নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি বড় বেশি আত্মকেন্দ্রিক, আত্মভোলা এবং সাধারণ। সম্ভবত এ নিয়ে আমার “সুখ ও দুঃখ” কোনোটিরই অন্ত নেই।

লোকনাথ ধর

আমার আমি!

লোকনাথ ধর › বিস্তারিত পোস্টঃ

ল্যাম্পপোস্ট!

০৫ ই নভেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৪:৫৩

অন্ধকারে শরীর মিশিয়ে হাটতে আমার খুব ভালো লাগে। ব্যাপারটার মাঝে অদ্ভুত একটা রহস্যময়তা আছে। ঢাকা শহরে রাত মানেই অন্ধকার নয়। ল্যাম্পপোস্টগুলো তার আশেপাশের একটু জায়গা আলোকিত করে রাখে। ফুটপাতের উপরটা অন্ধকারেই ঢাকা পরে থাকে।

অন্ধকারে হাটতে হাটতে যখন আর ভাল লাগে না, আলোতে বের হয়ে আসি। আবার একটু পর অন্ধকারে সেধিয়ে যাই! হাটতে হাটতে প্রায় বাসার কাছে এসে পরেছি। বাসার সামনের ল্যাম্পপোস্টটায় নতুন লাইট লাগিয়েছে সিটি কর্পোরেশন। সোডিয়াম আলোর জায়গাটা দখল করে নিয়েছে সাদা রঙ। সোডিয়াম আলোর সুবিধাটা ছিল, আমার গায়ের রঙ, পরনের টি -শার্টটার রঙ, সব বদলে যেতো! আমি অবাক হয়ে বদলে যাওয়া আমাকে দেখতাম। অবশ্য এই দুধ সাদা লাইটটার সুবিধাও কম না! অনেক বেশি জায়গা আলোকিত করে রাখে। আমি আমার ছায়ার দিকে তাকিয়ে থাকি। খুব আস্তে আস্তে এক কদম এক কদম করে এগিয়ে যাই। অপেক্ষায় থাকি, ছায়াটা আমার উচ্চতার দ্বিগুণ ছাড়িয়ে যাবে!

নিজেকে এভাবে বড় করতে আমার খুব ভালো লাগে। পাশ দিয়ে যাওয়া এক দুইজন পথচারী অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। রাতের এই আর এক রহস্য। কেউ কাউকে এই সময় বিশ্বাস করে না। ওদের ভয় ভয় চোখ দেখে আমার খুব মায়া হয়। আমি মুখে অভয় দানের হাসি ফুটাই। ওদের ভয় বাড়ে!

প্যান্টের পকেটে শক্ত একটা কিছুর খোঁচা অনুভব করছি। একটা বিয়ের কার্ড। দুইদিন ধরেই চাচ্ছি, এটা থেকে মুক্তি পেতে। কিন্তু ফেলে দিতে পারছি না। বড় কোনো বিষয় নয় এটা, বিয়েটা। কনের নামটাও হয়তো এখন আর বড় কোন বিষয় নয়। মেয়েটা আমার খুব পরিচিত। খুব আপন বলবো কি? উহু! বলা উচিত হবে না। “অধিকার” শব্দটা ধ্রুব নয় মনে হয়। দুইদিন আগেও অবলীলায় ওকে আপন বলতে পারতাম। বলার অধিকার ছিল। আজ বলতে গিয়ে গলায় আটকে আসছে! কেমন উথলে উঠা কি যেন একটা কষ্ট অনুভব করছি বুকের একটা পাশে।

ক্ষীণ আনন্দে ঠোঁট প্রসারিত করা, একটু কষ্টে ঠোঁট বাঁকানো, একশোটা আবদার —গত দুই বছরে প্রায় সব অনুভূতিই গিলে ফেলতে পেরেছি। হঠাৎ করেই জেগে উঠা এই অনুভূতিটার সঠিক নাম দিতে পারছি না তাই।

বাসায় যেতে ইচ্ছা করে না আর। চার দেয়ালটাকে খুব ভয় লাগে আজ। কেমন যেন হাফ ধরে যায়! অথচ একটা সময় এই চার দেয়ালটাকেই খুব ভালবাসতাম। ফিরে যাওয়ার জন্য পাগল হয়ে থাকতাম। মধ্যবিত্ত একটা সংসারে জন্মেছিলাম। একমাত্র ছেলে হওয়ার জন্যই কি না, বাবা মা মুদ্রার উল্টো পিঠটা কখনও দেখতে দেন নি। অদ্ভুত একটা স্নেহের মাঝে মুখ ডুবিয়ে রাখতাম সব সময়। সব কিছুকেই মনে হতো খুব আকর্ষণীয়! কিন্তু খুব সুখের এই দুটি উৎস একে একে আমার কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হল। প্রথমে বাবা, তারপর মা। মনে হয় যেন মেরুদণ্ড ভেঙে গিয়েছিল। একটা মানুষ নাকি অবলম্বন ছাড়া দাঁড়াতে পারে না। আমিও কখনও ভাবিনি, আবার সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবো! কিন্তু, কী আশ্চর্য!

সময় সবকিছুই বদলে দেয়!

মানব চরিত্র খুব অদ্ভুত! সোজা হয়ে দাঁড়ালাম আবার। এই কষ্টটাও গিলে ফেলতে পারলাম। মানিয়ে নিতে পেরেছিলাম। খুব ভরসার একটা হাত আমার হাতে হাত রেখেছিল। সব ভুলে গিয়েছিলাম। কষ্ট, বিরহ! হুমম, কোত্থেকে যেন উড়ে আসা একটা বিরহ আবার ঘর বাঁধতে চাইছে বুকে।

বিয়ের কার্ডটা পকেট থেকে বের করলাম। কনের নামে কোন ভুল নেই তো? কাল থেকে কতবার চেক করেছি, হাতে গুনে বলা যাবে না বোধহয়। উহু! নাম তো ঠিকই আছে! নাফিসা আত্তিরা রীমা। আজ রাতেই বিয়ে। রাতের বিয়ে সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই আমার। নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করতে যাবো কি না, ভাবছি। যাওয়া উচিত। বউ সাজে ওকে দেখতে কেমন লাগে, খুব ইচ্ছা করছে দেখতে! ওর নতুন দ্বিতীয় অধ্যায়কে।

পাশ দিয়ে একটা রিকশা যাচ্ছিল। হাত নেড়ে দাঁড় করালাম। হাটতে খুব ক্লান্তি লাগছে।

- কই যাইবেন?
- দুই নাম্বার গেট।

রিকশাওয়ালা না করতে যাচ্ছিল। আমি পকেট থেকে পাঁচশো টাকা বের করে হাতে ধরিয়ে দিলাম। এই একটা নোটই ছিল আমার কাছে। খালি হাতে যাওয়া উচিত হবে না এটা ভেবে সাথে নিয়েছিলাম। হা করে আমার দিকে দু সেকেন্ড তাকিয়ে থাকলো রিকশাওয়ালা। তারপর বলল, “উঠেন।”

আমি রিকশাওয়ালার ক্লান্ত পায়ের দিকে তাকিয়ে আছি। প্যাডেলে ওর পা কেমন যেন বিভ্রান্ত! খুব চেষ্টা করছে ও টাকাগুলো উসুল করে নিতে। এরা ক্ষেত্রবিশেষে খুব সৎ হয়। কিন্তু ক্লান্ত পা কথা শুনছে না। গতি খুব একটা বাড়ছে না। খুব মায়া হচ্ছে ওর জন্য।

রীমা প্রায়ই বলতো, আমি নাকি অনেকটাই হিমুর মত। হিমু অনেক হাটাহাটি করে। আমিও করি। এই একটাই মিল। বাকি সবই অমিল। হিমুদের শিকড় গজায় না। আমার গজিয়েছে। আমি পড়ে আছি এক জায়গাতেই। সবচেয়ে বড় পার্থক্য, হিমুদের জন্য রূপারা অপেক্ষা করে। আর আমার জন্য?

হিসেব মিলছে না। আমি কোনদিন জটিল হিসেব মেলাতে পারি নি। আমার সেখানে না যাওয়া ভালো। আমি মহাপুরুষ নই, ভীত সন্ত্রস্ত একজন মানুষ মাত্র। আমি ভয় পাচ্ছি কনের প্রিয় মুখ আর মায়াভরা সেই দুচোখ দুটো আবার দেখে নিজেকে সামলে নিতে পারবো কি না, বিধ্বস্ত মানুষের বারেবার ঘুরে দাঁড়ানোর মত ভয়াবহ আর কিছু নেই।
-“ভাই, থামেন।”

রিকশাওয়ালা রিকশার প্যাডেল মারা থামিয়ে ক্লান্ত চোখে আমার দিকে তাকাল। একেবারে থামতেই আমি নেমে পড়লাম। অবাক হয়ে রিকশাওয়ালা বলল, “ভাই, আর যাইবেন না?”
- উহু!
- তাইলে এতো ট্যাকা দিলেন ক্যান? আমার কাছে এত ট্যাকার ভাংতি নাই তো, ট্যাকা কম দেন।

আমি খুব মিষ্টি করে হাসার বৃথা চেষ্টা করলাম। বললাম, “বাসায় ছেলেমেয়ে আছে না? যা পান, ওদের জন্য কিছু কিনে নিয়ে যাবেন আজ। ওদের জন্য এটা আমার উপহার, কেমন? বাসায় যান, ভাই।”

রিকশাওয়ালা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তাকে ওইভাবে রেখেই আমি আবার হাঁটা শুরু করলাম উল্টো দিকে। ছোট ছোট বৃষ্টির ফোঁটা পরছে। ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগছে। আর যে চলে যাচ্ছে, তার যাওয়ার পথটা মসৃণ রাখাই উচিত।

রীমা? মায়া?
কি লাভ, শুধু শুধু মায়া বাড়িয়ে?

গল্পগুলো এমনই। হুটহাট শুরু, হুটহাট শেষ। না হয় ভাববো, রীমাও আমার একটা গল্প ছিল!

সামনের ল্যাম্পপোস্টটার দিকে হাটছি। খুব আস্তে ধীরে। এক কদম এক কদম করে! দেখতে ইচ্ছা করছে, কখন আমার ছায়াটা আমাকে ছাড়িয়ে দ্বিগুণ হয়ে যায়! নিজেকে এভাবে বড় করতে আমার খুব, খুবই ভাল লাগে!

না। আমি হিমু নই। আমি অন্য কেউ! হিমুরা কখনো নিজেদের বড় করে না। আমি করি...

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ০৬ ই নভেম্বর, ২০১৫ রাত ১২:১৯

রক্তিম দিগন্ত বলেছেন: বাহ! চমৎকার ভাবে সাবলীল করেছেন তো লেখাটাকে। লেখার শুরুতেই হিমু হিমু আভাস পাচ্ছিলাম - শেষে দেখি তাই ই। ভাল লিখেছেন মানতেই হবে।

২১ শে অক্টোবর, ২০১৬ বিকাল ৫:০৮

লোকনাথ ধর বলেছেন: Thanks.

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.