![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
অন্ধদের রাজ্যতে এক চোখা মানুষটি রাজা এবং আমি সেই রাজা।
কেয়া তুমি জানো, আমাদের এই সভ্যতায় হাজার হাজার প্রেম আর বিচ্ছেদের গল্প কাহিনি আছে,
তবে এই হাজার হাজার প্রেম-বিচ্ছেদের গল্প কাহিনির মাঝে একটা প্রিয় গল্প কাহিনি আছে।
এই গল্প কাহিনিটা ক্যানো আমার প্রিয় সেটা গল্পের শেষে বলব,
গল্প শুরু করা যাক,
আকাশের নীলতা যখন দিগন্ত ছুঁয়েছিল, থ্রেস নামের রাজ্যটি তখনও ছিল প্রকৃতি ও ঐশ্বর্যের মিশেলে গড়া এক শান্তি-আশ্রয়। সেই রাজ্যে, রাজপ্রাসাদের এক আঙ্গিনায়, গ্রীষ্মের এক সন্ধ্যায় জন্ম নেয় এক শিশু—নাম রাখা হয় অর্ফিয়ুস।
সে ছিল অন্য রকম।
তার কান যেন ধ্বনি নয়, হৃদয়ের নরম ভাষা শুনতে পারত। বাতাস যখন পাতার ফাঁকে সুর তোলে, দূরের নদী যখন পাথরে ধাক্কা খেয়ে কাঁদে—অর্ফিয়ুস তা বুঝত।
অর্ফিয়ুসের শৈশব থেকেই আশ্চর্য প্রতিভা ছিল। সে যখন আঙুল ছোঁয়াত বীণার তারে, তখন চারদিকে নেমে আসত নিস্তব্ধতা। রাজপ্রাসাদ, জনগণ, এমনকি প্রকৃতিও তার সুরে মুগ্ধ হয়ে যেত।
তার চারপাশে রাজসিকতা, প্রশংসা, দেবতাদের মুগ্ধতা—সব ছিল।
কিন্তু হৃদয়ের ভিতরে ছিল এক শূন্যতা।
এক গ্রীষ্মের উজ্জ্বল সকাল, যখন পৃথিবী জেগে উঠে, একটি উৎসবের প্রস্তুতি ছিল থ্রেসের গ্রামে। গ্রামের প্রান্তরে বসেছিল এক মেলা—সেখানে পৃথিবীর নানা প্রান্তের মানুষ আসত। মেলার আলো, গান, হাসি, আনন্দ—সবকিছুই যেন মিলে এক মায়াজালে আবদ্ধ হয়েছিল।
অর্ফিয়ুস তখন তার বীণায় সুর তুলছিল। তার সুর, যেন গহীন অরণ্য থেকে উদ্ভূত এক রহস্যময় শব্দ, বয়ে চলছিল বাতাসে। গান শুনে সবাই থেমে দাঁড়াল। এমন এক সুর ছিল, যা মানুষকে তার অন্তরলোকের গভীরে নিয়ে যেত। কেউ কিছু বলল না, সবাই যেন মুগ্ধ।
সেই মেলাতে প্রথমবারের মতন আসেছিল, ইউরিডাইস।
ইউরিডাইস—ছিল একজন পরী, সে যেন প্রকৃতির এক পূর্ণাঙ্গ চিত্র। তার চোখে অদ্ভুত এক শান্তি, যেন চিরন্তন সৌন্দর্যের প্রতীক। তার গা-গোলাপী শাড়ি, হালকা পা-এ মাটির সাথে মিশে যাওয়া, এবং তার হাসির দীপ্তি—সবকিছু মিলিয়ে সে যেন এক স্বপ্নের মতো।
অর্ফিয়ুসের সুরে ইউরিডাইসও হয়েছিল মুগ্ধ।
আর অর্ফিয়ুস হারিয়ে গেছিল ইউরিডাইসের সৌন্দর্যের আর নির্মল হাসিতে।
এক অদৃশ্য টানে তারা এঁকে অপরের কাছে আসল, কথা হল আর নিজের অজান্তে এঁকে অপরের প্রেমে পড়ে গেলো।
অর্ফিয়ুস তার সুরে ইউরিডাইসের জন্য গান লিখল, আর ইউরিডাইসের হাসি, তার নাচ—সবকিছুই অর্ফিয়ুসের হৃদয়ে গেঁথে গেল। তাদের সম্পর্ক ছিল অন্যরকম।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, অর্ফিয়ুস আর ইউরিডাইস একে অপরের জীবনে সম্পূর্ণরূপে প্রবাহিত হয়ে উঠল।
একদিন, বসন্তের উজ্জ্বল সকালে, ইউরিডাইস তখন কাঁপা কাঁপা হাতে অর্ফিয়ুসের হাতটি ধরল, তার ঠোঁটের কোণে হাসি ছিল, কিন্তু চোখে এক ভালোবাসার লজ্জা । অর্ফিয়ুসের প্রতি তার ভালোবাসা ছিল এতটাই বিশাল যে তা কোনো শব্দে প্রকাশ করার মতো ছিল না।
তারা সিদ্ধান্ত নিল, তার বিয়ে করবে, যাতে তারা একে অপরকে চিরকাল ভালোবাসাতে পারবে, যেখানে কোনো সীমানা, কোনো কাল, কোনো স্থানকে বাঁধা হতে পারবে না।
এতদিনে পুরো থ্রেস রাজ্য গুঞ্জরিত হয়ে উঠেছিল তাদের প্রেমের জয়ধ্বনিতে।
বিয়ের জন্য পুরো রাজপ্রাসাদ সাজানো হয়েছিল মল্লিক ফুলে, সোনালি রেশমী কাপড়ে, আর সেখানে ঝুলছিল এমন এক শান্ত সুর—যা সবকিছু মাতিয়ে তোলে।
অর্ফিয়ুস আর ইউরিডাইসের চোখে মুখে ছিল এক স্বর্গীয় আনন্দ।
আকাশ সেদিন কালো ছিল না, তবু বাতাসে অদ্ভুত এক ভার। যেন প্রকৃতি নিজেই থেমে ছিল এক ভবিষ্যদ্বাণীর সামনে। দেবতা হাইমেন, যিনি প্রেম আর বিবাহের আগুন জ্বালান, সেই আগুনে সেদিন শীতল ছাই ছড়িয়েছিলেন। তার চোখ ছিল ফাঁকা। তার কণ্ঠে ছিল কোনো আশীর্বাদ নয়, বরং এক নিঃস্ব ভবিষ্যৎ:
“এই বিবাহ অমর নয়। এই বন্ধন শেষ হবে বিষে, অশ্রুতে, এবং নিঃসঙ্গতায়।”
অর্ফিয়ুস বুঝেছিল না তখনও। ইউরিডাইস তখনও হাসছিল। তারা ভেবেছিল—ভালোবাসা হয়তো ভাগ্য বদলায়। কিন্তু ভাগ্য তো কখনও ভালোবাসে না, সে শুধু নির্দেশ দেয়।
ইউরিডাইস, যার পায়ের ছায়াতেও ফুল ফোটে, একদিন নদীর ধারে অন্যান্য বান্ধবীদের সাথে খেলছিল। তখনই, বনের অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এল Aristaeus—এক দগ্ধ পুরুষ, যার চোখে ছিল কাম, আর হিংস্রতার এক অমোঘ তৃষ্ণা।
ইউরিডাইস পালাতে চেয়েছিল। সে দৌড়ায়। ঘাসে পা পড়ে, তার আঙুলে সাপের হেসে ওঠা। একটা বিষাক্ত ছোবল, একটা স্তব্ধতা, একটা শেষ চিৎকার—আর ঈশ্বর তখনও নীরব।
আচমকা, বিষাধের ঝড় নেমে আসে অর্ফিয়ুসের জীবনে।
অর্ফিয়ুস কোন ভাবেই মেনে নিতে পারে না ইউরিডাইসের মৃত্যু,
ইউরিডাইসকে হারিয়ে যাওয়ার পর অর্ফিয়ুস বুঝে গিয়েছিল—ভালোবাসা যদি মৃত্যুর দেয়ালে আটকে পড়ে, তবে তাকে টেনে আনতে হয় অনন্ত অন্ধকারের ভেতর থেকে। সে নামল পাতালে। কোন নশ্বর মানুষ নামতে পারে মৃত্যুর রাজ্যে? কিন্তু তার হাতে ছিল লুটে, আর কণ্ঠে ছিল শোকের এমন এক সুর—যা স্বর্গ-নরক দুইই কাঁপিয়ে তোলে।
পাতাললোকের রাজা হেডিস কিন্তু হেডিস কাছে যাবার আগে চারণ ( Charon ) আছে তারপর সার্বেরাস ( Cerberus ) । কিন্তু অর্ফিয়ুস কিছু ভয় না করে হেডিসের সাথে দেখা করার পন করল।
চারণ, সেই মৃতদের ফেরিওয়ালা, যার চোখে কোনো করুণা নেই, সে থেমে গেল। অর্ফিয়ুস -এর সুর শুনে সে নৌকা নামিয়ে দিল।
সার্বেরাস, তিন-মাথাওয়ালা নরকরক্ষী কুকুর—যার দাঁত মানুষের আত্মাও ছিঁড়ে ফেলে—সে ঘুমিয়ে পড়ল, যেন সেই সুরে মৃত্যু নিজেই শুয়ে পড়েছে।
অর্ফিয়ুস পৌঁছাল হেডিস -এর দরবারে। এক রাজা, যার রাজত্বে শুধু অন্ধকার। অর্ফিয়ুস বলল কিছু না, শুধু বাজাতে লাগল। আর সেই সুরে ইউরিডাইস -এর নাম লেখা ছিল অশ্রু দিয়ে।
হেডিস স্তব্ধ হয়ে গেল। এমন সুর সে আগে শোনেনি। এমন ব্যথা, এমন অনুরোধ—যা নরকের ঈশ্বরের হৃদয়েও ফাটল ফেলে।
হেডিস অর্ফিয়ুসকে বলল, আমি এক শর্তে ইউরিডাইসকে নিয়ে যেতে দিব, “তুমি বা ইউরিডাইস কেউ ফিরে তাকাবে না, যতক্ষণ না তোমরা জীবিতদের পৃথিবীতে পৌঁছাও। একবারও না।”
অর্ফিয়ুস রাজি হয়ে গেল, তারা চলল। নরকের অন্ধকার পথ ধরে উপরের দিকে। কিন্তু নীরবতা ছিল ভয়ানক। ইউরিডাইস-এর পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছিল না, তার নিঃশ্বাস ছিল বাতাসের মতো হালকা।
অর্ফিয়ুস -এর হৃদয়ে কাঁপন ধরল। সে ভয় পেল—হয়তো সে একাই হাঁটছে। হয়তো সবটাই ছিল মায়া। হয়তো হেডিস প্রতারণা করেছে।
যেইমাত্র অর্ফিয়ুস আলোর দোরগোড়ায় পৌঁছালো, এক চুল আগে সে পৃথিবীতে প্রবেশ করল—তখনি সে পেছন ফিরে তাকাল। এক পলক। মাত্র এক দৃষ্টি।
কিন্তু ইউরিডাইস তখনো পাতালের সীমানায়। অর্ফিয়ুস দেখল, ইউরিডাইসের চোখে ছিল বিশ্বাস, মুখে নীরব কান্না। আর সেই মুহূর্তেই ইউরিডাইস ভেঙে পড়ল, অদৃশ্য হয়ে গেল পাতালে চিরকালের জন্য।
ইউরিডাইস হারিয়ে গেল অর্ফিয়ুসের জীবন থেকে, চিরকালের জন্য।
অর্ফিয়ুসের হারিয়ে যায় বিষাদের রাজ্যে আর জন্ম হয় এক বিদ্রোহীর ,"The Prophet of the Dead Lyre", এক মানুষ যে ঈশ্বরকে ভয় পায় না, প্রেমের ব্যর্থতায় লজ্জা পায় না, আর মৃত্যুর কাছে নত হয় না।
এই গল্পে কেয়া তুমি হলে সেই পরী ইউরিডাইস আর আমি অর্ফিয়ুসের।
নিয়তীর প্রতারনায় আমরা সর্বদা দুই গ্রহের।
©somewhere in net ltd.