নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি কেউ নই, আমি আমার নই, আমি তোমার নই, আমি তুমিও নই

বেচারা

Walid

বেচারা › বিস্তারিত পোস্টঃ

স্বপ্নচুরি

২৯ শে জানুয়ারি, ২০১৯ সন্ধ্যা ৭:০২


এক;
আফসারের আজকের দিনটাতেও অফিস যেতে হবে জেনে খুব রাগ হয়েছিল রেনুর। রেনু বারবার ওকে অনুরোধ করা স্বত্বেও ও অফিস মিস করতে কিছুতেই রাজি হল না।
কী হত এমন একটা দিনে অফিস কামাই করলে?

সে আসবে সেই দুপুরে। তারপর যেতে হবে সেই যাত্রাবাড়িতে। এতটা দূর। বাড়ির কাছেই সরকারী ম্যাটারনিটি ছিল। তা বাদ দিয়ে আফসার তাকে নিয়ে চলল সেই যাত্রাবাড়ি। সেখানে নাকি তার সব পরিচীত আছে। এমনিতেই আরলি সিজারিয়ান অপারেশন। তায় আবার আফসার রেনুর মাকে কিছুতেই সাথে নিতে দেবে না। তার নাকি সব ব্যবস্থা করা আছে। কোনো অসুবিধা হবে না।

তাই হয় কখনো? রেনুর বাচ্চা হবে, প্রথম বাচ্চা আর তার মা তার সাথে হাসপাতালে থাকবে না! আফসারটা যেন কেমন?

তাদের বিয়ে হয়েছে সে বছর খানেক হবে। প্রেমের বিয়ে। রেনুর পরিবার, মানে ওর মা কিছুতেই রাজি হতে চাননি। বিশেষ করে যখন শোনেন আফসারের বাবা-মা বা পরিবারের কেউ নেই। সে একা। কিন্তু রেনু যখন তার মাকে কান্নায় ভেঙে পড়ে জানাল, সে মা হতে যাচ্ছে আফসারের সন্তানের, রেনুর মা সালেহা বেগম আর না করার সাহস করেননি। চোখের জল গোপন করে রাজি হলেন। তারপর কাজির অফিসে রেনু আর আফসারের বিয়ে হয়। বিয়ের দিনও আফসারের পক্ষের কেউ ছিল না। বাধ্য হয়ে রেনুদের বাড়িওয়ালা সাক্ষি হয়।

বিয়ের এতমাস পরেও আফসার রেনুকে নিজের বাসায় তুলে নেয়নি। করবে, করছি বলে সময় চলে যায়। মাঝে মাঝে আফসার আসে। হয়তো একরাত থাকে। তারপর চলে যায়। রেনু শুধু জানে, আফসার কোনো এক বিদেশী অফিসে চাকরী করে আর যাত্রাবাড়ির ওদিকেই একটা মেসে থাকে। রেনু বিয়ের পরও সেই মেসে কখনো যায়নি। মেসে মেয়েদের নিয়ে যাওয়ায় নাকি কঠিন নিষেধ আছে।

ফেসবুকে আফসারের সাথে পরিচয়, প্রেম, প্রণয়, আর তারপর বিয়ে।

রেনু আফসারকে পাগলের মতো ভালবেসেছিল। তাই ওর শারিরীক সুখের ডাকে সাড়া না দিয়ে পারেনি। উত্তাল প্রেমের ফসল সন্তান পেটে এসে পড়ায় আফসারের সব অদ্ভূৎ কাজ ও মেনে নিয়েছিল। বেশি একটা কৌতূহল দেখায়নি। এমনকি আজকেও সে তেমন কোনো আপত্তি করতে পারেনি।

দুই;
যাত্রাবাড়িতে মাদার এইড নার্সিং হোমের ডাক্তার মিলি গোমস বহুদিন আছেন এই পেশায়। তিনি নিজেও কখনো গাইনোকলজিক্যাল ডাক্তার হিসেবে স্পেশালাইজ করতে চাননি। কিন্তু একরকম পরিস্থিতির চাপে পড়েই তার গাইনোকলজিতে আসা। এখন দেখছেন, কাজটা খারাপ হয়নি। অন্তত বর্তমান বাজারের বিচারে। গন্ডা গন্ডা পাশ করা ডাক্তাররা পশার জমাতে পারছে না। সেখানে পাশ করার ৪ বছরেই তিনি এই ম্যাটারনিটিটার একরকম অঘোষিত মালিকই হয়ে গেছেন। তার কথাতেই ক্লিনিক চলে। যদিও বাজারে চালু আছে, তিনি এই ক্লিনিকটার ৪০ পার্সেন্ট শেয়ার হোল্ডার। স্বামী ড. রোজারিও একই হাসপাতালের হেড অব এ্যাডমিন হওয়ায় তার আরো সুবিধা। টাকার অভাবে এককালে তার মেডিকেল পড়াশোনা বন্ধ হতে বসেছিল। আর আজ তার কী নেই? তার ম্যাটারনিটি বিশেষজ্ঞ পেশা তাকে দু’হাত ভরে দিয়েছে। অবশ্য সেজন্য নিজেকে তৈরী করতে হয়েছে-মেন্টালী।

আজ রাতে তার ডিউটি ছিল না। কিন্তু তার স্টাফ সাবেরার বিশেষ অনুরোধে তাকে রাতের একটা বিশেষ অপারেশনে থাকতেই হল। সাবেরার পরিচীত এক ভদ্রলোক সন্তান এবোর্ট করবেন। তবে আনটাইম এবোরশন না, এ্যাডভান্স সিজারিয়ান। বাবা চায় বাচ্চাটা নেবে না, কারন সে নাকি ওই সন্তানের বাবা না। জন্মের পর এখানে রেখে যাবে তবে সেটা বাচ্চার মা জানবে না। সাবেরা বাচ্চাটার যা ব্যবস্থা করার করবে। তাকে শুধু প্রসূতিকে একটা ছোট্ট মিথ্যে বলতে হবে যে তার একটা মৃত বাচ্চা হয়েছে। বিনিময়ে বাচ্চার বাবার কাছ থেকে ভাল একটা অঙ্ক আসবে। মিলিও এর বেশি কিছু নিয়ে মাথা ঘামাবেন না। এমনকি ওই ভদ্রলোককে দেখার আগ্রহও না। সাবেরার সাথে আগেই ফাইনাল হয়ে ছিল সব। এই লাইনে অবশ্য এমনই হয়। বেশি কথা বলতে হয় না। শুধু ফোনে দুয়েকবার কথা হয়েছে তার সাথে ওই লোকটার। সব ঠিক হয়ে যাবার পরে ভদ্রলোক তাকে ফোনে থ্যাংক ইউ জানায়।

তিন;
অরু খুব উত্তেজিত। কাল রাতে অর্নব যখন ওকে ফাইনাল খবরটা দিল, তখন হতেই তার উত্তেজনায় ঘুম আসছে না। সারারাত এপাশ ওপাশ করে কাটিয়েছে। দুচোখের পাতা এক হওয়ার মতো অবস্থায় তার মন ছিল না। এতকাল পরে পূরন হতে চলেছে তাদের জীবনের শুন্যতা। একটা বাচ্চার অভাব পূরন হবে সব ঠিকঠাক মতো হলে। যাত্রাবাড়ির একটা ম্যাটারনিটির একজন আয়া তার স্বামী অর্নবের পূর্ব পরিচীত। দাম্পত্যের ৬ বছর নিষ্ফলা কেটে যাবার পর অরু আর অর্নব অনেক চেষ্টা চরিত্র করে। কলকাতায়ও ঘুরে এসেছে। কিন্তু কোনো ডাক্তারই আশার বাণী শোনাতে পারেনি। অরুরই সমস্যা। মনে মনে সে কাঁটা হয়ে থাকে। অর্নবের কাছে সে অপরাধী অনুভব করে।

শুরুতে অর্নব বিষয়টা নিয়ে তেমন হইচই করেনি। বেশ সহজভাবেই নিয়েছিল বা নিয়েছে বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে ও বদলাতে থাকে। ইদানিং তো অনেক কথাই বলত অরুকে। যখন আর কিছুই হল না, অরু অর্নবকে দত্তক নেবার কথা বলে। অর্নব একদমই রাজি ছিল না। অন্যের বাচ্চাকে সে কিছুতেই নাকি নিজের বলে মানতে পারবে না। অনেক চরাই উৎরাই শেষে অরু অর্নবকে রাজি করায় দত্তক নিতে। অর্নব গোপনে বিভিন্ন স্থানে খোঁজ নেয়।

অরু জানতে চাইলেই তাকে ধমক দিত,
“তোমার এত জেনে কী হবে?”

আর তারপর পরশুদিন সে নিয়ে আসে এই খবরটা। ওর পরিচীত এক আয়া না নার্স। সে ওদের হাসপাতাল হতে একটা বাচ্চা দেবে। কোন এক দম্পতি নাকি বাচ্চা ড্রপ করতে চান আনওয়ানটেড বলে। তাদেরই সন্তান নেবে ওরা। অরু খুব অবাক হয়। তারা এত চেষ্টা করেও একটা বাচ্চা নিতে পারল না। আর এমনই বাবা-মা যারা তাদের জীবন্ত সন্তানকে অন্যের কাছে তুলে দিতে চান। যাহোক, তাতে অরুর কী? সে একটা বাচ্চা পেলেই তার কোল ভরে যাবে। বাচ্চাটাকে নিয়ে সে স্বপ্ন দেখাও শুরু করে দেয়, ওর কী নাম দেবে, কীভাবে ওকে মানুষ করবে, কত কত আদর করবে ইত্যাদি। তারপর হতে উত্তেজনা আর টেনশনে সে অস্থির হয়ে থাকে। অপেক্ষার পালা যেন আর ফুরোয় না।

চার;
এমন একটা কাজ করতে এতদিন পরেও ড. মিলির মনে একটা অপরাধবোধ জাগে। সেটা ক্ষণিকের জন্যই। টাকার জন্য তার কাছে কিছুই বাঁধা না। তার টাকার দরকার, অনেক টাকার। ক্ষণিকের জন্য

ড. মিলি একটু আনমনা হয়ে পড়েন, তার স্মৃতিতে ভাসে, ফোর্থ ইয়ারেই তিনি সন্তান সম্ভবা হয়ে যান। কিন্তু তখন তারা দু’জনেই ছাত্র। রোজারিও তার একবছরের সিনিয়র ছিল। তারও পড়াশোনা শেষ হয়নি। বিয়েটা লুকোনো ছিল ফ্যামেলী হতে। তার উপর ওদের কেউই আয় করে না। মিলি আর রোজারিও বাধ্য হয়ে বাচ্চাটা এবোর্ট করে ২ মাসের মাথায়। তবে একটা ক্ষতি হয়ে যায়। কোনো কারন ছাড়াই একটা জটিলতা সৃষ্টি হয় এমআর করার সময়। সেই জটিলতায় মিলি মা হবার ক্ষমতা হারান চিরতরে।

মিলির মনে হয়েছিল, পৃথিবীটাকে জ্বালিয়ে দেবে তার সেই শোকে। কিন্তু সময়ে সব সয়ে যায়। মিলিরও সয়েছে। রোজারিও কতটা মানিয়ে নিতে পেরেছে তা অবশ্য বোঝা যায়নি। হয়তো পেরেছে। ড. মিলি মাঝে মাঝে ভাবেন, এই যে, এত এত নবজাতকের ভাগ্য নির্ধারন করেন তিনি, তার ভেতর হতেই কাউকে এডপ্ট করলে কেমন হয়..................
বর্তমানে ফেরে তার চিন্তার গাড়ি।

সাবেরা তাকে বিশেষভাবে অনুরোধ করায় নিজেই সিজারিয়ান অপারেশন করতে রাজি হয়েছেন। সন্ধ্যার পরে ড. মিলি অপারেশন থিয়েটারে ঢুকলেন। নার্স আর স্ট্যাফরা আগেই প্রসূতিকে এনেসথেসিয়া দিয়েছিল। তখনো একটু হূশ ছিল রোগীর। সে একবার আফসারকে খোঁজার চেষ্টা করে, হাত বাড়িয়ে মিলিকে জড়ানো গলায় অস্ফুটে কিছু বলার চেষ্টা করে,

“ডক্টর, আমি আমার বেবিটাকে তাড়াতাড়ি দেখতে চাই আর আমার স্বামীকে একটু ডেকে..........দিন” এতটুকুই মিলির কানে যায়।

তিনি মুখে একটা পেশাদার হাসি ফুটিয়ে তোলেন।

“তোমার স্বামী বাইরে দাড়ানো আছে, কোনো ভয় নেই”- রোগীকে হাসিমুখে সাহস দিলেন।

“লাইটস”-মিলি হুকুম করেন।

হাজার ওয়াটের লাইটগুলো জ্বলে ওঠে রেনুর মুখের ওপর। ঘুমের মধ্যে হারিয়ে যেতে যেতে সে যেন শোনে,

“হ্যা, ফোরসেপটা নাও, .................................না না, ওনাকে কাছাকাছি থাকতে বলবে........কেন, আমি আছি না?..............না না কোনো অসুবিধা হবে না।”.........................আফসার যেন ওটির ওপাড়ে দাড়িয়ে তাকে ডাকছে, তার কানে আসছে একটা বাচ্চার কান্না....................ধুর, সে কীসব ভাবছে, ঘুমে জড়িয়ে আসছে কেন চোখ..............না না, তাকে তো জেগে থাকতে হবে................

পাঁচ;
অর্নব ডাক্তারের চেম্বারের ভিতরেই বসে ছিল। অরুকে সে সাথে আনেনি। একাই এসেছে। অরু খুব আশ্চর্য হয়েছিল, যখন অর্নব আজ সকালে তাকে বলে, অর্নব একাই যাবে হাসপাতালে। তার নাকি অফিসের জরুরী কাজ আছে। কাজ সেরে সোজা হাসপাতালে যাবে। সেই নিয়ে আসবে বাচ্চাটাকে। অরু হয়তো আপত্তি করত, কিন্তু অর্নবের শীতল চাউনির সামনে সে আর কথা বাড়ায়নি। শেষে যদি অর্নব আবার বেঁকে বসে? সাবেরা তোয়ালে জড়ানো বাচ্চাটাকে শশব্যস্তে তার কোলে তুলে দেয়।

অর্নব একটা বড় খাম গুঁজে দিল সাবেরার হাতে।

সাবেরা তাড়া লাগায় অর্নবকে তক্ষুনি বের হতে। অর্নব দ্রুত হাঁটতে থাকে হাসপাতালের লম্বা করিডোরটা দিয়ে। করিডোরের মাথায় পৌছে গিয়েছিল ও, হঠাৎ পাশের একটা দরোজা দিয়ে ড. মিলি বের হলেন, মুখে তখনো মাস্ক পড়া। সেটা খুলতে খুলতে আসছিলেন। বাচ্চা কোলে অর্নবের সাথে দেখা হয়ে গেল ড. মিলির। অর্নবকে তিনি এক নজর দেখলেন।
অর্নব আর ড. মিলির চারচোখ এক হল। তারপরই চোখ নামিয়ে নিল অর্নব, পরিমরি করে গেটের দিকে ছুটল। শুধু ড. মিলিকে পাশ কেটে বেরিয়ে যাবার সময় অস্ফূটে একবার বলে,

“থ্যাংক ইউ ডক্টর।”

গলাটা কেন যেন খুব পরিচীত লাগে ড. মিলির। খুব চেনা, অথচ মনে আসছে না। কিন্তু বেশিক্ষণ চিন্তা করার ফুরসত পাননা তিনি।

ফোনটা বেজে ওঠে। রোজারিওর কল। বাসায় যাবে একসাথে। ড. মিলির কানে ফোনের রিংটোন ছাপিয়ে অর্নবের কন্ঠস্বর ক্রমাগত বাজতে থাকে-”থ্যাংক ইউ ডক্টর”।

কর্কশ রিংটোন বেজেই চলেছে।

মন্তব্য ৩ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৩) মন্তব্য লিখুন

১| ২৯ শে জানুয়ারি, ২০১৯ সন্ধ্যা ৭:৪০

রাজীব নুর বলেছেন: সুন্দর গল্প।

৩০ শে জানুয়ারি, ২০১৯ সকাল ৯:৪৯

বেচারা বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ। আপনি বেশ ধারাবাহিক। যদিও আমি খুব ফাঁকিবাজ।

২| ১৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ বিকাল ৪:৪৬

নীল আকাশ বলেছেন: আমি বলব অসাধারন গল্প। আপনার এই গল্প ব্লগে আমার চোখ এড়িয়ে গেল কিভাবে????
আপনার আরও লেখা পড়তে হবে........
ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.