![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি নিতান্তই একজন সাধারন মানুষ।সৃষ্টকর্তার কাছে শুকরিয়া আমাকে পরিপূর্ণ জীবন দানের জন্য।
ফারাক্কা বাঁধের আদ্যোপান্ত
মোটামুটি প্রতি বছর বর্ষাকালে নিউজ পোর্টাল এবং টিভিতে শিরোনামে দেখতে পাই, গঙ্গা-পদ্মা অববাহিকায় পানি ১০ সেমি, ২০ সেমি বিপৎসীমার উপর দিয়ে বইছে। এ বয়ে যাওয়া পানি হাজারো মানুষের স্বপ্নভঙ্গ আর আহাজারি, দুর্দশার জন্য খলনায়ক। ভারত বর্ষাকালে ফারাক্কা বাঁধের গেট খুলে দেয়া, অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত কিংবা নদীর তলদেশে জমে যাওয়া পলিমাটিকে অনেকে দায়ী করেন। কিন্তু ফারাক্কা বাঁধ কি? আর ভারত তাদের গেট খুললে সেটা কেন আমাদের উত্তরাঞ্চল সহ বিভিন্ন জেলায় প্রভাব পড়ে?
বাংলাদেশের চাপাইনবাবগঞ্জ থেকে ১৮ কিমি দূরে ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলায় গঙ্গা নদীর উপর অবস্থিত ফারাক্কা বাঁধ।।। ১৯৬১ সালে গঙ্গা নদীর উপর এ বাঁধ নির্মাণ শুরু হয় এবং ১৩ বছর নির্মাণকাল শেষে ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরে এ বাঁধ উদ্ভোধন করা হয়।। বাঁধটির দৈর্ঘ্য ২.২৪৫ কিমি এবং এতে ১০৯ টি গেট আছে।।। এছাড়া বাঁধের উপর জায়গা সড়ক এবং রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা বিদ্যমান।।। এ ছাড়া ফারাক্কা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় পানির চাহিদা এখান থেকে মিটানো হয়।।।
১৯৫০-৬০ এর দশকে কলকাতা বন্দরের কাছে হুগলী নদীর তলদেশে জমে থাকা পলি ধুয়ে পরিষ্কার করার জন্য প্রাথমিকভাবে এ বাঁধের প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। উল্লেখ্য, এংকোরেজ তথা দূর সমুদ্র থেকে জাহাজ বন্দরে ভিড়ার জন্য পানির নুন্যতম গভীরতা থাকতে হয় যাকে ড্রাফট বলা হয়। এছাড়া নদীর পানির ঘনত্ব সাগরের পানির চেয়ে তুলনামূলক কম হওয়ায় জাহাজ সাগর থেকে নদী মোহনায় ঢুকলে জাহাজের অপেক্ষাকৃত বেশি অংশ ডুবে যায়। এছাড়া চ্যানেল বা নদী মোহনায় জাহাজ চলাচলের জন্য প্রয়োজনীয় গভীরতা না থাকলে কিংবা তলদেশে বেশি পরিমাণে পলিমাটি বা কাদা থাকলে, বর্ণিত স্থানের ড্রাফট বা পানির গভীরতা কমে যায় এবং জাহাজের তলা আটকে যেতে পারে তলদেশের সাথে, ফলে জাহাজ আর চলতে পারে না।। একে গ্রাউন্ডিং বলা হয়। এ গ্রাউন্ডিং প্রতিরোধ করার জন্য এবং সুন্দর নৌ চলাচলের ব্যবস্থা করার জন্য তখন নদীর তলদেশে জমে থাকা পলিমাটি নিঃসরণ প্রকল্পে এ পদক্ষেপ নেয়া হয়।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে গঙ্গার পানি বন্টন নিয়ে আলোচনা শুরু করেন এবং এর ধারাবাহিকতায় ১৯৭৪ সালের ১৬ মে বঙ্গবন্ধু এবং ইন্দিরা গান্ধী ফারাক্কা বাঁধ নিয়ে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, উভয় দেশ একটি চুক্তিতে সম্মত হবার আগে ভারত ফারাক্কা বাঁধ চালু করবে না এবং বাঁধের একটি অংশ পরীক্ষা করার জন্য বাংলাদেশ মাত্র ১০ দিনের জন্য ভারতকে ফারাক্কা বাঁধের পানি চালু করার অনুমতি দেয় এবং সর্বোচ্চ পানি প্রবাহের পরিমাণ নির্ধারণ করে দেয় ৩১০-৪৫০ কিউসেক পানি ( Cubic foot per second, তরল পদার্থকে প্রধানত আয়তনে হিসাব করা হয় এবং পরে উক্ত তরলের আপেক্ষিক ঘনত্ব দিয়ে গুণ মোট ভর নির্ণয় করা যায়) কিন্তু ভারত ১৯৭৬ সালের শুষ্ক মৌসুম পর্যন্ত গঙ্গা নদী হতে প্রায় ১২০০ কিউসেক পানি অপসারিত করে পশ্চিমবঙ্গের হুগলি, ভগীরথী নদীতে প্রবাহিত করে। ভারতের এ অন্যায় আচরণ জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে আলোচনা বা তীব্র নিন্দা করা হলেও ভারত তা গায়ে মাখে নি। এরপর ১৯৭৮, ১৯৮২, ১৯৮৫, ১৯৯২ সালে স্বল্প মেয়াদী পানি বন্টন চুক্তি করা হলেও ভারত কোনবার চুক্তি তথা এগ্রিমেন্টের মান রাখে নি। এরপর ১৯৯৬ সালে ৩০ বছর মেয়াদী গঙ্গার পানি চুক্তি করা হলেও তাও এখন মানছে না ভারত, ভারত বাংলাদেশের চুক্তি অনুসারে নদীতে ৭০ হাজার কিউসেক পানি থাকলে উভয় দেশ ৩৫ হাজার কিউসেক পানি পাবে আর ৭৫ হাজার বা তার বেশি কিউসেক পানি থাকলে ভারত পাবে ৪০ হাজার কিউসেক আর বাংলাদেশ বাকিটা পাবে। কিন্তু ভারত এসবের তোয়াক্কা না করে নিজেদের খেয়াল খুশিমত নদী থেকে পানি অপসারণ এবং অতিরিক্ত পানি ফারাক্কা বাঁধের গেট খুলে দিয়ে বাংলাদেশে অসময়ে পাঠানো এগুলো নিত্যকার দৃশ্য। যার ফলে, প্রতিবছর শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে তীব্র খরা এবং বর্ষায় তীব্র বন্যা দেখা যায় এবং যারা উত্তরবঙ্গের তারা এসব হাড়েহাড়ে টের পায়। ভারতের এসব স্বেচ্ছাচারিতায় বাংলাদেশ একাই নয়, ভারত নিজেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তীব্রভাবে।।।
ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের আগে দুইদেশের পানি বিশেষজ্ঞরা বলেন, পদ্মা কিংবা গঙ্গার মত এত বড় নদীগুলোর গতিপথে বাঁধ দিয়ে বিঘ্নতা ঘটালে নদীর উজান এবং ভাটি উভয় অঞ্চলের প্রাকৃতিক ভারসাম্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং এরফলে বন্যা, খরা এসব সাধারণ দৃশ্য হবে।।।তবে তৎকালীন ভারত সরকার এসবে পাত্তা না দিয়ে ফারাক্কা প্রজেক্ট নেয় এবং ফারাক্কা হতে পশ্চিমবঙ্গের হুগলী, ভাগীরথী নদী পর্যন্ত প্রায় ৪০ কিমি ফিডার খাল খনন করে। এ অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত এবং প্রকল্পের খেসারত দিতে হচ্ছে বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গ এবং ভারতের পশ্চিম বঙ্গ এবং বিহারের কয়েক কোটি মানুষ যারা পরিবেশ বিপর্যয় সংক্রান্ত দুর্যোগের সাথে সরাসরি ভুক্তভোগী। বাঁধের ফলে বাংলাদেশের পদ্মা নাব্যতা হারিয়েছে ২৫০০ কিমি নদীপথ এবং ৪৯ টি শাখা নদীর অস্তিত্ব বিলীন হয়েছে; এছাড়া শুষ্ক মৌসুমে এক টুকরো খন্ড জলাশয়ে পরিণত হল। গঙ্গার উজানে বিহার এবং উত্তর প্রদেশ এবং ভাটিতে সুন্দরবন পর্যন্ত বিপর্যয় সুস্পষ্ট। বাঁধের প্রভাবে পলি জমে বন্যা দেখা যায়। এ বাধেঁর কারণে এক সময়ের পদ্মা আজ অনেক বড় বিপর্যয়ে।
শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গার পানি অপসারণের ফলে বাংলাদেশের কৃষি, মৎস্য, বন, শিল্প, নৌ পরিবহণ প্রভৃতি ক্ষেত্রে ব্যাপক লোকসান হচ্ছে যা আর্থিক হিসাব করলে প্রায় তিনশ কোটি মার্কিন ডলার বা পঁচিশ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি।। শুষ্ক মৌসুমে দেশের ৩২০ কিমি নৌপথ চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। এছাড়া পদ্মার অববাহিকায় পানিপ্রবাহ কমে যাওয়ায় বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের চাপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী ভুগর্ভস্থ পানির স্তর ৬০-৬৫% নিচে নেমে গেল। শুষ্ক মৌসুমে পানির এমন অভাবে মাটির আর্দ্রতা কমে গেল এক তৃতীয়াংশ, এছাড়া আর্দ্রতার অভাবে দিনের সর্বোচ্চ এবং সর্বনিম্ন তাপমাত্রার পার্থক্য বাড়ে অনেক। এছাড়া এমতাবস্থার কারণে এককালের গড়াই নদী আজ প্রায় বিলুপ্ত। পানিপ্রবাহ কমে যাওয়ায় নদীর নাব্যতা কমে গেল, ফলে এখন বর্ষাকালে সামান্য বৃষ্টিতেই অনেক বন্যা হয় যা উত্তরাঞ্চলবাসী প্রত্যক্ষ করে প্রতিবছর।
বছর তিনেক আগ থেকে ফারাক্কার বিরুদ্ধে ভারতেও জনমত জোরালো হল কারণ এ ফারাক্কা ভারতীয় কিছু অঞ্চলের জন্যেও গলার কাঁটা। যে কলকাতা বন্দর টিকিয়ে রাখতে এ ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ তার সত্ত্বেও সেটা কলকাতা বন্দরের তেমন কাজে আসছে না। বন্দরের কাছাকাছি চ্যানেলগুলোর নাব্যতা টিকিয়ে রাখতে প্রতিনিয়ত ড্রেজিং (ড্রেজার দিয়ে পানির তলদেশ হতে পলি সরানো) করতে হচ্ছে; ফারাক্কা চালু হবার আগেও এত ড্রেজিং দরকার পড়ত না। ফারাক্কা বাঁধের দরুণ সৃষ্ট বন্যা প্রতিরোধকল্পে ২০১৭ সালের বিহারের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার ফারাক্কা বাঁধ ভেঙ্গে ফেলার জন্য আহবান জানান। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা মত দিলেন, যেহেতু বাঁধের উপর সড়ক ও রেলপথ বিদ্যমান, কাজেই বাঁধ না ভেঙ্গে শুধুমাত্র যে গেটগুলো আছে তা অপসারণ করে দিতে যাতে করে পানি প্রবাহে বিঘ্নতা না ঘটে। কাজেই ফারাক্কা বাঁধ হতে সৃষ্ট সমস্যার সমাধানে বাঁধের গেটগুলো তুলে ফেলা অপরিহার্য হয়ে পড়ল কিন্তু কবে কাটবে এ অমনিশার রাত? কবে যাবে এ দুর্যোগ? আদৌ কি যাবে??
Md Zaheerul Hasan
Bangladesh Marine Academy
©somewhere in net ltd.