নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি বড় বেশি আত্মকেন্দ্রিক, আত্মভোলা এবং সাধারণ। সম্ভবত এ নিয়ে আমার “সুখ ও দুঃখ” কোনোটিরই অন্ত নেই।

লোকনাথ ধর

আমার আমি!

লোকনাথ ধর › বিস্তারিত পোস্টঃ

মিথ্যের আরাধনা...

৩০ শে আগস্ট, ২০১৮ রাত ৯:৩৩



পৃথিবীর দিনগুলো খুবই অদ্ভুত - বিকেলে আলো ছেঁকে ছেঁকে পড়ছে পৃথিবীর উপর। বাইরের ছোট্ট সবুজ লনটার দিকে তাকিয়ে একটা সস্তা সিগারেট ধরালেন ছোটখাটো মানুষটা, আগুন উড়ে উড়ে যেতে চায় আকাশের দিকে। তার আগুনের নীলচে শিখাটা সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে, রঙয়ের মাঝে তার এইরকমটা প্রিয়। রাত গভীর হলে তার এ রঙয়ের সাথে বসে বসে গল্প করার শখ চাপে, লাইটার আর মোমে এই রঙটা ভালো করে ফুটে আসে। তার ভালো লাগে।

এখন তার ঘরে বেজে চলেছে বেথোভেন। মুনলাইট সনাটা। উচ্চস্বরে বাজলেও সুরটা যেন আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়ে তার চারপাশে, বাতাসে বাতাসে ধ্বনিটা আস্তে আস্তে প্রসারিত হয়। পিয়ানোর সুর মনে হয় কান্নার ফোঁটা পড়ার শব্দের মত, তার কাছে, কিন্তু বেথোবেন এর জিনিসটা তার কাছে মনে হতে থাকে অন্ধকার আর আলোর মাঝামাঝি যে দাগ চলে গেছে - তার উপর দাঁড়িয়ে থাকার মত। অলস অবসন্ন মনকে প্রথম প্রথম বসিয়ে রাখে, চোখ বন্ধ করলে বুঝা যায় তা আস্তে আস্তে চেপে ধরে রাখছে গদির সাথে - প্রতিটা নোট উঠানামা করার সাথে সাথে তার ভেতরে দোল খাচ্ছে তার অস্তিত্ব, মাথার ভেতরে শব্দের ঝড়কে শান্ত করে দিচ্ছে কিন্তু একইসাথে মনে করিয়ে দিচ্ছে তার ভেতর আলো আর অন্ধকারের সংমিশ্রণ।

তিনি মুলত একটা অফিসের ছোটখাট একজন কেরানি। গোটা সপ্তাহ জুড়ে মানুষের ভিড় চলে তার অফিসে, এটা কর, ওটা কর - চলে মানুষের নানা কথা, মত বিনিময় সভার মত কিন্তু আরও বেশি হুলস্থুল আর হট্টগোল। দিনের নয়টা থেকে শুরু হয়ে দুপুরের খাবারের আগ পর্যন্ত চলতে থাকে তার ডেস্কের সামনের কাজের ফরমাইশ, আর মাঝে মাঝে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার পায়ের ধুলির সাথে তার ছুটে চলা এক অফিস থেকে আরেক অফিসে। তার আশেপাশে মানুষের ফিসফিসানি। তার প্রথম প্রথম ভালো লাগতো না কিন্তু পরে সে আবিস্কার করেছে, এখানে তার একটা চরিত্র আছে। সে চরিত্র চালিয়ে যাওয়াই এখন তার মূল লক্ষ্য। মধ্যাহ্ন বিরতির সময় তিনি চলে যান অফিসের ছাদে, ভর দুপুরের তপ্ত রোদে পুড়ে পুড়ে কেউ ছাদে আসতে চায় না। এখানে এসে তিনি ভাবতে থাকেন তার চরিত্রটির কথা। ইচ্ছে হলেই তিনি কত সহজে ছাপ বসাতে পারেন মুখোশে। মধ্যাহ্ন বিরতির পর প্রায়শই মানুষের চাপ কমে যায়, তিনি তার চেয়ারে কাত হয়ে সিলিঙয়ের দিকে তাকিয়ে ভাবেন তার নিজস্ব সুরের কথা। একটু দূরে অফিসের নতুন জয়েন করা উচ্চবক্ষা সুন্দরী তরুণী জেনির পেছন পেছন লেলিয়ে বেড়ানো পুরুষদের দুষ্টু মিষ্টি হাসির কথা ভেসে আসে, চোখে প্রবল কামনার ছাপ নিয়ে ওরা ঘুরে বেড়ায় - মেয়েটি দক্ষ হাতে দুজনকে সামলে যায়। পাশের ডেস্কে বসে থাকা পঞ্চাশোর্ধ বুড়ো কলিগ রিটায়ার জীবনে করতে যাওয়া কাজের ফিরিস্তি বর্ণনা করতে থাকেন, মানুষটার কান অবধি পৌঁছায় না সে কথা, তিনি বুঝে কি না বুঝেন না - মাঝে মাঝে টিপ্পনী ছাড়েন তার স্ত্রীর কথা মনে পড়ে কি না দুপুরের পরে। একটু পরে গলার স্বর নিচু করে খুবই অশ্লীল ভাবে রসিয়ে রসিয়ে বর্ণনা করে যান দুপুরের খাবার পরে তার যৌবনে কাটানো দিনগুলোর কথা। না, মানুষটা তার স্ত্রীর কথা ভাবেন না। তাদের বিবাহিত জীবন খুব সুখকর কিছু নয়, তারা দুজনেই তা জানেন। বিশালবপু তার স্ত্রী পড়ে থাকেন টিভির উত্তেজনাময় অনুষ্ঠানগুলোর দিকে, সকালে উঠে দুটো নাস্তা তৈরি করার পর থেকে এই তার কাজ। মাঝে মাঝে বিলাপ করেন একা একা, ভাগ্যের দোষে তার সাথে ঘর করাকে শাপ শাপান্ত করেন কিন্তু একইসাথে তিনি জানেন, মানুষটা খুব উপদ্রব এমন কিছু নন। দিনের পর দিন নিঃস্পন্দন হয়ে যাচ্ছেন, কথাবার্তায় আগ্রহ কমে আসছে - এইটুকু পরিবর্তন লক্ষণীয়।

আজকের দৃশ্যে, তিনি বাসায় আছেন। একটু পরেই তার স্ত্রী মারা যাবেন।

তা নিয়ে তিনি খুব চিন্তিত তা নন। বরং সনাটার সুর একটু হাই নোটে উঠতেই তা তার মস্তিকের ভেতর গিয়ে আঘাত হানলো, তারপর সুরের সাথে হাত ধরে ধরে তা নামতে শুরু করলো তার শিরদাঁড়া বেয়ে বেয়ে নিচের দিকে - তিনি চেয়ারে বসে পড়লেন আস্তে করে। চেয়ারের হাতলে বাম হাতকে বিশ্রাম দিয়ে আবার তাকালেন সিলিঙয়ের দিকে। ডান হাতের ভেতর সিগারেট পুড়ছে আস্তে আস্তে, হুট করে তার দিকে তাকালে মনে হবে তিনি সে বিষয়ে সচেতন নন। চোখ বন্ধ করে তিনি সুরের উঠানামার সাথে সাথে চোখের মণি নাড়াচ্ছেন - বাইরে বাড়ি থেকে একটু দূরে একটা ময়লার সংগ্রহের ভ্যান এসে আস্তে করে থেমে গেলো। ব্যাপারটা অস্বাভাবিক কারণ আশেপাশের স্ট্রিটসহ তাদের স্ট্রিটে ময়লা সংগ্রহ করে দুপুরের পর পর অথচ আর পাঁচ মিনিট পরেই এদিকের আকাশে সন্ধ্যা পুরোপুরি নেমে যাবে।

তিনি জানেন, কেউ আসবে পেছনের গেইট দিয়ে। পেছনের গেইটের তালা খোলা। কারণ তিনি হয়তো চান তাদের বেশি কষ্ট না হোক। তিনি জানেন সবকিছুর শেষ এই সময়ে এভাবেই হবে এখন, আততায়ীর বুলেটের আঘাতে। আরেকটা কারণ হতে পারে, এখন ক্ষমতার চাহিদা সবখানে। শাসনের লোভে শাসকরা সবসময়ই সত্য চাপা দিয়ে যান। ক্ষমতার যুদ্ধে টিকে থাকার জন্য যা করা উচিত, সেটাই সত্য। যে কোন কিছু ব্যবহার করা তাদের অধিকার। এছাড়া বাকি সব মূল্যহীন।

পিয়ানোর সুর ধীরে ধীরে বাড়ছে, সিলিঙ স্পর্শ করবে...

তিনি চোখ খুলে বাইরের দিকে তাকালেন। সন্ধ্যাও স্পর্শ করবে তার বাড়ির সামনের গতকাল ছেঁটে রাখা সবুজ ঘাসগুলোকে...

আততায়ীরা পেছনের গেট দিয়ে ঢুকে তার স্ত্রীর বুকে সোজা বুলেট ঢুকিয়ে দিলো, যে বুকে কথারা জমে ছিল কি না তা জানা যায় নি কখনো। কিন্তু বুকের তীব্র স্পন্দন বন্ধ করে দেওয়া দরকার ছিল যেহেতু তিনি তার স্ত্রী এবং যাই হোক না কেন, জীবনের অর্ধেকের বেশি সময় তার সাথেই কাটিয়ে দিয়েছেন, মায়া থেকে মানুষ কাঁদে। মায়া থেকে মানুষ প্রতিশোধ চায়। চায় বিচার। রক্তের ভেতর জন্ম নেয় জিঘাংসা। তিনি এসব টের পেলেন না, হাতের শেষ হয়ে যাওয়া সিগারেটের ফিল্টারটা ফেলে শুধু সময় অনুমান করে হিসেব করে নিলেন। কারণ,

বাইরে, সন্ধ্যা স্পর্শ করলো ঘাসের চাদর।
আর একটা ফুল ঝরে পড়ে গেলো তার উপর।

তিনি অনুভব করলেন, তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে কেউ। তিনি ঘুরে তাকানোর চেষ্টা করলেন না। পিয়ানোর এই কাঁপা কাঁপা সুর কি সিলিং স্পর্শ করেছে? তিনি খেয়াল রাখেন নি। কিন্তু তার ভেতর ভেতর রক্তে রক্তে পৌঁছে গিয়ে কাঁপন তুলে তুলে ক্রমশ এগিয়ে চলেছে তার পাকস্থলী বরাবর, ঠাণ্ডা অনুভূতি ক্রমশ বাড়ছে।

একটা বুলেট ঢুকে গেলো তার মগজে।

পিয়ানোয় উঠে চলা বেথোভেন এর দরকার একটু পরেই শেষ হয়ে যাবে। আততায়ীরা খুঁজতে শুরু করলো একটা খয়েরী ব্রিফকেস যা তিনি সাথে নিয়ে অফিসে যান। দেয়ার ইজ আ ট্রুথ ইনসাইড...

কিন্তু কেউই টের পেলো না, সত্যটি আসলে এইমাত্র মরে গেছে, তার সাথে ঘুমিয়ে গেছে আলো। তারা যা খুঁজছে তা আসলে অন্ধকার। বেথোভেনের এর শেষটা মানুষটার কাছে সব সময় অন্ধকার জয়ের মত লাগতো কিন্তু তা সত্যি নয়। শেষটা খেয়াল করলে দেখা যায়, আলো আসার নতুন একটা পথের সৃষ্টি ছোট্ট একটা চাপে তৈরি হয়ে গেছে। এমনটাই হয়, সবখানে সবসময়।

গোটা বাড়িকে তেমনই রেখে বেরিয়ে গেলো তারা, শুধু একটা ব্রিফকেসহীন বাড়ি।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ৩১ শে আগস্ট, ২০১৮ দুপুর ১:১৪

রাজীব নুর বলেছেন: ভালো পোষ্ট। অথচ কোনো মন্তব্য নেই? কেন?

৩১ শে আগস্ট, ২০১৮ বিকাল ৩:৩৩

লোকনাথ ধর বলেছেন: হাহাহা, তা তো জানি নে। আমার তো মনে হচ্ছে এটা কিছুই হয় নি, তাই খালি।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.