![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
কিচেনে ছেলের জন্য ঘুঙনি রান্না করছে পৃথা। মটরশুঁটি আর গো-মাংসের এই প্রিপারেশানটি ছেলে
অয়নের খুব পছন্দ। মেয়ে আবার পছন্দ করে ফ্রুট কাস্টার্ড খেতে। শুক্রবার কাস্টার্ড করবে বলে ভেবে রাখল পৃথা।
-পৃথা, কোথায় গেলে? হাঁক ছাড়ল পৃথার বর মাহমুদ।
-কিচেনে। বলল পৃথা।
-আমার কোন কিছুই খুঁজে পাচ্ছিনা। প্রয়োজনে একটা জিনিসও যদি হাতের কাছে পাই। কি
কর তুমি সারাদিন? আমার কোন কিছুর দিকেই তোমার কোন খেয়াল নেই। মাহমুদ রাগে
গজরাতে লাগল।
পৃথার বুকচিরে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস বেরিয়ে এল। মাহমুদের সাথে ওর বিয়ে হয়েছে বার বছর। অথচ পৃথার মনে হল, বার শতাব্দী ধরে ও মাহমুদের তির্যক বাক্যবাণগুলো হজম করে যাচ্ছে।
শ্যামল-শোভন বেতসলতার মত ছিপছিপে চেহারার উচ্ছল প্রাণবন্ত মেয়ে পৃথা। চারবোনের
মধ্যে ও সবার বড়। বাবা ছোট্ট ব্যবসায়ী। মা গৃহিণী। খুব একটা সচ্ছল অবস্থা কখনই ছিলনা ওদের। চারবোন হলেও বাবা- মা তাদের যথাসাধ্য দিয়েই শাসন-সোহাগে গড়ে
তুলেছেন ওদের।
ছোটবেলা থেকেই পৃথা কিছুটা ডাকা-বুকো টাইপের। ফুটবল খেলত, সাইকেল চালাত।
ছেলেদের সাথে আড্ডা মারত। সহজিয়া একটা মন ছিল তার। তাই খুব সহজেই সবার সাথে
ওর বন্ধুত্ব হয়ে যেত।
ছেলে বন্ধু-মেয়ে বন্ধু সবমিলে বিশাল এক বন্ধু বাহিনী ছিল ওর। মা এবং আত্মীয়-স্বজনেরা
শাসন করলেও বাবার নীরব প্রশ্রয়ে পৃথা খুব স্বাধীনচেতা মেয়ে হিসেবে বেড়ে উঠতে লাগলো।
এইচ এস সি সেকেন্ড ইয়ারে উঠে পৃথা প্রেমে পড়ল বিজন নামে এক খৃষ্টান ছেলের। বন্ধুরা
সবাই নিষেধ করল এ সম্পর্কে না জড়াতে। পৃথাও বুঝতে পারল কাজটা ঠিক হচ্ছেনা। কিন্তু
নিজেকে ফেরাতে পারলনা কিছুতেই।
বিজন আর পৃথা দুজনেই স্বাধীনচেতা সহজ আর শুদ্ধমনের মানুষ। তাই এ ব্যাপারটা তাদের
কাছে অন্যায় বলে মনে হলনা। একদিন পৃথা বিজনকে বলল
-আমরা কোন ভুল করছিনা তো?
-ভুল!কেন? ভুল করব কেন?
-আমি মুসলমান তুমি খৃষ্টান। মা-বাবা তো মেনে নেবে না এই সম্পর্ক।
-তুমি কি চাও সেটা বল। বিজন বলল গম্ভির মুখে।
-আমার চাওয়াটা তুমি জান বিজন।
-তাহলে সেটা তোমার মা- বাবাকে বুঝিয়ে বল। আমি আমার মা- বাবার একমাত্র সন্তান।
তারা আমার কথা ফেলতে পারবেনা। ধর্মতো মানুষকে গোঁড়া করেনা, বরং উদার হতে সাহস যোগায়।
-সেটা তোমার-আমার মানসিকতা। সবাই তো আর এভাবে দেখবেনা।
-ঠিক আছে বাবা। ছেড়ে দাও। যখনকার বিষয় তখন ভাবা যাবে।
কিন্তু কিছুই ঠিক থাকলনা এবং ভাবাভাবির অবকাশও আর মিললনা।
সকাল থেকেই আকাশ অন্ধকার করে ঝমঝম বৃষ্টি ঝরেই চলেছে। ঘর থেকে বের হওয়ার কোন
উপায়ই নেই। আজ কি আর দেখা হবেনা বিজনের সাথে! চুলবুলে পৃথা ছটফট করছে বিছানায়।
-পৃথা..................... । বাবার ডাকে পৃথা উঠে বসল।
-পৃথা আমাদের ঘরে আয়। বাবা বললেন বাইরে থেকে।
-বিজন কে? বাবার সরাসরি আক্রমন।
পৃথা চিত্রার্পিত।ওর মনে হল কেউ ওকে পেরেক দিয়ে গেঁথে দিয়েছে। সমস্ত উচ্ছলতা এক নিমেষে
উধাও।
-কথা বলছিস না যে। বাবার কণ্ঠে জমাট মেঘ।
মা ঠাস ঠাস চড় কষালেন ওর দুই গালে।
-কতবার বলেছি মেয়েকে এত লাই দিওনা। শেষে সামলাতে পারবেনা। ফলল তো আমার কথা!
মান-সম্মান সব গেল। আমার তো আরও তিনটে মেয়ে রয়েছে। তাদের ভবিষ্যতও তো তুই শেষ করে দিলি।এক সপ্তাহের মধ্যে আমরা তোর বিয়ে দেব। এই সাতদিন তুই ঘর থেকে বেরোতে পারবিনা। একটানা কথাগুলো বলে পৃথার মা হাঁফাতে লাগলেন। পৃথার বাবার দু’চোখ ভরা অশ্রু।
তারপর পৃথাকে রুদ্ধ করা হল তার ঘরে।বিজনের সাথে যোগাযোগের কোন সুযোগই পেলনা পৃথা।
কান্নাকাটি, আত্মহত্যার ভয় পর্যন্ত দেখাল পৃথা। কিন্তু বরফ গলল না কিছুতেই। সারাক্ষণের ছায়াসঙ্গী হলেন মা। তাই কোন উপায়ই থাকল না আর।
এদিকে পৃথার কোন খবর না পেয়ে ছুটে এসেছে বিজন। কিন্তু পৃথার মা ওকে চূড়ান্ত অপমান করে তাড়িয়ে দিলেন। অব্যক্ত যন্ত্রণায় দুমড়ে-মুচড়ে গেছে পৃথার হৃদয়। মৃত্যু কামনা করেছে অহর্নিশ ।
বিজন ছাড়া আর কাউকে মেনে নেয়া অসম্ভব।
কিন্তু মনে না নিলেও মেনে নিতে হয়েছিল তার মাহমুদকে। দশদিনের মাথায় পৃথার বিয়ে হয়ে
গেল মাহমুদের সাথে। ঢাকায় একটি প্রথম সারির পত্রিকায় কাজ করে সে। একটু বয়সী হলেও
আর্থিকভাবে সচ্ছল, সুদর্শন।
পৃথার বিয়ের পরদিনই বিজন কোথায় চলে গেছে কেউ বলতে পারলনা।
একবুক কষ্ট আর বুকচেরা হাহাকার নিয়ে যন্ত্রচালিত পুতুলের মত ‘ও’ ঢাকায় চলে এল মাহমুদের সংসার করতে।
খুবই একরোখা আর আত্মগর্বী ছেলে মাহমুদ। আর পৃথা তো স্বাধীনচেতা আর স্পষ্টভাষী। তাই
ঠোকাঠুকি, লাগালাগি লেগেই থাকত সংসারে। মাহমুদ প্রায় তার পুরনো সম্পর্ক নিয়ে কথা তুলত। পৃথা বিজনকে ভুলতে চাইলেও মাহমুদই সেটাকে জাগিয়ে রেখেছিল। তাই একটা দগদগে ঘা হয়ে বিজন চিরকাল পৃথার বুকে লুকিয়ে রইল।
-মা আমাকে একটা পাখির ছবি এঁকে দাওনা। ও মা শুনছো তুমি?
-মা------। পৃথা ঈষৎ বিরক্ত হল মেয়ের বায়নায়।
-চুপ করনা বাবা! আমার এখন অনেক কাজ।
তোর বাবার কাছে যা। পৃথা বলল ক্লান্তস্বরে।
-বাবা? কি যে তুমি বলনা মা! বাবা এঁকে দেবে ছবি! মেয়ের গলায় কান্না।
সত্যিই মাহমুদ কেমন যেন। বাচ্চাদের জন্য ও তার তেমন কোন ফিলিংস আছে বলে মনে হয়না। ধমক- ধামক ছাড়া কথাই বলতে পারেনা। ভাবতে ভাবতে পৃথার বুকটা ভার হয়ে
গেল। মেয়ের ড্রয়িং খাতাটা টেনে নিল আনমনে।
-বুবাই তোর মা’কে ডাকতো। মাহমুদ বলল বাইরে থেকে।
পৃথা একটু চমকাল। মাহমুদের কণ্ঠে যেন মেঘ ডাকছে। কি হল আবার! পৃথা বেরিয়ে এল
বাইরে।
-এই ছবিটা কার?
পৃথা স্থির, নিস্পন্দ। চোখভরা আলো নিয়ে বিজন হাসছে। সাদা-কাল ছবিটা কেমন অস্পষ্ট,
ঝাপসা। কিন্তু চোখদুটো যেন জীবন্ত। যেন পৃথাকে বলছে, ‘আমি আজও তোমায় ভালবাসি পৃথা’।
-কথা বলছনা যে? মাহমুদ রাগে গজরাতে লাগল। পৃথা ভাবল মিথ্যে বলবে। কিন্তু মাথায় জিদ চেপে গেল। বলল,
-এটা বিজনের ছবি।
-কি বললে! বিজনের ছবি! এতবড় সাহস তোমার! আমারই খাবে পরবে আর আমারই সিঁদ কাটবে? বিজন, বিজন আর বিজন।আমার জীবনটা তুমি নরক করে দিয়েছ।
-আমি না। তুমিই আমার জীবনটা নরক করেছ। আর আমি বিজন, বিজন করছিনা। তুমিই
হিংসায়-ঈর্ষায় জ্বলে পুড়ে মরছ। নিজেও সুখী হলেনা, আর আমাকেও হতে দিলেনা। তোমাকে
ঘেন্না করি আমি।একটা সন্দেহ-বাতিকগ্রস্ত অপ্রকৃতিস্হ মানুষ তুমি। পৃথা বলল কান্না জড়ানো গলায়।
-কি বললি তুই? রাগে অন্ধ হয়ে মাহমুদ ঠাস ঠাস চড় কষাতে লাগল পৃথার দু’ গালে।
মেয়ে শ্রেয়া চিৎকার করে কেঁদে উঠল।
মেয়ের চিৎকারে মাহমুদ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল বাইরে। পৃথার ছায়াঢাকা আকাশটা ঘোর
অন্ধকারে ডুবে গেল। দুটি শিশু তার দু’পায়ে এক কঠিন শিকল পরিয়ে দিয়েছে। এই ঘেরাটোপ
থেকে তার মুক্তি নেই।
পৃথা বেরিয়ে এল বাইরে। উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটতে লাগল আনমনে। রাস্তার মোড়ে অনেক মানুষের ভিড়।নিজের অজান্তেই পৃথা সেদিকে এগোতে লাগলো। একতা রক্তাক্ত দেহ পড়ে আছে
মাটিতে। সম্মোহিতের মত পৃথা এগিয়ে গেল। কেমন চেনা চেনা যেন। রক্তে মাখামাখি পুরো
মুখ। পৃথা দৌড়ে দোকান থেকে এক বোতল পানি নিয়ে এল। ঢালতে লাগলো মানুষটার মুখে।
পরমুহূর্তেই একটা অস্ফুট আর্তনাদ বেরিয়ে এল তার মুখ থেকে।
বিজন!
তার সমস্ত অনুভূতিতে লক্ষ-কোটি সুঁই ফুটতে লাগল। দুলতে লাগলো সমস্ত পৃথিবী। হৃদয় নিংড়ে বেরিয়ে এল অব্যক্ত কান্না। এত কাছে এসে বিজনকে সে চিরজন্মের মত হারিয়ে ফেলল!
শীতের মরা বিকেলে দুটো কাক কা-কা করে উড়ে যাচ্ছে দূর আকাশে। নিঃসীম শূণ্যতায় নিজেকেও
ভাসিয়ে দিল পৃথা, কাক দুটোর মতই।
২| ২০ শে আগস্ট, ২০১৩ বিকাল ৫:০২
অলওয়েজ ড্রিম বলেছেন: আপনি আমার অনুসৃত ব্লগার। আপনার কোনো একটা পোস্ট অনেক ভাল লেগেছিল। অনেক দিন আগে। তারপর থেকেই আপনাকে অনুসরণ করছি। আপনার কাছ থেকে আরও শক্তিশালী গল্প প্রত্যাশিত।
ভাল থাকবেন। শুভেচ্ছা।
৩| ২০ শে আগস্ট, ২০১৩ রাত ৯:৩৬
ডাঃ নাসির বলেছেন: অলওয়েজ ড্রিম , আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ।
©somewhere in net ltd.
১|
১৯ শে আগস্ট, ২০১৩ রাত ১০:৩৭
অর্থনীতিবিদ বলেছেন: বিজনের শেষ পরিণতি দেখে দেবদাসের কথা মনে পড়ে গেল। সত্যিকারের ভালবাসা কত গভীর হতে পারে তা বিজনকে দেখে বুঝা যায়। সত্যিকারের ভালবাসা প্রকৃতপক্ষে একটি স্বর্গীয় অনুভূতি। যিনি একবার এর স্পর্শ উপলব্ধি করার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন, তার পক্ষে নাগরিক জীবনের শত ব্যস্ততা স্বত্ত্বেও তা ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়। অথচ বাস্তবতা হলো সত্যিকারের ভালবাসাই অধিকাংশ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সংখ্যক বার বেদনার আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যায়। চমৎকার একটি গল্প উপহার দেওয়ার জন্য লেখককে ধন্যবাদ জানাই।