নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি কেউ নই, আমি আমার নই, আমি তোমার নই, আমি তুমিও নই

বেচারা

Walid

বেচারা › বিস্তারিত পোস্টঃ

গফুর, কুবের আর মহেষের কোরবানি

২৯ শে জুন, ২০২৩ রাত ৯:৫৭

পূজার নৈবেদ্য বিক্রেতা নিজেই যখন পূজার অধিকার পায় না, তখন সেই পূজা কি কিছুটা হলেও রং হারায় না?

কী বলেন?

কী নিয়ে বললাম, সেটা আরেকটু এগোলে হয়তো জানতে পারবেন।

তার আগে আমার গরুর হাটের একমাত্র অভিজ্ঞতাটা বলি।

জীবনে এ পর্যন্ত একবারই পশুর হাটে গিয়েছি। সে বহু বছর আগে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলে থাকি তখন।

একদম শেষ সময়ে বাড়িতে গিয়েছি। বাবাই কাজটি সবসময় করলেও সেবার কোনো কারনে তিনি যান নাই।

আনাড়ি আমি একাই সদরের পার্শ্ববর্তি এক বাজারে গেলাম কোরবানির পশু কিনতে। আগের অভিজ্ঞতা শুন্য। এমনকি এক টুকরো কচু আনাজ কিনবার অভিজ্ঞতাও যার নেই। গ্রামের সেই হাটে যখন পৌছালাম, সেখানে রাজধানীর অভিজাত পশু বাজারের ঝকমারি নেই। খুবই ক্ষুদ্র একটি বাজার। হাতে গোণা কিছু গরু ছাগল বাঁধা।

আমি বাজারের এ মাথা হতে ও মাথায় একটা ঘুল্লা দিলাম। শেষ মাথায় একটা ছাগল পেলাম (ছাগলই বললাম, কারন, আজই তিন ইউটিউব মোল্লাকে বিতর্ক করতে দেখলাম, যে, পাঁঠা হালাল ভারসাস খাশি হালাল।) চোখের দেখায় মনে হল, আকার ও প্রকার ভালই। আমি দাম জানতে চাইলাম। (সম্ভবত হাজার সাতেক ছিল তখন।) আমি মিনিট তিনেক দামাদামি করে সেটা নিয়ে একটা ভ্যানে চড়লাম। বাজারে প্রবেশ হতে প্রস্থান-মোট সময় সম্ভবত ১৫ মিনিট।

এই ছাগল কোরবানি দেবেন আমার মা ও বাবা। কোরবানির মালিক মহান আল্লহ। আমি তার আকার, বস্তুগত ওজন ও দাম নিয়ে ভাববার কে। ছাত্র আমার সামর্থে যে টাকা আছে, সেই টাকায় যা পাই তাই। কম বা বেশি বা জেতা-হারা তো সবই আল্লহ’র, আমার ভাবনার দরকার কী? ব্যাস, এটাই জীবনের এ যাবতকালের প্রথম ও একমাত্র অভিজ্ঞতা।

হাল জামানায় ফেরত আসি।

যে পথে অফিসে যাই, সেই পথে একটা বাজার বসেছিল। ঈদের ৪ দিন আগেও সকালে যাবার সময়ে মাইকে বলতে শুনলাম, “রাস্তায় বাজার বসাবেন না। এলাকার টহলরহ পুলিশকে বেশ তৎপর দেখলাম রাস্তা ফাঁকা রাখতে। বঙ্গদেশের আশায় মরা বোকা জনগনের মতো আমিও বিশ্বাস করেছিলাম সেই ঘোষনায়।

সন্ধ্যায়ও তাই ফিরছিলাম সেই পথ ধরে।

O M G!

পুরোটা রাস্তা দুই পাশ হতে গরু ও ছাগলের দখলে। মূল বাজার ছাপিয়ে ১.৫ কিলোমিটার এলাকা গরু-ছাগল ও আনুসঙ্গিক পণ্যের দখলে। গাড়ি চলবার উপায় প্রায় নেই। সকালের বিশ্বাস মুহূর্তেই উবে গেল। তবু মানুষের উচ্ছাসের শেষ নেই। এই উচ্ছাসের মধ্যে আমাকে পেয়ে বসল অন্য ভাবনায়।

ধরুন, সিটি কর্পোরেশন (আসলে তারাও সরকার) নির্ধারিত বাজারে পশুর হাঁট বসানোর ব্যবস্থা করেছে। সবরকম আয়োজন ও নিয়মকানুনসহ।

তো, কেউ যদি সেই হাঁটে না নিয়ে হাঁটের ১ কিলোমিটার আগে হতে হাঁটতক যে রাস্তা, সেটার দুই পাশে লাইন দিয়ে গরু-ছাগল বেঁধে রেখে বেঁচাকেনা করে, হাসিল ও কর ফাঁকি দিয়ে, সেটা কি পাপ হবে? সেই পাপের আয় কি হালাল হবে?
যদি পাপ হয়, তাহলে সেই পাপের ফসল গরু-ছাগল কি হালাল হবে? নাকি হারাম? মানে, সেই অবৈধ স্থানে বেঁচাকেনা করা পশু কেনা কি জায়েজ হবে? যদি জায়েজ না হয়, তাহলে সেই পশুতে কোরবানি সহিহ হবে?

যদি উত্তর দিতে সংশয়ে পড়েন, বা মনে করেন, ’জালিম আম্লীগ ছ্যাড়কাড়ের’ আদেশ না মানাই তো জেহাদ, তাহলে বেশি চাপ নেবেন না।

শুধু যদি একটু বলে দেন, যে, এই যে, এত বড় একটা হাঁট থাকতেও মিরপুর-১৩’র মার্কস এর মোড় হতে কচুক্ষেত বাজার তক রাস্তার দুই পাশে গরু লাইন দিয়ে বেঁধে পথেই বাজার বানিয়ে ওই স্থান দিয়ে চলাচলকারী লক্ষ লোকের জীবনে (বিশেষত অফিস ছুটি হয় নাই আর ওখান দিয়ে গুলশান বনানীতে অফিস করতে যান লক্ষ লক্ষ মানুষ) কেয়ামত নামিয়ে আনার কাজটা যেসব ব্যপারী, ধান্দাবাজ ও পূর্ণার্থীরা করছেন ও করবেন-তাদের মানসিকতাটা ঠিক কী?

একই কথা প্রযোজ্য কোরবানি দেবার পরের চিত্রে। আল্লহ’র আদেশ পালন, তাকে উৎসর্গ করবার প্রথাকে, একজন নবীর হাত ধরে প্রিয় বস্তুকে উৎসর্গ করবার যে প্রতিকী উৎসব ছিল কোরবানি, তাকে আমরা বহু আগেই শো-অফ, সামাজিক স্ট্যাটাস, প্রেস্টিস সিম্বল তো বানিয়ে ফেলেছিই। ধর্মের ভাব-গাম্ভীর্য, সাম্য ও ত্যাগের মাহত্ম তো বহু আগেই আমরা শিকেয় তুলেছি। (কিছু মানুষ বাদে।)

তবুও কথা রয়ে যায় সামাজিক দায়ীত্বে। শহরের নির্দিষ্ট স্থানে পশু জবেহ ও প্রসেস করবার সরকারী উদ্যোগ তো আতুরেই মরে গেছে। অন্তত নিজ নিজ জবাইয়ের রক্ত, নোংরা ও উচ্ছিষ্ট নিজ দায়ীত্বে রাস্তা হতে অপসারনের যে ন্যুনতম সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দায়ীত্ব-সেটিও আজ তক আমরা অর্জন করতে পারিনি।

নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও সীমাবদ্ধতার কারনে কোরবানির সকালটা ঘরে খিল এঁটে বসে থাকি। প্রতিবারই। রক্ত, রক্তপাত, জবাই, কাটাছেড়া আমার সহ্য হয় না। (হ্যা, আমি ভেগান নই। আমি পশুপ্রেমী, তবে পশু জবাইয়ের একচ্ছত্র বিরোধীও নই।) কিন্তু, চোখের সামনে বিষয়টা নিতে পারি না। দুপুরের একটু পরে বের হয়েছি দু’জন মুরব্বীকে দেখতে। এলাকার প্রতিটি রাস্তা, গলি, উপগলি, বাসার পর্চ দলা দলা কালচে রক্ত, চর্বি, চামড়া, নানা উচ্ছিষ্ট, গোবর, পাটি, গরুর স্টমাকের বা উদরের টাটকা ময়লা, শিং, হাড়, ঘাস, পঁচা খড়-ইতস্তত পড়ে আছে। কেউ কেউ পানি ছিটিয়ে কিছুটা পাপ স্খলন করেছেন। তবে সেটাও দায়সারা।

আমরা এমন কেন?

বারান্দা হতে একবার উঁকি দিয়েছিলাম। ছোট ছোট শিশুরা পশু জবাই ও কাটাকুটির একদম রক্তাক্ত দৃশ্যটাতে সরাসরি দর্শক। ওয়েল, আপনার দ্বিমত থাকতে পারে। এই সেদিনই এক ভদ্রলোকের ফেসবুক পোস্টের মন্তব্যে ফেসবুকে গরুর ছবি নিয়ে ফান পোস্ট কেন এক ধরনের পাবলিক নুইসেন্স সেটা নিয়ে বলছিলাম। তিনিও তার স্ট্যান্স বলেছেন। হ্যা, প্রত্যেকেরই বাক স্বাধীনতা রয়েছে। রয়েছে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি। সেই মন্তব্যটি তুলে দিই। সময় থাকলে একটু পড়বেন।

[গরু বা ছাগলের সাথে ছবি তোলা ও পোস্ট করার যে সমালোচনা হয়, সেটি যে ধর্মের প্রতি এলার্জি হতেই করা হয়-তা সর্বৈব সত্য নয়। এটি করা হয় ভিন্ন প্রেক্ষিত হতেও। যারা এর পক্ষে, তাদের যেমন এটা করা স্বাধীনতা, তেমনি, যারা এর সমালোচক, সেটা করাও তার স্বাধীনতা। একই উন্মুক্ত মাধ্যমে যদি কেউ বিরাজ করেন, কিছু পোস্ট করেন, তাহলে সেটি নিয়ে নিজস্ব পর্যালোচনা দেয়া প্রত্যেক পাঠকের স্বাধীন অধিকার (অবশ্যই একটা নর্মস মেনে।) সেই প্রতিক্রিয়া দেবার সমালোচনা করা কিন্তু, বাক স্বাধীনতাকে নিরুৎসাহিত করাই হয়।

এই সমালোচনার প্রেক্ষিত হল, এই জবাইয়ের জন্য অপেক্ষারত প্রাণীটির সাথে ছবি তুলে, আনন্দ, উচ্ছাস বা সুখ প্রকাশ-এই প্রাণীটির প্রতি অসম্মান, এবং এগুলো ধর্মীয় মাহাত্ম্য ও গাম্ভির্যের খেলাফ বলে বিশ্বাস করেন কেউ কেউ। আপনি নিশ্চয়ই আপনার মৃত প্রিয়জনের সাথে মুখখোলা সেলফি তুলে পোস্টকে হজম করতে পারবেন না। অথবা, একজন স্বজন, যে কয়েকদিন পরে ফাঁসিতে ঝুলবে, তার সাথে জেলে ছবি তুলে পোস্ট করাকে আপনিও সহজভাবে নেবেন না।

এই যেমন, আপনি সুস্থ সবল পশুর সাথে ছবি তোলাকে ঠিক মনে করেন, কিন্তু, আবার রক্তাক্ত, কাটাকুটির ছবি দেয়াকে বেঠিক ভাবেন। ঠিক সেভাবেই, কেউ আরও একটু সুক্ষ্ণ চিন্তার অধিকারী, একটি পশু, যে, কয়েক দিন বাদেই জবেহ হবে, তার ছবি তুলে পোস্ট করাকে পশুটির প্রতি অসম্মান বলে যদি বিশ্বাস করেন ও তা প্রকাশ করেন-তাকে আপনি তীর বিদ্ধ করতে পারেন না।

আপনার একটি খামার আছে, সেখানে একটি গরু কিনলেন, অথবা, একটি গরু বাচ্চা দিল, তার সাথে আনন্দে ছবি তুললেন-এই ছবি, আর, আপনি বাজার হতে জবেহ’র জন্য একটা ষাড় গরু কিনলেন, কয়েক ঘন্টা পরে সেটিকে জবাই করে মাংস খাবেন-সেই গরুটির সাথে ছবি তুলে পোস্ট করাকে কেউ যদি অসম্মান ও ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের প্রতি অশ্রদ্ধা ভাবেন-তাকে ফেলে দেবেন কোন যুক্তিতে? আবার ভাবুন, যে, কোরবাণীর পশুর ছবি পোস্ট করাকে আমি যদি ঠিকঠাক ভাবি, তাহলে আরেকজন যদি আরেকটু এ্যডভান্সড মানুষ হন, আর মনে করেন, জেহাদের পরে ’*কাফের’দের কাটা মাথাসহ ফেসবুকে ছবি দেয়া পূণ্যের কাজ-তখন কী বলবেন? তাকে থামানোর যুক্তি পাবেন?

আরেকটা ক্লু বলি। যারা এই ছবি পোস্টকে সমালোচনা করেন, তাদের আরও একটা যুক্তি আছে। তারা মনে করেন, ফেসবুকে কোরবাণীর পশুর ছবি দেবার মধ্যে নিজের হ্যাডোম প্রকাশের একটা সুক্ষ্ণ চাল থাকে (সবার নয় অবশ্যই।) আপনি তার কিছু প্রমান এটা হতে ভেবে নিতে পারেন, যে, ফেসবুকে প্রকাশিত পশুর ছবি বা সেলফীর ৯৯%ই কিন্তু গরুর। ছাগলের সাথে পোস্ট আপনি প্রায় দেখবেন না। এই ইঙ্গিত হতে যা বোঝার বুঝে নিন।

যারা গরুর ছবি দেয়ার সমালোচনা করেন, তারা অন্য কোনো অসঙ্গতির সমালোচনা করেন না-এটা খুবই জেনারেলাইজড অবজারভেশন। এবং একদমই গবেষনালব্ধ না। তাছাড়া, একটি অন্যায়ের প্রতিবাদহীনতা আরেকটি অন্যায়ের প্রতিবাদহীনতার দাবীকে জাস্টিফায়েড করে না।

”শয়তান প্রতি বছর ভিন্ন ভিন্ন অবয়বে ভিন্ন ভিন্ন প্রগতির ঝান্ডা নিয়ে হাজির হয়।.....দুনিয়ার সবকিছু সোশ্যাল মিডিয়াতে শেয়ার করতে পারবেন, তাতে কোন সমস্যা হবে না কিন্তু ইসলাম ধর্মের কিছু শেয়ার করলেই এদের জ্বলতে শুরু করে।”-----আপনার এই লাইন দুটোর প্রেক্ষিতে বলতেই হল। ফেসবুক ও অন্যান্য বিষয়গুলো আসবার পরে হতে দেখছি, একদিকে মানুষের ধর্মহীনতা তীব্র হয়েছে, আবার, এক দলের ধর্মপ্রিয়তার প্রকাশ তীব্র হয়েছে। সেই সাথে, একটা দলের আবার, ধর্ম রসাতলে গেল-এই আতঙ্কবোধও তীব্র হয়েছে। এই আতঙ্ক অহেতুক।

এই সুবিশাল মন্তব্যকে আপনার সমালোচনা ভাববেন না। আপনি একটা এ্যঙ্গেল হতে ভেবেছেন। আমি অন্য ডাইমেনশনটাও দেখালাম।]

পশু জবাইয়ের মতো একটি কঠোর দৃশ্যে শিশুদের হাজির রাখা কি সত্যিই খুব জরুরী? বিষয়টা কি ধর্মীয়ভাবে অনিবার্য? জানা নেই। আমি তো আল্লামা নই।

প্রতি বছরই কোরবানি এলে ধর্মভীরু, ধর্মপ্রাণ, ধর্মান্ধ, ধর্মবিদ্বেষী, তথাকথিত প্রগতিশীল, সত্যিকারের প্রগতিশীল, কিছু প্রতিক্রিয়াশীল এবং কিছু ব্যতিক্রমী সুক্ষ্ণ চিন্তার মানুষদের মধ্যে কথার একটা যুদ্ধ শুরু হয়। পশু প্রেম ভারসাস খোদা প্রেম নিয়ে। সে হোক।

নানা মুনির নানা মত।

কিন্তু, তাতে কি কারো কিছু আসে যায়? চামড়ার দাম ও তা নিয়ে দুর্বৃত্বের সহায় রাষ্ট্রের তত্বাবধানে আয়োজিত যে মামদোবাজি-তা নিয়ে এখন আর আমাদের কিছুই আসে যায় না। তার বাদেও আমাদের আসে যায় না, যে, এই যে আমাদের কোরবানির নৈবেদ্য, আল্লহ প্রেমের প্রতীক, ত্যাগের প্রতীক পশুগুলো যারা আমাদের জন্য ব্রিড, লালন, পালন করে হাঁটে আনেন, তাদের ভাগ্যে কী ঘটে-তা নিয়ে। যদিও তাদের ভাগ্য আর দুর্ভাগ্যে টিকটকার, ফেসবুকার আর ইউটিউবারদের কপাল ঠিকই খোলে।

কোরবানি ও পশুর হাঁট নিয়ে, দাম-দর, গরুর নানারকম চটকদার ছবি, হাইপ, নানা আকারের হস্তি আকৃতির গরু নিয়ে বুস্টেড পোস্ট নজরে আসে। এক ফাঁকে আরও কিছু ভিডিও দেখি।

গরু, ছাগলের মূল পালনকারী, যারা মূলত ছোট ও প্রান্তিক গৃহস্ত, যারা নিজ সন্তানের মতো একটা দুটো পশু মাতৃ-পিতৃসম ভালোবাসায় পালেন, তাদের সাথে পশুদের ভালোবাসার হৃদয়বিদারক কিছু ভিডিও দেখি। (কিছু তো অবশ্যই হাইপ ও সাজানো।) কিন্তু, তার ফাঁকেও সন্তানতুল্য বাৎসল্য ও প্রিয়জনকে জবাইয়ের জন্য বিদায় দিয়ে হাত পেতে সামান্য কিছু টাকা (যেটাই হয়তো তাদের সারাবছরের ক্ষুদ-জলের খোরাকী) নিতে গিয়ে তাদের বুকফাটা কান্না দেখে মনটা খারাপ হয়ে যায়। কোরবানি যদি কেউ দিয়েই থাকে, সে দেন এই প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র গেরস্তরাই। আর দেয় ওই অবোধ পশুগুলো।

পশুরা কাঁদতে পারে কিনা জানি না। তাদের মালিকরা তো পারেনই। তাদের কান্না ফেসবুকের মতো ফেকবুক ছাপিয়েও চোখ ভিজিয়ে দেয়। আমার আম্মার গরু-বাছুর পালন কালের সেই দিনের কথা মনে পড়ে যায়। কখনো কোনো একটা গরু বিক্রী করতে হলে আম্মা সপ্তাহখানেক কাঁদতেন। খেতে পারতেন না।

প্রারম্ভিকার প্রসঙ্গটাতে একটু যাই।

চামড়ার বাজার যেমন চলে গেছে মুনাফাখোর সিন্ডিকেটের উদরে, তেমনি দিনকে দিন পশুর বাজারও তাদের লোভের করাল গ্রাসে যাবার ব্যবস্থা দিনকে দিন পাকা হচ্ছে। সবার অজান্তে, কিংবা সামনেই। ’দেশীয় উৎপাদক’দের স্বার্থরক্ষায় আমদানি বন্ধ। কিন্তু, সেই দেশীয় উৎপাদকরা কি পাচ্ছেন তাদের ভাগ্যবদলের দেখা?

বিশাল সব কর্পোরেটদের বিপুল পুঁজি আর বাহুবলের কাছে লালমনিরহাট, সিরাজগঞ্জ কিংবা নেত্রকোণার জমির আলি কিংবা সদরুদ্দির ভাগ্য যেই তিমিরে, সেই তিমিরেই।

সারা বছর, তারা নিজেরা না খেয়ে গরুকে খাওয়ান। নিজেরা বৃষ্টিতে ভিজে গরুকে শুকনো রাখেন। ধার, দেনা করে পশু বড় করেন। তারপর সেই গরু হাঁটে তোলেন দুটো পয়সার আশায়। ওদিকে শহুরে পয়সাওয়ালা পূণ্যার্থীরা সস্তায় ও সুবিধায় ঘরে বসে সেই পশু কিনে মহামহিমকে নৈবেদ্য দিতে হাঁটে যান। ফেসবুকে, ইউটিউবে সস্তায় বেশি ওজনের মোলাম গোসের গরু কেনার শত শত টিউটোরিয়াল। ইউটিউবাররা ভ্লগ বানান। ব্যপারীর গরু হাটে মরে, ঘাটে মরে, নদীতে ডোবে। অদৃশ্য সিন্ডিকেটের কোপে পড়ে গরুর দাম প্রত্যেকবার পানির দামের সমান পড়ে যায়। মানুষ সেই সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। কম দামে ভারী গরু কিনতে পেরে আনন্দে আটখানা হয়ে পূণ্যার্থীরা ঘরে ফেরে।

ওদিকে প্রিয়তম স্বজনকে অন্যের হাতে তুলে দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে ঘরের পানে ছোটে। হ্যা, মাত্রাতিরিক্ত হাইপ আর অতি লোভে ওভারপ্রাইসিং বা বিডিং অবশ্যই হয়। কিন্তু, সেটা কতটা? কতজন?

তার বিপরীতে ওই ক্ষুদ্র গেরস্ত, প্রান্তিক কৃষক তার উৎপাদিত পণ্যটির ন্যায্য দামটা পান কি?

গরুর হাটের ভেতর দিয়ে অফিস যেতে যেতে আমি হাটের ব্যাপারীদের দেখি। এই মানুষগুলো যেন একদিকে ঈশ্বরের দূত। আবার, যেন তারাই ওদিকে ঈশ্বরের বাস যেই ভদ্রপাড়ায়, তার বিপরীতের ছোটলোকদের পাড়ার শরৎ চন্দ্রের মহেষ আর গফুরের আখ্যানের কুশিলব। অথবা মানিক বন্দপাধ্যায়ের কুবের, যে প্রতিনিয়ত শেতল বাবুদের সস্তায় ইলিশ জুগিয়ে যায়।

হাটে আসা গরীব গেরস্ত মানুষগুলো হাটের ক’টা দিন হাটের পলিথিন দেয়া চালার নিচে গরুর সাথেই দিন-রাত কাটায়। তাদের গরুর সাথে তারা নিজেরাও অমানবিকতম পন্থায় গ্রাম হতে সুদূর শহরে আসে অবর্ননীয় যাত্রাপথ পাড়ি দিয়ে। গরুগুলো রওনা হয় শবযাত্রায়। রোদে পোড়ে, বৃষ্টিতে ভেজে।

হাটের ছাপড়ার নিচেও তারা রোদ-বৃষ্টিতে গরুর সাথেই সাম্যবাদ রক্ষা করে যায়। সাথে করে আনা হাড়িতে দুটো ডাল-চাল ফুটিয়ে আলু সেদ্ধ পোড়া লঙ্কায় মাখিয়ে তারা তিন বেলা কোনোমতে খায়। নাওয়ার উপায় নেই, খাওয়ার ঠিক নেই। কোথায় ঘুমাবে, কোথায় বাথরুম, কোথায় সামান্য আরাম-কিছুর ঠিকানা নেই। হাটের দিনগুলোতে তারা যেন হয়ে পড়ে মূর্তিমান হারকিউলিস।

এত কিছু করেও তারা কোনোদিন হয়ে উঠতে পারে না কোটিপতি। প্রায়শই শোনা যায়, তারা তুলতে পারে না উৎপাদন খরচ। দুটো বাড়তি টাকা আয়ের আশায় বড় শহরের বড় বাজারে এসে উল্টো ক্ষতিতে পড়েন তারা। লাভের মুখ দেখেন হাটের ধনী ইজারাদার আর পূর্ণ্যার্থীরা।

এই প্রান্তিক কৃষকরাই দেশের হিরো। সব সেক্টরে। অথচ, তারা এই পূণ্য উৎসবের মূল শিল্পী হয়েও কোনোদিন নিজেরা একটা কুরবানি দিতে পারেন না। অন্যের পূণ্য অর্জনের নৈবেদ্য সৃজন করে তাকে অশ্রুসজল চোখে কৃপাণের তলায় যাবার জন্য বিসর্জন দিয়ে নিজেরা ঘরে ফেরে যৎসামান্য টাকা হাতে নিয়ে। চাঁদ রাত শেষ করে ইদের দিন বা তার পরদিন। কখনো, কোনোদিন কি ভেবে দেখেছেন এই দিকটা?

ওদিকে কৃষকের স্ত্রী, পূত্র-কন্যা, বাবা-মা পথ চেয়ে বসে থাকেন। কৃষক শহর হতে ঘরে ফিরলে তবেই তাদের ঘরে চাল-ডাল আসে। হয়তো সামান্য ব্রয়লার মুরগী কারো ঘরে আসে। বেশিরভাগের সেটাও না। সেই মোটা চাল, আলু ভর্তা, ডালের পানি দিয়েই তাদের ইদ পালন হয়।

এ যেন পূজার নৈবেদ্য’র শিল্পীর নিজেরই পূজার অধিকার বিসর্জন।

ভাল কথা, এ বছর বেশ ক’টা লেখা পড়লাম, যেখানে কোরবানির পশুর মাংস পুরোটাই যে কোরবানি দাতা নিজেই ভোগ করতে পারবেন, এবং সেটাই যে রীতি-তাকে প্রমোট করা হয়েছে। আমি যেহেতু আল্লামা না, তাই ধর্মীয় বিধান কী-সেটাতে যাব না। তবে, এই যে, সারাটা বছর কোরবানির মাংসের আশায় থাকা মানুষদের জন্য এ যেন এক চপেটাঘাত, বিশেষত এই দুর্মূল্যের বাজারে। প্রতি বছরই নতুন নতুন শ্রেনীর মানুষ এই দলে যুক্ত হচ্ছেন। কিছু বছর আগে যে মধ্যবিত্ত সমাজের সবাইকে দিয়ে থুয়ে কোরবানি করতেন, আজকে অবশ্য তাকেও বাধ্য হতে হচ্ছে, ভাবতে, আগের সেই সামাজিক সাম্য ও বন্টন কতটা তিনিই বা করতে পারবেন, যেখানে, তারা নিজেরাও এখন সারাবছর নিয়মিত দামী ও বিলাসী গরুর মাংস খেতে পারেন না। তাদেরও দোষ দিই না।

আজ বিবিসির একটা আর্টিকেল পড়ছিলাম। মাংস সংগ্রাহক মানুষগুলোর কথা নিয়ে। কতটা অসহায় ও নিরুপায় এই মানুষগুলো থলি হাতে বাড়ি বাড়ি দৌড়ান। (এখানেও বলি, এদের একটি ক্ষুদ্র অংশ মাংস বিক্রী করেন।) ধরে নিলাম, ধর্মে বাধ্য করা হয়নি। কিন্তু, এই খুব ছোট রীতিটা (তিন ভাগ করার) যে একটা বিপুল সামাজিক সাম্য ও শেয়ারিং তৈরী করেছে, সেটাকে হালকা ও কার্যত মুছে দেবার একটা ধাক্কা যে অচীরেই আসছে-তা আন্দাজ করছি। এমনিতেও, আজকাল নাকি মানুষ কোরবানির মাংস খুব একটা গরীব বা আত্মীয়দের দেন না। ফ্রিজের বিক্রীর হার আর নানামুখী সামাজিক মাধ্যমের লেখালিখি হতে তো সেটাই আন্দাজ করা যায়।

যেই বুদ্ধিমান ও চতুর মানুষেরা কম দামে বেশি ওজনের গরু কিনে এবছর জিতেছেন, তাদের অভিনন্দন। তা, আপনার মাংসের কেজি কত পড়ল? আজকাল তো লাইভ ওয়েট জেনেই গরু কেনা যায়। দাঁত দেখে বয়স, লেজে মোচড় দিয়ে ’পাছা’ হাতিয়ে মাংসের আন্দাজ করার ঝামেলা ও ঠকার ঝুঁকি আর নেই। বেশ তো!

যারা কোরবানি দিতে পারেন নাই, অথচ একসময় দিতেন, তাদের দিন কেমন কাটছে জানি না। সামাজিক অবনমনের চাপ তুড়ি দিয়ে উড়িয়ে দেয়া এত সহজ না। ওসব বইয়েই থাকে। সমাজ বড় নিষ্ঠূর। সে পদে পদে আপনাকে হেয় করতে, ঠোকরাতে উদ্যত।

তবে দমে যাবেন না। আপনাদেরও সহযাত্রী ও সহমর্মী রয়েছে। সে ওই প্রান্তিক গেরস্তরা। তাদেরকে আপনাদের গুমরে মরা শোকের যাত্রায় পাশেই পাবেন। যারা সাজিয়ে গুছিয়ে শহুরে ধনীদের হাতে তাদের প্রাণাধিক প্রিয় সন্তানদের তুলে দিয়ে ঘরে ফেরে আদতে নিঃস্ব হয়েই। কোরবানি দিতে না পারার দুঃখ অবশ্য তাদের নেই। ওই দামী পূণ্য অর্জনের স্বপ্নও তারা স্বপ্নেও দেখেন না।

এই দীর্ঘ ওডেসি যদি সত্যিই আপনি শেষ লাইন তক পড়েই থাকেন, তাহলে আপনাকে মহামহিম সৃষ্টার আশির্বাদময় এক ত্যাগের উৎসবের শুভ কামনা। আর যদি আপনার এত কথার পরেও প্রশ্ন করতেই মন চায়, “ব্যাটা কি কোরবানিকে টুইস্ট করতে চাইল? সে কি তবে ছদ্মবেশী তথাকথিত ‘পশুপ্রেমী’? তাহলে আপনাকে পেন্নাম কত্তা।

মন্তব্য ৮ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (৮) মন্তব্য লিখুন

১| ৩০ শে জুন, ২০২৩ রাত ১২:০০

কামাল১৮ বলেছেন: হালাল হারাম দিয়ে কোন কিছু বিচার করা ঠিক না।বিচার করতে হবে ন্যায় হলো না অন্যায় হলো।

৩০ শে জুন, ২০২৩ সকাল ৯:৫৪

বেচারা বলেছেন: জ্বি। ভাল বলেছেন।

২| ৩০ শে জুন, ২০২৩ সকাল ১১:৪১

জু েয়ল বলেছেন: আমি পাপ পুন্য বুঝি না, আমি বুঝি ন্যায় অন্যায়, মানবিক অমানবিক। তাই আমি সব সময় কামনা করি মানুষ তুমি ধার্মীক হবার আগে মানবিক মানুষ হও।

০১ লা জুলাই, ২০২৩ দুপুর ১২:৫৪

বেচারা বলেছেন: সেটাই সবার আগে।

৩| ৩০ শে জুন, ২০২৩ বিকাল ৩:২১

বিজন রয় বলেছেন: অনেক দিন পর বেচারার লেখা পড়লাম। বেচারা!

০১ লা জুলাই, ২০২৩ দুপুর ১২:৫৫

বেচারা বলেছেন: লেখা একটু কমে গেছে। পড়বার জন্য ধন্যবাদ।

৪| ০১ লা জুলাই, ২০২৩ দুপুর ১২:৪৭

রাজীব নুর বলেছেন: আসলে আপনি ক বলতে চাচ্ছেন?

০১ লা জুলাই, ২০২৩ দুপুর ১২:৫৫

বেচারা বলেছেন: আপনার কী মনে হয়, কী বলতে চেয়েছি?

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.