নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি কেউ নই, আমি আমার নই, আমি তোমার নই, আমি তুমিও নই

বেচারা

Walid

বেচারা › বিস্তারিত পোস্টঃ

আত্মপ্রচারনা আর খামখেয়ালির সামাজিক হিড়িকের মধ্যে হাইপ-ভাইরাল নির্ভর ব্র্যান্ডিংয়ের ইঁদুর দৌড়

১৯ শে জানুয়ারি, ২০২৩ বিকাল ৫:৫৩

১. ম্যাডেল দেবেননি?

পূর্নেন্দু পত্রীর সোনার মেডেল কবিতাটা পড়েছেন কখনো?
একখানা কীর্তিমানের মেডাল গলায় ঝোলাবার আজন্ম সাধ আমার, আমাদের সবার। সেই হাউশ পূরণের রয়েছে কত তরিকা। সাদা তরিকা, কালো তরিকা।
অধুনা যোগ হয়েছে ডিজিটাল তরিকা, যার নাম ব্রান্ডিং।
অনেক ছোটবেলার একটা শোনা গল্প নতুন ঢঙে রং চড়িয়ে বলে শুরু করব। ভুলভাল হতে পারে। মার্জনা করে দেবেন। উঠতি লেখকরা এটুকু ভুল করতেই পারে।
এলাকার খেলার মাঠে বিকেলে বাচ্চারা গোল হয়ে কিচির মিচির করে কী যেন বলছিল। হঠাৎ হাবলু দা হাজির।
এই তোরা কী নিয়ে প্যাঁকপ্যাঁক করছিস”, হাবলু দা বাঁজখাই গলায় হাঁকলেন।”জানো দাদা, গতকাল ন্যাশনাল এ্যাথলেটিকস চ্যাম্পিয়নশিপে করা মাইকেল জাম্পের হাই জাম্পের রেকর্ড ভেঙে ফেলেছে একটা কমবয়সী বাচ্চা ছেলে। কী এক্সাইটিং, নাহ?”
”অঁ, এই কথা। তা এ আর এমনকি? ওরকম তো আমিও রেকর্ড ভাঙতে পারি।”
”ইস, বললেই হল? দেখাও তো?”
”কাল আসিস, এই সময়, মাঠে।” “দেখিয়ে দেব রেকর্ড ভেঙে।”
তো পরের দিন বাচ্চারা দলবেঁধে আরো একটু সিনিয়রদের নিয়ে মাঠে হাজির। কয়েকজন বয়স্ক লোকও মজা দেখতে এসে পড়েছেন। হাবলু দা একটু পরেই মাঠে এলেন। হাতে একটা ঢাউস বস্তা।
তিনি ভীড়টাকে একটু সাইডে সরিয়ে দিলেন। সবার চোখে মুখে ব্যাপক উৎসাহ, কৌতুহল, হাবলু দা আজ কী রেকর্ড ভাঙবেন।সবাইকে অবাক করে দিয়ে হাবলু দা মাঠের একপাশে আগে হতেই বানানো একটা ছোট প্লাটফরমের মতো স্থানে উঠলেন। হাতের বস্তা হতে অনেকগুলো গ্রামোফোন রেকর্ড বের করে সেই মঞ্চটার নিচে ছড়ালেন।
এরপর সবার তীব্র কৌতুহল, উৎসুক্য ও বিষ্ফোরিত চোখের সামনে হাবলু দা সেই অনুচ্চ প্লাটফরমটা হতে নিচে লাফ দিয়ে দিয়ে সেই গ্রামোফোন রেকর্ডগুলো পায়ের আঘাতে ভাঙতে লাগলেন। ভাঙা শেষ হলে নেমে এসে লম্বা দম নিয়ে বলতে লাগলেন, “দেখলি, কীভাবে হাই জাম্পে রেকর্ড ভাংলাম?”
পুরো মাঠ এভাবেই নাটকের ভিতর দিয়ে দেখল, হাবলু দা কর্তৃক রেকর্ড ভাঙার মহড়া।
গল্পটি ফেঁদে বসার কারন বোধহয় আকলমান্দ পাঠক খুব সহজেই ধরতে পারবেন। তবে ব্যক্তিগতভাবে নেবেন না। আমি কখনো ব্যক্তিকেন্দ্রীক কিছু লিখি না। ভাবিও না। ব্যক্তির কাজ বা কথাকে কাকতাল বানাতে চাই না।
তবে এই একটা ক্ষেত্রে আমরা অন্তত আমাদের পূর্বপুরুষকে কষে গালি দিতে পারি। পেছন দরোজা দিয়ে যুদ্ধ জয়ের কালচার আমরা বাঙালীরা শিখেছি পলাশীর যুদ্ধ হতে। ক্লাইভ ও ইংরেজ বাহিনী যখন দেখল, সোজা ও স্বাভাবিক পথে নবাবের বাহিনীকে যুদ্ধে পরাজিত করা যাবে না, তখন অন্য রাস্তা ধরল। সেই পথ হল প্রতারনা ও শর্টকাটের রাস্তা।
সেই হতে শুরু। আজও তা চলছে। শুধু ধরন বদলেছে। এখন তো আর পেছন পথে মসনদ দখল করার নেই। আছে পেছনের রাস্তা দিয়ে ভেলকীবাজি দেখিয়ে ডিজিটাল পথে তকমা, চেয়ার, লেবেল, টাইটেল, সার্টিফিকেট, ক্রেস্ট, পুরষ্কার বাগানো। একটু দৌড়ঝাঁপ করলেই আপনি পেয়ে যেতে পারেন পছন্দমতো তকমা, টাইটেল।
গাঁট হতে কড়ি খরচ করে স্তাবক ও দুঁয়ো দেবার লোক যোগাড় তো কোনো ঘটনাই না। আপনাকে বাড়িতে বয়ে এসে সার্টিফিকেট, ক্রেস্ট, চকচকে মেডাল ও গরুর (থুককু গুরুর) আসন দিয়ে যেতে রীতিমতো প্রতিষ্ঠান খুলে নেমে পড়েছে কত গুনীর কদরদার।
ইদানিং দেখি, শীত এলেই বিলাত হতে (পাশের দেশের বিলাত) একটি সংগঠন নিয়মিত আসে, মোটা কড়ির বিনিময়ে ক্রেস্ট, মেডাল, তকমা, খেলাত বিক্রী করে যায়। বড় অনুষ্ঠান করে ওসব খেলাম হস্তান্তরিত হয়। ওসবের ক্রেতারা সব ধনী ও চানক্য প্রফেশনাল। মোটা টাকা দিয়ে কিনে, জনসম্মুখে তা হাত পেতে নিয়ে তার গণপ্রচার করবার কী যে থ্রীল!
তবে জাতীয়ভাবে দুঃখ পাবার বা শরমিন্দা হবার কিছু নেই। সাদা সায়েবরাও ওই কর্মে আমাদের কাতারে আছেন। তারা পারলে আমরা কেন নয়? বিলেতেও কাড়ি কাড়ি টাকা ঢেলে সার্টিফিকেট আর তকমা বিক্রী হয় হর হামেশা। রেটিংয়ে মহাকাশ ছোঁয়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও পয়সার বিনিময়ে ডক্টরেট বিক্রী হয়। অস্কার তো নাকি কত কত রঙ আর ঢং না দিলে কপালে জোটে না। মারিও পুজোর গডফাদারে তার বর্ননা পড়েছিলাম বোধহয়।
হালে নোবেল ঠাকুরও বিক্রী হয়ে গেছেন কড়ি আর ছড়ির দাপটের কাছে। তাহলে আমাদের আর আব্রু রেখে কাজ কী?কষ্ট করে, পরিশ্রম দিয়ে, সাধনা, জ্ঞান, মেধা, অধ্যবসায় দিয়ে সত্যিকারে কিছু অর্জন করার মতো মহিয়ান মানুষেরা যে একদম বিলীন হয়ে গেছেন তা না। তারাও আছেন। তারা অবশ্যই আমার ও আপনার নমস্য।
তবে ডিজিটাল মসনদধারীদের বায়োস্কোপীয় মেধার ধারের কাছে তারা কোনঠাসা। লজ্জায় তাদের বহু আয়াসে অর্জিত প্রজ্ঞা ও অনন্যতাকে দেরাজে বন্দী করে রাখেন। পাছে কেউ সেগুলোর মলীন অবস্থা দেখে নকল বলে না বসে।

২. বালেগ ও বাচ্চালোক:

[সত্য ঘটনা অবলম্বনে আঞ্চলিক গল্প বিধায় আপনার সামান্য অফেনডেড হবার সম্ভাবনা আছে। যদি অফেনডেড হবার চান্স নিতে না চান-তাহলে না পড়াই ভাল।]
আমার একজন স্থানীয় চাচা তার নিয়মিত সফরে কুড়িগ্রাম গিয়েছেন। পথ চলার সময় তৃষ্ণা লাগায় তিনি একটি বাড়িতে থামলেন। সামনেই এক কিশোরীকে পেয়ে তাকে বললেন, “ও খুকি, আমাকে একটু পানি খাওয়াতে পারো?”
খুকি তাকে পানি দিল ঠিকই। কিন্তু তার চোখমুখে তীব্র গোস্বা স্পষ্ট। গলার স্বরে ঝাঁজ।
চাচা তাকে শুধালেন, ”ও খুকি, তুমি এত রেগে আছ কেন?”
খুকি তাকে (স্থানীয় ডায়ালেক্টে) বলল,
“তুমি আমারে খুকি বললা কেনে বাহে? তুমি জানো, আমি অহন **মাগী অয়েছি?”
অর্থাৎ কিনা, সে এখন সাবালিকা। সে আর খুকি নয়।
পারসোনাল ব্র্যান্ডিং ও সেলফ মার্কেটিং করার পরামর্শ আমরাই দিই।
তবে কখনো কখনো তার তীব্রতার ঝাঁজ দেখে আমাদেরই মনে হয়, যেন বিকাশের আগেই প্রকাশের তীব্র আতুড় জ্বালায় ভ্রূণটাও বলতে চায়, “দেখে নাও পৃথিবী, আমি **মাগী হয়েছি”। আকাশে, বাতাসে, ফেসবুকের বঙ্গমহাকাশে, লিংকিতে, হোয়াসসাপে জগতের সব কীর্তিমানদের মুহুর্মুহু সাফল্যের উদগীরন-আমি এই হয়েছি, আমি এই করেছি, আমার এই হয়েছে। (মন খারাপ করবেন না, আমিও এগুলো করি।)

৩. ব্র্যান্ডিংয়ের জঠর জ্বালা:

বিজ্ঞানী মার্কনী বেতার আবিষ্কার করেন-অফিশিয়ালী এটাই স্বীকৃত। তবে বাজারে ’গুজব’ আছে, স্যার জগদীশ চন্দ্র বোস তার অনেক আগে ওই যন্ত্র আবিষ্কার করেন।
স্রেফ ব্রান্ডিং, পেটেন্ট ও মার্কেটিং কূটকৌশলে মার্কনী ও তার ভৌগলিক দেশ এগিয়ে থাকায়, বেতারের ইতিহাস জড়িয়ে গেল মার্কনী ও তার দেশের নামে।
এই ইস্যূটার দুটো ডাইমেনশন আছে।
এক; সত্যি সত্যিই এটা বুঝতে ও মানতে হবে, জ্ঞান ও দক্ষতা শুধু আপনার ভিতরে থাকলেই হবে না। তাকে ব্রান্ডিং, প্রমোটিং, মার্কেটিং ও ক্যাপিটালাইজিং করার দক্ষতাও আপনার ভেতরে থাকতে হবে। তা না হলে, ওই বিদ্যা অব্যবহৃত বা আনসাঙ রয়ে যাবার সমূহ কারন রয়েছে। কমপক্ষে আপনার বাড়ানো বলে অন্যে গোল দিয়ে গোল্ডেন বুট হাতিয়ে নেবার সমূহ সম্ভাবনা থাকবে।
দুই; না, একজন জিনিয়াস বা ট্যালেন্টের ভিতরে সব বিদ্যা সমান তালে থাকা জরুরী না, সম্ভবও না। আইনস্টাইন, যিনি জগতখ্যাত বিজ্ঞানী, তিনি তার বিজ্ঞান বিদ্যা বাদে প্রায় কোনো কিছুই জানতেন না, পারতেন না। তাতে কিন্তু তার গ্রেট হবার এতটুকু কমতি হয়নি। তার গ্রেটনেস কমেও নি।
তাহলে এখন কেন একজন জিনিয়াস যিনি হয়তো ভাল গান পারেন, কিংবা ভাল লিখতে পারেন অথবা খুব ভাল ছবি আঁকেন বা কোনো থিওরিটিক্যাল বিষয়ে খুব ভাল জ্ঞান রাখেন, তাকে কেন যুগপৎভাবে নিজের ঢোল নিজে পিটিয়ে, হররোজ ফেবু স্ট্যাটাস পোস্ট করে, প্রচুর সেলফী ও দলফী দিয়ে, কারনে অকারনে লাইভে এসে নিজের বিদ্যাকে মার্কেটিং করতেই হবে?
ছবি কার্টেসী: কবি ও সাংবাদিক ফারহান হাবিবের ওয়াল।

৪. ক্যানভাচারের দাপট:

একসময় প্রচারনা ছিল কাজের একটি ক্ষুদ্র অংশ। এখন কাজ হয়ে গেছে প্রচারনার ক্ষুদ্র একটি অংশ। কনিষ্ঠ সুহৃদ মি. নাজমুলের একটি বাক্য মাঝে মধ্যে ধার করে বলি, “বিকাশের আগেই প্রকাশের তাড়না”। বিকাশের আগেই প্রকাশ হয়ে পড়লে তার পরিণতি তো জানাই আছে।
পৃথিবীতে সবাইই হয়তো নিজের একটি ফুটপ্রিন্ট রেখে যেতে চায়, অমর হয়ে থাকবার তাড়না সবারই মনে মনে সুপ্ত থাকে। অনেক পন্থাতেই আপনি পৃথিবীতে আপনার অনেক রকম ফুটপ্রিন্ট রেখে যেতে পারেন। ভাল কিছু করেও। খারাপ কিছুও। চয়েজ আপনার। আপনি আবার ভাববেন না, “আমার পাগলা গুড়া রে, কো তাইকা কো লয়া যায়?”
ছোটবেলায় আমাদের সর্দি লাগলে ভাতের গরম মাড় সামান্য হলুদ গুড়ো, লবণ ও রসুন বাটা মিশিয়ে খাওয়ানো হত। ১ ‍দিনে সর্দির কামড় কমে যেত।
উষ্ণতা, রসুন, হলুদের ঔষধি গুন, মাড়ের স্টার্চ-সব মিলে কাজটা হত।
ঠিকঠাক যদি ব্র্যান্ডিং করতে পারেন, সাথে কিছু মানুষকে স্বার্থের টানে নাচিয়ে হাইপ তোলাতে পারেন, ভাতের মাড়কেও জাতে উঠিয়ে ফেলতে পারবেন। ফ্যান তখন হটকেক ও সেক্স সিম্বল, স্যরি, স্ট্যাটাস সিম্বল।
তখন, ফেসবুকে দেখবেন,
”ইশ, এবার ফ্যান খাওয়াটা হল না।”
কিংবা "ইয়াহু, আজ আমরা অফিসের সবাই মিলে ফ্যান ডে আউট করতে এলাম।"
'মূলধারা' বা 'ভূলধারা'র পত্রিকাগুলো জরিমণিকে বাদ দিয়ে কলাম লিখবে, "বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী ফ্যান খাওয়ার উৎসবের মাস শুরু হল।"
বেশ কিছু মাস আগে দেখেছিলাম, জনৈক স্বর্ণকেশীনি তার *'ফাঁদ' এর সুগন্ধী জারে ভরে বিক্রী করেন, দামও বিপুল, চাহিদাও। সবই ব্র্যান্ডিংয়ের তেলেসমাতি।

৫. TRP’র জয়জয়কার:

ব্র্যান্ডিং ও মার্কেটিং যদিও এখন এক প্রতিষ্ঠিত বাস্তবতা। আমার প্রয়াত স্বল্পশিক্ষিত পিতা তার কর্মজীবনে (আজ হতে ৩০-৪০ বছর আগে) একজন স্বশিক্ষিত সুপারস্কীলড কর্মী ছিলেন। তাকে কখনো নিজের পসার ও প্রচার নিয়ে ভাবতে হয়নি। নিজের স্কীল তথা দরকারী সব কমপিটেন্স নিয়ে কনফিডেন্সের সাথে শুধু কাজ করে গেছেন।
এর বাইরে নেটওয়ার্ক, পিয়ারগ্রূপ, লিংকডিন কানেকশন, পারসোনাল ব্র্যান্ডিং করার ক্যারিয়ার চিন্তা নিয়ে কখনো ভাবিত হবার দরকার পরেনি। ফেসবুকে নিজের মার্কেটিং করতে হয়নি।
কিন্তু, আমি দেখতাম, মানুষ তার সার্ভিস নেবার জন্য বহু আগে হতে বুক করে রাখতে হত। তিনি কাজকে খুঁজতেন না, কাস্টমার ঢুঁড়তে হত না, কাস্টমার বাড়িতে আসত পায়ে হেঁটে। (আজও অবশ্য চাকরি কারো কারো কাছে পায়ে হেঁটে আসে; যাহোক, তারা সুপারম্যান।)
কিন্তু, তার সন্তান আমাকে আজকের পৃথিবীতে টিকে থাকবার জন্য প্রতি মুহূর্তে, প্রতিটি পলে, প্রতি ক্ষণেই হিসাব রাখতে হচ্ছে, TRP কমে গেল কিনা, নেটিজেনরা আমাকে ভুলে গেল কিনা, নাইক-কমান্ড কতগুলো জমল, কানেকশন কতগুলো হল, পোস্ট রিচ কত হল, ভাইরাল হতে পারলাম কিনা-কত কী। প্রতি মুহূর্তে সামাজিক মাধ্যমে এসে জানান দিতে হচ্ছে, আমি কিন্তু আছি দাদারা।
হালের প্রফেশনাল আমি বা আমার মতো যে কেউই, নিজের কাজ ও যোগ্যতা নিয়ে ভাবার সাথে সাথে, বাধ্যতামূলকভাবে ভাবতে হয় ওইগুলো নিয়ে, যা আমাদের বাবাদের না ভাবলেও চলত। কাজ বাদ দিয়ে বরং নেটওয়ার্ক আর টিআরপি নিয়ে বুঁদ থাকতে অনেকটা বাধ্যই হতে হচ্ছে এখনকার বাস্তবতায়।
একটা ঘামাচির দানা গজালেও এখন যেমন ফেসবুকে দেবার নিয়ম, তেমনি প্রফেশনাল হিসেবে ’ক আকারে কা’-এতটুকু করলেও সেটা দশগুন ইনিয়েবিনিয়ে ফেবু, লিংকিতে না দিলে টিআরপি শেষ।
আত্মপ্রচারের নাম এখন হয়েছে পারসোনাল ব্র্যান্ডিং। ম্যানিপুলেশনের নাম এখন হয়েছে কনভিন্সিং পাওয়ার। আগে যেটাকে আমরা বলতাম ‘মার্কা মারা’, সেটাই এখন ব্র্যান্ড। কাজ করব কখন, টিআরপি সামলেই তো সময় শেষ।
এখানে আমরা যা কিছুই করি, নিঃস্বার্থতম বা এমনকি উদ্দেশ্যহীনও, সেটার পেছনে খুব সূক্ষ্ণভাবে কি একটি উদ্দেশ্য থাকে না, যে, “শোনে সবাই, দেখো সবাই, আমার কাছে কিন্তু এটা আছে, ওটা আছে, আমি এই, আমি ওই, আমি পারি, আমি আছি”? জগতের নিঃস্বার্থতম কাজটিরও একটি স্বার্থ নিহীত থাকে, সেটি হল, ‘নিঃস্বার্থ’ স্বীকৃতি। হ্যা, স্বীকৃতি মানুষের টাকা, পজিশন, পাওয়ার, ইন্দ্রীয়সুখ, সম্পত্তি অর্জন হয়ে গেলে রয়ে যাওয়া আলটিমেট লক্ষ্য ও ধ্যান।
আগের দিনের বাবারা সন্তানদের জন্য রেখে যেতেন কাঠা দুয়েক জমি আর সামান্য লাইফ ইনসিওরেন্স। বর্তমানের প্রোফেশনাল বাবারা (বিশেষত এইচারের) রেখে যাবার সম্ভাবনা:
১. লাখখানেক ফলোয়ারযুক্ত ফেসবুক পেজ (বুষ্ট খাওয়া পেজ, রীতিমতো তাজা তাগড়া)।
২. তিন কোটি লাইক, সাত লাখ কমেন্টযুক্ত ফেসবুক প্রোফাইল (অগুনতি মিউচুয়াল চাচাসহ)।
৩. অসংখ্য অগুণতি চাবি (কি), সিসা (লিড), গ্রুমার, খোচ (কোচ) এডভাইজরের কাঠের টুকরা (ক্রেস্ট)।
৪. কয়েক হাজার প্রধান অতিথির গামছা (উত্তরীয়)।
৫. অন্তত তিন ডজন পেশাদার সংগঠনের সদস্যপদের শেয়ার ডিভিডেন্ট (যার মধ্যে সবশেষ সংযোজন থাকবে "মিরপুর লাভ রোডস্থ তিন নম্বর বাড়িস্থ ভুরুঙ্গামারিস্থ পদবঞ্চিত দুনিয়া উল্টাই দেবস্থ এইচার সমিতি।)
৬. অন্তত ৫ লাখ সহমত চাচা (বাপেরে যারা সহমত ভাই ডাকত, তারা তো সহমত চাচাই, না কি?)। অবশ্য সংখ্যাটা ৮ লাখ হত, যদি না, মাঝে বেশ কয়েক মাস আব্বাজান চাকরীহীন না থাকত।
৭. প্রায় সতের হাজার হেটার্স ও নিপাত যাক চাচা। এই সবকিছুই অবশ্য সম্ভব, যদি বাবাজান একজন ফেসবুক সেলেব্রিটি এইচার হয়ে থাকেন।

৬. ঢেল কার্নেগী হবার ব্রহ্মাস্ত্র

আপনি যার খোঁজে পাগল, কামরূপ কামাক্ষা হতে নীলক্ষেত চষে ফেলছেন, আজ সেই গোপন মন্ত্র শিখিয়ে দিচ্ছি। একদম ফ্রি।
যেই পেশাতেই থাকুন, সফল হতে গেলে কী করতে হবে? নাহ, ডেল কার্নেগী বা ওয়ারেন বাফেটের তত্ত্ব খুঁজলে তাতে পাবেন না। গোপন ও এক্সক্লুসিভ ১১টি টিপস আমি দিচ্ছি। মন দিয়ে শুনুন:
১.সর্বপ্রথম আপনাকে যেকোনো বিষয়ে একখানা এমবিএ করতে হবে। পিএইচডি হলে আরো ভাল। জ্ঞানের গভীরতা নিয়ে ভাববেন না। ডিগ্রী নিতে বলেছি, জ্ঞান না।
২.খুব দ্রূত সিভিতে নামের পাশে পিজিডি লাগান, সেটা ক্যাটল গ্রেজিং এ হলেও।
৩.দরকার নিয়ে ভাববেন না। একটি এলএলএম, ISOসহ কয়েকটা স্পেশালাইজ ডিগ্রী করে ফেলুন।
৪.বাংলাদেশের যত বড় বড় বিখ্যাত মানুষ আছে, খুঁজে খুঁজে তাদের অনুষ্ঠানে হাজির হয়ে তাদের সাথে ছবি তুলে আপ করুন। (একদম কোথাও না পেলে তাদের গাবতলীর গরুর হাটে পাবেনই। আর তাও না পেলে ফটোশপ আছে কেন?
৫.মাসে কমপক্ষে ওয়ালে ৭/৮ টা বড় বড় কনফারেন্স/সেমিনারের চেকইন লাগান।
৬.জ্ঞানের তলানি থাকুক বা না থাকুক, প্রতিমাসে ডজনখানেক ”কী স্পিকার” স্ট্যাটাস বাগাতে থাকুন। লাগলে মাগনা সেল করুন।
৭.“আলহামদুলিল্লাহ, আমার প্রথম............বের হলো” (বই/আর্টিকেল আর কি, অন্য কিছু না)” মর্মে ইর্ষনীয় স্ট্যাটাস দিয়ে দিন ঢাকঢোল পিটিয়ে।
৮.”........এর এক্সক্লুসিভ (সান্ডার তেল না আবার) ফরম্যাটটি দিচ্ছি” মর্মে মাঝে মধ্যে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিন। মুহূর্তে সেলেব্রিটি হয়ে যাবেন।
৯.নীলক্ষেত হতে কয়েকটা মেডাল আর ক্রেস্ট বানিয়ে আনুন। সেগুলো কাউকে ধরে বেঁধে আপনাকে দেয়ান। ছবি আপলোড করুন। তিনিও বিখ্যাত হবেন, আপনিও সেলেব।
১০.এক সদস্য বিশিষ্ট একটি প্যাডসর্বস্ব কোম্পানী খুলুন আর নামের শেষে, বিজনেস কার্ডে “লিড” আর “সিইও” কথাটা এবার জুড়ে নিন।
১১.আমার মতো “সফলতার ১১টি এক্সক্লুসিভ টিপস দিচ্ছি” এই মর্মে ফেসবুক/লিংকডইন স্ট্যাটাস দিতে শিখুন আর...............দেখুন ম্যাজিক। ডেল কার্নেগী হয়ে যাবেন। আপনাকে আর কেউ ’দাবায়া’ রাখতে পারবে না।
প্রথমে আপনি নির্বিচারে নেটিজেন ও প্রোফেশনালদের সাথে 'সহমত ভাই' হোন এবং অগণিত প্রোফেশনাল গ্রুপের সদস্য হোন। টুকটাক 'কঠিন ভাই' 'জটিল ভাই' মন্তব্য করে সবার কাছাকাছি যান। এরপর, কাঁপিয়ে দেয়া কিছু ছোট ছোট লেখা বেশ কয়েবার লিখুন। সবার ক্যারিয়ার যে আসন্ন ধ্বংসের মুখে, সবাই যে এযাবৎ কী মারাত্মক ভুল করে এসেছেন-সেই ভয়ের কাঁপন ধরিয়ে দিন। লাগলে মহামতি কার্লাইলের দুয়েকটা থিওরীও কপচে দিন।তারপর দেখবেন, সবাই ইয়া নফসি হিয়া নফসি করে আপনার মতো পীরের কাছে নির্বাণ খুঁজছে। হয়ে গেল।
আপনি কিন্তু ফিজিবল কাষ্টমার পেতে শুরু করে ফেলেছেন। এবার নেট হতে কপি ও ভর্তা করে ব্যাপক জার্গন সহকারে ঘুঁটা দিয়ে কয়েকটা "কী করিলে কী হইবে" কিংবা "ক্যারিয়ারের কনসটিপেশন ও তা হতে উত্তরনের টোটকা" টাইপের কয়েকটি পাউয়ার পয়েন্ট বানিয়ে কলমড্রাইভে রেখে নিন। ওগুলোই আপনার AK-47. এক ফাঁকে একটা চোস্ত বিজনেস কার্ড বানানো, নিজেকে সিইও ঘোষনার কাজটা করে রাখুন, আর নিজ খরচে/লবিতে চান্স নিয়ে কয়েকটা কী-নোট স্পিকারের ফেবুলিঙ্কি পোস্ট করে রাখবেন।
হ্যা, টিভিতে বকবক শো এর একটা চান্স আপনার জন্য এটোম বোমের কাজ দেবে।ব্যাস। হয়ে গেল। কী হল?
আপনার জন্য একজন উদীয়মান ক্যারিয়ার বিজনেসম্যান হবার কেকাপ্পা রেসিপি তৈরী। রেসিপিতে নুন কম আছে। এই ফিল্ডের পুরোনো প্লেয়ারদের কাছ থেকে একটু পোংটা ব্র্যান্ডের আজিনোমোতো নিয়ে ছিটিয়ে নেবেন।
কাস্টমাররা খুব খাবে।

৭. সোশ্যাল হাইপের তেলেসমাতি:

WFP কিংবা FAO এর বড়কর্তারা যদি একবার ঢাকার রাজধানী মিপ্পূঁতে (মিরপুর) আসতেন, তাহলে নির্ঘাত পরের দিন ঘোষনা করতেন,
”উগান্ডার জাতীয় খাবার পানিপুরি ও কাচ্চি।”
মিপ্পূঁ’র অলিতে, গলিতে, চিপাতলিতে, ফুটপাথে, ড্রেনের পাশে, মাঠে, রাস্তায়, দোকানে, ভ্যানে, ট্রলিতে, গলাতে শুধু পানিপুরি নামক ফুচকার তালতো ভাইয়ের জয়জয়কার। সন্ধার পরে মিপ্পূঁ আসলে আপনি প্রতি ৬০ সেকেন্ডের ওয়াকে ১২০টি পানিপুরির জটলা পাবেন।
গুনগত মান ও হাইজিন নিয়ে না হয় বললামই না। কারন, ওই দুই বিচারে এই জিনিস সায়নাইডের থেকে সামান্য নিচে।
মানুষের হিড়িক ও ক্রেইজ দেখে আপনি ভিড়মি খাবেন।
সেই সাথে ঢাকার মাটি ও অনলাইনে কাচ্চি নিয়ে যে কাছা মারামারি চলছে, তাতে অচীরেই, কাচ্চি হাজার বছরের বাঙালি ঐতিহ্যের ইউনুছ কোং তালিকায় ঢুকতে যাচ্ছে।
ফেসবুক, ইনস্টা, হোয়াটসএ্যাপ, ইউটিউব, টিকটক, রিল, হাতের মুঠোর ফোন আর ইনটারনেট এসে মানুষের প্রদর্শনেচ্ছার চিরসুপ্ত নেশাকে চরমভাবে চাগিয়ে দিয়েছে। সেই সাথে ব্র্যান্ডিং, ট্রেন্ডিং, হাইপ বিষয়গুলোকে দিয়েছে চরমতম মাত্রা।
একবার বলেছিলাম, ভালভাবে ব্র্যান্ডিং করাতে পারলে ‍তিন দিনের বাসি পুরিষও স্কুপ করে উচ্চদামে বিকোনো সম্ভব। জানেন কিনা, ভালুকের মল হতে প্রাপ্ত কফি বিন দিয়ে বানানো একধরনের কফি মেলে পশ্চিমে। অতি দুর্মূল্য (এবং নাকি সুস্বাদু।) ফেসবুক ও ইনস্টা মিরপুরকে ঢাকার স্ট্রিট ফুড আর রুফটপ কালচারের সাংস্কৃতিরক রাজধানী বানিয়ে ছেড়েছে। অথচ, আপনি বাস্তবে যদি এখানে আসেন, আর সেই স্বর্গের খাবার আস্বাদন করেন, পকেটের কড়ির গচ্চাই শুধু হবে। স্বাদ, দাম ও হাইজিন-সে যেন দুস্টু জ্বীন।
প্রচারনা, প্রোপাগ্যান্ডার জোরে যেই পৃথিবীতে মানবিকতা, গণতন্ত্র, সন্ত্রাসবাদ, মানবাধিকার-এসবই বিক্রী হয়, সেখানে ব্যক্তি পর্যায়ের হাইপ, ভাইরাল আর হিড়িক বা মাতামাতি তুলে কাজের আলীর কাজু বাদাম যদি ‘ক্যাশুনাট’ হয়েই বসে, তাকে দোষ দেয়া যায় না। সেই ভাতের বড়ির গল্পটা মনে আছে তো? ব্র্যান্ডিংয়ের হাত ধরে ভুরুঙ্গামারীর আক্কাসও হয়ে যায় ’আকাশ’, অথবা, আমাদের ল্যাংটো কালের দোস্ত আদিত্যনাথ গাঙ্গুলি হয়ে যায় ’আঁদি’।
অনেক পন্থাতেই আপনি পৃথিবীতে আপনার অনেক রকম ফুটপ্রিন্ট রেখে যেতে পারেন। ভাল কিছু করেও। খারাপ কিছুও। চয়েজ আপনার। চাচিকে বিয়ে করেও নাম ফুটানো সম্ভব, আবার ১০টি পথকুকুরের মা হয়েও।

মন্তব্য ৫ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (৫) মন্তব্য লিখুন

১| ১৯ শে জানুয়ারি, ২০২৩ সন্ধ্যা ৬:৩৪

কামাল১৮ বলেছেন: খুবই সুন্দর লিখেছেন।প্রতিটা বিষয়েই গুছিয়ে লিখেছেন।যেটা পেলাম না সেটা হলো জ্ঞান আসলে কি?জ্ঞান কেমন যদি সেটাই না জানি তবে জ্ঞানি হবো কি করে।

২০ শে জানুয়ারি, ২০২৩ সকাল ৯:২২

বেচারা বলেছেন: এতো বড় কঠিন প্রশ্ন হল। যার নিজের জ্ঞান নেই, সে কী করে জ্ঞানের সংজ্ঞায়ন করবে?

আমার কাছে, জ্ঞান হল তথ্য, সত্য, ডেটা, অভিজ্ঞতা, কল্পনা, চিন্তা ও বোধের একটি সম্মিলিত রুপ, যা মানুষকে ভাববার, বিশ্বাস তৈরীর, সৃষ্টি করবার ক্ষমতা এনে দেয়। হ্যা, আরেকটু বলা যায়, যে, জ্ঞান অবশ্যই ইতিবাচক জ্ঞান, যা বৃহত্তর মানব জাতির বা সভ্যতার উন্মেষ ঘটায়। যা কিছু সভ্যতাকে ধ্বংস করবে, তাকে জ্ঞান না বলে দুর্বুদ্ধি বলা চলে।

২| ১৯ শে জানুয়ারি, ২০২৩ রাত ১০:০৮

রাজীব নুর বলেছেন: প্রজ্ঞবান হওয়ার আগে জ্ঞানী হতে হয়।

২০ শে জানুয়ারি, ২০২৩ সকাল ৯:২৩

বেচারা বলেছেন: জ্বি। প্রকৃষ্টরুপে জ্ঞান=প্রজ্ঞা।

৩| ২০ শে জানুয়ারি, ২০২৩ রাত ৯:২৭

কামাল১৮ বলেছেন: অনেকটাই ঠিক বলেছেন,তবে১০/১০ না।কিন্তু সৃষ্টি তো বুঝলাম না।আমি একটু কম বুঝি তো।বিরক্ত হচ্ছেন নাকি।এ আবার কোন লোকের পাল্লায় পড়ালাম।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.