নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি বড় বেশি আত্মকেন্দ্রিক, আত্মভোলা এবং সাধারণ। সম্ভবত এ নিয়ে আমার “সুখ ও দুঃখ” কোনোটিরই অন্ত নেই।

লোকনাথ ধর

আমার আমি!

লোকনাথ ধর › বিস্তারিত পোস্টঃ

স্বপ্নযাত্রা!

২৩ শে জুলাই, ২০১৫ সকাল ১১:৫১

ঠাসসসসস......!

বাসের ভেতর আওয়াজটা বেশ জোড়ে শোনা গেল। থাপ্পড়টা এক হকার ছেলেকে মারা হয়েছে। তাল সামলাতে না পেরে হকার ছেলেটি সৌম্যের উপর হুমরি খেয়ে পড়লো। বাসের সিটে বসে জল্পনা কল্পনা করছিলো সৌম্য। খানিক সময় পর ঘটতে যাওয়া এক বিশেষ মূহুর্তের কথা ভাবছিলো সে।

নাদিয়াকে সে আজ তার ভালোবাসার কথা জানাবে, হাতে থাকবে একগুচ্ছ গোলাপ। তখন কিভাবে কাটবে সময়টা?
অনুভূতিটা কেমন হবে? যদি নাদিয়া না বলে দেয়? তাহলে কি হবে? ভাবতে গিয়ে অজানা একটা শঙ্কায় কেঁপে কেঁপে উঠছিল সে মাঝে মাঝেই! অনুভূতিটা অদ্ভুত।

অদ্ভুত রকমের আনন্দের!

ভাবনায় ছেদ পড়লো ছেলেটা গায়ের উপর এসে পড়ায়। সৌম্য বিরক্ত হল। ছেলেটাকে দাঁড় করিয়ে দেয়ার জন্য গায়ের উপর হাত রাখতেই চমকে উঠলো ও। ভয়ংকর জ্বর ছেলেটার গায়ে।

পিছন থেকে প্রায় খেকিয়ে উঠা এক পুরুষকণ্ঠের গলা শুনে সৌম্য আবার চমকাল। স্যুট টাই পড়া ভদ্রলোক। মাথায় ছোটখাট একটা টাক। চোখে ফুল রিম চশমা। ভদ্রলোক চিল্লাচ্ছেন, “ঐ হেল্পার, এসব শুয়োরের বাচ্চাদের বাসে উঠতে দিস ক্যান? ক্যামনে উঠে বাসে? দরজায় দাড়ায়ে দাড়ায়ে কি করস?”

সৌম্য ছেলেটাকে দাঁড় করিয়ে দিল। তারপর ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে আংকেল?”

লোকটা এবার দাঁড়িয়ে পড়লো, “এইসব হারামির বাচ্চাগুলারে দেখো। ভান করে, তাদের কিচ্ছু নেই। সাতদিনের না খাওয়া! বাসে উঠে হুমড়ি খেয়ে গায়ের উপর পরে। তারপর আলগোছে মানিব্যাগ গাপ করে দিয়ে ভেগে যায়। সবগুলা এক একটা কুত্তার পয়দা!”

সৌম্য হতবাক হয়ে গেল! একটা মানুষ আর একটা মানুষকে নিয়ে এভাবে বলতে পারে? সে কিছু বলতে পারলো না। ছেলেটির দিকে তাকালো। ময়লা জমে কালো হয়ে যাওয়া চেহারা চোখ থেকে মায়া কেড়ে নিতে পারেনি! কী মায়াভরা চোখ ছেলেটার!

এখন চোখদুটোয় স্পষ্ট ভয়।
হয়তো ভাবছে, সৌম্যও বুঝি তাকে মারবে।

সৌম্য তাকে অভয় দেয়ার চেষ্টা করলো। অভয়দানের একটা হাসি দিয়ে সে ছেলেটিকে কাছে ডাকলো, “এদিকে আয়।”
ছেলেটি পায়ে পায়ে এগিয়ে আসলো। চোখে জল টলমল করছে! একটু দূরত্ব রেখেই দাঁড়ালো ছেলেটি।
-“পেপার দে দেখি একটা?”
-“কোনটা ভাইজান?”
-“কোনটা নিব, তুইই বল।”
-“বাংলাদেশ প্রতিদিন নিবেন? পাঁচ টেকা।”
-“দে দেখি।”

ছেলেটা আস্তে করে পত্রিকা এগিয়ে দিলো।.এতক্ষণে সে বুঝে গেছে, এই ভাইজান মানুষ খারাপ না! পত্রিকাটি হাতে নিয়ে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট এগিয়ে দিলো সৌম্য।
-“ভাইজান, ভাংতি নাই তো আমার কাছে।”
-“আমার কাছেও তো ভাংতি নাই রে! কত আছে তোর কাছে?

ছেলেটা মাথা নিচু করলো। বউনির কাস্টোমার আজ তাকে হারাতে হচ্ছে। কপাল খারাপ হলে যা হয় আর কি।.মাথা নিচু রেখেই সে বলল, “বিশ টেকা।”
-“দে। বিশ টাকাই দে।”

ছেলেটার মুখ উজ্জ্বল হয়ে গেল। ছেঁড়া প্যান্টের পকেট থেকে বিশ টাকার একটা ময়লা নোট বের এগিয়ে দিলো।
সৌম্য পঞ্চাশ টাকার নোটটা তার হাতে গুঁজে দিলো। বলল,
“তোর গায়ে অনেক জ্বর। বাড়তি টাকা দিলাম। ওষুধ কিনে খাবি। আর রোদে আজ আর বেশি ঘোরাঘুরি করিস না। অসুখ
বাড়বে, কেমন?”

ছেলেটা মুখ তুলে তাকালো। তার চোখ পানিতে টলমল করছে। সৌম্য অন্যদিকে মুখ সরিয়ে নিলো। মৃদু দুঃখ তাকে অনেক বিচলিত করে। মৃদু কৃতজ্ঞতার দৃষ্টি তার চোখে পানি এনে দেয়। সে তার চোখের পানি ছেলেটাকে দেখাতে চায় না।

আরে ধুর! এখন কী এগুলো ভাবার সময়? আজ আর সে অন্যকিছু ভাববে না। আজ কেবল নাদিয়ার কথা ভাববে।
তার ভালোবাসা, স্বপ্ন এবং...... এবং, হয়তো তার সবটা!

নাদিয়ার সাথে পরিচয়ের আজ তিন বছর পূর্ণ হলো। এই দিনটার কথা সৌম্য কখনও ভুলে না! এই দিনে সে নাদিয়ার সাথে দেখা করবেই। নাদিয়া তাকে প্রায়ই বলে, “তুই একটা পাগল।”

আপনমনেই হাসে সৌম্য। সে তো পাগলই বটে! তবে এটাতো কেবল নাদিয়ার জন্যই! সে নাদিয়াকে ভালোবাসে। নাদিয়া যেমন তাকে.... নাদিয়ার আচরণেই তা বোঝা যায়। ভাষায় প্রকাশ হতেই যা বাকি।.সৌম্য মুখ ঘুরিয়ে তাকাল। ছেলেটা এখন অবধি কাঁদছে! কী আশ্চর্য! সে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে রে? কাঁদছিস কেন?”

ছেলেটা কান্নায় কথা বলতে পারছে না। সৌম্য বলল, “কি হয়েছে বল? না বললে বুঝব কিভাবে?”

ছেলেটি কান্না থামাবার চেষ্টা করছে। ওর পিঠ কেঁপে কেঁপে উঠছে! ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়েই বলল,
-“ ভাইজান?”
-“হ্যা বল?”
-“আমার আম্মা...”

ছেলেটা আর কথা বলতে পারছে না। সৌম্য খারাপ কিছু শোনার আশঙ্কায় আছে...

-“কি হয়েছে তোর আম্মার?”
-“অনেক অসুখ আম্মার। ঔষধ খাওয়াইতে পারি নাই ঠিকমতো। আইজ বাইর হওয়ার সময় কইছিলাম ঔষধ আনমু। কিন্তু পারলাম না!”
-“তোর নাম কি?”
-“আবু।”

আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না সৌম্য। ওর পকেটে নয়শ.টাকার মত আছে। নাদিয়াকে একগুচ্ছ গোলাপ আর ছোট্ট একটা উপহার কিনে দেবার জন্য টাকাটা। সে একবার পকেটে হাত দিয়ে টাকার অস্তিত্ব দেখল। না থাক। আর কিছু ভাববে না সে!

বাস রুপায়নের মোড়ে দাঁড়াতেই উঠলো সৌম্য। সৌম্যের হাতের মুঠোয় ছোট্ট ছেলেটার হাত। ঠিক যেন দুটি ভাই।

সৌম্য ছেলেটাকে টান দিলো, "আয় আমার সাথে।"
বাস থেকে আবুকে নিয়ে নামলো সৌম্য। নামার আগে সেই সুবেশী ভদ্রলোকটির দিকে জ্বলন্ত চোখে একবার তাকালো, ঘৃণায় ওর মুখ কুঁচকে আসছে।

বিকেলটা বেশ সুন্দর! সূর্য তার ভয়ংকর রোদ আছড়ে ফেলতে চাচ্ছে। কিন্তু পারছে কই!
কী মিষ্টি রঙে আকাশটা সেজেছে। অথচ ভাবতে খুব অবাক লাগে! এই সুন্দরের মাঝেই কত কষ্ট আর বেদনা লুকিয়ে আছে!

দীর্ঘশ্বাস ফেলল সৌম্য। আবুর দিকে তাকাল।
-“তোর বাড়ি কোথায়?”
-“নীড়পাড়ার পেছনের বস্তিতে।”
ছোট্ট ছেলেটা মৃদু ফোঁপাচ্ছে। আর কিছু ভাবলো না সৌম্য। পকেট থেকে পুরো টাকাটা বের করে ছেলেটার.হাতে ধরিয়ে দিলো সে। বলল, “যা।”
ছেলেটা টাকাটা হাতে নিয়ে বোকার মত দাঁড়িয়ে আছে। সৌম্য অবাক হলো, “দাঁড়িয়ে আছিস কেন!”

ছেলেটা কিছুই বলতে পারল না। সৌম্য বসে ছেলেটার কাঁধে হাত রাখল। বলল, “টাকাটা দিয়ে মাকে ওষুধ কিনে দিবি, নিজেও ওষুধ খাবি। আর মায়ের খেয়াল রাখবি সবসময়। মার কথা শুনবি। ঠিক আছে?”

ছেলেটার চোখ পানিতে ভরে উঠেছে। আস্তে একটু টোকা দিলেই যেন ঝরে পরবে! কী অদ্ভুত দৃশ্য! চোখের পানির রঙ মনে হয় আলাদা। এই জিনিসটায় অনেকখানি আবেগ মিশে থাকে বলেই হয়তোবা! সৌম্য মুখে হাসি ফুটিয়ে ছেলেটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো, “এখন সোজা বাসায় যাবি, কেমন?”

ছেলেটা নড়লো না। সৌম্য ধমকে উঠলো এবার, “গেলি রে!”

ছেলেটা কয়েক পা পিছিয়ে গেল। হাতের পত্রিকাগুলো ফেলে দিয়েই ঘুরে দৌড়াতে শুরু করলো।
দূরত্ব বেড়ে যাচ্ছে সৌম্যের সাথে। সৌম্য অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে ফেলল। সে ভয় পাচ্ছে, ছেলেটা হয়তো পিছনে ফিরে তাকাবে!

সে ছেলেটাকে তার ভিজে উঠা চোখ দেখাতে চায় না।

সে জানে। হ্যাঁ, সৌম্য জানে অনেকে লোক ঠকায় এভাবে।
কিন্তু আজ, এখন সে জানে, সে ভুল করে নি। এটা ভুল হতে পারে না। কিছুতেই না। আজ পৃথিবীর এক বৃহৎ ভালোবাসার প্রতি ছোট্ট সামর্থ্য দিয়ে কিছু করার চেষ্টা করেছে সে। এর বদলে যে সুখের অনুভূতি বইছে ওর ভেতরে, তা আর কি দিয়ে পাবে সে? মায়ের উপরে আর কিছু কি থাকতে পারে? সৌম্য মা হারা। সে জানে মায়ের অভাব কি। সৌম্য স্থির করলো , নীড়পাড়ার বস্তিতে থাকা মায়ের কাছে সে একবার যাবেই।

সৌম্য পিছনে ফিরে তাকাল।
ছেলেটা দৌড়াচ্ছে।

সৌম্য চোখটা মুছে নিলো সন্তর্পনে।
.
.
.
.
.
ঠাসসসসস......!

নাদিয়ার হাতের থাপ্পড় খেলো সৌম্য! থাপ্পড় খেয়ে মেয়েটার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলো, মেয়েটা কাঁদছে!
-“রামছাগল আমার। তুই এতো ভাল কেন রে?”

আসতে আধঘণ্টা লেট হয়ে গিয়েছে। মেয়েটার সামনে গিয়ে মাথা নিচু করে অপরাধীর মত দাঁড়িয়েছিল সৌম্য।
নাদিয়া কারণ জানতে চাইলে মৃদু স্বরে বলেছে সব। বলেছে এক গুচ্ছ গোলাপ আর ছোট্ট একটা উপহার না আনতে পারার ব্যর্থতার কথা।

মেয়েটা রেগে রেগে কি সব বলছে কিন্তু কিছুই কানে ঢুকে নি তার। একটা গিফট না হোক, একটা গোলাপ অন্তত নিয়ে আসার দরকার ছিল ওর। কিন্তু কি আর করা। যখন এই কথাটা মাথায় আসলো, ততক্ষণে পকেট গরের মাঠ!

হঠাৎ সবার সামনে সৌম্যকে জড়িয়ে ধরলো নাদিয়া। ঘটনার আকস্মিকতায় বিমূঢ় হয়ে গেলো সে! বিশ্বাস করতে পারছেনা সে কিছুই! এসব কি হচ্ছে! সে নাদিয়াকে সরানোর চেষ্টা করলো। সবাই অবাক হয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে! সে ফিসফিস করে বলল,
“কি করছিস এসব? ছাড়! সবাই তাকিয়ে আছে, দেখ!”

কোন উত্তর দিলো না নাদিয়া।সৌম্য মৃদু স্বরে বললো,
“তোকে অনেক ভালোবাসি।”
-“আমিও তোকে অনেক ভালোবাসি।”

নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলো না সৌম্য। চিৎকার করে সে জিজ্ঞেস করলো, “কি বললি!”

হঠাৎ যেন সম্বিত ফিরে পেলো নাদিয়া। সৌম্যকে ধাক্কা দিয়ে সরে দাঁড়ালো। সৌম্য দেখলো লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে নাদিয়ার চেহারা। চোখের কোণে কান্না জমে আছে। অথচ ঠোঁটে কী মিষ্টি এক টুকরো লাজুক হাসি।

নাদিয়া কখনও জানবেও না, এই সময়টায় কী সুন্দরই না লাগছিল ওকে!

-“কিছু বলি নাই তো! তোর রুমালটা দে দেখি। চোখ মুছব।”

সৌম্য দ্রুত পকেটে হাত দিল। রুমাল কই? সে করুণ মুখ করে নাদিয়ার দিকে তাকাল। নাদিয়া খিলখিল করে হেসে ফেলল।

সৌম্যের চুল এলোমেলো করে দিয়ে বলল, “গাধা, আবার রুমাল আনতে ভুলে গেছিস?”

বোকার হাসি হাসলো সৌম্য। তারপর হাতটা বাড়িয়ে দিলো। গলা কেঁপে উঠলো কথা বলতে গিয়ে। ফিসফিস করে বললো,
“আয়।"

হাতটা ধরলো নাদিয়া।

কৃপণতা করেনি আকাশটা।
বুকে চেপে ধরে রাখা সারি সারি পাহাড়ের গায়ে কে যেন আবীর মেখে দিয়েছে! খুব দূরে কয়েকটা গাছের মাথায় যেন চড়ে বসেছে লালপরী। সূর্যটা ডুবতে গিয়েও কেন যেন এখনও এক কোণে ঝুলে আছে! একটা দুটা তারা সময় জ্ঞানকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে জ্বলে উঠেছে এখনই। আকাশের এমন আবেদনে চুপ থাকতে পারেনি প্রকৃতিও!

পাখিরা সারাদিন দেশ দেশান্তর ঘুরে ফিরে আসছে নিজ নিজ নীড়ে, কথার ঝুলি নিয়ে! তাদের কিচিরমিচিরে মেতে উঠেছে একটা প্রান্তর! সবুজ ঘাসের বুকে একটা ছেলে আর একটা মেয়ে হেটে চলেছে হাতে হাত রেখে।

গাছের পাতায় বাতাস লুটিয়ে পরে অদ্ভুত একটা আবেশ সৃষ্টি করছে! যেন খুব গোপনে বলতে চাইছে,

“ভালোবাসি, ভালোবাসি!”

সৌম্য এবং নাদিয়া অনেকক্ষণ ধরেই এই আবেশটা ধরার চেষ্টা করছে। কে জানে, এই আবেগের উৎস কি! আদৌ কোন উৎস আছে কি না! থাকলে হয়তো খুব কাছেই! এতো কাছে যে, আমরা হাত বাড়ালেই ছুঁয়ে দিতে পারি....!!

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.