![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
যখন ছোট ছিলাম তখন বাসায় একটা ভাঙা ক্যাসেট প্লেয়ার ছিল, ক্যাসেট বাজাতে গেলে কিছুক্ষণ পর পরই ফিতা পেঁচিয়ে যেত। ইকোনো ডিএক্স বা রেডলিফ কলম ক্যাসেটের গর্তে আটকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ফিতা খোলা হত। পরিষ্কার শব্দ শোনা যেত না, তুলোর মধ্যে আফটার শেভ লোশন ভিজিয়ে সেই ক্যাসেট প্লেয়ারের 'হেড' পরিষ্কার করা হত। আদৌ এই প্রযুক্তিতে সাউন্ড ভাল হয়তো হতো না, তবে আত্নতৃপ্তির কারণে মস্তিষ্ক শব্দের গুণগত মান কিছুটা উন্নত করেই অনুভব করতে দিত। ক্যাসেটের গায়ে লেখা থাকত 'সাইড এ'-'সাইড বি' অথবা 'এপাশ'-'ওপাশ'। মানে, একদিকে ঘুরানো শেষ হলে আরেকদিকে ঘুরিয়ে ক্যাসেট শুনতে হবে। একটা সাইড বাজাতে গেলে আবার শুরুতে কিছুক্ষণ সাদা রঙের ফিতা থাকবে, মানে সেখানে কোন শব্দ রেকর্ড করা নেই। একটা গান না শুনে পরেরটা শুনতে চাইলে কিছুক্ষণ টেনে দিতে হতো ক্যাসেট, বেশি যেন টানা না হয়ে যায় সে জন্যে সতর্ক থাকতে হতো, কী উত্তেজনা একটা গান শোনার জন্যে! সৌখিন বাড়িগুলোতে ক্যাসেট রাখার শেলফ থাকত, সেখানে সারি সারি করে সাজানো থাকত বিভিন্ন ধরণের গানের ক্যাসেট। আমাদের বাসায় অবশ্য ক্যাসেট রাখার শেলফ ছিল না, সব অগোছালো পরে থাকত, প্রায়ই রবীন্দ্রসঙ্গীতের কাভারের মধ্যে ঢুকে যেত আধুনিক বাংলা গান।
মাঝে মাঝে মনে হয়, এত কষ্ট করে একেকটা গান শোনা হত দেখেই শ্রোতারা তখন সেটার মর্ম উপলব্ধি করতে পারতাম। ক্যাসেট দোকান থেকে খরিদ করে এনে শুনতেই যদি এতটা কষ্ট হয় তাহলে একজন শিল্পীকে সেই গান গুলো তৈরী করতে কতটা কষ্ট করতে হয়? সম্ভবত তিরিশ টাকা, এরপর পঁয়ত্রিশ টাকা ছিল এলবামগুলোর মূল্য, আমি টিফিনের পয়সা জমিয়ে প্রচুর এলবাম নিজেই খরিদ করেছিলাম। এবং একবারের জন্যেও মনে হয়নি পয়সাগুলো জলে যাচ্ছে। বরং এলাকার ক্যাসেটের দোকানগুলোতে সপ্তাহে সপ্তাহে গিয়ে জানতে চাইতাম অমুক শিল্পীর নতুন এলবাম কবে আসবে! রাম-অযোধ্যা সবই একসময় হারায়, আমাদের প্রজন্ম বড় হতে হতে এমপিথ্রি নামক ভয়াবহ মহামারী ভাসিয়ে নিয়ে গেল এলাকার সব ক্যাসেটের দোকান, দুঃখজনকভাবে ভাসিয়ে নিল অনেক অনেক শিল্পী, সুরকার ও এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত কলাকুশলীদেরও। অনেক শিল্পীই গান করা ছেড়ে দিলেন অর্থকষ্টে পড়ে। একটা গান শ্রোতার কাছে পৌঁছানোর জন্য শিল্পী তো আর বাড়ি বাড়ি গিয়ে এলবাম বিক্রি করতে পারেন না, পরিবেশনার জন্য তাঁকে সাহায্য নিতে হয় কোন প্রকাশনা ও প্রযোজনা সংস্থার। সেই সংস্থা, যাবতীয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মতোই, এলবাম থেকে প্রাপ্ত অধিকাংশ টাকাই নিয়ে নিত; শিল্পীর পকেটে যেত সামান্যই। তবু কিছু তো বিক্রি হতো এলবাম, শিল্পীরা অনেকেই শ্রোতাদের ভালবাসাটাকে অর্থের চেয়ে বড় মনে করে সেটা নিয়েই খুশি থাকতেন। কিন্তু এমপিথ্রি নামক মহামারী ডিজিটাল ফরম্যাট তাঁদের এলবাম বিক্রি নামিয়ে আনল প্রায় শূণ্যের কোঠায়। আমি ব্যক্তিগতভাবে দেখেছি, এমনও এলবাম প্রকাশিত হয়েছে যেটার কেবল একটামাত্র কপি বিক্রি হয়েছে আমাদের এলাকায়, সেই কপি থেকেই গানগুলোকে এমপিথ্রি ফরম্যাটে কনভার্ট করে ক্যাসেটের দোকানদার এক সিডিতে দশটা এলবামের গান ভরে শ্রোতার কাছে বিক্রি করছেন। শ্রোতাও দেখছেন ৪০ টাকায় ১০০ গান পাওয়া গেলে কেন ৪০ টাকায় মাত্র দশটা গান কিনব? শিল্পী ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন কি হচ্ছেন না সেটা তো আমার দেখার বিষয় না, আমি দেখব কত সস্তায় আমি আমার বিনোদন খরিদ করতে পারি।
কোন এক কারণে, জাতিগতভাবে আমরা মেধাসত্ত্ব বলে একটা বিষয় আছে সেটা স্বীকার করতে চাই না। আসলে, বলা উচিৎ- স্বীকার করা তো অনেক পরের বিষয়, আমরা মেধাসত্ত্ব বলে যে একটা বিষয় আছে সেটা জানিই না। আমরা ধরেই নেই গান শোনা আমাদের অধিকার আর শিল্পীদের কাজ হচ্ছে নিত্য নতুন গান তৈরী করে আমাদের কাছে বিনামূল্যে পৌঁছে দেয়া। আমরা এমপিথ্রি বিক্রেতাকে ৪০ টাকা দিতে রাজী, কিন্তি শিল্পীকে গান প্রতি ৫ টাকা দিতে রাজী না। আমরা ধরেই নেই ইউনিভার্সিটির ছাত্র-ছাত্রীরা নতুন কিছু চিন্তা করলে সেটা আমরা শিক্ষকেরা নিজেদের নাম-ধাম দিয়ে গবেষণা হিসেবে চালিয়ে দেয়াটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। আমরা ধরেই নেই বিদেশি পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত লেখা দাঁড়ি কমা সহ অনুবাদ করে নিজের নামে দেশের পত্র-পত্রিকায় ছাপিয়ে দেয়াটা তেমন কোন অপরাধ নয়। প্রসঙ্গত একটা গল্প বলি। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের এক বন্ধু কবির খ্যাতির প্রথম দিককার সময়ে একদিন কবিকে এসে বললেন, 'নজরুল, তুমি কি জান তোমার অনেক কবিতা অনেকে নিজের নামে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশ করছে?'
কবি শান্ত স্বরে বললেন, 'নিক না, সাগর থেকে দুই এক আঁজলা জল তুলে নিলে কী এমন ক্ষতি?'
আমি এই গল্প বলে প্রমাণ করতে চাইছি না শিল্পীদের মেধাসত্ত্ব রক্ষা না করলে তেমন কোন ক্ষতি নেই। সবাই কাজী নজরুল ইসলাম হয় না, কাজী নজরুল ইসলাম হয় লক্ষ কোটিতে একজন। আমাদের দেশের বেশিরভাগ শিল্পীই মধ্য আয়ের মানুষ, অনেকে নিম্ন আয়েরও আছেন। আপনারা দেখেছেন, তাঁদের চিকিৎসা বা এই রকম কোন ব্যাপারে আমরা একজন সাধারণ মানুষের জন্য যেভাবে টাকা তুলে তাঁকে বাঁচানোর চেষ্টা করি, একজন শিল্পীর ব্যাপারেও তাই করি। কাজেই তাঁদেরকে সুন্দর জামা কাপড় পরে টিভির পর্দায় দেখা গেলেই তাঁদেরকে প্রচুর টাকা পয়সার মালিক ভাবার কিছু নেই। তাঁরা যে শুধু মধ্য আয়ের মানুষ তাই না, তাঁদের বেশিরভাগই রবীন্দ্রনাথ বা কাজী নজরুল না যে তাঁদের হাজার হাজার সৃষ্টি আছে, দুই একটা গানের জন্য টাকা না দিলে তাঁদের কিছু হবে না। আর তাছাড়া, ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয় কাজী নজরুল ইসলামের এই যুক্তি ভুল যুক্তি। তাঁর এই ভুল যুক্তির জন্য তিনি নিজেও জানতেন না তাঁর রচিত গান বা কবিতার সঠিক সংখ্যা কত। নজরুলের সৃষ্টি নিয়ে গবেষণা করেন এমন কেউকে জিজ্ঞেস করলেই এটার সত্যতা জানতে পারবেন। তাঁর প্রচুর অসামান্য সৃষ্টি হারিয়ে গেছে তাঁর এই উদাসীন মনোভাবের কারণে। তবে মহামানবদের এইরকম কিছু উদাসীনতা থাকে, এগুলো তাঁদের মানায়; কিন্তু আমাদের দেশের মধ্যবিত্ত শিল্পীদের এটা মানায় না, তাই তাঁদের মেধার মূল্যায়ন এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।
একটা বিষয় মনে রাখতে হবে, মেধার মূল্যায়ন না করা হলে সেই মেধা আস্তে আস্তে হারিয়ে যায়। কেউ কি একবারও ভেবে দেখেছেন নব্বইয়ের দশকের অসম্ভব জনপ্রিয় সব শিল্পী ও কলাকুশলীরা কেন অনেকটা আড়ালে চলে গেছেন, কেন তাঁরা আজ বিস্মৃত? কারণটা খুব সহজ- তাঁদের মেধার মূল্যায়ন কেউ করেনি। তাঁরাও টিকে থাকার প্রয়োজনে একেকজন একেক পেশা বেছে নিয়েছেন। বাংলাদেশের বেশিরভাগ ব্যান্ড নিয়মিত এলবাম প্রকাশ করত, কেন তাঁরা সবাই এলবাম বাদ দিয়ে এখন শুধু স্টেজ পারফর্ম করেন? কেউ কেউ বলেন, তাঁদের মেধা ফুরিয়ে গেছে, নতুন গান আর করার ক্ষমতা তাঁদের নেই, তাই তাঁরা স্টেজ পারফর্ম করে দিন কাটান। আসলে, তাঁদের মেধা ফুরিয়ে যায়নি, তাঁদেরকে আমরা মেধাশূণ্য করে দিয়েছি আস্তে আস্তে। একজন শিল্পীকে তাঁর প্রাপ্য সম্মানী না দিয়ে গান গাইতে নিরুৎসাহিত করার মানেই হচ্ছে তাঁকে তাঁর মেধার চর্চায় বাধা দেয়া।
ডিজিটাল যুগের শুরুর দিকে হয়তো ডিজিটাল কনটেন্টের কপি প্রটেকশনের প্রযুক্তি ছিল না, কিন্তু এখন আছে। আর আসলে প্রযুক্তি লাগে না, লাগে মেধাসত্ত্বকে সম্মান করার মানসিকতা। সেটা না থাকলে প্রযুক্তি থাকলে খুব একটা লাভ হয় না। আমাদের ভাবার সময় এসেছিল অনেকদিন আগেই, কেউ ভাবেনি, ভাবার সময় চলেও গিয়েছে। এখন ভেবে খুব একটা লাভ হবে কি না আমি জানি না, তবে কথায় আছে, সবকিছু নতুন করে শুরু করার জন্যে কখনোই খুব দেরী হয়ে যায় না। আমাদের সব হারানোর এই দেশটাকে আমরা আরও মেধাশূণ্য করে তুলব কি না সেটা ঠিক করার জন্যেও নিশ্চয়ই খুব দেরী হয়ে যায়নি।
২| ২০ শে জুন, ২০১৫ রাত ৮:২৩
রূপক বিধৌত সাধু বলেছেন: গুরুত্বপূর্ন একটা বিষয় তুলে ধরেছেন । অনেক গুণী শিল্পীর আজ দৈন্য দশা । অনেকেই হারিয়ে গেছেন, চিকিৎসার অভাবে ধুকে ধুকে মরছেন । এ দিকে কারো খেয়াল নেই!
©somewhere in net ltd.
১|
২০ শে জুন, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:৪৫
চাঁদগাজী বলেছেন:
এখন কিভাবে গান শুনেন?