![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
বিদ্যাসাগর : এক অন্তহীন মহাজীবনের নাম
আবদুল্লাহ আল আমিন
কেউ অসাধারণ কিংবা মহামানব হয়ে জন্মায় না। ধীরে ধীরে একজন সাধারণের মধ্যে প্রকাশিত হয় তার মহামানবিক সত্তা। ঊনিশ শতকের বাঙালি সারস্বত সমাজের উজ্জ্বল প্রতিনিধি ঈশ্বরচন্দ্রের ক্ষেত্রেও এর ব্যত্যয় হয়নি । বিদ্যাসাগরে উত্তরণ এক বিস্ময়কর জীবন পরিক্রমা। এই পরিক্রমা একদিনে সম্পন্ন হয়নি। কুঁড়ি থেকে পাপড়ি মেলে পুষ্পিত হওয়ার মতই তিনি বিদ্যাসাগরে রূপান্তরিত হয়েছেন। তার সমকালে আরও তিন জন খ্যাতিমান ব্যক্তি সংস্কৃত কলেজ থেকে কৃতবিদ্যার স্মারক হিসেবে বিদ্যাসাগর উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন। তারা হলেন উনিশ শতকের খ্যাতিমান ভাষাবিজ্ঞানী বীরেশনাথ বিদ্যাসাগর, যশস্বী অনুবাদক, সম্পাদক জীবানন্দ বিদ্যাসাগর এবং ঐতিহাসিক প্রাণকৃষ্ণ বিদ্যাসাগর। কিন্তু তারা তিনজনই বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে গেছেন। একালে বিদ্যাসাগর মানে কেবলই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। ঊনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকেই বিদ্যাসাগর বাংলার শহরে গ্রামে পরিচিত হয়ে উঠতে থাকেন। অনন্যসাধারণ পা-িত্য, লেখক ও অনুবাদক হিসেবে সাফল্য এবং সংস্কৃত কলেজ পরিচালনায় প্রশাসনিক দক্ষতা, একাডেমিক সিদ্ধতা, ব্যক্তিগত দয়া-দাক্ষিণ্য তাকে সর্বমহলে গ্রহণীয় করে তোলে। বিধবা বিবাহ আন্দোলন, বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন, নারী আন্দোলনের সূত্রে তার নাম মহানগর কলকাতা ছাপিয়ে বাংলার ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়ে। বিধবা বিবাহ প্রবর্তন, বহুবিবাহ নিবর্তনের জন্য তিনি যে সংগ্রাম করে গেছেন, বাঙালির ইতিহাসে তা সত্যিই অসামান্য। বিদ্যাসাগরের আবির্ভাব ঊনিশ শতকীয় রেনেসাঁর সূচনালগ্নে, যখন রামমোহন রাধানগর গ্রাম ছেড়ে কলকাতায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেছেন এবং হতাশাগ্রস্ত অবক্ষয়িত বাঙালিকে মোহনিদ্রা থেকে জাগানোর চেষ্টায় ব্রতী হয়েছেন। পাশ্চাত্য শিক্ষার পীঠস্থান হিন্দু কলেজের প্রতিষ্ঠা, প্রথম সংবাদপত্র সমাচার দর্পন এর প্রকাশনা (১৮১৮), কলকাতায় প্রথম বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন (১৮১৯) বাঙালির নাগরিক জীবনে এনেছে বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনা। সেই সাথে ডিরোজিওর (১৮০৩-৩১) অনুপ্রেরণায় ইয়ং বেঙ্গলের উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছে মহানগর কলকাতায়। পাশ্চাত্য শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ হিন্দু কলেজের একদল তরুণ পড়তে শুরু করেছে গোল্ড স্মিথের ইতিহাস,বার্ট্রান্ড রাসেলের আধুনিক ইউরোপ, রবার্টসনের পঞ্চম চার্লস, পোপের অনুবাদে হোমারের ইলিয়াড- অডিসি, ড্রাইডেনের অনুবাদে ভার্জিল, মিলটনের প্যারাডাইস লস্ট, রবার্ট পেইনের এজ অব রিজন-যুক্তির যুগ। মধ্যযুগের গাঢ় আঁধার পেরিয়ে যখন নবজাগৃতির নবীন আলোয় বাংলার আকাশ ভরে উঠেছে, তখন বিদ্যাসাগরের আবির্ভাব ও বেড়ে ওঠা। তিনি ভয় শূন্য চিত্তে অন্ধ সমাজের পীড়ন ও নিষ্ঠুরতাকে প্রতিহত করে আঁধার পেরিয়ে এগিয়ে যেতে চেয়েছেন উজ্জ্বল আগামীর পথে।
ঊনিশ শতকে যে কজন খ্যাতিমান ও প্রতিভাবান এর আবির্ভাব ঘটে তার প্রায় সকলেই ছিলেন ধর্মের প্রতি অনুগত। রাজা রামমোহন, কেশবচন্দ্র সেন, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এর নাম এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়। অবশ্য অনেকে পূর্বপুরুষের ধর্ম ত্যাগ করে নতুন ধর্মের মতাদর্শে দীক্ষিত হয়েছিলেন। এক্ষেত্রে কেবল ব্যতিক্রম ছিলেন বিদ্যাসাগর। তিনি স্বধর্ম, শাস্ত্র ত্যাগও করেন নি, আবার অন্য ধর্মের প্রতি ঝুঁকেও পড়েন নি। ধর্ম বিষয়ে তাঁর আগ্রহ সব সময় ছিল, তথাপি সমাজ ও ধর্মের নানা অসঙ্গতি দূর করার বিষয়ে তিনি মনোযোগী ছিলেন বেশী। এক্ষেত্রে হিন্দু কলেজের শিক্ষক ভিভিয়ান ডিরোজিও মনে করতেন, “যে তর্ক করতে পারে না, সে নির্বোধ আর যে তর্ক করে না সে ক্রীতদাস”। প্রবল অত্মপ্রত্যয়ী বিদ্যাসাগর যুক্তিতর্ক ছাড়া কোন কিছু গ্রহণ করেননি। তাই সহসিকতা আর আত্মবিশ্বাস নিয়ে বিদ্যাসাগর স্পষ্ট কওে জানিয়ে দিয়েছেন, “আমি দেশাচারের দাস নই”। সমাজ, সম্প্রদায়, স্বধমের্র জন্য যা কল্যাণকর বলে মনে করেছেন, তাই তিনি করেছেন বা করতে চেয়েছেন। হিন্দু শাস্ত্র ও দর্শনে সুপ-িত হয়েও তিনি ধর্ম ও শাস্ত্রের কোন কিছুই যুক্তি তর্ক ছাড়া গ্রহণ করেননি। সুস্থ,স্বস্থ সমাজ ও ব্যক্তি জীবন গড়ে তোলার জন্য ধর্মের যে টুকু গ্রহণ করা দরকার তিনি সেটুকু গ্রহণ করেছেন।
সমসাময়িক কালে দেবেন্দ্রনাথ যখন ‘ আত্মপ্রত্যয়সিদ্ধ জ্ঞানোজ্জ্বলিত বিশুদ্ধ হৃদয়’ দিয়ে উপনিষদের পরমব্রহ্মকে উপলদ্ধি করতে চেয়েছিলেন, বিদ্যাসাগর তখন মানব প্রেমের সাধক হিসেবে নিজেকে মেলে ধরেন দেশবাসীর সামনে। তিনি মানবতাবাদের পূজারী ছিলেন আর তাই তার সকল সাধনা ও কর্মপ্রয়াস মানুষকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে। এজন্যই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন,
‘হিন্দুত্বের দিকে নহে, সাম্প্রদায়িকতার দিকে নহে, বিদ্যাসাগরের যাত্রা ছিল মনুষ্যত্বের দিকে।... তিনি যে বাঙালি বড়লোক ছিলেন তাহা নহে। তিনি যে রীতিমত হিন্দু ছিলেন তাহা নহে।...তিনি তাহা অপেক্ষাও অনেক বেশি বড় ছিলেন,তিনি যথার্থ মানুষ ছিলেন।’ (রবীন্দ্রনাথ:চরিত্রপূজা)
লেখালেখির ক্ষেত্রে তার চিন্তা চেতনা ছিল ভিন্ন ধরনের। নাম, যশ, খ্যাতির জন্য বিদ্যাসাগর লেখালেখি করেননি। বঙ্কিমচন্দ্র, মধুসূদন দত্ত যে অর্থে সাহিত্যিক, তিনি সে রকম কিছু হতে চাননি। সংসারের ঝড় ঝঞ্ঝা আর সমাজের সংঘবদ্ধ আঁধারের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য তিনি তার কলম চালিয়ে গেছেন। ডিরোজিও’র বৈঠকখানা ও শ্রীকৃষ্ণ সিংহের মানিকতলার বাগানবাড়ির তর্কসভার তরুণ তুর্কীদের মত হৈ চৈ হাঙ্গামা না বাধিয়েও তিনি কলমকে শাণিত অস্ত্রে পরিণত করেছিলেন মননশীল ভাবনা প্রকাশের জন্য। ধর্মীয়, সামাজিক, দার্শনিক সব বিষয়েই তিনি তাঁর অসংকোচ আবেগ ব্যক্ত করেছেন সত্য প্রতিষ্ঠা ও সমাজ প্রগতির প্রশ্নে। নিস্ক্রিয় তাত্ত্বিক বা চিন্তাবিদদের জীবন বিদ্যাসাগর বেছে নেননি। আমৃত্যু তিনি লড়াই করে গেছেন ব্যক্তি, সমাজ,সংস্কৃতি ও ধর্মের সংস্কার ও সুস্থতার জন্য। পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন, অনুবাদকর্ম, বাংলা হরফ সংস্কার ও বিন্যাস, সাহিত্য রচনা সবকিছুর মূলে ছিল মানুষের প্রতি জাগতিক কল্যাণ কামনা।
বিদ্যাসাগর কোন মৌলিক সাহিত্য সৃষ্টি করেননি বা করতেও চাননি। তার অধিকাংশ সাহিত্যকর্ম বিভিন্ন ভাষার সাহিত্যের ছায়া অবলম্বনে রচিত। একজন কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, কবি যে অর্থে সাহিত্যিক সে অর্থে তিনি সাহিত্যিক ছিলেন না। বিদ্যাসাগর বিদ্বেষী বঙ্কিম তো তাকে সাহিত্যিকদের পঙক্তিতেই অন্তর্ভূক্ত করতে চাননি। তাকে কেবলই পাঠ্যপুস্তক রচয়িতা হিসেবে শনাক্ত করেছেন। বঙ্কিমচন্দ্রের চোখে পাঠ্যপুস্তক প্রণেতা হিসেবে সাব্যস্ত হয়েছিলেন, তথাপি অনুবাদকর্মে, সমালোচনা সাহিত্যে , বাংলা ভাষার শ্রীবৃদ্ধিতে ও পরিভাষা নির্মাণে তার আবদান অসামান্য । শেকসপিয়রের ‘ কমেডি অব ইরোর’ এর বিদ্যাসাগরকৃত অনুবাদ ‘ভ্রান্তিবিলাস’ সাহিত্যিক বিবেচনায় মৌলিক রচনা হিসেবে স্বীকৃিত লাভ করেছে। এই আনুবাদ কর্ম দেখে মনে হয় বিদ্যাসাগর ইচ্ছে করলে বড়মাপের কথাসাহিত্যিক কিংবা নাট্যকার হতে পারতেন অনায়াসে। কিন্তু সাহিত্যিক হবার বাসনা তাকে তাড়িত করেনি কখনই।
প্রাথমিক শিক্ষার সংস্কার ও উন্নয়নে বিদ্যাসাগরের ভূমিকা স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তিনি তাঁর শিক্ষা পরিকল্পনায় বাংলা ভাষাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি বলেছিলেন, কেবল লিখন , পঠন ও সরল অঙ্ক কষার মধ্যে বাংলা শেখা পরিসীমিত রাখলে চলবে না। যতদূর সম্ভব বাংলা ভাষাতেই শিক্ষা জীবন সম্পন্ন করতে হবে এবং ভূগোল ,ইতিহাস, গণিত, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, জ্যামিতি, পদার্থবিজ্ঞান সবই বাংলা ভাষাতে শিক্ষা দেয়া প্রয়োজন। কোপার্নিকাস, নিউটন, গ্যালিলিও, উইলিয়াম জোনস প্রমুখের জীবনী শিশুদের পাঠ্যসূচির অন্তর্ভূক্ত করতেও তিনি শিক্ষা পরিকল্পকদের আহবান জানিয়েছেন। প্রাথমিক শিক্ষার জন্য বিদ্যাসাগর এক বিশাল পাঠ্যক্রম প্রণয়ন করেছিলেন। আর এই পাঠ্যক্রম সনাতন পাঠশালার পাঠ্যক্রম থেকে ছিল সম্পূর্ণরূপে আলাদা। তবে তাঁর শিক্ষা পরিকল্পনা ছিল উচ্চাভিলাসী এবং এটা সাধারণ ছাত্রদের পক্ষে গ্রহণ করা সহজসাধ্য ছিল না। প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য তিনি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের পাশাপাশি নতুন পাঠ্য পুস্তক প্রণয়ন ও শিক্ষক প্রশিক্ষণের প্রস্তাব দেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশুদের কী কী বই পড়া দরকার তারও একটি তালিকা তিনি করে দিয়েছিলেন। তার পরামর্শক্রমেই ইংরেজ সরকার স্কুল পরিদর্শকের পদ সৃষ্টি করেন। সরকার তাকে প্রধান পরিদর্শক পদ না দিয়ে সহকারী পরিদর্শকের পদ প্রদান করেন। সহকারী স্কুল পরিদর্শক হিসেবেও তিনি নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করেন এবং পাঠ্যপুস্তক রচনা করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেন।
যশ, খ্যাতি, পদ-পদবী কিংবা উপাধির জন্য বিদ্যাসাগর সারাজীবন কাজ করেননি, আক্ষরিক অর্থে কর্মযোগী বলতে যা বোঝায় তিনি ছিলেন তাই। সেসময় বিদ্বান ও বিত্তবানরা সরকারি খেতাব লাভের জন্য কী কাঙালপনাই না করেছে যার ইয়ত্তা মেলা ভার! অথচ প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসাব-নিকাস না করেও তিনি ১৮৫৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো ও এশিয়াটিক সোসাইটির সম্মানসূচক সদস্য পদ লাভ করেন। ১৮৭৭ সালে তদানীন্তন লে. গভর্নর স্যার রিচার্ড টেম্পল তাকে সি আই ই উপাধিতে ভূষিত করেন। বিদ্যাসাগরের জ্ঞান, মনীষা, প্রতিভা, মানবিকতায় মুগ্ধ হয়ে ইংরেজ প-িতরা তাঁর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন।
অখ- চরিত্রের অধিকারী এই বিরলপ্রজ প-িত সারাজীবন যুক্ত থেকেছেন মানুষের বেদনা আর তার হৃদয়ের রক্ত ক্ষরণের সাথে। মানুষকে বৃক্ষের মতই জাগিয়ে রাখা এবং তাকে কল্যাণের পথে ধাবিত করানোই ছিল তার স্বপ্ন। এজন্য তিনি বিধবা বিবাহ প্রবর্তন, নারী মুক্তি আন্দোলনের পাশাপাশি শিক্ষানীতি প্রণয়ন পাঠ্যপুস্তক রচনা, স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা, শিক্ষার প্রসার, হরফ বিন্যাস, শিশু পাঠ্য প্রণয়নের মতো বিভিন্ন দরকারী কাজে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখেন আমৃত্যু। বাংলা ভাষায় যে সাহিত্য, ইতিহাস, বিজ্ঞান চর্চা করা যায় তা তিনিই আমাদের শিখিয়েছেন। পাশ্চাত্যের হিতবাদী দর্শন কিভাবে আমাদের সমাজ উন্নয়নে প্রয়োগ করা যায় তা শিখেছি আমরা বিদ্যাসাগরের কাছ থেকে। তার সকল কর্মপ্রয়াস ছিল সমাজলগ্ন এবং গভীরভাবে মানবিকতা ও নীতিবোধে উজ্জ্বল। পারত্রিক মুক্তি নয়, মানুষের জাগতিক ও মানবিক কল্যাণেই তিনি তার শিক্ষা, জ্ঞান, অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়েছেন। এ কারণেই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘এই অবমানিত দেশে বিদ্যাসাগরের জন্ম বিধাতার নিয়মের আশ্চর্য ব্যতিক্রম’। হ্যা, আশ্চর্যই বটে নইলে ধর্ম শাস্ত্রশাসিত, অন্ধত্ব গোঁড়ামিতে ভরা, জাতপাত, ছুঁৎমার্গে বিভক্ত বিভাজিত বাঙালি সমাজে থেকেও আধুনিকতা, যুক্তিবাদিতা ,ধর্মনিরপেক্ষতার পাঠ নিলেন কীভাবে? কোন দল বা সংঘ না করেও যে সামাজে সুস্থ মানবিকতা জাগিয়ে তোলা যায় তার উদাহরণ কেবলই বিদ্যাসাগর। একারণেই দ্বিধাহীন ভাবে বলা যায়, অসংখ্য বাঙালির মধ্যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সর্বতোভাবেই অনন্য এবং আদর্শ বাঙালির প্রমূর্ত পতীক যাকে নিয়ে তর্ক করা যায় না বললেই চলে। মানবিকতার এই সাধক কেবল বিদ্যাতে নয়, দয়া দাক্ষিণ্যেও ছিলেন অনন্য। ১৮৭৬ সালে দেশজুড়ে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে দিলে অসহায় অনাহারী মানুষের মুখে খাবার তুলে দিতে বিদ্যাসাগর এগিয়ে আসেন। সরকারি সাহায্যে মেদিনীপুর, হুগলি জেলায় শতশত লঙ্গরখানা খোলার ব্যবস্থা করেন। নিজ গ্রাম বীরসিংহ ও আশে পাশের গ্রামেও স্বউদ্যোগে নিজস্বব্যায়ে লঙ্গরখানা খোলেন এবং হাজার হাজার অভুক্ত মানুষের মধ্যে খাবার বিতরণ করেন। বিদ্যাসাগর যে কতভাবে কত মানুষ কে সাহায্য করেছেন তার কোন ইয়ত্তা নেই। ফ্রান্সে পরিবার পরিজন নিয়ে মাইকেল মধুসূদন দত্ত অভাব অনটনে দিন কাটাচ্ছেন জেনে বিদ্যাসাগর তাকে আট হাজার টাকা পাঠিয়ে দেন। কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত আমৃত্যু এ ঋণের কথা ভোলেননি। বিদ্যাসাগর এক অন্তহীন মহাজীবনের নাম। তার অজেয় পৌরুষ ও অক্ষয় মনুষ্যত্ব উন্নত ও আলোকিত আগামীর পথে এগিয়ে যেতে বাঙালির প্রেরণার উৎস থাকবে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে সকলের কাছে স্মরণীয় হয়ে আছেন এবং থাকবেন।
পৃথিবীতে মানুষ আসে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এবং সময় শেষ হলে প্রত্যেক মানুষই পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়। এটাই প্রকৃতির অমোঘ নিয়ম। কিন্তু মৃত্যুর পরেও কোন কোন মানুষ বেঁচে থাকেন তার অবিনশ্বর কর্মের মধ্য দিয়ে। নশ্বর শরীরের মৃত্যু হলেও তার অবিনশ্বর কর্মের মৃত্যু হয় না। মহৎ কর্মের মধ্য দিয়েই তার নাম বিশ্বে স্মরণীয় ও অক্ষয় হয়ে থাকে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এমনই এক মহাপুরুষের নাম যিনি কালকে জয় করে মানুষের মনে একটি স্থায়ী আসন করে নিতে পেরেছেন শুধুমাত্র মানবকল্যাণে কালজয়ী ভূমিকা পালনের মাধ্যমে। এই মহামনীষী অনেক আগে জগতে এসেছিলেন আবার জগত সংসার ছেড়ে চলেও গেছেন। কিন্তু কাল¯্রােত তাঁর স্মৃতি মুছে দিতে পারেনি। কারণ সময়ের সাহসদীপ্ত সন্তান হিসেবে যে অনন্য ভূমিকায় তিনি অবতীর্ণ হয়েছিলেন তার জন্যই তিনি বেঁচে আছেন মানুষের হৃদয়ে। পিতা ঠাকুরদাস পুত্র ঈশ্বরচন্দ্রকে তাদের গ্রামের পাঠশালার প-িত করার জন্য কলকাতায় এনে শাস্ত্রজ্ঞ বানাতে চেয়েছিলেন, শাস্ত্রজ্ঞ হয়ে শাস্ত্রের সারবত্তাকে নতুনভাবে আবিষ্কার করেন এবং উত্তরকালে তাকে আধুনিকভাবে উপস্থাপন করেন হিন্দুধর্ম ও সমাজের সংস্কারে। তিনি যদি শাস্ত্রের প-িত হয়েই জীবন যাপন করতেন, যদি ইউরোপীয় ভাষা সাহিত্যের চর্চা না করে পাশ্চাত্য ভাবধারা থেকে দূরে থাকতেন তবে হিন্দু সমাজের অন্ধ সংস্কার পীড়নকে প্রবলভাবে আঘাত করতে পারতেন না। হিন্দু সমাজের সকল ধরনের কুসংস্কার , ধর্মীয় গোড়ামি, বর্ণাশ্রম প্রথার বিরুদ্ধে ঈশ্বরচন্দ্র ছিলেন তো এক আপসহীন, নির্ভিক যোদ্ধা। সব ধরনের কুপ্রথার বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টিতে তিনি ছিলেন এক নিরলস কর্মী। সেইসাথে তিনি ছিলেন সর্বতোভাবে মুক্তবিশ্বের মুক্ত মানুষ এবং সংগ্রাম করে গেছেন ‘বুড়ো যুগের’ বদ্ধ সমাজের বিরুদ্ধে। আর এ জন্যই অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী, বাঙালির প্রগতি আন্দোলনের প্রাণপুরুষ, প-িতপ্রবর সাধক বিদ্যাসাগর চিরকাল বাঙালির স্মৃতিসত্তায় অমর হয়ে থাকবেন।
আবদুল্লাহ আল আমিন :সহকারী অধ্যাপক, মেহেরপুর সরকারি কলেজ।
©somewhere in net ltd.