নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

নবীন আনন্দ

আবদুল্লাহ আল আমিন

আবদুল্লাহ আল আমিন › বিস্তারিত পোস্টঃ

দীনেন্দ্রকুমার রায়: বাংলাদেশের সম্প্রীতিমুখর গ্রাম

০৯ ই জুন, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:৩৭

দীনেন্দ্রকুমার রায়: বাংলাদেশের সম্প্রীতিমুখর গ্রাম

আবদুল্লাহ আল আমিন



“দীনেন্দ্রকুমার রায় এক দরিদ্র বাঙালি লেখক, কলকাতার কল-কোলাহল ও সাহিত্য পরিবেশ ছেড়ে এই নিস্তরঙ্গ বরোদায় এসে পড়ে থাকার কোনও বাসনা তার ছিল না। কিন্তু পেটের জ্বালা বড় জ্বালা। বাংলা গল্প-প্রবন্ধাদি লিখে পয়সা পাওয়া যায় না। তাই বাধ্য হয়ে গৃহশিক্ষকতার কাজ নিতে হয়েছে। এমন ছাত্র পাওয়ায়ও অবশ্য ভাগ্যের কথা। ছাত্রটি মাস্টারের থেকে অনেক বেশি জ্ঞানী এবং স্বয়ং একজন অধ্যাপক। বরোদা রাজ কলেজে ইংরেজির অধ্যাপক হিসেবে এর মধ্যেই অরবিন্দর বেশ নাম ছড়িয়েছে।

......... আজ সকালে পড়ানো হচ্ছে দীনবন্ধু মিত্রের ‘লীলাবতী’। তার এক জায়গায় রয়েছে একটি রসের ছড়া;

মদের মজাটি গাঁজা কাটি কচকচ

মাসীর পিরীতে মামা হ্যাকচ প্যাকচ।” (সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ঃ প্রথম আলো, ২য় খন্ড, পৃ: ৪৩৩)

এভাবেই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তার ‘প্রথম আলো’ উপন্যাসে অরবিন্দের গৃহশিক্ষক ও সাহিত্যিক দীনেন্দ্রকুমার রায় সম্পর্কে লিখেছেন। মহাকাব্যিক ব্যাপ্তি ও বিশালতা নিয়ে লেখা এই বর্ণাঢ্য উপন্যাসে তৎকালীন অবস্থা বোঝাবার জন্য রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের ধর্ম আন্দোলন, প্রবাদ প্রতিম অভিনেতা গিরিশ ঘোষ-অর্ধেন্দু শেখর মুস্তাফি, ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ, অরবিন্দের সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন, হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ভেদ-বুদ্ধি, রবীন্দ্রনাথের কবি জীবনের নানা রূপান্তরের প্রসঙ্গ এসেছে অনুপঙ্খ ভাবে। সমকালের খ্যাতিমান লেখক হিসেবে দীনেন্দ্র কুমার রায়ের প্রসঙ্গও এসেছে এই উপন্যাসে। লেখক, প্রাবন্ধিক, সংবাদ-সাময়িকপত্র সম্পাদক, শিক্ষক, কথাপুরুষ, ডিটেকটিভ উপন্যাসের রচয়িতা ও অনুবাদক হিসেবে তৎকালীন বাঙালি সারস্বত সমাজে দীনেন্দ্রকুমার রায়ের (১৮৬৯-১৯৪৩) অধিষ্ঠান ছিল তর্কাতীত। একালে তিনি প্রায় বিস্মৃত একটি নাম। অথচ তাঁর রচনা পড়ে অভিভূত হয়েছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ এবং দীনেন্দ্র কুমার সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন ‘বাংলাদেশের হৃদয় হইতে আনন্দ ও শান্তি বহন করিয়া আনিয়া আমাকে উপহার দিয়াছে।’

ইংরেজরা আসার আগে বাংলার গ্রামগুলি ছিল নিস্তরঙ্গ, সচ্ছল, স্বনির্ভর ও উৎসব মুখর। মার্কসের ভাষায়, ‘শাশ্বত গ্রাম।’ গ্রামে সুখ-শান্তি সাচ্ছন্দ্য ছিল আর ছিল মানুষের মধ্যে সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি ও সহবত। সারা বছর জুড়ে গ্রামে গ্রামে চলতো নানা সব পাল-পার্বণ-নৃত্য-গীত, আচার-অনুষ্ঠান ও উৎসব। ইউরোপের শিল্পবিপ্লবের ঢেউ আর নবজাগৃতির নবীন আলোয় বাংলাদেশের গ্রামগুলির সেই চিরায়তরূপ একসময় বদলে যেতে থাকে। গ্রামের মানুষের জীবন, সংস্কৃতি, ভাবনা, মূল্যবোধ, বিশ্বাস, দর্শন এক নূতন সমীকরণের মুখোমুখি হয়। নাগরিক জীবনের আলো-ছাঁয়ায় প্রলুব্ধ হয়ে মানুষ পিঁপড়ের মতো শহরে এসে ভিড় জমাতে থাকে। গভীর দুঃখ-বেদনায় ম্লান ও পীড়িত হয়ে করুণ স্মৃতি নিয়ে পড়ে থাকে অসংখ্য গ্রাম। সম্পূর্ণভাবে লুপ্ত ও বিধ্বস্ত হওয়ার আগে দীনেন্দ্রকুমার রায় অন্তর্লোকের প্রেরণা আর গভীর আবেগ দিয়ে বেদনাপীড়িত গ্রামবাংলার হৃদয় থেকে তুলে নিয়ে আসেন গ্রামীণ জনজীবনের হর্ষ-বিষাদ, সুখ-দুঃখ , মিলন- বিরহ, পাল-পার্বণ, উৎসব-উদযাপনের বহুবর্ণিল রূপ প্রতিমা। দীনেন্দ্রকুমারের ‘পল্লীচিত্র’, ‘পল্লী বৈচিত্র্য’, ‘পল্লীকথা’, ‘পল্লীবধু’, প্রভৃতি গ্রন্থে মূলতঃ চিরায়ত বাংলার রূপপ্রতিমা উঠে এসেছে আবেগ ঘন বর্ণনায়। সেই সাথে তাঁর সমকালের সমাজ, সংস্কৃতি ও জীবনের একটি অনন্য দলিলও রচনা করেছিলেন ‘সেকালের স্মৃতি’ নামে একটি মূল্যবান স্মৃতি কথায়। ঊনিশ শতক ও বিশ শতকের চল্লিশ দশকের কালপর্বের অবিভক্ত বাংলা জীবন্ত হয়ে উঠেছে তার এই আত্মজীবনীতে।

দীনেন্দ্রকুমারের জন্ম অবিভক্ত নদীয়া জেলার মেহেরপুরের এক অভিজাত পরিবারে ২৫ আগস্ট ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে। তাঁর পিতা ব্রজনাথ ছিলেন সাহিত্য সেবী, পেশাগত কারণে কৃষ্ণনগরে বসবাস করতেন। মেহেরপুরে জন্ম হলেও দীনেন্দ্র কুমারের শিক্ষা জীবন অতিবাহিত হয় পিতার কর্মস্থল কৃষ্ণনগরে। দুই পুরুষের স্মৃতি বিজড়িত কৃষ্ণনগরে জীবনের দিনগুলি বেশ সুখেই কেটে ছিল তার, যদিও শিক্ষা ক্ষেত্রে তেমন বিশেষ কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখতে পারেননি সেখানে। তবে এখানেই তাঁর সাহিত্য জীবনের অভিষেক ঘটে। সাহিত্যের প্রতি ঝোঁক বেড়ে যাওয়ায় কাকা তাকে মহিষাদল নিয়ে আসেন এবং মহিষাদল হাই স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাস করেন এবং পরবর্তীতে কৃষ্ণনগর কলেজে ভর্তি হন। দীনেন্দ্র কুমারের কাকা ছিলেন মহিষাদল এস্টেটের ম্যানেজার এবং মহিষাদল রাজস্কুলের প্রেসিডেন্ট। এক পর্যায়ে এই স্কুলে শিক্ষকতা দিয়ে শুরু হয় তার কর্মজীবন। শিক্ষকতার সুবাদে সহকর্মী হিসেবে সাহচর্য লাভ করেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক জলধর সেনের। তিনি কাকার মাধ্যমে জলধর সেনকে মহিষাদল স্কুলে তৃতীয় শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দানের ব্যবস্থা করেন। চলতে থাকে দুই বন্ধু মিলে সাহিত্যচর্চা। সাহিত্যিক জলধর সেনের সাথে সাহচর্য লাভকে দীনেন্দ্র কুমার জীবনের পরম সৌভাগ্য হিসেবে বর্ণনা করেছেন সেকালের স্মৃতি গ্রন্থে। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘সুপ্রসিদ্ধ সাহিত্যিক রায় বাহাদুর শ্রীযুক্ত জলধর সেন মহাশয় সাহিত্য সমাজে খ্যাতি লাভ করিয়া রায় বাহাদুর হইবার পূর্ব হইতে আমি তাঁহার সহিত পরিচিত হইবার সৌভাগ্য লাভ করিয়াছি।’ (দীনেন্দ্র কুমার রায়: সেকালের স্মৃতি। রচনাসমগ্র, পৃ: ৩৭১)। মহিষাদলের দিনগুলি দীনেন্দ্র কুমারের জন্য বেশ সুখকর ছিল। কাকার বাসাতে জলধর বাবুর সাথে একত্রে বসবাস করার সুবাদে পেয়েছিলেন সাহিত্য চর্চার অফুরন্ত সুযোগ। আর তাঁর কাকাও ছিলেন বাংলা সাহিত্যের প্রবল অনুরাগী। সে সময় তার কাকার বাসায় আসতেন সাহিত্যিক চন্দ্রশেখর কর এবং দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। কাকার বাসায় অনুষ্ঠিত এক মজলিসে তিনি শুনেছিলে ডি.এল রায়ের স্বকণ্ঠে স্বরচিত হাসির গান, ‘পারো তো জোন্মো না ভাই, বিষ্যুৎ বারের বারবেলায়’, ‘তার রং যে বড্ড ফরসা, তারে পাবো হয় না ভরসা’। এ সময় থেকেই তিনি স্বর্ণকুমারী দেবী সম্পাদিত ‘ভারতী’ পত্রিকায় লেখালেখি শুরু করেন। জনপ্রিয় এই পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তাঁর অন্যাতম বিখ্যাত নাটক ‘হেঁয়ালী নাট্য’। এই নাটক প্রকাশনার জন্য পত্রিকা সম্পাদিকা স্বর্ণকুমারী দেবী পাঠকের বিরূপ সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছিলেন। মহিষাদলের সুখকর দিনগুলি খুব বেশি স্থায়ী হয়নি দীনেন্দ্রকুমারের। নিদারুণ অর্থকষ্ট ও জীবন-জীবিকার তাগিদে বাধ্য হয়ে মহিষাদল ত্যাগ করে তাঁকে রাজশাহীতে চলে যেতে হয়। জেলা জজের কর্মচারী হিসেবে সেখানে কর্মজীবনের দ্বিতীয় অধ্যায় আরম্ভ হয়। এ চাকুরী পেতে তাঁকে সাহায্য করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ সুহৃদ লোকেন্দ্রনাথ পালিত। অর্থকষ্টের কারণে সেখানেও তিন বছরের বেশি থাকতে পারেননি। তবে রাজশাহীর দিনগুলি তার জীবনের এক অনন্য অধ্যায়। এখানে তাঁর নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে প্রখ্যাত ঐতিহাসিক, লেখক অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য যদুনাথ সরকারের সাথে। দীনেন্দ্রকুমার ‘সেকালের স্মৃতি’ গ্রন্থে যদুনাথ সরকার সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। তাঁর কাছে যদুনাথ যেন “দ্যুতিমান মধ্যমণি’Ñ যার উজ্জ্বল প্রভায় আজ বাঙ্গালা, বিহার, উড়িষ্যা গৌরদীপ্ত।” ম্যাজিস্ট্রেট সুহৃদ লোকেন্দ্রনাথ পালিতের আতিথ্য গ্রহণ করে রবীন্দ্রনাথও মাঝে মাঝে রাজশাহীতে আসতেন। রাজশাহীতে লোকেন্দ্রনাথের মাধ্যমেই রবীন্দ্রনাথের সাথে তার পরিচয় হয়।

দীনেন্দ্রকুমার আশৈশব সাহিত্য অনুরাগী। শৈশবেই সাক্ষাৎ লাভ করেন কবি, নাট্যকার ডি.এল রায়ের সাথে। তাঁর বয়স যখন দশ বছর ‘সেই সময় কবিবর দ্বিজেন্দ্রলাল একবার মেহেরপুরে বেড়াইতে গিয়েছিলেন।’ মেহেরপুরে বেড়াতে এসে তিনি কবিতার উপর যে বক্তৃতা করেছিলেন, সেই বক্তৃতা শুনে দীনেন্দ্রের সাহিত্যপ্রীতি জন্মায়। বাবা ব্রজনাথ ছিলেন কবি ও সাহিত্যব্রতী। তিনি ‘আকিঞ্চনের মনের কথা’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। কাঙাল হরিনাথ মজুমদার (১৮৩৩-১৮৯৬) এর সাথে তাঁর বাবার ছিল অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। তারা দুজনেই ছিলেন সংসারে নির্লিপ্ত ও ধর্মনিষ্ঠ। রাজশাহীতে তিনি সান্নিধ্য লাভ করেন অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়, যদুনাথ সরকার প্রমুখ খ্যাতিমানদের সাথে। পরবর্তীতে ঘনিষ্ঠতা হয় সুরেশ সমাজপতি, রজনীকান্ত সেন ও শিবচন্দ্র বিদ্যার্ণব এর সাথে। দীনেন্দ্রকুমার ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকায় অগ্রহায়ণ ১৩২৪ সংখ্যায় ‘কবি রজনীকান্ত’ শীর্ষক স্মৃতিকথা লেখেন। ‘পূজার ছুটির পর তিনি বাড়ী হইতে রাজশাহীতে ফিরিয়া যাইতেছিলেন, আমিও ছুটির শেষে রাজশাহী যাইতেছিলাম... স্টিমারে উঠিয়া দেখি, স্টিমারের ডেকের উপর একখানি শতরঞ্চি বিছাইয়া রজনীকান্ত আড্ডা জমাইয়া লইয়াছে। তাহার গল্প আরম্ভ হইয়াছে।’

দীনেন্দ্রকুমার ছিলেন প্রখর স্মৃতিসম্পন্ন এক প্রতিভাধর লেখক। বারিদবরণ ঘোষ তার ‘দীনেন্দ্রকুমার রায়: জীবন ও সাধনা’ শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছেন, “দীনেন্দ্রকুমার ছিলেন আশ্বর্য স্মৃতিকথার মহান ভাণ্ডারী।’ তিনি আরও লেখেন, ‘মাসিক বসুমতী’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত তার সেকালের স্মৃতি (১৩৩৯-৪৩) এক মহামূল্যবান স্মৃতিচারণা। এটি আশু গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হলে সেকালের যুগ ও জীবনের একটি বিশ্বাসযোগ্য দলিল আমাদের করায়ত্ত হতে পারবে।”

বলা যেতে পারে সেই কথা ভেবে কলকাতার আনন্দ পাবলিশার্স এই মহামূল্যবান স্মৃতি কথা ‘সেকালের স্মৃতি’ (১৯৮৮) একালের পাঠকদের জন্য গ্রন্থাকারে পুনঃপ্রকাশ করেন। শুধু সেকালের স্মৃতিই নয় আনন্দ পাবলিশার্স দীনেন্দ্রকুমারের রচনা সমগ্র (২০০৪) পুনঃ প্রকাশ করেছে। গ্রন্থের ভূমিকায় কবি জয় গোস্বামী লিখেছেন, ‘এই রচনাগুলির ধমনীতে যে রক্তস্রোত বয়ে চলেছে তা এই এক শতাব্দীকাল পেরিয়ে এসেও জীবন্ত রয়েছে। কারণ তার মধ্যে আছে স্নেহ করুণার সঞ্জীবনী। সকলকে নিয়ে, সমস্ত পড়শী, প্রতিবেশীকে সঙ্গে জড়িয়ে যে বেঁচে থাকা, তারই উদ্ভাসন আছে এই সব রচনায়।’

দীনেন্দ্রকুমারের কর্মজীবনের এক বর্ণাঢ্য অধ্যায়ের সূচনা হয় বরোদায় এক মহান মানুষের সংস্পর্শে। এখানে তিনি অরবিন্দের বাংলা শিক্ষক হিসাবে কাজ শুরু করেন। এই কাজ পেতে রবীন্দ্রনাথের বিশেষ ভূমিকা ছিল। অরবিন্দের শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালনকে জীবনের এক অনন্য অধ্যায় হিসেবে বর্ণনা করেছেন তিনি। সেকালের স্মৃতি গ্রন্থে এই মহান দেশপ্রেমিক মানুষটির জীবনের নানা অজানা দিক উন্মোচন করেছেন। এই গ্রন্থে তিনি অরবিন্দকে অসামান্য প্রতিভার অধিকারী এক বিরলপ্রজ মানুষ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। অরবিন্দ এমন প্রখর মেধাসম্পন্ন মানুষ ছিলেন যে, সে সময় সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় গ্রীক ও ল্যাটিনে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। পরবর্তীতে তিনি বরোদা কলেজে ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। এই সময়কালে দীনেন্দ্রকুমার বরোদায় ছিলেন এবং অরবিন্দকে বাংলা শেখানোর দায়িত্ব পালন করেন। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ১৮৯২ খ্রি. অরবিন্দ কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ট্রাইপস বৃত্তি লাভ করে পরের বছর দেশে ফিরে আসেন। মাত্র সাত বছর বয়স থেকে বিলেতে থাকার কারণে তিনি বাংলা শিখতে পারেননি। অথচ বাংলা ভাষা সাহিত্য, সংস্কৃতি, বাঙালির ঐতিহ্যের প্রতি ছিল তাঁর অশেষ শ্রদ্ধা। তিনি ও তার অভিভাবকেরা আগ্রহ সহকারে একজন দক্ষ বাংলা শিক্ষকের খোঁজ করছিলেন। অবশেষে দীনেন্দ্রকুমার বাংলা শিক্ষকের দায়িত্ব ভার নিয়ে বরোদায় যান এবং সেখানে দুই বছর অতিবাহিত করেন। শিক্ষক হলেও এই জ্ঞানী ছাত্রের প্রতি শিক্ষক দীনেন্দ্রের ছিল গভীর শ্রদ্ধা। অরবিন্দের চারিত্রিক দার্ঢ্য, হৃদয়ের প্রসারিত সৌন্দর্য, সহজ ‘সাদা সিধে জীবন যাপন’ এবং প্লেইন লিভিং হাই থিংকিং এর আদর্শে তিনি গভীরভাবে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘অরবিন্দ আজন্ম সন্ন্যাসী। বাল্যকাল হইতে প্রায় পঁচিশ বৎসর বয়স পর্যন্ত তাহাকে ইংল্যাণ্ডে বাস করিতে হইয়াছিল। কিন্তু বিলাস লালসা তাঁহাকে স্পর্শ করিতে পারে নাই..... আমি দুই বৎসরের অধিককাল তাহার বঙ্গভাষার শিক্ষকরূপে তাঁহার সহিত একত্রে বাস করিয়াছি। কিন্তু কোন দিন তাহাকে মূল্যবান পরিচ্ছদ ব্যবহার করিতে দেখি নাই।’ (দীনেন্দ্রকুমার: সেকালের স্মৃতি, রচনা সমগ্র, পৃষ্ঠা: ৩০০)।

দীনেন্দ্রকুমার যখন বরোদায় ছিলেন তখন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে যোগাযোগ হয় চিঠিপত্রের মাধ্যমে। সে সময় তিনি সাধনা ও ভারতী পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখতেন। রবীন্দ্রনাথও চিঠিপত্রের মাধ্যমে তাঁর সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতেন। ‘অরবিন্দ, রবীন্দ্রের লহো নমস্কার’ কবিতাটি অবশ্য রবীন্দ্রনাথ বেশ পরে লিখেছিলেন; যখন সারা বাংলায় অরবিন্দ খ্যাতিমান হয়ে ওঠেন। বরোদা পর্বের শেষ পর্যায়ে দীনেন্দ্রকুমারের স্থায়ী কর্মজীবনের সূচনা হয় এবং সাহিত্যিক হিসেবে তার নামডাক ছড়িয়ে পড়ে। এসময় সাপ্তাহিক ‘বসুমতী’র প্রথম প্রকাশ (১০ ভাদ্র ১৩০৩) হয়। প্রথমে ব্যোমকেশ মুস্তাফি, পরে পাঁচকড়ি বন্দোপাধ্যায় এই পত্রিকার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি পত্রিকা ছেড়ে দিলে দীনেন্দ্র কুমারের প্রথম জীবনের সহকর্মী বন্ধু জলধর সেন এই কাগজের দায়িত্বভার পান। জলধর সেনের আহবানে দীনেন্দ্র বসুমতীতে যোগদেন এবং ভুবনমোহন মুখোপাধ্যায়, ক্ষেত্রমোহন গুপ্ত, সুরেশচন্দ্র সমাজপতির নিকট গ্রহণ করেন সাংবাদিকতার প্রথম পাঠ। একপর্যায়ে দীনেন্দ্রকুমার ‘বসুমতী’র সম্পাদক পদে অধিষ্ঠিত হন। তার অসংখ্য লেখা বসুমতী’র পাতায় মুদ্রিত হয়েছে এবং এসব লেখার বেশীর ভাগ আজও অগ্রন্থিত রয়েছে। ‘কথাশিল্পীর হত্যা রহস্য’ নামে একটি অনুবাদ উপন্যাস ১৩৫০ বঙ্গাব্দ থেকে তার মৃত্যুর পরও ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে। পরবর্তীকালে তিনি ‘নন্দন কানন’ নামে একটি মাসিক পত্রিকার সম্পাদনার সাথে যুক্ত হন। এই পত্রিকার প্রথম প্রকাশ ছিল ফাল্গুন ১৩০৭। দীনেন্দ্র কুমারের জনপ্রিয়তা ও খ্যাতির মূলে ছিল এই পত্রিকাটি। এতেই প্রকাশিত হয় তাঁর জনপ্রিয় সিরিজ ‘রহস্য লহরী’ এবং লঘুস্বাদের সেই রহস্য কাহিনী তাঁর বিপুল খ্যাতি এনে দেয়। তবে এসব রচনা তার সাহিত্য প্রতিভার আংশিক প্রকাশ মাত্র। রহস্য কাহিনীর বা ডিটেকটিভ উপন্যাসের লেখক হিসেবে তিনি জনপ্রিয়তা অর্জন করলেও এটি তার আসল পরিচয় নয়। বস্তুতঃ অপেক্ষাকৃত গৌণ পরিচয়কে প্রধান করতে গিয়ে তার সত্যিকার পরিচয় অনেকটা ঢাকা পড়ে গেছে। পল্লীচিত্র (৮ ডিসেম্বর ১৯৮১) পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কে তাই আচার্য সুকুমার সেন বলেন, “এখন যারা দীনেন্দ্রকুমার রায়ের নাম শ্র“ত আছেন; তাঁরা জানেন তাঁকে রহস্যলহরী সিরিজের গ্রন্থকর্তারূপে, মিষ্টার ব্লেকের স্রষ্টা রূপে। কেউ কেউ তাকে ‘মেয়ে বোম্বেটে’, ‘জাল মোহান্ত’ অথবা ‘পিশাচ পুরোহিত’ ইত্যাদি গ্রন্থের লেখক (বা অনুবাদক) রূপে জানেন।” এসব লেখা বা অনুবাদ তাঁর সৃষ্টিকর্মে মূল দিক নয়। তার শ্রেষ্ঠ কীর্তি উনিশ শতকের গ্রামবাংলা ও সমসময়কে নিয়ে লেখা রচনাবলী। ঊনিশ শতকের গ্রামবাংলার মানুষের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, উৎসব-পার্বণ নিয়ে রচিত তাঁর পল্লীচিত্র (১৩১১), পল্লীবৈচিত্র্য (১৩১২০), পল্লীকথা (১৩২৪) প্রভৃতি পল্লী বিষয়ক রচনাবলী তাঁর সাহিত্যিক জীবনের এক অনন্য কীর্তি এবং এসব লেখা শিল্প প্রসাদগুণ সম্পন্ন সাহিত্যের মর্যাদা পেয়েছে। পল্লীচিত্র গ্রন্থের উৎসর্গ পত্রে লেখা ছিল: ‘পরম শ্রদ্ধা ভাজনেষু, কবিবর শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয়, শ্রীকর কমলেষু।’ গ্রন্থটি প্রকাশে রবীন্দ্রনাথ ও সুরেশচন্দ্র সমাজপতি বিশেষ আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। ঊনিশ শতকের মধ্য বঙ্গের এক বর্ধিষ্ণু গ্রামের মানুষের যাপিত জীবনের নানা রঙিন ছবি আঁকা হয়ে এই গ্রন্থে। ঊনিশ শতকের গ্রাম মানে বারো মাসে তের পার্বণ, সে সময় নানা সব পাল পার্বণ ধর্মীয় আচার আমোদ-উৎসবে গ্রামবাসী মেতে থাকত। গ্রামে গ্রামে অনুষ্ঠিত হত রথযাত্রা, স্নানযাত্রার মেলা, বৈশাখ সংক্রান্তি, নন্দ উৎসব, চড়ক, গাজন উৎসব। গ্রামে ছিল সুখ শান্তি আর সচ্ছলতা। পাঠক সমাদৃত এ গ্রন্থের পাতায় পাতায় আঁকা হয়েছে সেকালের সৌহার্দ্য সম্প্রীতিমুখর গ্রাম আর আনন্দ ও উৎসবময় জীবনের নানা খন্ডচিত্র। দীনেন্দ্রকুমার রায় ‘পল্লীচিত্রে’ সেকালের পল্লী জীবনের যে বর্ণনা দিয়েছেন তাতে আবেগের অতিশহ্য নেই, আহা মরি বাড়াবাড়ি নেই। আছে প্রতিদিনের ঘটে যাওয়া সাধারণ ঘটনা অসাধারণ ভাবে তুলে ধরার আন্তরিক প্রয়াস। সেকালের কথায় ভরপুর পল্লীচিত্র অনেক বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা শেখার পাঠ্যগুলির অন্যতম ছিল। অথচ নিজ দেশ বাংলাদেশের তিনি নির্বাসিত। স্বতঃই মনে প্রশ্ন জাগে কার অভিশাপে বাংলাদেশের পাঠককুল তাঁকে ভুলে গেল?

পল্লীচিত্রের মত ‘পল্লীবৈচিত্রে’ (১৩১২) বাংলার পল্লী অঞ্চলের নানা ছবি আঁকা হয়েছে। লেখক গ্রন্থের ভূমিকায় বলেছেন, ‘পল্লীচিত্রে পল্লী সমাজের বিশেষত্ব সম্বন্ধে যে সকল কথা বলিতে পারি নাই সেই সকল কথায় আলোচনা করিলাম।’

এই গ্রন্থে এগার টি প্রবন্ধ রয়েছে। প্রবন্ধগুলির বিষয়বস্তু বাংলাদেশের বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠান। দীনেন্দ্রকুমার রায়ের আমলে অর্থাৎ ঊনিশ শতক থেকে বিশ শতকের চল্লিশ দশক বর্তমান বাংলাদেশের প্রায় সব গ্রামে কার্ত্তিক থেকে চৈত্র পর্যন্ত যে সব সামাজিক ও লৌকিক উৎসব এবং ধর্মানুষ্ঠান চলত তারই আবেগঘন বর্ণনা পল্লীবৈচিত্র। গ্রন্থের প্রথম প্রবন্ধ হলো কালীপূজা। অষ্টাদশ শতকে শক্তির আরাধনা করতে ডাকাতরা কালীপূজার আয়োজন করতো। ডাকাতেকালী পূজকদের পুরোহিতরা কালীপূজায় পুরোহিতের দায়িত্ব পালন করতেন। এখন কালীপূজা সার্বজনীন দূর্গাপূজার রূপ ধারণ করেছে। দীনেন্দ্রকুমার কালীপূজা সম্পর্কে যে বর্ণনা দিয়েছেন তার যথেষ্ট ঐতিহাসিক মূল্য রয়েছে।

গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত অন্যান্য প্রবন্ধগুলি যথাক্রমেÑ ভ্রাতৃদ্বিতীয়া, কার্তিকের লড়াই, নবান্ন পোষলা, পৌষ সংক্রান্তি, উত্তরায়ন মেলা, শ্রী পঞ্চমী, শীতল ষষ্ঠী, দোলযাত্রা ও চড়ক। গ্রন্থের ষষ্ঠ প্রবন্ধ হলো পৌষ সংক্রান্তি। ‘পৌষ মাসকে পল্লী রমণিগণ লক্ষ্মী মাস বলিয়া মনে করেন। কোন রমনী পৌষ মাসে স্বামীগৃহ হইতে পিতৃগৃহে বা পিতৃগৃহ হইতে স্বামীগৃহে গমন করে না।’ (দীনেন্দ্রকুমার রায়: পৌষ সংক্রান্তি। পল্লী বৈচিত্র, রচনা সমগ্র। পৃষ্ঠা-১৫১।)

হেমন্তে বাংলাদেশের সব গ্রাম জুড়ে চলত ধান কাটামাড়ার উৎসব। পৌষের প্রথম ভাগে এ ব্যস্ততার রেশ কিছুটা বেশি থাকতো। শীতের শেষের দিকে শাকসবজি বা কাঁচা তরকারি উৎপাদনে নিয়োজিত কৃষকের দিনের বেলায় কিছুটা ব্যস্ততা থাকলেও সন্ধ্যা থেকে রাতভর তাদের ছিল অখণ্ড অবসর। তাছাড়া প্রাকৃতিক দূর্যোগ বা বিপর্যয় না থাকায় পৌষ মাস থেকেই বাংলার গ্রামগুলো উৎসবমুখর হয়ে উঠত। গ্রামের মানুষ পৌষ মাসে শীতের নিমন্ত্রণে পাড়ায় পাড়ায় আয়োজন করতো যাত্রাপালা, কীর্তন, সার্কাস, নাচ-গান, মাদার পীরের গান, মানিক পীরের গান ইত্যাদি। পৌষ মাসের শেষ দিবসে উনিশ শতকের গ্রাম বাংলায় অনুষ্ঠিত হত পৌষ সংক্রান্তি। ‘৩০ পৌষ রাত্রি প্রভাত হইতে না হইতেই পল্লীবাসী...... শ্রমজীবীগণের ছেলেরা আনকোরা ধুতি চাদরে সজ্জিত হইয়া দলে দলে ভিক্ষায় বাহির হইত। এ তাদের সখের ভিক্ষা।’ (পৌষ সংক্রান্তি, পল্লী বৈচিত্র। পৃষ্ঠা- ১৫১।)। পৌষ সংক্রান্তি উৎসব প্রায় বিলুপ্তির পথে। তবে পৌষ মাসে মানিক পীরের গান আজও হয়, যা সেকালেও হতো। সেকালে মুসলমান শ্রমজীবীগণ টুপি মাথায় দিয়ে গলায় রুমাল বেঁধে মানিকপীরের গান গাইতে গাইতে ঢোল বাজাতে বাজাতে দলে দলে গৃহস্থ গৃহে উপস্থিত হত। পৌষ সংক্রান্তি উৎসবের কৃত্যাচারগুলি বিশ্লেষণের মাধ্যমে বাংলাদেশের আর্থ সামাজিক, সাংস্কৃতিক ইতিহাস ব্যাখ্যা করা যায়। কারণ এই সব কৃত্যাচার ও অনুষ্ঠানের গভীরে লুকিয়ে আছে আমাদের ইতিহাসের নানা অজানা দিক।

ডিটেকটিভ উপন্যাস রচয়িতা হিসেবে খ্যাত দীনেন্দ্রকুমার প্রবল সাহিত্য বোধ ও সৃজনশীলতার স্বাক্ষর রেখেছেন তার নানা ছোট গল্পে। এসব শিল্পগুণসম্পন্ন ছোট গল্পে পল্লীবাসীর সুখ-দুঃখ, আশা-আকাঙ্খা ও বেদনার নানা উজ্জ্বল চিত্র অঙ্কিত হয়েছে সাবলীল ভাবে। তার গল্পগুলিতে রয়েছে হত্যার রহস্য, ভৌতিক পরিবেশ, হাস্যরস এবং তার প্রিয় প্রসঙ্গ পল্লী জীবন। সামান্য ঘটনা যে অসামান্য ও মনোগ্রাহী হতে পারে তা তিনি তার গল্পের বর্ণনা ও বুনটে দেখিয়েছেন। শিশির কুমার দাস তার ‘বাংলা ছোটগল্প’ (প্রথম প্রকাশ- অক্টোবর ১৯৬৩, কলকাতা) গ্রন্থে দীনেন্দ্রকুমারের গল্প সম্পর্কে বলেছেন, ‘তার সৃষ্টি অতি সহানুভূতিশীল। অনেক পরিমাণে তিনি বাস্তবানুগ, খুঁটিনাটি তথ্যের প্রতি তার আসক্তি, অত্যাধিক ভাবালুতা তার দোষ। কিন্তু বর্ণনায় তিনি অনেক ক্ষেত্রে শরৎচন্দ্রের শুধু পূর্বসূরীই নয়, শরৎচন্দ্রের চেয়ে উৎকৃষ্ট।’ তবে শরৎচন্দ্রের পল্লীচিন্তার সাথে দীনেন্দ্রকুমারের পল্লী চিন্তার অমিলই বেশী। তবুও পল্লীই তার ভাবনা ও গল্পের প্রধান প্রসঙ্গ। আগমনী, পরিত্যাক্ত, প্রত্যাখ্যান, বিজয়ার মিলন প্রভৃতি পল্লী বিষয়ক গল্প বিশ শতকের পাঠক মহলে দারুণভাবে সমাদৃত হয়েছে। শিশির কুমার আরও বলেছেন, ‘দীনেন্দ্রকুমারের ঘটনাগুলি অতি তুচ্ছ ও অতি সাধারণ। এ বিষয়ে বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের পূর্বসূরী তিনি। বিভূতিভূষণের পল্লী জীবনের ঘটনা গুলিতে যেমন অতি তুচ্ছ ঘটনাকে আশ্রয় করে গভীর অনুভূতি ব্যক্ত হয়েছে তেমনি দীনেন্দ্রকুমারের।’ বাংলাদেশের পল্লী গ্রাম নিয়ে তিনি যে ভাবনা চিন্তা করেছিলেন তা তার ছোটগল্প ও পল্লী বিষয়ক রচনাতে প্রকাশিত হয়েছে। প্রবাসী পত্রিকার ফাল্গুন ১৩৪০ সংখ্যায় প্রিয়রঞ্জন সেন বাংলা সাহিত্যের একশতটি ভাল বই এর যে তালিকা প্রণয়ন করেছিলেন তাতে দীনেন্দ্র কুমারের পল্লীচিত্র গ্রন্থটি স্থান পেয়েছে। পল্লীবৈচিত্র (১৩৫২), পল্লীকথা (১৩২৪), পল্লীবধূ (১৩২৩), পল্লীচরিত্র (১৩২৩) প্রভৃতি গ্রন্থও পাঠক সমাজে সমাদৃত হয়েছে। জলধর সেন, পাঁচকড়ি বন্দোপাধ্যায়ও পল্লী বিষয়ক বহু রচনা লিখেছেন। কিন্তু দীনেন্দ্রকুমারের মত তারা প্রখর সৃজন শক্তি ও প্রতিভার অধিকারী ছিলেন না। সুরেশচন্দ্র সমাজপতির জনপ্রিয় ‘সাহিত্য’ পত্রিকাতে দীনেন্দ্রকুমারের অধিকাংশ পল্লী বিষয়ক রচনাবলী প্রকাশিত হয়েছে। সুরেশ সব সময় দীনেন্দ্রের রহস্য লহরী বা রহস্য কাহিনীর চেয়ে পল্লী বিষয়ক ও মননশীল রচনা প্রকাশে আগ্রহ দেখিয়েছেন বেশী। রবীন্দ্রনাথও তার পল্লী বিষয়ক রচনা প্রকাশে আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ অভিভূত হয়ে তাকে লিখেছিলেন, ‘বাংলাদেশের হৃদয় হইতে আনন্দ শান্তি বহন করিয়া আনিয়া আমাকে উপহার দিয়াছে।’ দীনেন্দ্রকুমার তীক্ষè অনুভূতিসম্পন্ন অসামান্য প্রতিভার অধিকারী এক বিরলপ্রজ শিল্পস্রষ্টা। ছোট ছোট ঘাট-পুকুর, দিঘি, ছায়া সুনিবিড় পল্লী, ছোট পার্বণ-উৎসব, আটপৌরে জীবন তার সৃজন স্পর্শে অসামান্যতা পেয়েছে। কোন ধরনের জীবন একদিন আমাদের ছিল, কোন ধরনের শ্যামল ছায়া, জ্যোৎস্না রাত, রোদ বৃষ্টি পেরিয়ে আজ আমরা এতদূর এসেছি, তা তার লেখা থেকে জানতে পারি। আমরা আমাদের দেশের অতীতকে, পিতামহ ও প্রপিতামহদের উদ্বেগহীন, আনন্দময় জীবনের সাথে যদি নিজেদের গাঁথতে চায়, তবে দীনেন্দ্রকুমারের পাঠ গ্রহণ করতেই হবে। আর যাদের গবেষণার আগ্রহ আছে তারা হয়তঃ তাঁর রচনা থেকে একাধিক থিসিসের তথ্য পেতে পারেন। এ যুগের পাঠককে তার শেকড় ও আত্মপরিচয়ের সন্ধান পেতে এবং আনন্দময়, উৎসবমুখর বাংলাদেশকে আবিস্কার করতে অবশ্যই দীনেন্দ্রকুমারের কাছে যেতে হবে। রাজনৈতিক উত্থান, পতনে বদলেছে বাংলা ভাষার ভূগোল, আর বিজ্ঞান প্রযুক্তির অভিঘাতে বদলেছে বাঙালির জীবন জীবিকা, বিশ্বাস, মূল্যবোধ। বিশ্বায়ন ও নগরায়নের অপ্রতিরোধ্য আক্রমনে লুপ্ত, অপহৃত ও বিধ্বস্ত হয়েছে বাংলাদেশের শাশ্বত গ্রাম ও তার নীলিমা ও সৌন্দর্য। কিন্তু এই ঐশ্বর্যহীন, বিধ্বস্ত পল্লী যে একদিন প্রাণরসের আধার ও উৎসব মুখর ছিল তা দীনেন্দ্রকুমার রায়ের পল্লী বিষয়ক রচনা পাঠ করে আমরা জানতে পারি।

আবদুল্লাহ আল আমিন: লেখক ও প্রাবন্ধিক, সহকারী অধ্যাপক, মেহেরপুর সরকারি কলেজ, মেহেরপুর।



আবদুল্লাহ আল আমিন



“দীনেন্দ্রকুমার রায় এক দরিদ্র বাঙালি লেখক, কলকাতার কল-কোলাহল ও সাহিত্য পরিবেশ ছেড়ে এই নিস্তরঙ্গ বরোদায় এসে পড়ে থাকার কোনও বাসনা তার ছিল না। কিন্তু পেটের জ্বালা বড় জ্বালা। বাংলা গল্প-প্রবন্ধাদি লিখে পয়সা পাওয়া যায় না। তাই বাধ্য হয়ে গৃহশিক্ষকতার কাজ নিতে হয়েছে। এমন ছাত্র পাওয়ায়ও অবশ্য ভাগ্যের কথা। ছাত্রটি মাস্টারের থেকে অনেক বেশি জ্ঞানী এবং স্বয়ং একজন অধ্যাপক। বরোদা রাজ কলেজে ইংরেজির অধ্যাপক হিসেবে এর মধ্যেই অরবিন্দর বেশ নাম ছড়িয়েছে।

......... আজ সকালে পড়ানো হচ্ছে দীনবন্ধু মিত্রের ‘লীলাবতী’। তার এক জায়গায় রয়েছে একটি রসের ছড়া;

মদের মজাটি গাঁজা কাটি কচকচ

মাসীর পিরীতে মামা হ্যাকচ প্যাকচ।” (সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ঃ প্রথম আলো, ২য় খন্ড, পৃ: ৪৩৩)

এভাবেই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তার ‘প্রথম আলো’ উপন্যাসে অরবিন্দের গৃহশিক্ষক ও সাহিত্যিক দীনেন্দ্রকুমার রায় সম্পর্কে লিখেছেন। মহাকাব্যিক ব্যাপ্তি ও বিশালতা নিয়ে লেখা এই বর্ণাঢ্য উপন্যাসে তৎকালীন অবস্থা বোঝাবার জন্য রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের ধর্ম আন্দোলন, প্রবাদ প্রতিম অভিনেতা গিরিশ ঘোষ-অর্ধেন্দু শেখর মুস্তাফি, ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ, অরবিন্দের সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন, হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ভেদ-বুদ্ধি, রবীন্দ্রনাথের কবি জীবনের নানা রূপান্তরের প্রসঙ্গ এসেছে অনুপঙ্খ ভাবে। সমকালের খ্যাতিমান লেখক হিসেবে দীনেন্দ্র কুমার রায়ের প্রসঙ্গও এসেছে এই উপন্যাসে। লেখক, প্রাবন্ধিক, সংবাদ-সাময়িকপত্র সম্পাদক, শিক্ষক, কথাপুরুষ, ডিটেকটিভ উপন্যাসের রচয়িতা ও অনুবাদক হিসেবে তৎকালীন বাঙালি সারস্বত সমাজে দীনেন্দ্রকুমার রায়ের (১৮৬৯-১৯৪৩) অধিষ্ঠান ছিল তর্কাতীত। একালে তিনি প্রায় বিস্মৃত একটি নাম। অথচ তাঁর রচনা পড়ে অভিভূত হয়েছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ এবং দীনেন্দ্র কুমার সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন ‘বাংলাদেশের হৃদয় হইতে আনন্দ ও শান্তি বহন করিয়া আনিয়া আমাকে উপহার দিয়াছে।’

ইংরেজরা আসার আগে বাংলার গ্রামগুলি ছিল নিস্তরঙ্গ, সচ্ছল, স্বনির্ভর ও উৎসব মুখর। মার্কসের ভাষায়, ‘শাশ্বত গ্রাম।’ গ্রামে সুখ-শান্তি সাচ্ছন্দ্য ছিল আর ছিল মানুষের মধ্যে সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি ও সহবত। সারা বছর জুড়ে গ্রামে গ্রামে চলতো নানা সব পাল-পার্বণ-নৃত্য-গীত, আচার-অনুষ্ঠান ও উৎসব। ইউরোপের শিল্পবিপ্লবের ঢেউ আর নবজাগৃতির নবীন আলোয় বাংলাদেশের গ্রামগুলির সেই চিরায়তরূপ একসময় বদলে যেতে থাকে। গ্রামের মানুষের জীবন, সংস্কৃতি, ভাবনা, মূল্যবোধ, বিশ্বাস, দর্শন এক নূতন সমীকরণের মুখোমুখি হয়। নাগরিক জীবনের আলো-ছাঁয়ায় প্রলুব্ধ হয়ে মানুষ পিঁপড়ের মতো শহরে এসে ভিড় জমাতে থাকে। গভীর দুঃখ-বেদনায় ম্লান ও পীড়িত হয়ে করুণ স্মৃতি নিয়ে পড়ে থাকে অসংখ্য গ্রাম। সম্পূর্ণভাবে লুপ্ত ও বিধ্বস্ত হওয়ার আগে দীনেন্দ্রকুমার রায় অন্তর্লোকের প্রেরণা আর গভীর আবেগ দিয়ে বেদনাপীড়িত গ্রামবাংলার হৃদয় থেকে তুলে নিয়ে আসেন গ্রামীণ জনজীবনের হর্ষ-বিষাদ, সুখ-দুঃখ , মিলন- বিরহ, পাল-পার্বণ, উৎসব-উদযাপনের বহুবর্ণিল রূপ প্রতিমা। দীনেন্দ্রকুমারের ‘পল্লীচিত্র’, ‘পল্লী বৈচিত্র্য’, ‘পল্লীকথা’, ‘পল্লীবধু’, প্রভৃতি গ্রন্থে মূলতঃ চিরায়ত বাংলার রূপপ্রতিমা উঠে এসেছে আবেগ ঘন বর্ণনায়। সেই সাথে তাঁর সমকালের সমাজ, সংস্কৃতি ও জীবনের একটি অনন্য দলিলও রচনা করেছিলেন ‘সেকালের স্মৃতি’ নামে একটি মূল্যবান স্মৃতি কথায়। ঊনিশ শতক ও বিশ শতকের চল্লিশ দশকের কালপর্বের অবিভক্ত বাংলা জীবন্ত হয়ে উঠেছে তার এই আত্মজীবনীতে।

দীনেন্দ্রকুমারের জন্ম অবিভক্ত নদীয়া জেলার মেহেরপুরের এক অভিজাত পরিবারে ২৫ আগস্ট ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে। তাঁর পিতা ব্রজনাথ ছিলেন সাহিত্য সেবী, পেশাগত কারণে কৃষ্ণনগরে বসবাস করতেন। মেহেরপুরে জন্ম হলেও দীনেন্দ্র কুমারের শিক্ষা জীবন অতিবাহিত হয় পিতার কর্মস্থল কৃষ্ণনগরে। দুই পুরুষের স্মৃতি বিজড়িত কৃষ্ণনগরে জীবনের দিনগুলি বেশ সুখেই কেটে ছিল তার, যদিও শিক্ষা ক্ষেত্রে তেমন বিশেষ কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখতে পারেননি সেখানে। তবে এখানেই তাঁর সাহিত্য জীবনের অভিষেক ঘটে। সাহিত্যের প্রতি ঝোঁক বেড়ে যাওয়ায় কাকা তাকে মহিষাদল নিয়ে আসেন এবং মহিষাদল হাই স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাস করেন এবং পরবর্তীতে কৃষ্ণনগর কলেজে ভর্তি হন। দীনেন্দ্র কুমারের কাকা ছিলেন মহিষাদল এস্টেটের ম্যানেজার এবং মহিষাদল রাজস্কুলের প্রেসিডেন্ট। এক পর্যায়ে এই স্কুলে শিক্ষকতা দিয়ে শুরু হয় তার কর্মজীবন। শিক্ষকতার সুবাদে সহকর্মী হিসেবে সাহচর্য লাভ করেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক জলধর সেনের। তিনি কাকার মাধ্যমে জলধর সেনকে মহিষাদল স্কুলে তৃতীয় শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দানের ব্যবস্থা করেন। চলতে থাকে দুই বন্ধু মিলে সাহিত্যচর্চা। সাহিত্যিক জলধর সেনের সাথে সাহচর্য লাভকে দীনেন্দ্র কুমার জীবনের পরম সৌভাগ্য হিসেবে বর্ণনা করেছেন সেকালের স্মৃতি গ্রন্থে। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘সুপ্রসিদ্ধ সাহিত্যিক রায় বাহাদুর শ্রীযুক্ত জলধর সেন মহাশয় সাহিত্য সমাজে খ্যাতি লাভ করিয়া রায় বাহাদুর হইবার পূর্ব হইতে আমি তাঁহার সহিত পরিচিত হইবার সৌভাগ্য লাভ করিয়াছি।’ (দীনেন্দ্র কুমার রায়: সেকালের স্মৃতি। রচনাসমগ্র, পৃ: ৩৭১)। মহিষাদলের দিনগুলি দীনেন্দ্র কুমারের জন্য বেশ সুখকর ছিল। কাকার বাসাতে জলধর বাবুর সাথে একত্রে বসবাস করার সুবাদে পেয়েছিলেন সাহিত্য চর্চার অফুরন্ত সুযোগ। আর তাঁর কাকাও ছিলেন বাংলা সাহিত্যের প্রবল অনুরাগী। সে সময় তার কাকার বাসায় আসতেন সাহিত্যিক চন্দ্রশেখর কর এবং দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। কাকার বাসায় অনুষ্ঠিত এক মজলিসে তিনি শুনেছিলে ডি.এল রায়ের স্বকণ্ঠে স্বরচিত হাসির গান, ‘পারো তো জোন্মো না ভাই, বিষ্যুৎ বারের বারবেলায়’, ‘তার রং যে বড্ড ফরসা, তারে পাবো হয় না ভরসা’। এ সময় থেকেই তিনি স্বর্ণকুমারী দেবী সম্পাদিত ‘ভারতী’ পত্রিকায় লেখালেখি শুরু করেন। জনপ্রিয় এই পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তাঁর অন্যাতম বিখ্যাত নাটক ‘হেঁয়ালী নাট্য’। এই নাটক প্রকাশনার জন্য পত্রিকা সম্পাদিকা স্বর্ণকুমারী দেবী পাঠকের বিরূপ সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছিলেন। মহিষাদলের সুখকর দিনগুলি খুব বেশি স্থায়ী হয়নি দীনেন্দ্রকুমারের। নিদারুণ অর্থকষ্ট ও জীবন-জীবিকার তাগিদে বাধ্য হয়ে মহিষাদল ত্যাগ করে তাঁকে রাজশাহীতে চলে যেতে হয়। জেলা জজের কর্মচারী হিসেবে সেখানে কর্মজীবনের দ্বিতীয় অধ্যায় আরম্ভ হয়। এ চাকুরী পেতে তাঁকে সাহায্য করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ সুহৃদ লোকেন্দ্রনাথ পালিত। অর্থকষ্টের কারণে সেখানেও তিন বছরের বেশি থাকতে পারেননি। তবে রাজশাহীর দিনগুলি তার জীবনের এক অনন্য অধ্যায়। এখানে তাঁর নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে প্রখ্যাত ঐতিহাসিক, লেখক অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য যদুনাথ সরকারের সাথে। দীনেন্দ্রকুমার ‘সেকালের স্মৃতি’ গ্রন্থে যদুনাথ সরকার সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। তাঁর কাছে যদুনাথ যেন “দ্যুতিমান মধ্যমণি’Ñ যার উজ্জ্বল প্রভায় আজ বাঙ্গালা, বিহার, উড়িষ্যা গৌরদীপ্ত।” ম্যাজিস্ট্রেট সুহৃদ লোকেন্দ্রনাথ পালিতের আতিথ্য গ্রহণ করে রবীন্দ্রনাথও মাঝে মাঝে রাজশাহীতে আসতেন। রাজশাহীতে লোকেন্দ্রনাথের মাধ্যমেই রবীন্দ্রনাথের সাথে তার পরিচয় হয়।

দীনেন্দ্রকুমার আশৈশব সাহিত্য অনুরাগী। শৈশবেই সাক্ষাৎ লাভ করেন কবি, নাট্যকার ডি.এল রায়ের সাথে। তাঁর বয়স যখন দশ বছর ‘সেই সময় কবিবর দ্বিজেন্দ্রলাল একবার মেহেরপুরে বেড়াইতে গিয়েছিলেন।’ মেহেরপুরে বেড়াতে এসে তিনি কবিতার উপর যে বক্তৃতা করেছিলেন, সেই বক্তৃতা শুনে দীনেন্দ্রের সাহিত্যপ্রীতি জন্মায়। বাবা ব্রজনাথ ছিলেন কবি ও সাহিত্যব্রতী। তিনি ‘আকিঞ্চনের মনের কথা’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। কাঙাল হরিনাথ মজুমদার (১৮৩৩-১৮৯৬) এর সাথে তাঁর বাবার ছিল অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। তারা দুজনেই ছিলেন সংসারে নির্লিপ্ত ও ধর্মনিষ্ঠ। রাজশাহীতে তিনি সান্নিধ্য লাভ করেন অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়, যদুনাথ সরকার প্রমুখ খ্যাতিমানদের সাথে। পরবর্তীতে ঘনিষ্ঠতা হয় সুরেশ সমাজপতি, রজনীকান্ত সেন ও শিবচন্দ্র বিদ্যার্ণব এর সাথে। দীনেন্দ্রকুমার ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকায় অগ্রহায়ণ ১৩২৪ সংখ্যায় ‘কবি রজনীকান্ত’ শীর্ষক স্মৃতিকথা লেখেন। ‘পূজার ছুটির পর তিনি বাড়ী হইতে রাজশাহীতে ফিরিয়া যাইতেছিলেন, আমিও ছুটির শেষে রাজশাহী যাইতেছিলাম... স্টিমারে উঠিয়া দেখি, স্টিমারের ডেকের উপর একখানি শতরঞ্চি বিছাইয়া রজনীকান্ত আড্ডা জমাইয়া লইয়াছে। তাহার গল্প আরম্ভ হইয়াছে।’

দীনেন্দ্রকুমার ছিলেন প্রখর স্মৃতিসম্পন্ন এক প্রতিভাধর লেখক। বারিদবরণ ঘোষ তার ‘দীনেন্দ্রকুমার রায়: জীবন ও সাধনা’ শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছেন, “দীনেন্দ্রকুমার ছিলেন আশ্বর্য স্মৃতিকথার মহান ভাণ্ডারী।’ তিনি আরও লেখেন, ‘মাসিক বসুমতী’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত তার সেকালের স্মৃতি (১৩৩৯-৪৩) এক মহামূল্যবান স্মৃতিচারণা। এটি আশু গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হলে সেকালের যুগ ও জীবনের একটি বিশ্বাসযোগ্য দলিল আমাদের করায়ত্ত হতে পারবে।”

বলা যেতে পারে সেই কথা ভেবে কলকাতার আনন্দ পাবলিশার্স এই মহামূল্যবান স্মৃতি কথা ‘সেকালের স্মৃতি’ (১৯৮৮) একালের পাঠকদের জন্য গ্রন্থাকারে পুনঃপ্রকাশ করেন। শুধু সেকালের স্মৃতিই নয় আনন্দ পাবলিশার্স দীনেন্দ্রকুমারের রচনা সমগ্র (২০০৪) পুনঃ প্রকাশ করেছে। গ্রন্থের ভূমিকায় কবি জয় গোস্বামী লিখেছেন, ‘এই রচনাগুলির ধমনীতে যে রক্তস্রোত বয়ে চলেছে তা এই এক শতাব্দীকাল পেরিয়ে এসেও জীবন্ত রয়েছে। কারণ তার মধ্যে আছে স্নেহ করুণার সঞ্জীবনী। সকলকে নিয়ে, সমস্ত পড়শী, প্রতিবেশীকে সঙ্গে জড়িয়ে যে বেঁচে থাকা, তারই উদ্ভাসন আছে এই সব রচনায়।’

দীনেন্দ্রকুমারের কর্মজীবনের এক বর্ণাঢ্য অধ্যায়ের সূচনা হয় বরোদায় এক মহান মানুষের সংস্পর্শে। এখানে তিনি অরবিন্দের বাংলা শিক্ষক হিসাবে কাজ শুরু করেন। এই কাজ পেতে রবীন্দ্রনাথের বিশেষ ভূমিকা ছিল। অরবিন্দের শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালনকে জীবনের এক অনন্য অধ্যায় হিসেবে বর্ণনা করেছেন তিনি। সেকালের স্মৃতি গ্রন্থে এই মহান দেশপ্রেমিক মানুষটির জীবনের নানা অজানা দিক উন্মোচন করেছেন। এই গ্রন্থে তিনি অরবিন্দকে অসামান্য প্রতিভার অধিকারী এক বিরলপ্রজ মানুষ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। অরবিন্দ এমন প্রখর মেধাসম্পন্ন মানুষ ছিলেন যে, সে সময় সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় গ্রীক ও ল্যাটিনে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। পরবর্তীতে তিনি বরোদা কলেজে ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। এই সময়কালে দীনেন্দ্রকুমার বরোদায় ছিলেন এবং অরবিন্দকে বাংলা শেখানোর দায়িত্ব পালন করেন। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ১৮৯২ খ্রি. অরবিন্দ কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ট্রাইপস বৃত্তি লাভ করে পরের বছর দেশে ফিরে আসেন। মাত্র সাত বছর বয়স থেকে বিলেতে থাকার কারণে তিনি বাংলা শিখতে পারেননি। অথচ বাংলা ভাষা সাহিত্য, সংস্কৃতি, বাঙালির ঐতিহ্যের প্রতি ছিল তাঁর অশেষ শ্রদ্ধা। তিনি ও তার অভিভাবকেরা আগ্রহ সহকারে একজন দক্ষ বাংলা শিক্ষকের খোঁজ করছিলেন। অবশেষে দীনেন্দ্রকুমার বাংলা শিক্ষকের দায়িত্ব ভার নিয়ে বরোদায় যান এবং সেখানে দুই বছর অতিবাহিত করেন। শিক্ষক হলেও এই জ্ঞানী ছাত্রের প্রতি শিক্ষক দীনেন্দ্রের ছিল গভীর শ্রদ্ধা। অরবিন্দের চারিত্রিক দার্ঢ্য, হৃদয়ের প্রসারিত সৌন্দর্য, সহজ ‘সাদা সিধে জীবন যাপন’ এবং প্লেইন লিভিং হাই থিংকিং এর আদর্শে তিনি গভীরভাবে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘অরবিন্দ আজন্ম সন্ন্যাসী। বাল্যকাল হইতে প্রায় পঁচিশ বৎসর বয়স পর্যন্ত তাহাকে ইংল্যাণ্ডে বাস করিতে হইয়াছিল। কিন্তু বিলাস লালসা তাঁহাকে স্পর্শ করিতে পারে নাই..... আমি দুই বৎসরের অধিককাল তাহার বঙ্গভাষার শিক্ষকরূপে তাঁহার সহিত একত্রে বাস করিয়াছি। কিন্তু কোন দিন তাহাকে মূল্যবান পরিচ্ছদ ব্যবহার করিতে দেখি নাই।’ (দীনেন্দ্রকুমার: সেকালের স্মৃতি, রচনা সমগ্র, পৃষ্ঠা: ৩০০)।

দীনেন্দ্রকুমার যখন বরোদায় ছিলেন তখন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে যোগাযোগ হয় চিঠিপত্রের মাধ্যমে। সে সময় তিনি সাধনা ও ভারতী পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখতেন। রবীন্দ্রনাথও চিঠিপত্রের মাধ্যমে তাঁর সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতেন। ‘অরবিন্দ, রবীন্দ্রের লহো নমস্কার’ কবিতাটি অবশ্য রবীন্দ্রনাথ বেশ পরে লিখেছিলেন; যখন সারা বাংলায় অরবিন্দ খ্যাতিমান হয়ে ওঠেন। বরোদা পর্বের শেষ পর্যায়ে দীনেন্দ্রকুমারের স্থায়ী কর্মজীবনের সূচনা হয় এবং সাহিত্যিক হিসেবে তার নামডাক ছড়িয়ে পড়ে। এসময় সাপ্তাহিক ‘বসুমতী’র প্রথম প্রকাশ (১০ ভাদ্র ১৩০৩) হয়। প্রথমে ব্যোমকেশ মুস্তাফি, পরে পাঁচকড়ি বন্দোপাধ্যায় এই পত্রিকার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি পত্রিকা ছেড়ে দিলে দীনেন্দ্র কুমারের প্রথম জীবনের সহকর্মী বন্ধু জলধর সেন এই কাগজের দায়িত্বভার পান। জলধর সেনের আহবানে দীনেন্দ্র বসুমতীতে যোগদেন এবং ভুবনমোহন মুখোপাধ্যায়, ক্ষেত্রমোহন গুপ্ত, সুরেশচন্দ্র সমাজপতির নিকট গ্রহণ করেন সাংবাদিকতার প্রথম পাঠ। একপর্যায়ে দীনেন্দ্রকুমার ‘বসুমতী’র সম্পাদক পদে অধিষ্ঠিত হন। তার অসংখ্য লেখা বসুমতী’র পাতায় মুদ্রিত হয়েছে এবং এসব লেখার বেশীর ভাগ আজও অগ্রন্থিত রয়েছে। ‘কথাশিল্পীর হত্যা রহস্য’ নামে একটি অনুবাদ উপন্যাস ১৩৫০ বঙ্গাব্দ থেকে তার মৃত্যুর পরও ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে। পরবর্তীকালে তিনি ‘নন্দন কানন’ নামে একটি মাসিক পত্রিকার সম্পাদনার সাথে যুক্ত হন। এই পত্রিকার প্রথম প্রকাশ ছিল ফাল্গুন ১৩০৭। দীনেন্দ্র কুমারের জনপ্রিয়তা ও খ্যাতির মূলে ছিল এই পত্রিকাটি। এতেই প্রকাশিত হয় তাঁর জনপ্রিয় সিরিজ ‘রহস্য লহরী’ এবং লঘুস্বাদের সেই রহস্য কাহিনী তাঁর বিপুল খ্যাতি এনে দেয়। তবে এসব রচনা তার সাহিত্য প্রতিভার আংশিক প্রকাশ মাত্র। রহস্য কাহিনীর বা ডিটেকটিভ উপন্যাসের লেখক হিসেবে তিনি জনপ্রিয়তা অর্জন করলেও এটি তার আসল পরিচয় নয়। বস্তুতঃ অপেক্ষাকৃত গৌণ পরিচয়কে প্রধান করতে গিয়ে তার সত্যিকার পরিচয় অনেকটা ঢাকা পড়ে গেছে। পল্লীচিত্র (৮ ডিসেম্বর ১৯৮১) পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কে তাই আচার্য সুকুমার সেন বলেন, “এখন যারা দীনেন্দ্রকুমার রায়ের নাম শ্র“ত আছেন; তাঁরা জানেন তাঁকে রহস্যলহরী সিরিজের গ্রন্থকর্তারূপে, মিষ্টার ব্লেকের স্রষ্টা রূপে। কেউ কেউ তাকে ‘মেয়ে বোম্বেটে’, ‘জাল মোহান্ত’ অথবা ‘পিশাচ পুরোহিত’ ইত্যাদি গ্রন্থের লেখক (বা অনুবাদক) রূপে জানেন।” এসব লেখা বা অনুবাদ তাঁর সৃষ্টিকর্মে মূল দিক নয়। তার শ্রেষ্ঠ কীর্তি উনিশ শতকের গ্রামবাংলা ও সমসময়কে নিয়ে লেখা রচনাবলী। ঊনিশ শতকের গ্রামবাংলার মানুষের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, উৎসব-পার্বণ নিয়ে রচিত তাঁর পল্লীচিত্র (১৩১১), পল্লীবৈচিত্র্য (১৩১২০), পল্লীকথা (১৩২৪) প্রভৃতি পল্লী বিষয়ক রচনাবলী তাঁর সাহিত্যিক জীবনের এক অনন্য কীর্তি এবং এসব লেখা শিল্প প্রসাদগুণ সম্পন্ন সাহিত্যের মর্যাদা পেয়েছে। পল্লীচিত্র গ্রন্থের উৎসর্গ পত্রে লেখা ছিল: ‘পরম শ্রদ্ধা ভাজনেষু, কবিবর শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয়, শ্রীকর কমলেষু।’ গ্রন্থটি প্রকাশে রবীন্দ্রনাথ ও সুরেশচন্দ্র সমাজপতি বিশেষ আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। ঊনিশ শতকের মধ্য বঙ্গের এক বর্ধিষ্ণু গ্রামের মানুষের যাপিত জীবনের নানা রঙিন ছবি আঁকা হয়ে এই গ্রন্থে। ঊনিশ শতকের গ্রাম মানে বারো মাসে তের পার্বণ, সে সময় নানা সব পাল পার্বণ ধর্মীয় আচার আমোদ-উৎসবে গ্রামবাসী মেতে থাকত। গ্রামে গ্রামে অনুষ্ঠিত হত রথযাত্রা, স্নানযাত্রার মেলা, বৈশাখ সংক্রান্তি, নন্দ উৎসব, চড়ক, গাজন উৎসব। গ্রামে ছিল সুখ শান্তি আর সচ্ছলতা। পাঠক সমাদৃত এ গ্রন্থের পাতায় পাতায় আঁকা হয়েছে সেকালের সৌহার্দ্য সম্প্রীতিমুখর গ্রাম আর আনন্দ ও উৎসবময় জীবনের নানা খন্ডচিত্র। দীনেন্দ্রকুমার রায় ‘পল্লীচিত্রে’ সেকালের পল্লী জীবনের যে বর্ণনা দিয়েছেন তাতে আবেগের অতিশহ্য নেই, আহা মরি বাড়াবাড়ি নেই। আছে প্রতিদিনের ঘটে যাওয়া সাধারণ ঘটনা অসাধারণ ভাবে তুলে ধরার আন্তরিক প্রয়াস। সেকালের কথায় ভরপুর পল্লীচিত্র অনেক বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা শেখার পাঠ্যগুলির অন্যতম ছিল। অথচ নিজ দেশ বাংলাদেশের তিনি নির্বাসিত। স্বতঃই মনে প্রশ্ন জাগে কার অভিশাপে বাংলাদেশের পাঠককুল তাঁকে ভুলে গেল?

পল্লীচিত্রের মত ‘পল্লীবৈচিত্রে’ (১৩১২) বাংলার পল্লী অঞ্চলের নানা ছবি আঁকা হয়েছে। লেখক গ্রন্থের ভূমিকায় বলেছেন, ‘পল্লীচিত্রে পল্লী সমাজের বিশেষত্ব সম্বন্ধে যে সকল কথা বলিতে পারি নাই সেই সকল কথায় আলোচনা করিলাম।’

এই গ্রন্থে এগার টি প্রবন্ধ রয়েছে। প্রবন্ধগুলির বিষয়বস্তু বাংলাদেশের বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠান। দীনেন্দ্রকুমার রায়ের আমলে অর্থাৎ ঊনিশ শতক থেকে বিশ শতকের চল্লিশ দশক বর্তমান বাংলাদেশের প্রায় সব গ্রামে কার্ত্তিক থেকে চৈত্র পর্যন্ত যে সব সামাজিক ও লৌকিক উৎসব এবং ধর্মানুষ্ঠান চলত তারই আবেগঘন বর্ণনা পল্লীবৈচিত্র। গ্রন্থের প্রথম প্রবন্ধ হলো কালীপূজা। অষ্টাদশ শতকে শক্তির আরাধনা করতে ডাকাতরা কালীপূজার আয়োজন করতো। ডাকাতেকালী পূজকদের পুরোহিতরা কালীপূজায় পুরোহিতের দায়িত্ব পালন করতেন। এখন কালীপূজা সার্বজনীন দূর্গাপূজার রূপ ধারণ করেছে। দীনেন্দ্রকুমার কালীপূজা সম্পর্কে যে বর্ণনা দিয়েছেন তার যথেষ্ট ঐতিহাসিক মূল্য রয়েছে।

গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত অন্যান্য প্রবন্ধগুলি যথাক্রমেÑ ভ্রাতৃদ্বিতীয়া, কার্তিকের লড়াই, নবান্ন পোষলা, পৌষ সংক্রান্তি, উত্তরায়ন মেলা, শ্রী পঞ্চমী, শীতল ষষ্ঠী, দোলযাত্রা ও চড়ক। গ্রন্থের ষষ্ঠ প্রবন্ধ হলো পৌষ সংক্রান্তি। ‘পৌষ মাসকে পল্লী রমণিগণ লক্ষ্মী মাস বলিয়া মনে করেন। কোন রমনী পৌষ মাসে স্বামীগৃহ হইতে পিতৃগৃহে বা পিতৃগৃহ হইতে স্বামীগৃহে গমন করে না।’ (দীনেন্দ্রকুমার রায়: পৌষ সংক্রান্তি। পল্লী বৈচিত্র, রচনা সমগ্র। পৃষ্ঠা-১৫১।)

হেমন্তে বাংলাদেশের সব গ্রাম জুড়ে চলত ধান কাটামাড়ার উৎসব। পৌষের প্রথম ভাগে এ ব্যস্ততার রেশ কিছুটা বেশি থাকতো। শীতের শেষের দিকে শাকসবজি বা কাঁচা তরকারি উৎপাদনে নিয়োজিত কৃষকের দিনের বেলায় কিছুটা ব্যস্ততা থাকলেও সন্ধ্যা থেকে রাতভর তাদের ছিল অখণ্ড অবসর। তাছাড়া প্রাকৃতিক দূর্যোগ বা বিপর্যয় না থাকায় পৌষ মাস থেকেই বাংলার গ্রামগুলো উৎসবমুখর হয়ে উঠত। গ্রামের মানুষ পৌষ মাসে শীতের নিমন্ত্রণে পাড়ায় পাড়ায় আয়োজন করতো যাত্রাপালা, কীর্তন, সার্কাস, নাচ-গান, মাদার পীরের গান, মানিক পীরের গান ইত্যাদি। পৌষ মাসের শেষ দিবসে উনিশ শতকের গ্রাম বাংলায় অনুষ্ঠিত হত পৌষ সংক্রান্তি। ‘৩০ পৌষ রাত্রি প্রভাত হইতে না হইতেই পল্লীবাসী...... শ্রমজীবীগণের ছেলেরা আনকোরা ধুতি চাদরে সজ্জিত হইয়া দলে দলে ভিক্ষায় বাহির হইত। এ তাদের সখের ভিক্ষা।’ (পৌষ সংক্রান্তি, পল্লী বৈচিত্র। পৃষ্ঠা- ১৫১।)। পৌষ সংক্রান্তি উৎসব প্রায় বিলুপ্তির পথে। তবে পৌষ মাসে মানিক পীরের গান আজও হয়, যা সেকালেও হতো। সেকালে মুসলমান শ্রমজীবীগণ টুপি মাথায় দিয়ে গলায় রুমাল বেঁধে মানিকপীরের গান গাইতে গাইতে ঢোল বাজাতে বাজাতে দলে দলে গৃহস্থ গৃহে উপস্থিত হত। পৌষ সংক্রান্তি উৎসবের কৃত্যাচারগুলি বিশ্লেষণের মাধ্যমে বাংলাদেশের আর্থ সামাজিক, সাংস্কৃতিক ইতিহাস ব্যাখ্যা করা যায়। কারণ এই সব কৃত্যাচার ও অনুষ্ঠানের গভীরে লুকিয়ে আছে আমাদের ইতিহাসের নানা অজানা দিক।

ডিটেকটিভ উপন্যাস রচয়িতা হিসেবে খ্যাত দীনেন্দ্রকুমার প্রবল সাহিত্য বোধ ও সৃজনশীলতার স্বাক্ষর রেখেছেন তার নানা ছোট গল্পে। এসব শিল্পগুণসম্পন্ন ছোট গল্পে পল্লীবাসীর সুখ-দুঃখ, আশা-আকাঙ্খা ও বেদনার নানা উজ্জ্বল চিত্র অঙ্কিত হয়েছে সাবলীল ভাবে। তার গল্পগুলিতে রয়েছে হত্যার রহস্য, ভৌতিক পরিবেশ, হাস্যরস এবং তার প্রিয় প্রসঙ্গ পল্লী জীবন। সামান্য ঘটনা যে অসামান্য ও মনোগ্রাহী হতে পারে তা তিনি তার গল্পের বর্ণনা ও বুনটে দেখিয়েছেন। শিশির কুমার দাস তার ‘বাংলা ছোটগল্প’ (প্রথম প্রকাশ- অক্টোবর ১৯৬৩, কলকাতা) গ্রন্থে দীনেন্দ্রকুমারের গল্প সম্পর্কে বলেছেন, ‘তার সৃষ্টি অতি সহানুভূতিশীল। অনেক পরিমাণে তিনি বাস্তবানুগ, খুঁটিনাটি তথ্যের প্রতি তার আসক্তি, অত্যাধিক ভাবালুতা তার দোষ। কিন্তু বর্ণনায় তিনি অনেক ক্ষেত্রে শরৎচন্দ্রের শুধু পূর্বসূরীই নয়, শরৎচন্দ্রের চেয়ে উৎকৃষ্ট।’ তবে শরৎচন্দ্রের পল্লীচিন্তার সাথে দীনেন্দ্রকুমারের পল্লী চিন্তার অমিলই বেশী। তবুও পল্লীই তার ভাবনা ও গল্পের প্রধান প্রসঙ্গ। আগমনী, পরিত্যাক্ত, প্রত্যাখ্যান, বিজয়ার মিলন প্রভৃতি পল্লী বিষয়ক গল্প বিশ শতকের পাঠক মহলে দারুণভাবে সমাদৃত হয়েছে। শিশির কুমার আরও বলেছেন, ‘দীনেন্দ্রকুমারের ঘটনাগুলি অতি তুচ্ছ ও অতি সাধারণ। এ বিষয়ে বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের পূর্বসূরী তিনি। বিভূতিভূষণের পল্লী জীবনের ঘটনা গুলিতে যেমন অতি তুচ্ছ ঘটনাকে আশ্রয় করে গভীর অনুভূতি ব্যক্ত হয়েছে তেমনি দীনেন্দ্রকুমারের।’ বাংলাদেশের পল্লী গ্রাম নিয়ে তিনি যে ভাবনা চিন্তা করেছিলেন তা তার ছোটগল্প ও পল্লী বিষয়ক রচনাতে প্রকাশিত হয়েছে। প্রবাসী পত্রিকার ফাল্গুন ১৩৪০ সংখ্যায় প্রিয়রঞ্জন সেন বাংলা সাহিত্যের একশতটি ভাল বই এর যে তালিকা প্রণয়ন করেছিলেন তাতে দীনেন্দ্র কুমারের পল্লীচিত্র গ্রন্থটি স্থান পেয়েছে। পল্লীবৈচিত্র (১৩৫২), পল্লীকথা (১৩২৪), পল্লীবধূ (১৩২৩), পল্লীচরিত্র (১৩২৩) প্রভৃতি গ্রন্থও পাঠক সমাজে সমাদৃত হয়েছে। জলধর সেন, পাঁচকড়ি বন্দোপাধ্যায়ও পল্লী বিষয়ক বহু রচনা লিখেছেন। কিন্তু দীনেন্দ্রকুমারের মত তারা প্রখর সৃজন শক্তি ও প্রতিভার অধিকারী ছিলেন না। সুরেশচন্দ্র সমাজপতির জনপ্রিয় ‘সাহিত্য’ পত্রিকাতে দীনেন্দ্রকুমারের অধিকাংশ পল্লী বিষয়ক রচনাবলী প্রকাশিত হয়েছে। সুরেশ সব সময় দীনেন্দ্রের রহস্য লহরী বা রহস্য কাহিনীর চেয়ে পল্লী বিষয়ক ও মননশীল রচনা প্রকাশে আগ্রহ দেখিয়েছেন বেশী। রবীন্দ্রনাথও তার পল্লী বিষয়ক রচনা প্রকাশে আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ অভিভূত হয়ে তাকে লিখেছিলেন, ‘বাংলাদেশের হৃদয় হইতে আনন্দ শান্তি বহন করিয়া আনিয়া আমাকে উপহার দিয়াছে।’ দীনেন্দ্রকুমার তীক্ষè অনুভূতিসম্পন্ন অসামান্য প্রতিভার অধিকারী এক বিরলপ্রজ শিল্পস্রষ্টা। ছোট ছোট ঘাট-পুকুর, দিঘি, ছায়া সুনিবিড় পল্লী, ছোট পার্বণ-উৎসব, আটপৌরে জীবন তার সৃজন স্পর্শে অসামান্যতা পেয়েছে। কোন ধরনের জীবন একদিন আমাদের ছিল, কোন ধরনের শ্যামল ছায়া, জ্যোৎস্না রাত, রোদ বৃষ্টি পেরিয়ে আজ আমরা এতদূর এসেছি, তা তার লেখা থেকে জানতে পারি। আমরা আমাদের দেশের অতীতকে, পিতামহ ও প্রপিতামহদের উদ্বেগহীন, আনন্দময় জীবনের সাথে যদি নিজেদের গাঁথতে চায়, তবে দীনেন্দ্রকুমারের পাঠ গ্রহণ করতেই হবে। আর যাদের গবেষণার আগ্রহ আছে তারা হয়তঃ তাঁর রচনা থেকে একাধিক থিসিসের তথ্য পেতে পারেন। এ যুগের পাঠককে তার শেকড় ও আত্মপরিচয়ের সন্ধান পেতে এবং আনন্দময়, উৎসবমুখর বাংলাদেশকে আবিস্কার করতে অবশ্যই দীনেন্দ্রকুমারের কাছে যেতে হবে। রাজনৈতিক উত্থান, পতনে বদলেছে বাংলা ভাষার ভূগোল, আর বিজ্ঞান প্রযুক্তির অভিঘাতে বদলেছে বাঙালির জীবন জীবিকা, বিশ্বাস, মূল্যবোধ। বিশ্বায়ন ও নগরায়নের অপ্রতিরোধ্য আক্রমনে লুপ্ত, অপহৃত ও বিধ্বস্ত হয়েছে বাংলাদেশের শাশ্বত গ্রাম ও তার নীলিমা ও সৌন্দর্য। কিন্তু এই ঐশ্বর্যহীন, বিধ্বস্ত পল্লী যে একদিন প্রাণরসের আধার ও উৎসব মুখর ছিল তা দীনেন্দ্রকুমার রায়ের পল্লী বিষয়ক রচনা পাঠ করে আমরা জানতে পারি।

আবদুল্লাহ আল আমিন: লেখক ও প্রাবন্ধিক, সহকারী অধ্যাপক, মেহেরপুর সরকারি কলেজ, মেহেরপুর।

মন্তব্য ১ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ১৭ ই জুন, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:১১

জাহাঙ্গীর.আলম বলেছেন:
দীনেন্দ্রকুমারকে মূলতঃ রহস্য উপন্যাস রচয়িতা হিসেবে বিশেষ ভাবে বিখ্যাত ৷ আপনি তার কম উল্লেখিত দিকগুলো তুলে বলে কৃতজ্ঞতা ৷ পড়া উচিত লেখকের সব দিকগুলো নিয়েই ৷ সাথে আরো মহারথীদের কথাও এনেছেন ৷

অনেক কিছু জানলাম ৷ ধন্যবাদ ৷


পোস্টের লেখাগুলো দুইবার এসেছে ৷ এডিট করে দিবেন ৷

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.