণ ও নিষ্ঠূর পরিণতি। দায়ীত্বের ভারে ভেঙে পড়া একজন মানুষের বাস্তব নিয়তি। দায়ীত্বের এমন কর্কশতা আমাকে কীপ্যাডে বসায়। ঘ্যাসঘ্যাস করে লিখে চলি পাগলের মতো। লিখতে বসে দেখি কত কথা জমে ছিল এই তিন অক্ষরের শব্দটাকে নিয়ে। দায়ীত্ব। কর্তব্য।

প্রেক্ষাপট-২: কয়েক মাস আগে কোনো একটি বেসরকারী টিভি চ্যানেলে একটা নাটক দেখানো হয়। ’বড়ছেলে’ শিরোনামের সেই নাটকটি দেখে দীর্ঘদিন আমরা রাস্তায়, গাড়িতে, অফিসে, আড্ডায় ফেসবুকের খোরাক হিসেবে নানা হাস্যরস, মূল্যায়ন, হাহাকার, হতাশা, আশাবাদ, বাহবা, সাবাশি-অনেক কিছু করি। আমরা বেশ কয়েক সপ্তাহ মেতে ছিলাম বড় ছেলের চরিত্রে রূপ দেয়া অপূর্ব’র অভিনয়ের বিশ্লেষণে, মেহজাবিনের প্রশংসায়। কেউ কেউ আবার সমালোচনা করেছেন (নাটকের খুব স্বাভাবিক আর বাস্তবের অস্বাভাবিক হলেও) এই সীনে অপূর্ব এটা করতে পারত, ও কেন ওটা করল না? ইত্যাদি ইত্যাদি। বাস্তবের বড় ছেলেরা কিন্তু ঠিকই বিরাজ করে সমাজে। নাটকতো আমাদের জীবনেরই প্রতিবিম্ব, তাই না? দায়ীত্বশীল মানুষটির একাকী হেরে যাওয়ার সেই চিরচেনা চিত্র।

প্রেক্ষাপট-৩: ছোটবেলায় বাংলা বইয়ে একটা গল্প পড়েছেন কি? ওই যে, বড়মিয়া বা ভাঙাকুলা এমন নামের? বড়মিয়া গাঁয়ের অশিক্ষিত ছেলে।
রাখালদের সর্দার। শহর হতে লেখক গাঁয়ে কোনো একটা কাজে যাবার কালে বিপদে পড়লে তাকে নদী পাড় হতে সাহায্য করেন। গ্রামে বন্যা দেখা দিলে তিনি নৌকাডুবিতে পড়া একদল লোককে উদ্ধার করতে গিয়ে একসময় নিজেই ডুবে যান।

কিংবা মনে পড়ে কি শরতচন্দ্রের বিলাসী গল্পের মৃত্যুঞ্জয়কে। সারা গাঁয়ের গরীব মানুষের ছেলেদের বই, খাতা, কলম, কাপড়ের অর্থসংস্থান হত তার পয়সায় অথচ ছোটজাত বলে তার সাথে কথার সম্পর্কও কবুল করতে চাইত না কেউ। শেষতক তার মৃত্যু হয় গোটা গাঁয়ের চোখে ঘৃনিত অবস্থায় সাপের কামড়ে।

দায়ীত্ব নেয়া সরল মানুষের অবশ্যম্ভাবি শেষ পরিণতি।

টিপিক্যাল বাঙালী হিসেবে আমাদের ছোটবেলা হতেই দায়ীত্ব নিতে শেখানো হয়। দায়ীত্ব নেয়াটাকেই স্বাভাবিক বলে চেনানো হয়। দায়ীত্ব নেবার মহান ব্রত নিতে অভ্যস্ত আমরা। কিন্তু কখনো কখনো দায়ীত্বটাই হয়ে যায় কারো জন্য অর্পিত। চাপিয়ে দেয়া।

কলুর বলদ নামে একটি প্রবচনের ব্যবহার আছে বাংলা ভাষায়। দায়ীত্বের চাপে নুয়ে পড়া মানুষটি সমাজের চোখে বাহবা কুড়ায়। সমীহ পান দশজনের চোখে। কিন্তু এই সামাজিক স্বীকৃতির মেঘে আড়াল হয়ে যায় আরেকটি সত্য। দায়ীত্ববান মানুষটির নিজের জীবনটি। নিজস্ব স্বত্ত্বাটি।

পরিবার হতে আমাদের দায়ীত্ব নেবার পাঠ শুরু হয়। বাবা-মাকে দায়ীত্ব পালন করতে দেখে আমাদের দায়ীত্ব নেবার শিক্ষার শুরু। একজন বাবা বা মা কিংবা একজন বড় ভাই বা বোন দায়ীত্বে থাকেন আমাদের। তার ঘাড়ে সব দায়ীত্ব তুলে দিয়ে আমরা নিশ্চিন্তে থাকি। তারা ভরসার ডানা মেলে আমাদের সবরকম দায়ীত্ব নিজেরা নিয়ে, সব ঝড়ঝাপটা, বিপদ, অপ্রাপ্তির কষ্ট হতে দূরে রেখে সুখী করেন আমাদের। আমাদের ’ক্ষিপ্ত’ টিভিতেও কয়েকদিন আগে একটা সিরিয়াল হত ‘অপরাজিতা’। সংগ্রামী একজন নারীর জীবনযুদ্ধের গাঁথা।

উৎকট ইন্ডিয়ান সিরিয়ালের সব মালমশলা ওই নাটকে থাকলেও আমি ওতে অন্য এক চাপা আকর্ষন পেয়ে যাই। ওই যে, দায়ীত্ব নেবার মহান চিত্রায়ন। বাবা-মা’র অবর্তমানে ভাইবোনদের মানুষ করতে গিয়ে একজন বড়বোনের জীবন সায়াহ্নে ওই ভাইবোনদের হাতেই নিগ্রহ আর অবহেলার শিকার হবার সেই অসহ্য ঘ্যানঘ্যানানি আর সামাজিক কোষ্ঠকাঠিন্য। অনেক সময়ই ওই দায়ীত্ব নেয়াদের বিরাট ব্যক্তিত্বের আড়ালে চাপা পড়ে যাই আমরা। একসময় ভুলে যাই দায়ীত্বে থাকা মানুষটিকে, তার অবদানকে। মনে হয় যেন এমনটাই হবার কথা। গা সওয়া হয়ে যায় অন্যের দায়ীত্বে থাকা আমাদের নিরাপদ জীবন। চোখেই পড়ে না বিশেষ কিছু।

কিন্তু এতকিছুর ভীড়ে সেই মানুষটিকে কে দেখে? তার জন্য কে ভাবে? সবাইকে নিয়ে বাঁচতে গিয়ে, সবাইকে বাঁচাতে ব্যস্ত যেই মানুষটি, তার জন্যে কে কাজ করে? কখনো ভেবেছেন? পরিবার ও সমাজের দশটা দায়ীত্ব নিতে গিয়ে তিনি নিজেকে হারিয়ে ফেলেন। বহু বছর বহু রকম দায়ীত্ব পালন শেষে যেদিন পিছনে ফিরে তাকান তখন দেখেন, জীবনের নদীতে ভাটির টান। যাদের জন্য এতটা কাল বিলিয়ে এসেছেন নিজের জীবনের সব আশা, সব সম্ভাবনা, সব স্বাদ, আল্লাদ, সবরকম প্রাপ্যকে সমানে কোরবানী করে এসেছেন, তারা যখন প্রতিষ্ঠিত তখন সময় থাকে না তার জন্য।

মেয়েদের অসম্মান বা একজন নারীর বঞ্চনা নিয়েতো প্রচুর কথা সমাজে, সাহিত্যে দেখাই যায়। সে তুলনায় একজন বাবাকে নিয়ে কতটা লেখালেখি হয় সেটা নিয়ে আমার একটু দোনোমোনো আছে। আমি প্রচুর দেখেছি, একজন বাবা সারাজীবন স্ত্রী, বাবা-মা, সন্তান, ভাইবোনের জন্য জীবন উৎসর্গ করে কাজ করে গেছেন। তারপর যখন পরন্ত জীবনে সবাই দাড়িয়ে গেছে, তখন সেই পুরুষ বা বাবাটির জন্য সময় নেই কারো। (অন্যরকমভাবে নেবেন না।) মা’কে নিয়ে ব্যস্ত থেকে বাবাকে অবহেলা বা তাকে প্রান্তিক করে রাখার প্রচুর নজির আমি দেখেছি। মা’কে তো অবশ্যই ভালবাসবেন। কিন্তু বাবা, যিনি আমাদের জীবন গড়ে দিলেন, তাকে অপাংক্তেয় করে রেখে মা’কে নিয়ে ভালবাসার চরম পরাকাষ্ঠাকে আমার কাছে ভন্ডামী মনে হয়।

পুরুষ মানুষের অত্যাচারী আর পশুরূপী সত্ত্বাকে নিয়ে প্রচুর সাহিত্য রচনা প্রায়ই দেখি। কিন্তু ওই ছবিখানার একটা বিপরীত চিত্রও আছে। দায়ীত্ববান পুরুষ এবং অতঃপর তার একান্ত নিজস্ব জগত ও অধিকারের বৃত্তটুকুর অকাল মরন কেউ দেখে না। দেখে না, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রের জন্য দায়ীত্ব পালন করতে গিয়ে তার নিজের একান্ত জীবন বলে আর কিছু যে থাকেনা।
একজন দায়ীত্ববান বাবা বা বড় ভাইয়ের পাশে তারও যে একটি নিজস্ব জগত আছে, নিজস্ব চাওয়া, পাওনা, বাসনা, স্বপ্ন থাকে তা আমরা যেমন ভুলে যাই, হয়তো তিনি নিজেও ভুলে যান বা ভুলে থাকেন।

এবার আবার বিপরীত দিকটাতে দেখি। একদিন বাসে পরিবার নিয়ে চিড়িয়াখানায় যাচ্ছি। পথে এক স্টপেজ হতে সামনের সিটে উঠলেন এক ভদ্রমহিলা। ভদ্রমহিলা এতটাই মোটা যে তাকে তুলতে আর নামাতে বাসের স্টাফকে অনেক কসরত করতে হল। তিনি নেমে যাবার পর যাত্রীরা স্বাভাবিকভাবেই একটা মন্তব্য করে বসে,

“কোন দোকানের চাল খায়?” একজন বলে, “জামাই আনে, বউ নিশ্চিন্তে খায়।”

ভাবখানা এমন যেন, শুধু ভাত খাওয়ার কারনেই তার এই অবস্থা। কিছুক্ষণের জন্য আমারও মনে হল, তাইতো, মেয়েরা কী সুন্দর সারাটা জীবন খাওয়া পড়ার জন্য একটুও ভাবতে হয় না। চাকরী, ব্যবসা নিয়ে মরতে হয়না। সব স্বামীর ঘাড়ে ফেলে দিয়ে নিশ্চিন্তে সিরিয়াল দেখে বেড়াও, শপিং, গসিপিং কত কী?

কিন্তু পরে ঠান্ডা মাথায় একটা সত্যি কথা ভাবলাম। এই মেয়েরা ছোটবেলা হতেই বাবা-মায়ের কাছ হতে দায়ীত্ববিহীন বা ভরসা কাম্যহীন হয়ে বড় হয়। তাদের তৈরীই করা হয় দায়ীত্ব নেবার নয় বরং অন্যের দায়ীত্বে মাথা নত করে বাঁচতে শেখার জন্য। তাছাড়া এই মেয়েরাই তাদের সবরকম যোগ্যতা ও সম্ভাবনা থাকা স্বত্বেও স্বামীর উপর অন্ধের মতো ভরসা করে, নিজের ক্যারিয়ার বিসর্জন দিয়ে, স্বামীর (নিজেরও) সংসার ও সন্তানাদির দায়ীত্ব পালন করতে গিয়ে বছর বছর নিজেকে সম্পূর্নরুপে স্বামীর উপরে অন্ধের মতো সঁপে দেয় কিংবা বলা যায়, স্বামীর ওপর ভয়ানক রকম নির্ভরশীল করে নিজেকে একপ্রকার স্বেচ্ছা অকর্মন্য করে তোলে।

নিজের সবটুকু কর্মশক্তি, পোটেনশিয়ালকে, নিজের শিক্ষাগত যোগ্যতাকে ঘুম পাড়িয়ে কার্যত স্বাবলম্বি হবার সব রাস্তা ধীরে ধীরে বন্ধ করে দেয়। তো সেক্ষেত্রে তার সবরকম দায়ীত্ব বিয়ের সময় স্বামীকে তো তাই নিতেই হবে তাই না? দায় যেমন সে নেয়, দায়ীত্বও তো কাউকে নিতেই হবে।

কিছু কিছু মানুষ পৃথিবীতে আসেই দায়ীত্ব নিতে। কাজ করতে। বিলোতে। উজাড় করে দিতে। নিজের জন্য নিজে বাঁচতে শেখে না তারা। পারেও না। তাদের জীবনটার জন্মই যেন অন্যের তরে। অন্যকে সুখী করা, অন্যের মুখের হাসির জন্য জীবন দেয়া, অন্যের অধিকারের জন্য নিজের ন্যুনতম অধিকারটুকুও ছেড়ে দেয়া, অন্যের চাহিদাটা মেটাতে নিজের শেষটুকুও দিয়ে দেয়া, অন্যের বোঁঝা বইতে গিয়ে নিজের জীবন সায়াহ্নে নিজেকে নিঃস্ব, রিক্ত অবস্থায় আবিষ্কার করাই এদের ব্রত।

মহান সাঁজবার এক নেশা তাদের তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় আজীবন। কেউ তাদের হয়তো দায়ীত্ব দেয়নি। সে নিজেই নিজেকে জড়িয়ে ফেলে। কারন তারা এড়িয়ে যেতে পারে না। তারা না বলতে শেখেনি। পলায়নপর মনোঃবৃত্তি তাদের চরিত্রে নেই। কিন্তু নিষ্ঠূর ও স্বার্থপর এই পৃথিবী মনে রাখে না তাদের কথা। সবকিছু গুছিয়ে দিয়ে তারা থাকেন তফাতে। অন্যের প্রাপ্তি আর তৃপ্তি উদযাপন দেখেন দূর হতে। হয়তো একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করেন স্বক্ষেদে। তপ্ত দু’ফোটা পানিও হয়তো গোপন করেন। গোপন করতে হয়। কারন ওটুকুও তারা দেখাতে চান না কাউকে। দায় নেবার ভার যে বড় গুরু ভার। দায় যে নেয়, সেই তো দায়ীত্ববান।

ওগো জীবন,
তোমার ভারে আমি সত্যিই জর্জরিত।
ক্লান্ত, লুপ্ত, রিক্ত
তোমাকে দিয়েছি সময় অনেকটা।
আজ আমি বড্ড ক্লান্ত। আমি নিঃস্ব।
আমার একটু সময় চাই। নিজস্ব।
নিজেকে নিজের করে পাবার
নিজের মতো করে, নিজেকে বুঝবার
একটু সময় চাই। একান্তে
রাতের আগক্ষণে অথবা দিনান্তে।

ছবিয়াল: স্বহস্তে, সস্তা Non-Iphone এ।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ১৫ ই জানুয়ারি, ২০১৮ রাত ৯:৫৪

বিদ্রোহী ভৃগু বলেছেন: দায় নিয়ে দারুন দায়িত্বপূর্ণ লেখা!

পারিবারিক মূল্যবোধগুলো যখন পূজির চাপে একে একে ভেঙ্গে পড়ছে তখন সবই ক্রমশ
তার চিরচেনা রুপ হারিয়ে ফেলছে। ভাবনা বদলের সাথে সাথে বদলে যাচ্ছে আবেগ
বদলে যাচ্ছে অনুভব, তার প্রকাশ বদলে যাচ্ছে দায়িত্বের প্রকারভেদও!

জীবনের বোধ যখন ভোগী তখন সবই আনুষ্ঠানিকতা সর্বস্ব! জীবন বোধ যখন ত্যাগী তখন বড় মিয়াতেই তৃপ্ততা!

পোষ্টের জন্য ধন্যবাদ

+++

১৫ ই জানুয়ারি, ২০১৮ রাত ১০:২১

বেচারা বলেছেন: ধন্যবাদ ভৃগু। আসলেই তাই। খুব বিষন্ন মন নিয়ে লিখছিলাম লেখাটা। বড্ড খারাপ সময় আসছে।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.