নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

চরন বিল

চরন বিল › বিস্তারিত পোস্টঃ

স্মৃতির চিলেকোঠায় রাখা ভালবাসার ছবি

২৬ শে জুন, ২০১৫ সকাল ১১:১০

আমার বয়স যখন তিন বছর এবং আমার বড় বোনের বয়স যখন চার বছর তখন আমার মা-বাবার ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়।

এরপর থেকে আমার জন্মদাতা, আমার মায়ের সঙ্গে আর কোন যোগাযোগ করেননি।
আমার মায়ের বয়স তখন মাত্র ১৯ বছর। পুরোনো ঢাকার উর্দূ ভাষিত পরিবারের কন্যা আমার মা বাল্য বিবাহের শিকার ছিলেন না, ছিলেন অপরিণত প্রেমের শিকার, নিজের ইচ্ছেতেই অত্যন্ত অল্প বয়সে তাঁকে বিয়ে দিতে বাধ্য হন আমার নানাবাড়ির মানুষজন, এবং মাত্র পনের বছর বয়সে তিনি প্রথম সন্তান জন্ম দেন।

খুব বিচিত্র ঘটনা এটা আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে নয়, যখন সময়টা ছিল ১৯৮৬, এই দেশের মানুষজন তখনো মাত্র এক যুগ বয়সী যুদ্ধবিদ্ধস্ত রাজনীতিকে সামলে নিতে পারেনি, একের পর এক রাজনৈতিক হত্যাকান্ড আর ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকা দুর্নীতিতে বিভীষিকাময় হয়ে ছিল সমগ্র রাষ্ট্র ও সমাজযন্ত্র, প্রাথমিক শিক্ষা বলে একটা অধিকার মানুষের আছে সেই অনুভূতিটুকুও খুব একটা হৃদয়গ্রাহ্য হয়ে উঠেনি দেশের মানুষের; বাল্যবিবাহকে চোখ রাঙানো আজকেও দেখা যায় না খুব একটা, ৮৬তে সেটা পুরোনো ঢাকার অশিক্ষিত পরিবারগুলোতে প্রায় অসম্ভবই ছিল। ফলে আমার মা যখন ক্লাস এইটে পড়ার সময় জেদ ধরে বসেন মাঠের ঐ পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সানগ্লাস চোখের যুবককেই তাঁর চাই, খুব একটা আপত্তি উঠেনি নানাবাড়ি থেকে। ছেলে সুদর্শন না হোক, বেশি রোজগার না থাকুক, বয়স আছে ছেলের, হুটহাট করে সিদ্ধান্ত নেয়ার মতো নয়, এর কাছে মেয়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে থাকা যেতে পারে- এইটুকুই যথেষ্ট ছিল সেদিন মায়ের বিয়ের মতো একটা ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে।

আমার বাবা-মায়ের বিয়ে টিকেনি পাঁচ বছরও, তাঁদের সংসারে দুটি সন্তান এসেছে ততদিনে, দুটি কন্যা সন্তান, বেকার বাবা ছিলেন প্রথাগত পুরুষ, বিচ্ছেদই ঠিক মনে করেন তিনি, এবং আমাদের ভরণ-পোষণের তোয়াক্কা না করে নিরুদ্দেশ হন। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে দেশের পরিস্থিতি থমথমে হওয়া শুরু হয়েছিল তখন, বাবাকে খুঁজে বের করার দায়িত্ব কেউ নেয়নি, কেউ ছিলই না নেয়ার মতো, আমার মা-র ঠাঁই হয় মামাদের সংসারে, আমাদের দু'বোন কে নিয়ে।

মামা সচ্ছল ছিলেন না, হতদরিদ্রও ছিলেন না, তবে দু'সন্তান সহ স্বেচ্ছায় বিয়ে করা ছোট বোনকে লালন-পালন করতে যথেষ্টই অপারগ ছিলেন। শুধু নিজের মৃত পিতার ঋণ শোধ করতে গিয়েই আমার মাকে তিনি স্থান দিয়েছিলেন তাঁর সংসারে। শুরু হয়েছিল আমাদের দু'বোনের জীবনের এক নতুন অধ্যায়ের, এই অধ্যায়ের নাম সংগ্রাম রাখা যেতে পারে, রাখা যেতে পারে অভিশাপ, চাইলে কেউ এটাকে অবহেলা বা অপমান অধ্যায়ও রাখতে পারে- এতটাই নিগৃহীত হওয়া শুরু হয়েছিলাম আমরা দু'বোন সেই সংসারে।

সুতি কাপড়ে বানানো হাফপ্যান্ট পরতাম আমরা দু'বোন. লাল, মেরুন, বেগুনী আর নীল। সব গাঢ় রঙের ছিল, যেন মাসে একবার ধুলেই চলে সেসব; এর উপর মামাতো ভাইদের ফেলে দেয়া আধ-ছেঁড়া স্যান্ডো গেঞ্জি পরেই দিন কাটত আমাদের। নানাবাড়ি বলে কিছু ছিল না আমার দরিদ্র মাতৃকূলে, ভাড়া বাসা কিছুদিন পরপরই বদল হতো, তবে সবগুলো ভাড়া বাসাই হতো ঐ বিশাল মাঠটি ঘিরে, যেখানে কাটতো আমাদের দু'বোনের পুরোটা দিন। রিকশার মতো দেখতে তিন চাকার ছোট ছোট রিকশা পাওয়া যেত সেখানে, বাচ্চারা ভাড়া নিয়ে চালাত, দুই টাকায় আধা ঘন্টা আর পাঁচ টাকায় এক ঘন্টা। আমাদের দু'বোনের সামর্থ্য ছিল না আধা ঘন্টা ঐ আকর্ষণীয় ত্রি-চক্রযান ভাড়া নেয়ার, অন্য শিশুরা ভাড়া নিত, আমরা দু'বোন সেগুলো বালুময় মাঠে ঠেলে ঠেলেই বিপুল আনন্দ উপভোগ করতাম। কখনও হয়তো কেউ আমন্ত্রণ জানাতো সেই স্বপ্ন শকটে বসার, সুতীক্ষ্ণ গগনবিদারী আনন্দ চিৎকারে আমরা প্রতিধ্বনি তুলতাম ঐ বিস্তৃত মাঠে, খুশিতে ভুলে যেতাম আমরা ওই একই খেলার সাথীদের তিরস্কার- ঐ, সবারই তো বাপ আছে, কারো বাপ মইরা গ্যাছে, তগো দুইজনের বাপই নাই ক্যান?

ধূসরিত দেহে দুপুরে বাসায় ফিরতাম ক্ষুধার্ত হয়ে, গোসল করে নিতাম রাস্তের পাশের কল থেকেই। কখনো ভেজা হাফপ্যান্ট, কখনো বা নগ্ন হয়ে গোসল সেরেই আবার আগের হাফপ্যান্ট, এভাবেই চলে যেত, মা থাকতেন না বাসায় দিনে, তিনি তখনকার ঢাকার সেলসগার্লদের একজন ছিলেন, সামান্য বেতনের তদানীন্তন ওই চ্যালেঞ্জিং চাকরিটা কী করে মা জুটিয়েছিলেন সেটা আমরা জানতাম না, জানতে চাইওনি কোনদিন, আজ পর্যন্ত না। মামী ভাত খেতে ডাকতেন না কখনোই, ভাত চাইলে মুখ ঝামটা দিয়ে বলতেন- নিজে বাইড়া খাইতে পারস না বাপ খাওয়া মাগীরা? মাগনা তো খাবিই, আবার বাইড়া মুখে তুইল্যা খাওয়াইয়া দেওন লাগব? আমরা অবশ্য তেমন কিছু মনে করতাম না মামীর কথায়, একটা প্লেটে খানিকটা ভাত আর ডাল/ভাজি নিয়ে দু'বোন খেয়ে উঠতাম, তরকারি নিতাম না, ওটা তোলা থাকত মিটসেফে। কখনো কখনো অলস দুপুরগুলোতে নানু জেগে থাকলে এক-দুই টুকরো মাছ-মাংস তুলে দিতেন আমরা খেতে বসলে।

মামাতো ভাইয়ের জন্মদিন ছিল একবার, কেক আনা হয়েছিল, আমরা ভাগেই পাইনি, বিরানীর একটা প্যাকেট জুটেছিল শুধু, আমরা তৃপ্ত ছিলাম ঐ স্বাদে। উপহার এসেছিল অনেক, মামাতো ভাই সেগুলো দিয়ে খেলত, আমরা বসে থেকেই উপভোগ করে ফেলতে পারতাম খেলার আনন্দটুকু, বিধাতা বিচিত্র ক্ষমতা দিয়ে আমাদের দু'বোনকে সৃষ্টি করেছিলেন। খারাপ যাচ্ছিল না আমাদের দিন, সারাদিন ছুটোছুটি, হুল্লোড়, গাছ থেকে আম পেড়ে খাওয়া, আমরা দু'বোন বড় হচ্ছিলাম দুরন্ত ছেলের মতো। বেশিদিন থাকেনি এই আনন্দ, কত দিন, কত মাস বা কত বছর তার হিসাবও আমরা রাখিনি তখন, আমার এক বছরের বড় বোনকে "বয়স' হয়ে যাচ্ছে দেখে মামা আবাসিক মহিলা মাদ্রাসায় পাঠিয়ে দিলেন। আমার জগৎ জুড়ে একটা নিকষ অন্ধকার নেমে এলেও খুব একটা ভাঁটা তবুও পড়েনি শৈশব জুড়ে থাকা উচ্ছাসে। সারাদিন তখন আর বোনের সাথে খুনসুটি ছিল না, ছিল না একসাথে বিশাল মাঠে ইটের টুকরোতে ঘর কেটে মেয়েলী খেলার দিন, ছিল না মাঠের পাশের বিশাল গাছটাতে দু'বোন পা দুলিয়ে বসে গলা ছেড়ে গাওয়া সদ্য শেখা হিন্দী গান; শুধু ছিল মামা-মামীর অকথ্য গালাগালি আর এলাকাবাসী-খেলার সাথীদের তিরস্কার আর লাঞ্ছনা- তবু কখনো একা বোধ করিনি।

সত্যিকার অর্থে জীবনের প্রথম আঘাতটা পাই যখন শুনি আমার মায়ের দ্বিতীয় বিয়ের কথা চলছে প্রবাসী এক ছেলের সাথে। আমার ভেতরটা কখনো পিতৃস্নেহের জন্য আকুল হয়নি, জ্ঞান হওয়ার পর থেকে মাকেও আদর করতে দেখিনি, কই, কখনও তো মনে হয়নি আমি একা। কিন্তু মায়ের বিয়ের কথা শুনে প্রচন্ডভাবে নড়ে ওঠে আমার শৈশবের একান্ত নীড়, ভয়াবহ কোন এক ঝড় তোলে আমার ছোট্ট বুকে সেই সিদ্ধান্ত।
মাকে অনেক বলেছিলাম- আম্মা, তুমি বিয়ে করো না, আমার ভয় লাগে- মা শুধুই কাঁদতেন। খুব ঘৃণা জন্মেছিল মায়ের বাসর ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে সে রাতে, অনেক বড় হওয়ার পর বুঝেছিলাম, মা ভুল সিদ্ধান্ত নেননি; হয়তো তখন তাঁর হয়ে অন্যদের নিয়ে দেয়া সেই সিদ্ধান্তকে তাঁর অবজ্ঞা করার মতো অবস্থাই আর ছিল না।

আমার মায়ের নতুন স্বামী মানুষটা খারাপ ছিলেন না, অন্তত আমাদের দু'বোনকে আদর না করলেও কখনও অনাদর করেননি, অবজ্ঞা করেননি, মিটিয়েছেন নিজের সাধ্যমত আমাদের অনেক চাহিদা, যদিও আমরা খুব একটা কিছু চাইতে পারতাম না তাঁর কাছে। আমি স্কুলে ভর্তি হয়ে গেলাম, কিছুদিন পর আমার বোনকেও মাদ্রাসা ছাড়িয়ে এনে স্কুলে ভর্তি করা হল, তবে ও ততদিনে আমার এক ক্লাস নিচে পড়ে গেছে। সময় কাটতে লাগল দ্রুত, তবে হারিয়ে গেল আগের সেই উচ্ছ্বাস আর আনন্দ, একটা ভীতি নিয়ে আমরা আমাদের মায়ের নতুন স্বামীর ঘরে বসবাস করতে লাগলাম, মায়ের নতুন শাশুড়ি স্থলাভিষিক্ত হলেন আমাদের মামীর, অকথ্য যত শব্দাবলী নীরবে সহ্য করা ছাড়া তেমন কোন কষ্ট আর ছিল না সেখানে।

কয়েক বছরে আমার মায়ের কোলে এল আরও দুটি পুত্রসন্তান, আমাদের সৎ ভাই, কিন্তু জলজ্যান্ত খেলার পুতুল। আমি দুরন্তপনাটা ছাড়তে পারিনি তখনও, তাই আমার খাতির ছিল এলাকার ছোট বড় সবার সাথেই, এমনকি কয়েক বছরের বড় আমাদের প্রতিবেশী রাজিন ভাইয়ের সাথেও; বুঝিইনি কখন আমি তাকে ভালবেসে ফেলেছি। দুর্বল ছিলাম আমি ভীষণ মানসিকভাবে, রাজিনের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার আগে যা বুঝিনি কোনদিন। অনেক পরে বুঝেছি আমার ভেতরটা শুকিয়ে রূক্ষ হয়ে ছিল দীর্ঘদিন সামান্য স্নেহের জন্য, সামান্য ভালবাসার জন্য, সামান্য একটু আবেগের জন্য; আমি ধরেই নিয়েছিলাম রাজিন আমার সেই শূণ্যতাটুকু পূরণ করে দিবে। আমি তখন ক্লাস এইটে পড়ি, আমার মায়ের করা একই ভুল আমিও করতে চাইনি, তবু নিজের শূণ্যতাটুকু সহ্য হয়নি, ছুটে যেতাম বারবার রাজিনের কাছে, প্রচন্ড আত্নবিশ্বাস নিয়ে বারবার বলতে চাইতাম কিছু, বলতে পারতাম না কিছুতেই। ওই চোখে তাকালে আমার বুকের ভেতরটা অন্যরকম হয়ে যেত, আমার নিঃশ্বাস আর আমার থাকত না, আমি বোধ করতাম অন্য এক আবেগ, আমি হয়ে যেতাম অন্য পৃথিবীর অন্য ভুবনের অন্য কোন সত্তা।

আমার জীবনের প্রথম শাড়ি পড়েছিলাম আমি রাজিনের জন্য, সেই ছবিটা আজও আছে আমার বিছানার পাশের ড্রয়ারে; অতীতটা যখন তাড়া করতে চায় ভীষণ, আমি আজও সেই ছবিটা বের করে আমার একহারা সেই কিশোরী গড়নটা একপলক দেখি, অনেক অনেক স্মৃতি তখন অশ্রু হয়ে ভিড় করে আমার চোখের পাতায়, কার আগে কে ঝরে পড়বে সেই প্রতিযোগীতায় নামে। প্রথম শাড়ি পড়ে আমি রাজিনকে প্রথম জানাই আমার ভাললাগার কথা, এবং আমার ছোট্ট জীবনের দ্বিতীয় এবং ভয়াবহতম আঘাতটি আমি পাই। ভুল বলেনি রাজিন সেদিন- ও কেন আমাকে ভালবাসার মানুষ ভাবতে যাবে? রাজিন ঠিক ছিল ওর স্থানে, আমি ভালবেসে ফেলেছিলাম ওকে, আমার জায়গায় আমিও ঠিক ছিলাম, শুধু ঠিক ছিল না আমাদের পারিপার্শ্বিকতা, ঠিক ছিল না আমাদের নিয়তি। আমাকে সম্পূর্ণ ভেঙে চুরে নিঃশেষ করে দিয়েছিল রাজিনের ওই কথাটি। আমার পড়াশোনা শিকেয় উঠেছিল, শুনতাম মা তাঁর স্বামী আবার বিদেশ চলে যাওয়ার আগেই এই বাসা বদলাবেন, শুধু প্রহর গুনতাম কবে বদলানো হবে বাসা। আমি তখন স্কুলে যাওয়া বাদে সম্পূর্ণ গৃহবন্দী করে ফেলেছিলাম নিজেকে।

আমি ক্লাস টেনে উঠার পর আমাদের নিজস্ব বাসা হল একদিন, রাজিনদের বাসা থেকে দূরে, একটা ছোট্ট ভাড়া বাসা, দু কামরার, ছাদের সঙ্গে লাগোয়া বাসা; আমার মায়ের দ্বিতীয় স্বামী আবারো চলে গেলেন দেশের বাইরে। কিছুদিন পর রাজিনরাও বাসা বদলে চলে গেল কল্যাণপুরে, ওর মা আমাকে সে কথা জানিয়েছিলেন। বোধ করছিলাম না বাসা বদলে ফেলার পর রাজিনের প্রতি বিন্দুমাত্র আবেগ, ব্যস্ত ছিলাম সম্পূর্ণ নিজেকে নিয়েই, সারাটা জীবন নিগৃহীত হয়েও বুঝিনি আমি অপাঙক্তেয়া, বুঝেছিলাম ওর কাছে নিগৃহীত হবার পর। মাধ্যমিকের পর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম বদলে যাব আমি, সবাইকে কাছে টানব অথচ বাঁধনে জড়াব না কখনোই, নিজের কষ্টকে ভুলে থাকতে এক নৃশংস খেলায় আমি মেতে উঠলাম। আমার সেই খেলার প্রথম শিকার ছিল আমার একটা গোবেচারা ছেলে বন্ধু, মাদ্রাসা থেকে এসে যে মাধ্যমিক পাশ করেছে কোনক্রমে। আমি ওকে কাছে টানিনি, ও নিজেই এসেছিল আমার কাছে, অনেক অনেক কাছে, অনেক সন্ধ্যা আমি ওর সাথে ছিলাম, এই শহরের সবগুলো রাজপথ-শাখাপথ-গলিপথ আমরা একসাথে হেঁটেছিলাম অনেক অনেক দিন, অনেকগুলো বছর একসাথে আমরা পথ চলেছি- ও সত্যি আমার খুব ভালো বন্ধু ছিল। ওকে আমি প্রতিশোধের লক্ষ্যবস্তু হিসেবে ভাবতে চাইনি কখনও, তবে ও একসময় আক্রমণাত্নক হয়ে ওঠে আমার ভালবাসা পাবার জন্যে, বাধ্য হয়ে আমাকে রূক্ষ ব্যবহার করতে হয় ওর সাথে, ওকে ঠেলে দিতে হয় দূরে। গোবেচারা বন্ধুটি কুঁকড়ে যায় আমার সেই অবহেলায়, খুব খারাপ লাগলেও আমি ওকে কখনো ডাকতে চাইনি আর। তবে ভাগ্য আমাদের অনেকবার কাছে টেনে আনে, অনেকবার দূরে সরিয়ে দেয়- আমি একসময় বাধ্য হয়ে ওর মাঝে রাজিনের ছায়া খুঁজতে চাই এবং ওকে চিরতরে হারাতে বাধ্য হই।

আমার মায়ের দ্বিতীয় স্বামীর প্রয়োজন হয়ে পড়ে এদিকে নিজের স্ত্রী ও শিশুপুত্রদের, আমি উচ্চ-মাধ্যমিক দিতে দিতেই মা চলে যেতে চান দেশের বাইরে, নিজের স্বামীর কাছে। আমি ততদিনে অনেক বড় হয়ে গেছি, নিজের জীবনে যথেষ্ট জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে, বুঝতে শিখেছি কেন মা চলে যেতে চাইছেন, তাঁর জীবনকে নষ্ট করতে চাইনি আমি বা আমার বোন। মা শুধু বললেন আমাদের মাসে মাসে খরচ পাঠাবেন, দু'টি উঠতি মেয়েকে একা রেখে যেতে তাঁর খুবই কষ্ট হচ্ছে, যে করেই হোক দ্রুত তিনি আমাদের নিয়ে যাবেন.....আমি জানতাম সেটা তিনি কখনোই পারবেন না। বাধা দেইনি তাঁর সিদ্ধান্তে, আমরা দু'বোন তৃতীয়বার নিগৃহীত হয়েছিলাম, অবহেলিত হয়েছিলাম।

মায়ের কাগজপত্র তৈরী হতে হতে আমার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল বেরুল, আশা কখনোই করিনি ফলাফল নিয়ে, তাই ৪.৫০ আমার কাছে আশাতীত আনন্দ বয়ে এনেছিল। বাধ্য হয়েছিলাম আমি একটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে, অবশ্য মায়ের কাছ থেকে টাকা নিতে বাধছিল। খুব কষ্ট করে রেজাল্ট ভাল করলাম প্রতিটা সেমিস্টারে, প্রথম সেমিস্টারের পর থেকে তাই স্টাইপেন্ড নিয়েই চলে যাচ্ছিল আমার।
বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সময়টা খুব সুখকর ছিল, "যাচ্ছেতাই' শব্দটার অর্থ পুরোপুরিই উপলব্ধি করেছিলাম সেই সময়টাতে, অসংখ্য ছেলেকে আমি পুড়েয়েছি এই সময়টাতে ব্যর্থতার অনলে, অনেক কাছে টেনে হঠাৎই দূরে ঠেলে দিয়ে বোধ করেছি বিচিত্র নির্মম সুখ।

এরপর অনেকদিন কেটে গেছে, এখন গ্রাজুয়েট হয়েছি, অনেক বাধাকেই বাধা দিয়ে চলে এসেছি জীবনের অনেকটা পথ, জীবনের সবচেয়ে বন্ধুর সময়টুকু। ভুলিনি আমি আজও রাজিনকে, ভুলিনি ওইসব দিনগুলোকে, ভুলিনি অসংখ্য ছেলেকে কাছে টেনে দূরে ঠেলে দিয়ে অবজ্ঞা করার তীব্র সুখগুলোকে। আমার গোবেচারা বন্ধুটির জন্য খারাপ লাগে মাঝে মাঝে, ও আমাকে বুঝতে পারত অনেক ভালভাবে, তবু, নিজের আবগেটুকুকেই বা ও কী করে সামাল দেবে? ওকে আমি দোষ দেই না, যদিও একদিন ওকে ফোন করায় ও খুব ক্ষেপে গিয়েছিল আমার উপর! আমি অবশ্য রাগ করিনি, ওর সাথে আমি যা করেছি, এইটুকু রাগ করার অধিকার তো ওর আছেই। আর তাছাড়া, আমি তো জানি, কতটা পাগলের মতো ও আমাকে ভালবাসে, আমার জন্মদিন পৃথিবীতে কারও মনে না থাকলেও ওর ঠিকই মনে থাকে, আমি জানি আজও ও সযত্নে আগলে রেখেছে ওর মুঠোফোনে পাঠানো আমার অদ্ভূত পাগলামিগুলো। করুক ও সামান্য রাগ, এই পৃথিবীতে অনেকেই অনেককে ভালবাসে, কিন্তু সবাই কি সবার হয়? সবাই সবার জায়গায় ঠিক থাকে, শুধু ঠিক থাকে না আমাদের নিয়তি, আমাদের পারিপার্শ্বিকতাটুকু।

আমরা দু'বোন মাকে ছাড়া খুব খারাপ কি আছি এখন? কী পার্থক্য ছিল পুরোনো ঢাকার ওই বিশাল মাঠে মা-হীন সারাদিন আর এখনকার মা-হীন সিকিযুগ? মা আমাদের মাসে মাসে টাকা পাঠান, মাঝে মাঝে চিঠি পাঠান, তার সাথে ছবি থাকে, ঝকঝকে আলোকজ্জল শহরের ছবি, আমাদের ছোট্ট ভাই দুটি বেশ বড় হয়ে উঠেছে এখন। মা আমাদের নিয়ে যাননি, তবে নিয়মিত টাকা দিয়েছেন, আমরা দু'বোন বাসা ভাড়া করে থেকেছি, এলাকায় বাজে মেয়ে হিসেবে আমাদের সবাই ট্যাগ করেছে, নোংরা মন্তব্য ছুঁড়েছে আমাদের দেখে, তবু আমরা পিছু হটে যাইনি। আমার মা একটা ভুল করেছিলেন জীবনে, যদিও তিনি নিজের জীবন গোছাতে এর পর আর ভুল করতে চান নি, সেই ভুলের মাশুল গুণছি হত চব্বিশ বছর ধরে আমরা দু'বোন, তাই আমরা কোন ভুল করতে চাইনি। নিজের আবেগটুকুর মূল্য আমি যার কাছে চেয়েছিলাম তার কাছে পাইনি, তাই অন্যদের আবেগকে আমি দু'পয়সার মূল্যও দেইনি কোনদিন, এটা যদি বাজে মেয়ে হওয়ার কারণ হয়, তবে আমি তা মেনে নিতে রাজী আছি।

এখন আমরা ছেড়ে দিব অনেক দিনের এই দু'কামরার বাসাটা, জীবনের অনেকগুলো বছর এখানে থেকেছি আমরা। এখন এখানে উঠবে বিশাল এপার্টমেন্ট হাউস, বাইরের দিকে শোভা পাচ্ছে সেটা কেমন হবে দেখতে তার বড় একটা সাইনবোর্ড, তিন বছর পর এলে হয়তো আমরা কোন চিহ্নই খুঁজে পাব না আমাদের এতদিনের আনন্দ-বেদনার চিলেকোঠার, যেমন আমরা আজ আর খুঁজে পাই না শৈশবের বিশাল মাঠের পাশের সেই অন্ধকার মামাবড়ি। সব বদলে গেছে আজ। সব বদলে যায়। আজ যা আছে তাও কাল বদলে যাবে। শুধু নিয়ত অপরিবর্তনশীল থেকে যায় মানুষের হৃদয়ে প্রথম কাঁপন তোলা অনুভূতিটুকু, প্রথম শিহরণ জাগানো স্পর্শটুকু; এই অনুভূতি এই স্পর্শ কখনো বদলে যাবার নয়।

/*এই লেখাটি দিয়ে ব্যক্তিগত কিছু ঋণ শোধ করার প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে।*/

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.