![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
রাজশাহী তে আমাদের একটা ছোট বাসা আছে -ফার্ম হাউজ টাইপ বলা যেতে পারে। ওখানে বাইরের মত কোনো ঘোড়া ঘোরাঘুরি করে না কিন-ু বেশ কয়েকটা গরূ ঠিকই দেখতে পাবেন। ছোটো ছাগল, এবং তার সাথে কিছু কুকুর ফ্রি! হাস মুর্গির ও একটা পার্ট ছিল, কোনো ভাবে দেশের মানুষের কাছে কোনো বাসা মুরগী ছাড়া অসম্পুর্ন মনে হয় - তাই আমার ফুপু প্রায় বেশ কিছু(প্রায় 20 30 টার মত ) মুরগী পোষা আরম্ভকরলেন। আমি অনেকটা খাদক প্রকৃতির মানুষ - তাই জখনই যেতাম, খামারের সাইজ অর্ধেক হয়ে যেত। অসুবিধা হত না যদিও - আমাদের মোরগ বেশ পুষ্ট ছিল।
ফার্ম হাউজেই বেশির ভাগ সময় কাটাতাম আমি - জখনই যেতাম। আর তাছাড়া - আমরা সরকার ছিলাম একসময় সে গ্রামের - এখোন প্রতিপত্তি তেমন চলে যায়নি - তাই গেলেই বেশ ভাল মানুষের সমাগম ঘটে আমাদের বৈঠকখানায় - পটল সাহেব থেকে শুরু করে গ্রামের দোকানদার পর্যন্ত একবার হলেও দেখা করে যায়। ভালই লাগে - না, সম্মান টা নয় - তাদের হৃদ্যতা ।
ওখানেই তার সাথে পরিচয়।
সেদিন সকালে ভোর বেলায় হাটতে যাব - মোটে খেজুরের রস খেয়ে ভারী করলাম নিজেকে। বের হতে হতে প্রায় 8টা বেজে গিয়েছিল। একটু দুর হাটার পর হঠাৎ শুনলাম কোথায় যেন মোরগ ডাকলো... নিতান্তই বেরসিক মোরগ... সকাল 6টায় যা ডাকা দরকার তা ডাকছে 8টায়। আমিও মোটামুটি লেট করে উঠি ... তাই ভাবলাম দেখি আমার মোরগ ভার্সন।
সামনে গিয়ে অবাক হয়ে দেখলাম - 12, 13 বছরের একটা ছেলে - নিজের মনে মোরগের ডাক ডেকে যাচ্ছে। এবং তার চারপাশে মুরগী ঘোরাফেরা করছে... যেন তার ডাকে সাড়া দিতেই। সভাবতই বেপারটা দেখার মত - আর তাছাড়া আমি সবসময়ই ছোক ছোক স্বভাবের মানুষ - তাই যাই দেখি তাতেই নাক গলায় বসি।
কাছে গেলাম। আমাকে দেখে মুরগী গুলো লেজ তুলে দৌড় দিল - যত ছোটই হোকনা কেন লেজটা, লেজ তো লেজই! ছেলেটা মহা বিরক্ত হয়ে তাকালো আমার দিকে "ধুৎ মিয়া দিলেন তো সব ভাগাইয়া। এগুলানরে দেইখা রাখতে কইসিল আম্মা - এখন আবার ডাইকা আনতে হৈব"।
শহর থেকে আমি - পোষাকেই মোটামুটি ধোপদুরস্ত ভাব। কখনই গ্রামের কোনো ছেলে - তাও নিজের গ্রামের কোনো ছেলে এভাবে কথা বলবে ভাবিনি। তবু খুব ভালভাবেই বললাম: "ডেকে আনবে মানে? তোমার কথা শুনে এগুলো?" এমন ভাবে তাকালো ছেলেটা যেন খুব অবাক হল :"শুনবোনা মানে? আমি এগোর লগে কতা কই না?" এবার আমার অবাক হবার পালা - আজ পর্যন্ত কখনো animal linguist পাইনি আমি। তাই মোটামুটি ভালভাবেই বললাম ওকে ডাকতে। আমাকে পাশে দাড়াতে বলে সে দুবার ডাকল - এবং সত্যি সত্যি বেশ ক'টা মুরগী কাছাকাছি এসে দাড়ালো।
এভাবেই পরিচয় রাসেলের সাথে।
রাসেল তার বাসার বড় ছেলে - তার ছোট বোনটা বাসায় বাসায় কাজ করে বেড়ায় - ছোট খাট কাজ, খুটিনাটি পরিস্কার করা, রান্না করতে সাহায্য এরকম। আর রাসেল কাজ করে রাখাল হিসেবে। তাদের নিজস্ব একটা গরু আছে - প্রতি বছরই তারা একটা করে গরু কিনে - শুধু মাত্র কোরবানীর সময় বিক্রি করবার জন্য। 700, 800 টাকায় বাছুর কিনে সেটা বড় করে বিক্রি করে 12000 13000 এ। একটা গরু 18000 টাকায় বিক্রি হয়েছিল একবার - সে গরুর কথা সে আজ পর্যন্ত মনে রেখেছে। যে কিনেছিল তার কাছ থেকে টাকা নিয়ে সে ছবি কিনে ফ্রেম করে টাংগিয়ে রেখেছে তার বাসায়। আহামরি কিছু নয়- ছনের বাসা - মাটির প্রলেপ দেয়া। তবু তার বাসাতে গেলে বেশ একটা সুঘ্রান পাওয়া যায়। মাটি, গাছ মিলে একটা অন্যধরনের ঘ্রান, যা লিখে বোঝানোর নয়।
প্রতি ঈদের আগেই সে বাসা থেকে চলে যায়। দুতিনদিন ধরে তার কোনো খবর থাকেনা - তাতে তার মা'র খুব রাগ। ছেলে থাকলে কসাইদের সাহায্য করে কিছু তো পেত... মা তো রান্না করে, না হয় কাটতেই সাহায্য করল? তাও তো "সংসারে" কিছু টাকা আসে! আমাকে বলল ছেলেকে বোঝাতে। আমি বার বার জিগ্গেস করলাম কেন যায়, কিছু না বলে রাসেল তার বিখ্যাত "আমি সবজান্তা " হাসি হাসতো। কোন উত্তর দিতোনা সে.. হয়তো প্রয়োজন বোধ করতো না।
আমি তাকে আমার ফার্ম হাউজে নিয়ে আসি। ছেলেটা আর যাই হোক - গরু, খাসি, মুরগী যা যা আছে - পুষতে বেশ পারদশী। মোটামুটি ওকে আমাদের ধরা রাখাল করে ফেললাম আমি। জখনই বের হতাম, দেখতাম সে হয় কোনো গরূর কাছে আছে, মনযোগ দিয়ে কিছু একটা বিড়বিড় করছে, নয়তো মুরগীদের খাবার দিচ্ছে । সারাদিন থাকতো, এবং সন্ধ্যাতে হয় বাসায় যেত, নতুবা আমি বের হলে আমাকে সংগ দিত। ওর সাথে বেরোনোও বেশ ঝককির কাজ ছিল - পাশের নেড়ি কুকুর থাকলেও সে থামবে। চুপচাপ কিছুখন দাড়িয়ে থাকবে। তারপরে আবার জখন হাটবে তখন নেড়ি কুকুরটা তার পিছু পিছু আসতে থাকবে। এভাবে দেখা যেত প্রায় তিন চারটা কুকুর আমাদের ফোলো করছে। আমি চেষ্টা করতাম ঢিল মেরে তাড়াতে, একটু দূরেও যেত ভয় পেয়ে, কিন্তু আবার ঠিকই আমাদের সাথে সাথে আসতো। ঠিক আমাদের সাথে না - রাসেলের সাথে।
অনেক কথাই হত আমাদের মাঝে - সিগারেট টানতাম আমি - আর কথা বলত সে। ওর জীবন কাহিনী তেমন একটা মজার না - আর দশটা ছেলের মতই ও ছিল। কিন্তু ও বলত - ও পশুর কথা বুঝতে পারে - তাদের সাথে কথা বলতে পারে। আমি হয়তো কিছু সময় হেসে উড়িয়ে দিতাম, বেশীরভাগ সময়ই বেশ গ্ভিীর ভাবে জিগগেশ করতাম - তা কি বলল এই কুকুর টা? কখনই সে উত্তর দেয়নি - চেপে গেছে তার হাসি দিয়ে। আমিও ঘাটাইনি - ছেলেটা আর যাই হোক - ভাল কম্পানীওন ছিল।
সে সব পারতো, কুকুরের ডাক, শিয়ালের ডাক, গরূর ডাক মুরগী থেকে শুরু করে সব। মজার বেপার হচ্ছে সে ডাকলে সাথে সাথে সাড়া দিত গরুগুলো। কি জন্য কে জানে, কিন্তু ও ডাকলেই ছাগল আর গরূ - দুটোই সাড়া দিয়ে উঠতো।
আমরা আসার আগে একটা গরূ ছদকা দেবার কথা। আম্মু বলেছিল। আমরা ঠিকও করে রেখেছিলাম কোন গরূ দিব। মোটা তাজা - লাল রংএর, বেশ বড় - এই আমার চেয়ে আধা ফিট ছোট হবে? আর বেশ বড় সড় ভুড়ি। ওকেই খাওয়াতো রাসেল - তার যত্নের জন্যই রাখতে চেয়েছিলাম। ছেলেটি বেশ ভালই কেয়ার নিত - ডলে ডলে পরিস্কার করতো, খাওয়াতো এবং বিড় বিড় করত। মাঝে মাঝে আমরা যখন হাটতে যেতাম সে কলা গাছ থেকে একটা বড় পাতা ছিড়ে নিত "হে কলা খাইতে পসন্দ করে" বলে লাজুক হাসিও দিত। একেই বলে পাগলামী!
যেদিন আমরা ছদকা দিবো সেদিন সকাল থেকে তার খবর নাই। তার আগের রাতে সে বাসায় ফেরৎ যায়নি - এবং সকালে আমাদের বাসায় আসেনি। মোটামুটি বিরক্তই হলাম আমি - বার বার করে বলেছিলাম আসতে - গরুটা মোটেও শান্ত শিষ্ঠ নয়। এক মাত্র ও ই পারতো একে ঠিক রাখতে।
বিকালবেলা আসরের পরে আমরা গরু কাটতে দেখলাম। দেখি রাসেল আসছে - খুব আস্তে আস্তেহেলতে দুলতে। মেজাজ যারপরনাই খারাপ হল - কিন্তু তার মা আমার থেকে এক ডিগ্রি বেশী... দৌড়ায় গিয়ে কষে এক চড় - "লাট সাহেব আসছেন!" ছেলেটি কিছু না বলে আমার সামনে এসে বলে "সিমাব ভাই - একটু কি আইবেন??" আমি বললাম চল। দূরে নিয়ে গিয়ে বলে "ভাই এরে জবাই না দিলে হয়না?" আমি বললাম" ভাইয়া ... এটা কেমনে হয় - সব কিছু তো ঠিক হয়ে গেছে" ... ছেলেটি কিছুখন চুপ করে থেকে বলে "আপনে জিগাইসিলেন না কেন আমি ভাইগ্যা যাই? আমারে এরা ডাকে। ডাইকা কয় যাতে না মারে। আমার ঐ মরন কান্দন শুনতে ইচ্ছা করে না"।
আব্বু জোরে ডাকলো - সিমাব এইদিকে আসো। আমি কিছুখন ওর দিকে তাকিয়ে চলে আসলাম।
গরু টা জবাই করার সময় কোনো কিছু করেনি - মোটা তাগড়া, তবুও নড়েওনি। তার সমস্ত তেজ হঠাৎ ধুয়ে গিয়েছিল। কিভাবে কে জানে? আমি একটা জিনিস খেয়াল করলাম গরু টা যেন এক দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে রাসেল এর দিকে।
আর রাসেলের চোখ থেকে টপ টপ করে পানি পড়ছে।
(ওপরের কথা সব সত্যি। এখোনো দয়রামপূর গেলে রাসেলের কথা জিগ্গেস করতে পারেন। সে এখনো রাখাল। তবে সে এখন গরু নিজে পালে। আর নিজেই কাটে - তার নিজস্ব গরুর মাংসের দোকান আছে। আমাদের কে সে প্রায় এক কেজি মগজ ফ্রি দিয়েছিল - কারন আমি মগজ খেতে খুব পছন্দ করি)
২| ১১ ই মার্চ, ২০০৬ বিকাল ৫:০৩
অতিথি বলেছেন: Interesting.
ছেলেটাকে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে ।
৩| ১১ ই মার্চ, ২০০৬ সন্ধ্যা ৭:০৩
কামরান বলেছেন: ধন্যবাদ অপবাক।
তীর্থক - এখোনো আছে রাসেল। জদিও বেশ বড় হয়ে গিয়েছে। দয়রামপুর ক্যানটনমেন্টে র পাশে বসে সে। সবাই একনামে চিনবে
©somewhere in net ltd.
১|
১১ ই মার্চ, ২০০৬ বিকাল ৪:০৩
অপ বাক বলেছেন: ভালো লাগলো, এমন ছোটোবেলা সবার থাকে না।