| নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
দানবিক রাক্ষস
অন্ধদের রাজ্যতে এক চোখা মানুষটি রাজা এবং আমি সেই রাজা। না ঈশ্বর, না পিশাচ—আমি তৃতীয় বিশ্বাস।
১. কংক্রিটের রাজ্য ও নিঃসঙ্গতার আশ্রয়
ঢাকা শহরটা আমার কাছে যেন এক বিশাল কারাগার—
বিল্ডিংয়ের কংক্রিটের দেয়াল,
গাড়ির হর্ন,
বিষাক্ত ধুলো,
যন্ত্রের মতো হাঁটা মানুষ।
তবুও এই শহরের মধ্যেই আমি কাজ করি,
একটা কর্পোরেট অফিসে—
যেখানে মানুষের মুখের হাসির নিচে লুকিয়ে থাকে
চাপা ক্লান্তি আর বেঁচে থাকার অসহ্য প্রতিযোগিতা।
কিন্তু আমার মুক্তি আছে।
প্রতিদিন সন্ধ্যায় আমি বাইক চালিয়ে এক ঘণ্টা দূরের সেই বাড়িতে ফিরি—
যেখানে আমি থাকি একা।
চারপাশে গাছ, পাখি,
আর আমার বারান্দার সামনে ছোট্ট একটা পুকুর।
রাত নামলে আমি রকিং চেয়ারে বসি,
হাতে সিগারেট,
চোখে চাঁদ-তারার নরম আলো।
সেই নীরবতা আমাকে বাঁচিয়ে রাখে…
শহরের ভিড় আমাকে মেরে ফেলুক,
কিন্তু রাতের এই নিস্তব্ধতা আমাকে আবার জীবিত করে তোলে।
________________________________________
২. নীলা
আমার টিমে বছরখানেক আগে যোগ দিয়েছিল এক মেয়ে—
নীলা।
মফঃস্বল শহরের মেয়ে,
সাদামাটা পোশাক,
কিন্তু চোখে তীব্র উচ্চাকাঙ্ক্ষা
এবং অদ্ভুত এক মোহ।
তার সৌন্দর্য ছিল বেয়াড়া,
ধরতে গেলে হাত ফসকে যায় এমন।
আমার টিমে খুব দ্রুত সে হয়ে উঠেছিল কেন্দ্রবিন্দু।
বুদ্ধি, পরিশ্রম, শিখে ফেলার ক্ষমতা—
সবকিছুতেই সে আমাকে অবাক করত।
কিন্তু ছয় মাস পর একদিন সে বলল—
“স্যার, আমি রিজাইন করছি।”
কারণ?
মা আর বোনদের সব খরচ তার,
তাই ভালো বেতনের দরকার।
আরেকটা স্বপ্নও আছে তার—
বিদেশে পড়তে যাবে, বিদেশেই থাকবে।
আমি বললাম,
“উচ্চশিক্ষা ভালো… কিন্তু দেশের মাটির টান ভুলে যেও না।”
সে তবুও একরোখা—
যে করেই হোক দেশ ছাড়বে।
তার সেই জেদ, সেই সৌন্দর্য, সেই উচ্চাশা…
কার যেন খুব কাছাকাছি মনে হলো।
হ্যাঁ—কেয়া।
________________________________________
৩. কেয়া—আমার জীবন সমুদ্রের প্রথম জোয়ার
কেয়া আর আমি এক মফঃস্বল শহরের মানুষ।
হাইস্কুলে প্রথম দেখা—
তার হাসি ছিল যেন আকাশ ফুঁড়ে নেমে আসা আলো।
আমি তাকে ভালোবাসতাম,
কিন্তু বলতে পারতাম না।
কলেজের ২য় বর্ষে যেদিন বললাম, "কেয়া তোমাকে আমি বড্ড ভালোবাসি !!"
সে শুধু শুনল— নিশ্চুপ থাকল অনেকক্ষণ,
তারপর হেসে অন্য কথা বলতে লাগল।
উত্তর দিল না,
তবুও দূরে গেল না।
ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর বুঝলাম—
সে-ও আমাকে ভালোবাসে।
কিন্তু বলতে পারে না।
আমাদের সম্পর্ক এতটাই গভীর ছিল যে আমরা প্রায়ই সিগারেট শেয়ার করতাম,
বর্ষার দিনে রিকশায় ভিজতাম,
ক্যাম্পাসের প্রতিটা কোণায় সময়টাকে স্বর্ণের মতো আঁকড়ে ধরতাম।
আমি ভেবেছিলাম—
আমরা দুজন… আকাশের মতো সারাজীবন একই রঙে রঙিন থাকব।
কিন্তু তৃতীয় বর্ষে এসে কেয়া বদলাতে লাগল।
বিদেশে যাওয়ার স্বপ্ন, ওখানেই স্থায়ী হওয়া—
সেসব নিয়ে আমাকে চাপ দিত মাঝে মাঝে ।
আমি বলতাম—
“দেশটা ছেড়ে যেতে মন চায় না। এইদেশে মাটিতে ধূলয় এক আদ্ভুত টান আছে।”
সে চুপ করে যেত,
চোখে একটা অদ্ভুত শূন্যতা দেখা যেত।
তবুও…
যেদিন আমি কদমফুল হাতে হাটু গেড়ে তাকে প্রপোজ করলাম,
সে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল যেন পুরো পৃথিবী আমিই।
কিন্তু সে দিনো কেয়া বলেনি—
“আমি তোমাকেও ভালোবাসি।”
________________________________________
৪. বিদায়ের দিন—ভালোবাসা আর স্বপ্নের যুদ্ধ
গ্রাজুয়েশনের তিন মাস পর
এক সন্ধ্যায় কেয়া আমাকে জানাল—
তার স্কলারশিপ হয়েছে।
আমি কিছু বলতে পারিনি।
শুধু বুঝেছিলাম—
আমি কেয়াকে হারাতে যাচ্ছি।
সে বলল,
“তুমিও প্রস্তুতি শুরু করো। আমরা ওখানেই নতুন জীবন শুরু করব।”
কিন্তু আমার স্বপ্ন তো অন্যরকম—
আমি ধুলোবালিমাখা এই দেশটার মধ্যেই শান্তি খুঁজে পাই।
সেই রাতে অনেক উদাসীন হয়েছিলান, আমি ছাদে গিয়ে বসলাম।
অন্ধকার আকাশ,
তারার নরম আলো,
আর হাতে ছিল আমার পুরনো বন্ধু—গাজার একটা পট। আমার এই পুরানো বন্ধুর কথা কেয়া জানে না। একবার বলছিলাম, কিন্তু সে আমার বন্ধুকে পছন্দ করেনি, প্রেমিকারা তাদের প্রমিকের কাছের বন্ধুকে পছন্দ করে না তাই আমি আর কখন আমার এই কাছের বন্ধুর কথা কেয়াকে বলিনি।
চিন্তা, স্মৃতি, ভয়, ভালোবাসা—
সব মিলেমিশে এক ধরনের ধোঁয়াশা তৈরি করেছিল।
সেই রাতে আমি আমার পুরানো বন্ধু (গাজার পটের) সাথে অনেকক্ষণ ছিলাম কিন্তু সমাধান খুজে পাইনি, কেয়া নাকি এই দেশ, মাটি মানুষ !
অবশেষে…
কেয়া চলে গেল।
এয়ারপোর্টে আমি তাকে শেষবারের মত আলিঙ্গন করেছিলাম,
কিন্তু ধরে রাখতে পারিনি।
আমরা দুই ভিন্ন গ্রহের মানুষ—
এটা সেদিন স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল।
আজ দশ বছর কেটে গেছে।
সে বিদেশে,
আমি ঢাকায়—
তবুও প্রতিদিন কথা হয়।
________________________________________
৫. নীলা—অতীতের পুনর্জন্ম
একদিন কফিশপে হঠাৎ নীলাকে দেখি এক কোণে বসে আছে।
চোখে দুঃখ,
মুখে শক্ত হওয়ার চেষ্টা।
আমি তার কাছে গিয়ে বললাম,
“নীলা কী হয়েছে তোমার, তুমি ঠিক আছো তো?”
সে স্বাভাবিক ভাবে উত্তর দিল কিন্তু আমি বুঝেছিলাম নীলার ভিতরে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চলছে !
অনেক চাপাচাপির পর
সে একসময় ভেঙে পড়ল।
সে বলতে শুরু করল,
সে বিদেশে যেতে চায় শুধু একটা নিরাপদ ভবিষ্যৎ গড়ার জন্য নয় বরং সে বিদেশ যেতে চায় তার ভালোবাসার মানুষকে তারমতন করে পাবার জন্য,
যেখানে সমাজ ওদের ভালোবাসার ওপর ছুরি চালাতে পারবে না।
এই সমাজ, জাত আর ধর্ম তাদের কনো দিনও এক হতে দিবে না
কিন্তু তার প্রেমিক দেশ ছাড়তে চায় না।
নীলা তখন মুচড়ে কাঁদছিল… তার মনের ভাবনা তার প্রেমিককে বুঝিয়ে বলার ভাষা তার জানা নেই।
আর আমি চুপ করে ছিলাম—
কারণ তার গল্প শুনে
আমার ভেতরে কেয়ার কথা জেগে উঠছিল।
নীলা চলে গেল।
আর আমি ব্লাক কফির শেষ চুমুকে ভাবছিলাম—
ঈশ্বর মানুষ সৃষ্টি করেছেন,
মানুষ সৃষ্টি করেছে জাত-ধর্ম, অন্যকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য।
আর সেই জাত-ধর্মের একমাত্র শিকার হয় নিষ্পাপ ভালোবাসা।।
________________________________________
৬. রাত—ধোঁয়া—স্মৃতি
সেদিন রাতে বারান্দায় বসলাম।
হাওয়া থমথমে।
চারপাশে নিস্তব্ধতা।
নীলা আর কেয়ার গল্প মাথায় ঘুরতে লাগল।
আমি আবার আমার বন্ধু গাজার পট জ্বালালাম।
সবকিছু ধোঁয়াশা—
জীবন, ভালোবাসা, ভবিষ্যৎ।
হঠাৎ কেয়ার ফোন এল।
মধ্যরাতে যেমন আসে।
সে জিজ্ঞেস করল—
“তুমি ভালো আছো?”
আমি বললাম—
“আজ সবকিছু ধোঁয়ার মতো লাগে… কিছু বুঝতে পারছি না।”
আমি তাকে নীলার গল্প বললাম।
সব শুনে
সে শুধু বলল—
“অবশেষে কেউ তোমাকে সত্যিটা বলল।”
এই বলে ফোন কেটে গেল।
আমি স্তব্ধ।
কেয়া কি একই কারণে দেশ ছেড়ে চলেগেছে ?
সমাজের দেয়াল ভাঙতে পারোনি বলে?
আমি কি তখন বুঝতে পারিনি তার ভেতরের আতঙ্ক?
হঠাৎ মনে হলো—
এখন যদি তাকে বলি,
“দেখো, আমরা এখন প্রতিষ্ঠিত।
সমাজ আমাদের কিছু করতে পারবে না।”
তাহলে যদি কেয়া বলে —
“তুমি কিছুই জানো না…
এসো বিদেশে, এখানেই আমাদের ভবিষ্যৎ।”
আমি তখন কী বলব?
কোন উত্তর নেই।
শুধু ধোঁয়া আছে…
রাত আছে…
আর আকাশে একটা চাঁদ—
যে আমাকে নীরবে দেখে যায়।
________________________________________
ধোঁয়ার ওপারে নীল আকাশ — নিষ্ঠুর সমাপ্তি
রাত তখন গভীর।
অন্ধকারে পুকুরের পানি কালো কাঁচের মতো চকচক করে।
আমি রকিং চেয়ারে দুলছি…
হাতে শেষ গাজার পট ধরিয়েছি।
কেয়ার বলা শেষ বাক্যটা মাথায় ধাক্কা মেরে যাচ্ছে—
“অবশেষে কেউ সত্যিটা বলল।”
আমি হঠাৎ অনুভব করলাম—
এটা শুধু একটা মন্তব্য নয়।
এটা এক ধরনের স্বীকারোক্তি।
এক ধরনের অভিযোগ।
এক ধরনের লুকিয়ে থাকা ক্ষত।
আসলে কেয়া আমাকে ছাড়েনি।
আমি-ই তাকে হারিয়েছি।
কারণ আমি পৃথিবীটাকে দেখেছি
মাটির গন্ধে,
কর্ণফাটানো শহরে,
নিজের শেকড়ে—
আর সে দেখেছে পৃথিবীটাকে
স্বপ্নের সিঁড়িতে,
স্বাধীনতার খোঁজে,
অন্য এক আকাশে।
দুজনেই ঠিক ছিলাম,
দুজনেই ভুল ছিলাম।
এটাই সবচেয়ে নিষ্ঠুর সত্য।
ঠিক তখনই ফোনটা হাতে তুলে নিলাম।
কেয়াকে কল করতে ইচ্ছে হলো—
বলতে ইচ্ছে হলো,
“এসো, আবার শুরু করি।”
বলতে ইচ্ছে হলো,
“এবার সমাজ, পরিবার, কেউই বাধা নয়।”
কিন্তু আঙুল থেমে গেল।
কারণ একটা প্রশ্ন ছুরির মতো কেটে গেল—
“যদি সে বলে—
তুমি বিদেশে এসে থেকো,
এখানেই শুরু করি সব?”
আমি জানতাম…
সেদিনের মতো আজও
উত্তর দিতে পারব না।
হৃৎপিণ্ডে যেন কে যেন জোরে একটা লাথি মারল।
দোলচেয়ারটা হালকা দুলছে।
রাতের নীরবতা আরও কালো হয়ে গেছে।
গাজার ধোঁয়া উঠছে ওপরে—
কিন্তু এই ধোঁয়া আর শান্তি দিচ্ছে না।
এটা শুধু সত্যিটাকে স্পষ্ট করছে।
সত্যিটা হল—
কিছু ভালোবাসা জন্মায় ভুল সময়ে।
কিছু মানুষ একে অপরকে খুব ভালোবাসে—
কিন্তু তাদের পৃথিবী আলাদা হয়।
দুজনেই বাঁচে—
কিন্তু একসাথে নয়।
আমি চোখ তুলে আকাশের দিকে তাকালাম।
তারাগুলোকে মনে হলো ছিন্ন ভিন্ন।
চাঁদটাকে মনে হলো ক্লান্ত।
আমার বুকের ভিতর একটা ভারী চাপা কান্না উঠল,
কিন্তু সেটা বের হলো না।
পুরুষেরা কাঁদে না—
এটা সমাজ শেখায়।
আর ঠিক সেই সমাজটাই
ভালোবাসাকে মেরে ফেলে।
রাত বাড়তে থাকে—
আর আমি শেষ গাজার পটটা নিভিয়ে দিই।
কারণ আমি বুঝলাম—
কেয়া বা নীলা—
কেউই আসলে আমার গল্পের শুরু বা শেষ নয়।
এ গল্পের একটাই সত্যিকারের নায়ক—
সময়।
সময় সব নিয়ে যায়,
সব বদলে দেয়,
সব ভেঙে আবার গড়ে।
আর নায়ক যখন সময়,
তখন মানুষ কেবল পথিক।
ভালোবাসা কেবল একটি থামা-স্টেশন।
আর শেষ স্টেশন—
একাকীত্ব।
রকিং চেয়ারে বসে
নিজেকে খুব ছোট মনে হলো।
খুব তুচ্ছ।
খুব অচেনা।
মনে হলো—
জীবন খালি,
রাত খালি,
আকাশ খালি।
আর সবচেয়ে খালি—
আমার ভেতর।
গল্পের শেষ লাইন যেন নিজে থেকেই মনের মধ্যে লেখা হয়ে গেল—
“যে ভালোবাসা সময়ের সাথে যুদ্ধ করে—
সে ভালোবাসা বেঁচে থাকে না।
কিন্তু ক্ষত—
সারা জীবন বেঁচে থাকে।”
©somewhere in net ltd.