| নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
দানবিক রাক্ষস
অন্ধদের রাজ্যতে এক চোখা মানুষটি রাজা এবং আমি সেই রাজা। না ঈশ্বর, না পিশাচ—আমি তৃতীয় বিশ্বাস।
আদিমকাল, বরফে ঢাকা পৃথিবী। বাতাসে কাঁপতে থাকা তীক্ষ্ণ হাওয়া।
সেই যুগে আমাদের জীবন ছিল শুধু— বেঁচে থাকা।
আমি ছিলাম " শিকারি "। আমাদের গোত্র পাহাড়ের গুহায় থাকে, আর প্রতিদিন আমরা বের হই বন্য জন্তুর শিকার করতে।
শিকার না করলে, না খায়ে মৃত্যু নিশ্চিত।
আমাদের নিয়ম—
যে শিকার করবে, সে পুরো গোত্রকে বাঁচাবে।
সেদিন সকালের বাতাস ছিল অস্বাভাবিক ঠান্ডা। আকাশ জুড়ে সাদা ধোঁয়া। আমরা তিনজন শিকারের জন্য বের হয়েছিলাম।
এক বিশাল শৃঙ্গ হরিণকে আমি অনুসরণ করছিলাম গাছের মাথা দিয়ে। কিন্তু পা হঠাৎ পিছলে গেল—
এক মুহূর্তে মনে হল পৃথিবী উল্টে গেল।
শরীরটা আছড়ে পড়ল বরফে ভরা নদীতে।
তুষারের মতো ঠান্ডা পানি শরীরে খঞ্জরের মতো বিঁধে গেল।
তারপর নদী আমাকে টেনে নিয়ে গেল ভয়ংকর গর্জনের দিকে—
এক বিশাল জলপ্রপাত।
আর কিছু মনে নেই…
শুধু মনে আছে অন্ধকার আমাকে গিলে ফেলেছিল।
অনেকদিন পর চোখ খুললে বুঝলাম আমি এখনো জীবিত।
নিজেকে পেলাম এক গুহার ভেতর, কিন্তু সেই গুহা আমাদের গুহার মতো অন্ধকার নয়—
বরং ভেতরে নরম আলো, সবুজ বৃক্ষ, রঙিন ফুলে ভরা।
পাহাড় ভেদ করে যেন বসন্ত এসে থেমে গেছে এই এক কোণে।
কিন্তু আমি নড়তে পারছিলাম না।
শরীর ভাঙা, হাড়ে ব্যথা, রক্তে ভেজা।
হঠাৎ আলোর মতো নরম পায়ের শব্দ।
এক নারী… না, নারী নয়—পরী বলে মনে হল।
তার গায়ের গন্ধ ছিল বৃষ্টি ধোয়া মাটির মতো, চোখে ছিল কোন প্রাচীন শান্তি।
সে আমার ক্ষত ছুঁয়ে দেখল, তারপর গাছ-গাছড়া থেকে তৈরি কোন ওষুধের রস আমার শরীরে লাগাল।
আমার ব্যথা ধীরে ধীরে নরম হয়ে এল।
এইভাবেই দিন কেটে গেল।
সে আসত, আমার ক্ষত বাঁধত, খাবার দিত।
একদিন আমি বললাম,
“তোমায় ধন্যবাদ… তোমার নাম কী?”
সে নরম হাসল, যেন পাহাড়ি বাতাসে ফুল দুলে উঠল—
“আমার নাম কেয়া।”
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি কে, তোমারা কারা? তোমাদের গুহায় এত সবুজ কীভাবে?”
কেয়া বলল,
“আমরা পৃথিবীকে আঘাত করি না। আমরা শিকার করি না। আমরা মাটির সন্তান, মাটিকে লালন করে বাঁচি। এখানে আমাদের ছোট্ট গোত্র আছে। আমরা চাষ করি, ফল ফলাই, আর জন্তুকে ভালোবাসা দিয়ে বশ মানাই।”
এই কথা আমার কাছে যেন দেবতার ভাষা।
আমার গোত্রে জীবন মানে ছিল হত্যা।
এদের কাছে জীবন মানে লালন করা।
কেয়া আমাকে থাকতে বলল,
“তুমি আঘাত পেয়েছ, তোমার গোত্র দূরে। চাইলে তুমি এখানে থাকতে পারো।”
আমি মাথা নিচু করলাম আর ,
মনে হল আমার ভেতরের বর্বর শিকারী ধীরে ধীরে ভেঙে যাচ্ছে।
কেয়ার সঙ্গে কাটানো সময় আমার জীবনে নতুন রঙ, নতুন বোধ এনেছিল।
আমার শরীর পুরোপুরি সুস্থ হতেই কেয়া আমাকে তার গোত্রে নিয়ে গেল—
এক গোপন উপত্যকা, পাহাড়ের ফাটলে লুকিয়ে থাকা আশ্চর্য স্বর্গ।
উপত্যকার মাঝখানে ধোঁয়া ওঠা উষ্ণ ঝরনা,
চারপাশে সবুজ গাছ, ফলভরা লতা,
আর শীতল বাতাসে পাখিদের মধুর ডাক।
কেয়ার গোত্র ছিল মাত্র তিরিশ-চল্লিশ জনের।
তারা সবাই শান্ত স্বভাবের, যোদ্ধা নয়—
তাদের অস্ত্র ছিল ভালোবাসা আর শ্রম,
রক্ত আর শিকার নয়।
কেউ আমার দিকে ভয় বা সন্দেহের চোখে তাকাল না।
বরং কেয়া যখন বলল,
“তুমি—এখন থেকে আমাদের একজন।”
সবাই মাথা নত করল সম্মানের সঙ্গে।
কেয়া আমাকে শেখাতে শুরু করল আসতে আসতে,
কীভাবে মাটি নরম করতে হয়,
কীভাবে বীজ রোপণ করতে হয়,
কীভাবে পশুকে ভয় নয়, ভালোবাসা দিয়ে পাশে রাখা যায়।
আমি ধীরে ধীরে বুঝতে লাগলাম, কেয়া এখানে শুধু একজন নারী নয়—
সে এই গোত্রের হৃদয়।
তার কথা সবাই শুনে,
তার নির্দেশে সবাই কাজ করে,
সে যেন প্রাচীনকালের কোনও শামান—
যার সঙ্গে প্রকৃতি নিজেই কথা বলে।
রাতে আগুনের চারপাশে বসে আমি দেখতাম—
পাহাড় থেকে নামা অন্ধকারের ভেতরেও তার চোখে এক অদ্ভুত আলো।
সে বলত—
“পৃথিবীতে শুধু শক্তি দিয়ে টিকে থাকা যায না।
পৃথিবী টিকে থাকতে হয় সহানুভূতি দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে।”
তার প্রতিটি কথা আমার বুকে কাঁপন তুলত।
আমি বুঝতাম, আমি আর আগের বর্বর শিকারী নই।
তার হাত ধরে আমি প্রথমবার বুঝলাম—
পৃথিবী শুধু রক্ত নয়, রঙও ধারণ করে।
ধীরে ধীরে আমি কৃষি করতে ভালোবাসতে লাগলাম।
কারও চোখে ভয় ছিল না…
এখানে ছিল শুধু শান্তি।
কেয়ার দিকে তাকালে একটা কাঁপুনি উঠত বুকের ভেতর।
সে যেন একজন মানুষ নয়—
একটা দেবীর মতো।
প্রতিটি কাজে তার শান্তি, তার কোমলতা, তার চোখের গভীরতা আমাকে মুগ্ধ করত।
একদিন ভোরে কেয়া আমাকে নিয়ে গেল লাল মাটির এক ফসলক্ষেতে।
মাটির উপর কুয়াশা বসে আছে।
পাশেই পর্বতের ঢালে দুইটি বন্য ঘোড়া চরে বেড়াচ্ছে।
সে নরম গলায় বলল,
“আজ আমি তোমাকে নতুন কিছু শেখাবো—
মাটি কেমন কথা শোনে।”
আমি হাসলাম।
“মাটি কথা শোনে?”
কেয়া হাত তুলে বাতাসে ছুঁয়ে বলল,
“হ্যাঁ। মানুষের মতো মাটিও অনুভব করে।
যেখানে ভালোবাসা থাকে, সেখানে ফসল বেশি হয়।”
তার কথা শুনে আমার বুকের ভেতর হঠাৎ একটা কম্পন উঠল—
কারণ আমি জানতাম তার প্রতিটা শব্দই সত্য।
ফসলের মাঠে তার ছায়া পড়ে থাকত সোনালি ঘাসের উপর।
আমি কাজ করতাম, আর তার দিকে তাকালে মনে হত—
সে যেন বরফযুগের নিষ্ঠুর পৃথিবীতে
মানুষের প্রাণে বেঁচে থাকা শেষ আলো।
আমি তাকে বলতে চেয়েছিলাম—
“আমি তোমাকে ভালোবাসি, কেয়া। আমি তার প্রতিটা হাসি, প্রতিটা স্পর্শ, প্রতিটা শব্দে ডুবে যাচ্ছি”
কিন্তু আমার জাতির ভাষায় এই শব্দ নেই।
আমরা ভালোবাসা জানতাম না।
আমরা শুধু ভয়, হিংস্রতা ও শক্তিকে চিনতাম।
আমি নীরব থাকতাম।
কেয়া কিছু বুঝত, কিন্তু কিছু বলত না।
শুধু কাজের ফাঁকে একটা হাসি দিত, আর সেই হাসির ভিতর দিয়ে
আমার হৃদয়টাকে নরম করে দিত।
আমি রোজ তার পাশে দাঁড়িয়ে জমিতে কাজ করতাম।
গরুকে পানি দিতাম, পশম পরিষ্কার করতাম।
তার প্রতিটি জিনিসে আমি নিজেকে গড়ে নিচ্ছিলাম।
সে এক অদ্ভুত শক্তি দিয়ে আমাকে বদলে দিচ্ছিল,
যেন বরফযুগের পাথরখণ্ড ভেঙে ভেতরের মানুষটাকে বের করে আনছে।
সে মনে হয় বুঝত আমার নীরবতা…
কিন্তু কিছু বলত না।
শুধু হাসত।
আর সেই হাসি দেখে মনে হত—
হয়তো আমার পৃথিবীটা পরিবর্তিত হতে শুরু করেছে।
সময়ের সঙ্গে বুঝলাম—
আমি শুধু বেঁচে নেই,
আমি বাঁচতে শিখছি।
শিকারী ধীরে ধীরে মরছিল।
নতুন আমি জন্ম নিচ্ছিলাম—
যে কৃষি ভালোবাসে,
যে পশুর চোখে ভয় নয়, শান্তি দেখে,
যে কেয়ার সঙ্গে কাটানো প্রতিটা দিনে
নিজেকে আরও মানবিক করে তুলতে চায়।
কেয়ার উপস্থিতি আমার কাছে আশীর্বাদ ছিল,
আর আমি জানতাম—
এই গুহা, এই সবুজ পৃথিবী, এই কোমল জীবন…
আর সেই পরীর মতো মেয়েটি—এরা সবাই আমার নতুন গোত্র।
আর আমি…
আমি ধীরে ধীরে শিখছিলাম ভালোবাসার ভাষা।
এক রাতে সবাই আগুনের চারপাশে বসে গান গাইছিল।
আমিও ছিলাম।
হঠাৎ কেয়া আমার পাশে বসে ফিসফিস করে বলল—
“তুমি জানো?
এই উপত্যকা প্রকৃতির রক্ষা-ঢাল দিয়ে ঢাকা।
বাইরের লোকেরা কখনো খুঁজে পায় না।
তুমি ছাড়া।”
আমি বললাম,
“হয়তো ভাগ্য আমাকে এখানে এনেছে।”
কেয়া আমার দিকে তাকাল।
তার চোখে ছিল এমন এক গভীরতা,
যেখানে হাজার বছরের শান্তি ঘুমিয়ে থাকে।
“হয়তো।”
তার কণ্ঠ ছিল হালকা,
কিন্তু মনে হল সে আরও কিছু বলতে চায়।
হঠাৎ —
গুহার বাইরে পাহাড়ের গায়ে কোথাও থেকে
একটা অন্ধকার আলো ঝলসে উঠল।
তারপর ভেসে এল ভয়ংকর এক শব্দ—
মানুষের চিৎকার।
আমি চমকে উঠলাম।
কেয়ার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল।
কেয়ার গোত্র ভয় পায়,
তারা যুদ্ধ জানে না।
তারা অস্ত্র ব্যবহার করে না।
কিন্তু এই চিৎকার—
আমি জানতাম এই চিৎকার কী ধরনের।
এটা ছিল শিকারীদের ডাক।
আমার জাতির।
আমার গোত্রের।
আমি ঠিকই চিনলাম এই শব্দ।
ওরা আমার গোত্রের লোক।
যারা আমাকে মৃত ভেবেছিল।
হয়তো এখন এই উপত্যাকার দিকে চলে আসছে—
এবং শিকারীর চোখে
এই সবুজ উপত্যকা মানে নতুন প্রাণী, নতুন সম্পদ।
আমি দাঁড়িয়ে উঠতেই কেয়া আমার হাত চেপে ধরল।
“তোমার লোকেরা আমাদের খুঁজে পেলে…
আমরা রক্ষা পাব না।”
তার কণ্ঠে ভয় ছিল—
প্রথমবার।
আমি বুঝলাম,
আমার জীবনের দুই পৃথিবী—
শিকারীর অন্ধকার আর প্রকৃতির আলো—
আজ মুখোমুখি দাঁড়াতে যাচ্ছে।
আর এই উপত্যকা… কেয়া…
আমি কি হারাতে দেব?
আমি কি আমার পুরোনো গোত্রের সঙ্গে দাঁড়াব—
নাকি সেই মেয়েটার পাশে দাঁড়াব,
যে আমাকে মানুষ করেছে?
আমার হাত ধীরে ধীরে তার হাতের উপর শক্ত হল।
কেয়া আমার চোখের দিকে তাকাল।
তার ঠোঁটে ক্ষীণ নরম হাসি।
পালানোর পথ, বেঁচে থাকার প্রতিশ্রুতি
রাতে আগুনের আলো নিভে আসছিল।
উপত্যকার বাতাসে কাঁপন—চেনা মানুষের ভয়ংকর চিৎকার মিলিয়ে যাচ্ছিল পর্বতের গায়ে।
আমি জানতাম, আমার গোত্র খুব কাছে।
কেয়া আমার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল।
তার চোখে ভয়, কিন্তু তার ঠোঁটের কোণে থাকা বিশ্বাস আমাকে শক্ত করে তুলল।
আমি সিদ্ধান্ত নিলাম—
আমি লড়াই করব না। কখনোই আমার গোত্রের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলব না।
কিন্তু একই সঙ্গে
আমি কেয়ার গোত্রকেও মরতে দেব না।
দুটি সত্যের মাঝে দাঁড়িয়ে
আমি সেই পথটাকেই বেছে নিলাম
যেটা মানুষের পথ—
বাঁচানো, রক্ষা করা, পালানো।
কেয়া আমার হাত ধরে সামনে এগিয়ে এসে বলল—
“আমি প্রস্তুত, যা হবে দেখা যাবে , আমরা যুদ্ধ করব না , ।
তার চোখের মধ্যে
একটা অচেনা সাহস দেখলাম—
যে সাহস একজন মানুষকে দেবীও বানাতে পারে।
আমরা সবাই মিলে দ্রুত একটা পরিকল্পনা করলাম—
রাতের অন্ধকারে উপত্যকা ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া।
যুদ্ধ নয়—বেঁচে থাকা।
প্রকৃতির পথে,
বরফ, বন, নদী, ঝরনা পেরিয়ে
এক নতুন নিরাপদ ভূমি খুঁজে বের করা।
একটা যাযাবর জীবনের শুরু।
কেয়ার গোত্র নিজেদের ছোট ছোট গুটির মতো করে জিনিস গুছিয়ে নিল—
খাদ্য, শুকনো পাতা, পশু, আগুন জ্বালানোর পাথর।
আমি শেষবারের মতো তাকালাম সেই গুহার দিকে
যেখানে চোখ বন্ধ করলে কেয়ার হাতের স্পর্শ টের পেতাম।
যেখানে আমি মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসলাম।
যেখানে
আমার বর্বরতা মুছে গিয়ে
আমি মানুষ হলাম।
কেয়া পাশে এসে দাঁড়াল।
আমার বুকের ওপর হাত রেখে বলল—
“… তুমি প্রস্তুত?”
আমি বললাম—
“তোমার সাথে থাকলে আমি সবসময় প্রস্তুত।”
সে হাসল।
আর সেই হাসি বরফযুগের অন্ধকারকে আলোকিত করে দিল।
আমরা দল বেঁধে চলতে লাগলাম পাহাড়ের ভেতর দিয়ে।
চাঁদের আলোতে বরফ চকচক করছে।
পিছনে কোথাও থেকে ভেসে আসছে আমার গোত্রের বাঁশির শব্দ—
শিকারীরা তাদের শিকার খুঁজে পেতে এই শব্দ ব্যবহার করে।
সেই শব্দ শুনলে
অন্য যেকোনো মানুষ ভয় পেত।
কিন্তু আমি এখন আর শুধু শিকারী নই—
আমি পিছনে তাকিয়ে নিচু কণ্ঠে বললাম—
“ওরা কাছে এসেছে। আমাদের দ্রুত চলতে হবে।”
আমি পথ দেখাচ্ছিলাম,
আর তার হাত শক্ত করে ধরে রেখেছিলাম
যেন তাকে রাতের অন্ধকার ছুঁতেও না পারে।
একসময় আমরা পৌঁছালাম
এক বিশাল হিমায়িত নদীর ধারে।
নদীর উপর বরফ।
চলতে পারব—
কিন্তু ঝুঁকি আছে।
বরফ ভেঙে যেতে পারে যে কোনো মুহূর্তে।
আমি বললাম—
“এটাই একমাত্র পথ।
যদি আমরা এই নদী পার হই,
তাহলে ওরা আর কখনো আমাদের খুঁজে পাবে না।”
কেয়া আমার হাত শক্ত করে ধরল।
“তাহলে চল,
এখান থেকেই আমাদের নতুন পৃথিবী শুরু।”
পুরো গোত্র ধীরে ধীরে বরফের ওপর পা রাখল।
আমরা নরম নরমভাবে এগোলাম।
বরফে হালকা কটুকট শব্দ হচ্ছিল।
পিছনে শিকারীদের চিৎকার আরও কাছে আসছিল।
আমি শেষ গোষ্ঠীটির হাত ধরিয়ে দিয়ে বললাম—
“দৌড়াও!”
সবাই পার হয়ে গেল।
আমি আর কেয়া ছিলাম নদীর মাঝ বরফের ওপর।
আর তখনই—
পিছনে শিকারীরা দেখা গেল।
আমার পুরোনো গোত্র।
আগুনের মশাল হাতে।
আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে।
আমি শেষবার চোখের কোণে তাকালাম তাদের দিকে।
মনে হলো—
কখনো আমিও ওদের মতোই ছিলাম।
তারপর কেয়াকে বুকে টেনে নিয়ে
বললাম—
“চলো!”
আমরা দৌড়ালাম।
বরফ ভাঙতে ভাঙতে ফাটল ধরতে লাগল।
কিন্তু ঠিক আমাদের পেছনে
ভয়ে, ক্ষুধায় ও আগুনে তাড়া করা শিকারীরা
বরফের ফাটলে পড়ে গেল।
বরফ আমাদের বাঁচাল।
ওদের থামাল।
দুটি পৃথিবীর শেষ সীমানা
সেই বরফের সেতুতেই টেনে দিল—
চূড়ান্ত রেখা।
নদী পেরিয়েই
আমরা নতুন যাত্রা শুরু করলাম।
আর নেই আগের গুহা,
আর নেই কেয়া উপত্যকার নিরাপত্তা—
শুধু সামনে—
অজানা, বরফে ঢাকা পৃথিবী।
এখন আমরা যাযাবর।
নতুন আশ্রয় খুঁজছি।
নতুন উপত্যকা, নতুন সূর্য, নতুন জীবন।
আমি পাশে হাঁটছি কেয়ার।
তার হাত আমার হাতে।
পৃথিবীর শেষ প্রান্তে পৌঁছালেও
আমরা আলাদা হব না।
এক রাতে আগুন জ্বেলে
পাহাড়ের তলায় বসে
কেয়া আমার বুকে মাথা রেখে বলল—
“ তুমি জানো?
প্রকৃতি যাদের বাঁচতে দেয়,
তাদের জন্যই নতুন ভূমি অপেক্ষা করে।”
আমি তার চুলে হাত বুলিয়ে বললাম—
“আমি জানি।
কারণ আমার নতুন পৃথিবী—
তুমি।”
চাঁদের আলোতে কেয়ার চোখ দুটো জ্বলছিল
দেবীর মতো।
পরীর মতো।
মানুষের থেকেও বেশি কিছু।
বারফযুগের সেই দীর্ঘ রাতের শেষে
আগুনের পাশে,
ঠাণ্ডা হাওয়ার বিরুদ্ধে একসঙ্গে দাঁড়িয়ে
আমরা বুঝলাম—
এটাই আমাদের গল্পের শেষ নয়…
এটাই নতুন যুগের শুরু।
©somewhere in net ltd.