![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
বাংলাদেশের বাউল আর তাদের গান
আবদুল্লাহ আল আমিন
অবিভক্ত বাংলার নদীয়া আউল- বাউল- বৈষ্ণব সাধনার তীর্থভূমি; মরমি সাধকদের ভাষায় , এ অঞ্চল হলো ‘ মহামানবের মিলনতীর্থ ’। নদীয়া মানে বাংলাদেশের কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা আর পশ্চিমবঙ্গের কৃষ্ণনগর, রানাঘাট, নবদ্বীপ। আঠারো শতকের নদীয়া বলতে অখ- নদীয়াসহ বর্ধমান, ২৪-পরগণা, যশোর, হুগলির কিছু অংশ মিলে গঠিত বিশাল জনপদকে বোঝাতো। এ অঞ্চল দ্রোহী লোকধর্ম চর্চা, মরমী সাধনার উর্বর লীলাভূমি হিসেবে পরিচিত। কর্তাভজা, বলরামী, সাহেবধনী, খুশিবিশ্বাসী, লালনশাহী, বৈষ্ণব প্রভৃতি সঙ্গীতাশ্রয়ী লোকধর্মের উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে ৩৪১৪ বর্গমাইল বিশিষ্ট বিশাল ভূখ-ের অবিভক্ত নদীয়ায়। বাউল মতের উৎপত্তি এই অঞ্চলে বলে প-িতদের অভিমত।(মুহাম্মদ এনামুল হকঃ ‘বঙ্গে সূফী প্রভাব’।কলিকাতা,১৯৩৫,পৃষ্ঠা১৯৬-৯৭) বৃহত্তর নদীয়ার কুষ্টিয়া মেহেরপুর চুয়াডাঙ্গা অঞ্চলের বাউল সাধক , পদকর্তা, অনুসারীদের সংখ্যা উল্লেখ করার মতো।‘১৯৭৬ সাল অবধি ভেকধারী ফকিরদের সংখ্যা কুষ্টিয়া জেলা অর্থাৎ মেহেরপুর,চুয়াডাঙ্গা,কুষ্টিয়া মিলে ২৫২জন ছিল। ১৯৮২-৮৩ সালে এই সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ৯১৫ জনে দাঁড়ায়। বর্তমানে এ সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। অনুসারী অথবা সহযোগীদেও সংখ্যা ৫০ হাজার ছাড়িয়ে যাবে।’ ( ড. আনোয়ারুল করীম, ‘বাংলাদেশের বাউল: সমাজ, সাহিত্য,সংগীত।’ঢাকা,২০০২, পৃ:৮৩। ) এসব কারণে আশুতোষ ভট্টাচার্য বৃহত্তর কুষ্টিয়াকে ‘বাংলার বাউলের লীলাভূমি’ হিসেবে উল্লেখ করেছে। এ অঞ্চল থেকেই বাউল মত পার্শ্ববর্তী পাবনা,যশোর,ফরিদপুর জেলায় ছড়িয়ে পড়ে। বাউলের লীলাভূমি বৃহত্তর কুষ্টিয়াতে জন্মেছেন বাউল সাধনার অগ্রগণ্য পুরুষ লালন সাঁই এবং গগন হরকরা, গোসাঁই গোপাল, সর্বক্ষেপী বোষ্টমী, পাঞ্জু শাহ, দুদ্দু শাহ’র মতো সাধক মহাজনরা।
১
বাংলাদেশের বাউল সমাজ ও তাদের গান সম্পর্কে আলোচনার আগে তাদের তত্ত্ব,দর্শন এবং এদের সাথে সম্পর্কযুক্ত বিভিন্ন লোকধর্ম নিয়ে আলোচনা করা প্রাসঙ্গিক। বাংলাদেশের বাউলরা মূলতঃ একটি লোকায়তবাদী সাধন সম্প্রদায়। প্রচলিত ধর্ম, প্রথা, শাস্ত্রবিরোধী হিসেবে বাউলদের আবির্ভাব। সম্প্রদায়গতভাবে এরা হিন্দু কিংবা মুসলমান হলেও এরা নামাজ-রোজা, পূজা-আহ্নিক করে না। এরা মসজিদ মন্দিরের ঘেরটোপের বাইরে গানে গানে মনের মানুষ, সাঁই নিরঞ্জন বা পরমারাধ্যের তালাস করে। এরা মুখে কোরান-হাদিস, পুরান-উপনিষদ, গীতা-বাইবেলের মত আওড়ালেও সেইভাবে অন্তর দিয়ে তা মানে না। তবে তারা কোনোভাবেই নিরীশ্বরবাদী নয় বরং প্রবলভাবে আস্তিক। জীবনের জন্য যা অনুকূল নয়, বাউলরা সেসব অনুকরণ বা অনুসরণ করে না। বাউলরা পৃথিবী ও মানুষ ভালবাসে এবং জীবনকে সত্য বলে মানে। সেজন্য তারা দেহাত্মবাদী, যোগী ও অমরত্ব পিপাসু। তারা বিভিন্ন ধর্মের প্রতীক, উপমা ব্যবহার করে গান বাঁধে, পদ রচনা করে, কিন্তু কোনো ধর্মই তারা বিশুদ্ধরূপে মেনে নেয়না। আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে নিজের মতো করেই তারা বৌদ্ধ, ব্রাহ্মণ্য ধর্ম কিংবা ইসলামকে গ্রহণ করেছে। তাদের সকল সাধনার মূলে রয়েছে দীর্ঘ জীবন লাভের আকাঙ্খা। যোগ-তন্ত্র-কায়া সাধনার মাধ্যমে তারা মূলতঃ দীর্ঘজীবন লাভের সাধনা করে।
বাউলরা কেবল দেহাত্মবাদী নয়, তারা অসাম্প্রদায়িক ও মানবতাবাদী। গ্রামে গ্রামে গান গেয়ে ভিক্ষা করার সময় তারা সকল সার্বজনীন মূল্যের কথাই ধ্বনিত করে। বাউলের গুরুবাদেও মূলতঃ মানবতত্ত্ব বা মানবতাবাদের মহিমাই ঘোষিত হয়েছে। বাউলদের অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদে মুগ্ধ হয়ে রবীন্দ্রনাথ লেখেন:
‘ বাংলা সাহিত্যে বাউল সাধনায় সেই সাধনাই দেখি, এ সাধনা হিন্দু মুসলমান উভয়েরই, একত্র হয়েছে অথচ কেউ কাউকে আঘাত করেনি। এই মিলনে সমিতি প্রতিষ্ঠা হয়নি, এই মিলনে গান জেগেছে, এই গানের ভাষা ও সুর অশিক্ষিত মাধুর্যে সরস। এই গানের ভাষায় ও সুরে হিন্দু মুসলমানেরা মিলেছে, কোরান-পুরানে ঝগড়া বাধেনি। এই মিলনেই ভারতের সত্য পরিচয়, বিবাদে-বিরোধে বর্বরতা। বাংলাদেশের গ্রামের গভীর চিত্তে উচ্চ সভ্যতার প্রেরণা ইস্কুলের-কলেজের অগোচওে আপনা-আপনি কি রকম কাজ করে এসেছে, হিন্দু মুসলমানের জন্য এক আসন পাতার চেষ্টা করছে, এই বাউল গানে তারই পরিচয় পাওয়া যায়।’ (মুহাম্মদ মনসুর উদ্দীন, হারামণি ১ম খ-,‘ আশীর্বাদ’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। )
বাউল গানে সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি নেই। হিন্দু গুরুর মুসলমান শিষ্য , আবার মুসলমান গুরুর হিন্দু সাগরেদ হতে কোনো বাধা নেই। হিন্দু বাউলের গানে থাকে আল্লাহ-রসুল, মক্কা-মদিনার বয়ান আর মুসলমান বাউলের কণ্ঠে ধ্বনিত হয় রাধা-কৃষ্ণের পদাবলী। বাউল ধর্ম মূলতঃ বাঙালির লোক ভাবনা প্রসূত ধর্ম, তাদের গানে-ধ্যানে, ভাবনা-কল্পনায় সবসময়ই অসাম্প্রদায়িক মানবিক চেতনা প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষের অসাম্প্রদায়িক মানস গঠনে লালন সাঁই, পাঞ্জু শাহ, দুদ্দু শাহ, মদন বাউলসহ অসংখ্য নামগোত্রহীন বাউল ও মরমি সাধকের গান, বাণী ও দর্শন ভূমিকা রেখেছে।
বাউল সাধনা ও চর্চার সাথে যারা যুক্ত তারা অধিকাংশই সামাজিকভাবে নি¤œবর্গীয়, অর্থনৈতিকভাবে প্রান্তিক । এদের প্রবর্তক কিংবা সাধু গুরুরাও নি¤œবর্গীয়। ছেঁউড়িয়ার ফকির দুর্লভ শাহ, কয়ার তারাপদ দাস, খোকসার নটবরচন্দ্র বিশ্বাস, টাঙ্গাইল থেকে ছেঁউড়িয়ায় আসা জ্ঞানদাস গোঁসাই, মেহেরপুরের গোলাম ঝড়– শাহ, আরাফাত শাহ, জামাল শাহ’রা ছিলেন গরীবের গরীব; ভিক্ষা করে এরা জীবিকা নির্বাহ করতো। বেহাল শাহ, শুকচাঁদ ফকির, করিম শাহ, গোলাম ইয়াছিন শাহ, খোদা বকশো শাহ গান গেয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। তবে অবস্থাসম্পন্ন গৃহস্থরাও বাউল হয়েছেন, তবে এ সংখ্যা খুব বেশি নয়। যেমন: ‘ মাগুরার ছাবদার আলী শাহ, খলিসাকু-ির আব্দুর রব শাহ, দহকোলার শামসুল আলম শাহ, মেহেরপুরের ঝাঁঝার আজমত শাহ ও ফতেহপুরের দৌলত শাহ, কিংবা ফরিদপুরের রহমান শাহ- এরা সকলেই অবস্থাসম্পন্ন গৃহী বাউল।’ ( আবুল আহসান চৌধুরী, ‘ লোকসংস্কৃতি বিবেচনা ও অন্যান্য প্রসঙ্গ,। বাংলা একাডেমি,জুন ১৯৯৭, পৃ. ৪৭।) মেহেরপুরের গাংনীর মাতু ফকির ও দবিরউদ্দিন শাহদের জন্ম জোতদার পরিবারে। এখন প্রশ্ন জাগে, কেন নি¤œবর্গীয় মানুষ দলে দলে বাউলধর্মের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করে। উত্তর হচ্ছে, অধিকার বঞ্চিত মানুষ বাঁচার তাগিদে এসব ধর্মের ছায়াতলে আশ্রয় নেয়। ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, পলাশী যুদ্ধের আগে ও পরে পঞ্চাশ বছর ধরে বাংলার সমাজ-সংস্কৃতি ও উৎপাদন ব্যবস্থায় পরিবর্তনের যে হাওয়া লাগে তাতে করে বাংলার গ্রাম জনপদের পিছিয়ে পড়া মানুষ আরও শোষণ-বঞ্চনার শিকার হয়। হিন্দু উচ্চবর্ণবাদীদের প্রবল আধিপত্যে সামাজিক স্তরবিন্যাসে যারা নিচে ছিল তারা আরও নিচে চলে যায়। এছাড়াও শ্রীচৈতন্যদেব প্রবর্তিত নববৈষ্ণব ধর্মের অবক্ষয়, ধর্মান্ধ মৌলবি-মোল্লাদের ধর্মচর্চার নামে বাড়াবাড়ি সাধারণ মানুষকে শাস্ত্রবিমুখ করে তোলে এবং এর ফলে গড়ে ওঠে কর্তাভজা, সাহেবধনী, বলরামি, খুশিবিশ্বাসীসহ অনেকগুলো লোকধর্ম। এসব লোকধর্মের পাশাপাশি বাউল মতবাদ সুসংহত ও লোকপ্রিয় হতে থাকে। নিপীড়িত, নিগৃহীত মানুষ দলে দলে এসব লৌকিক গৌণধর্মে যোগ দেয়। তারপরও বাংলাদেশের লোকমানসে সুফি-দরবেশদের প্রভাবও কম নয়।
২
বাউল সাধনতত্ত্ব ও দর্শন সম্পর্কে প-িতরা নানা মত প্রকাশ করেছেন। কেউ বলেন, বাউল শব্দটি সংস্কৃত শব্দ; আবার কেউ বলেন, ফারসি শব্দ। শব্দগত অর্থ যাই হোক না কেন; এর সাধারণ অর্থ পাগল, উন্মাদ, ভাবোন্মত্ত বা প্রেমোন্মাদ। অধ্যাপক উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য বলেন,
সংস্কৃত বাতুল অর্থাৎ প্রেমোম্মত্ত শব্দের প্রকৃত রূপ নিয়ে বাউল শব্দটি বাংলা ভাষায় এসেছে। তিনি বাউলদের তান্ত্রিক, সাংখ্য এবং বৈষ্ণব ধর্মের শাখা রূপে গণ্য করেছেন। ‘আবার একে কেউ কেবলমাত্র সূফি সাধনার শাখা হিসেবে চিহ্নিত করেন। আবার কেউ বলেন, বজ্রযানী, সহজযানী থেকে নাথ, শিব, যোগী, বৈষ্ণব ও বিভিন্ন গুরুবাদের বেনামে হিন্দু-মুসলিম বাউল সাধনার বিকাশ ও বিস্তৃতি।’ (ড. আনোয়ারুল করিম, পূর্বোক্ত, পৃ. ৩২-৩৩)
মালাধর বসু ‘শ্রীকৃষ্ণ বিজয়’ এ প্রথম বাউল শব্দটি ব্যবহার করেন। এতে আছে-
‘মুকুল তো মাথার চুল/ন্যাংটা যেন বাউল/ রাক্ষসে রাক্ষসে বুলে রণে।’ (ড. মালাধর বসু। শ্রীকৃষ্ণ বিজয়, কলিকাতা ১৩৫৭, পৃ. ৫২৯)
ষোল শতকের শেষদিকে ‘চৈতন্য চরিতামৃতে’ বাউল শব্দের বহুল ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। যেমন-
‘আমি তো বাউল আন কহিতে আন কহি
কৃষ্ণের মাধুর্য স্রোতে আমি যাই বহি।’
চ-ীদাসের ভণিতাযুক্ত একটি পদেও বাউল শব্দের ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়:
‘শুন মাতা ধর্ম বাউল হইনু অতি
কেমনে সুবুদ্ধি হবে প্রাণী।’
(ড. আনোয়ারুল করিম । ‘ বাউল কবি লালন শাহ’। ঢাকা-১৯৭৩, পৃ. ৩৯-৪০)
ড.আহমদ শরীফ এবং আব্দুল হাই-এর মতে, ‘পনের শতকের শেষ পদের শ্রীকৃষ্ণ বিজয়ে এবং ষোল শতকের শেষ পদের চৈতন্য চরিতামৃতে ‘ক্ষেপা’ ও বাহ্যজ্ঞানহীন অর্থে বাউল শব্দের প্রয়োগ দেখা যায়।’ (ড. আনোয়ারুল করীম, পূর্বোক্ত, পৃ. ৪৬)
‘বাউল’ শব্দের বুৎপত্তিগত অর্থ সম্পর্কে পন্ডিতদের মধ্যে মতদ্বৈধতা থাকলেও এর সাথে ভাবোন্মত্ততা ও প্রথাবিরোধিতা গভীরভাবে যুক্ত। সে সাথে বাউল শব্দটি বায়ু সংলগ্ন যোগ সাধনার ইঙ্গিত বহন করে। কারো মতে, বায়ু মানে শ্বাস-প্রশ্বাস এবং শ্বাস-প্রশ্বাস অর্থ জীবন ধারণ এবং তাহা সংরোধ করিয়া দীর্ঘ জীবনলাভের সাধন করেন যাহারা তাহারাই বাউল। আবার ‘ কাহারো মতে, সাধারণ সমাজ বহির্ভূত আচার-ব্যবহার সম্পন্ন ধর্ম সম্প্রদায় বাউল।’ (চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, বঙ্গবীণা। কলিকাতা-১৩৬০, পৃ. ৪৫১)
আবার কেউ মনে করেন, বাউল শব্দটি ‘আউল’ থেকে এসেছে, যা থেকে আউলিয়া শব্দের উদ্ভব। ড. ব্রজেন্দ্রনাথ শীল বলেন, বাউল শব্দটি আউল শব্দজ। কেননা আমরা সাধারণতঃ আউল বাউল বলি। আউল শব্দটি আরবি ‘আউলিয়া’ সম্ভূত, আউলিয়া মানে ঋষি। (মুহাম্মদ মনসুর উদ্দিন, হারামণি। ঢাকা ১৩৮৩ পৃ. ১) বাউল শব্দের অর্থ যাই হোক, এদেরকে ফকির, নেড়ার ফকির, বেশরা ফকির, মারফতি বা বেদাতি ফকির, রসিক বৈষ্ণব, রসিক পন্থী, বৈষ্ণবও বলা হয়। উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য বলেন, ‘আমার মনে হয়, সূফি প্রভাবানি¦ত মুসলমান ‘নেড়া’ বা বেশরা ফকিররাই বাংলার বাউল ধর্ম সাধনার আদি প্রবর্তক।’ (উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, পূর্বোক্ত পৃ. ২৮৩)
লালন নিজেও তার গানে ‘ নাড়া ’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন বারবার। তার একটি গানে আছে:
“কুলের হলাম ভারি হলাম নাড়ি নাড়ার সাথে/ নাড়ার সাথে নাড়ি হয়ে পরনে পরেছি ডুরি /দিব না আর আঁচির কড়ি বেড়াবো চৈতন্য পথে।।” তবে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে উভয় সম্প্রদায়ই বাউল দর্শন ও গান দ্বারা আকৃষ্ট। প্রাতিষ্ঠানিক শরিয়তি ইসলামের কাছে পরাভূত এই বেশরা বা ফকিরি মতবাদ বা দর্শন লোকজীবনকে আশ্রয় করে রূপান্তরের মধ্য দিয়ে বয়ে চলেছে। বিরুদ্ধ প্রতিবেশ সত্ত্বেও এই বেশরা, বেদবিরোধী অবৈদিক সংস্কৃতির ধারাটি বহমান রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক ইসলামি ও বৈদিক ধারার সমান্তরালে। তবে এ দু’ধারার মধ্যে যেমন বিরোধপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে তেমনি মিলনাত্মক সম্পর্কও কম নেই। বাউল দর্শন মূলতঃ সংশ্লেষণবাদী দর্শন। দক্ষিণ ভারতের ভক্তিবাদ, উত্তর ভারতের সন্তধর্ম, বৈষ্ণব সহজিয়া, যোগী শৈবধর্ম এবং ইসলামি সূফিবাদের সমন¦য়ে বাউল দর্শন সমৃদ্ধ হয়েছে। সূফিদের মতো বাউলরা মনে করে, সঙ্গীতের মাধ্যমে মানুষের অন্তরে খোদা-প্রেমের বাতি জ¦লে ওঠে, ধ্যানে তন্ময়তা আসে। আধ্যাত্মিক বোধ ও অনুভূতি জাগানো এবং সাধন-ভজনের জন্য তারা গান করে। তাই বাউল গান অন্যান্য লোকসঙ্গীতের মতো গান নয়, এ গান হল সাধকের সাধন-ভজনের সঙ্গীত।
প-িত ও গবেষকরা নদীয়াকে বাউল সাধনার ভিত্তিভূমি হিসেবে মনে করেছেন বিভিন্ন লেখা ও গবেষণায়। ষোড়শ শতকে চৈতন্যদেব নদীয়ার পথে পথে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষকে মহামিলনের মন্ত্র শুনিয়েছিলেন। তাতে নদীয়ায় এক নতুন প্রেম ধর্মের আবির্ভাব হয়, যার নাম বৈষ্ণব ধর্ম। এই নতুন ধর্ম নিম্নবর্গীয় মানুষকে দিয়েছিল বেঁচে থাকার অনিঃশেষ প্রেরণা। বৈষ্ণব ধর্মের ঐতিহ্য ও পরম্পরায় স্নাত হয়ে বাউল দর্শন ও সম্প্রদায় গড়ে ওঠে। ড. এনামুল হক বলেন, ‘নদীয়া জেলাই বাউল মতের উদ্ভবের স্থান। ঈশ্বরপুরী, চৈতন্যদেব, অদ্বৈতাচার্য্যরে কথা’ বাদ দিয়াও নদীয়ার আরও কয়েকজন প্রাচীনতম বাউলের নাম জানতে পারা যায়, তাহারা হরিগুরু, বনচারী, সেবাকমলিনী ও অখিল চাঁদ। নদীয়ই বাংলাদেশে বাউলমতের জন্মদাতা। এ জেলা হইতে জ্ঞানের কথা, শাস্ত্রের কথা জন্ম লইয়াছে, তেমনি মর্মের কথা, প্রেমের কথাও জন্ম লওয়া নিতান্তই সম্ভবপর ----এই নদীয়ার মধ্যেই গোবরা, হজরত, খুশী বিশ্বাস প্রমুখ মুসলমান এবং আউল চাঁদ, বীরচন্দ্র প্রমুখ হিন্দুর চেষ্টায় ভাববিদ্রোহী দলগুলি গঠিত হইল, বাঙ্গালায় বাউল মতকে প্রতিষ্ঠিত ও বিস্তৃত করিবার পক্ষে তাহাদের প্রভাব নিতান্তই কম নহে।’ (ড. মুহাম্মদ এনামুল হক। বঙ্গে সূফী প্রভাব। ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০০৬, পৃ. ১২৯-১৩০)
৪
বাউল ধর্ম ও দর্শন বিকাশে আঠারো শতকের বাংলার সঙ্গীতাশ্রয়ী লোকধর্মগুলির ভূমিকা অনস্বীকার্য। সাহেবধনী সম্প্রদায়ের সাথে বাউল ধর্মের মিল রয়েছে অনেকাংশে। এ মতের উদ্ভব নদীয়ার নাকাশীপাড়া থানার শালিগ্রাম দোগাছিয়া গ্রামে। সঙ্গীতাশ্রয়ী এ মতে হিন্দু মুসলমান মিলনের কথা বলা হয়েছে। চাপড়ার বৃত্তিহুদা গ্রামকে সাহেবধনী সম্প্রদায়ের সাধনপীঠ মনে করা হয়। এ গ্রামকে কুবির গোসাঁই বৃন্দাবনের চেয়ে বড় শ্রীপাট বলে মান্য করেছেন, কারণ এখানেই তাঁর গুরু চরণচাঁদ নীলাচলের অধিক লীলা করেছেন। এ গ্রামে সাহেবধনী সম্প্রদায়ের গীতিকার কুবির গোঁসাই-এর সমাধি মন্দির রয়েছে। কুবির গোসাঁই (১৭৮৭-১৮৭৯) এর একটি গানে আছেঃ
‘হরিষষ্ঠি মনসা মাখাল/ মিছে কাঠের ছবি মাটির ঢিবি সাক্ষী গোপাল/বস্তুহীন পাষাণে কেন মাথা কুটে মরো?/ মানুষে করো না ভেদাভেদ/কর ধর্মযাজন মানুষ ভজন/ছেড়ে দাওরে বেদ/ মানুষ সত্য তত্ত্ব জেনে /মানুষের উদ্দেশ্যে ফের।’
মানুষে মানুষে কোন ভেদ নেই, যে ভেদ আছে তা মানুষই সৃষ্টি করেছে। বৈদিক মন্ত্রের মহিমা ত্যাগ করে মানুষতত্ত্বকে সত্য বলে জানতে হবে। প্রাণহীন পাথরে মাথা কুটে কোন লাভ নেই। এসব কথা বলেছেন সাহেবধনী সম্প্রদায়ের গীতিকার কুবির গোঁসাই। কুবির গোঁসাই-এর গুরুপাট চাপড়ার বৃত্তিহুদা গ্রাম হলেও তার জন্মভিটে চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা থানার ঘোষবিলা গ্রামে। ঘোষবিলা থেকে বৃত্তি হুদার দূরত্ব ২০ মাইল। কেউ কেউ বলে তাঁর পৈতৃক ভিটে চুয়াডাঙ্গার মধুপুর গ্রামে। তবে কুবির যে অবিভক্ত নদীয়ার অধিবাসী ছিলেন তাঁর গানের ভাষা ও শব্দ চয়নে বেশ বোঝা যায়। আলমডাঙ্গা ও চাপড়া থানা মেহেরপুর সংলগ্ন হওয়ায় মেহেরপুরের বাউলদের গানে কুবিরের প্রভাব লক্ষণীয়। কুবির গোঁসাই এর একটি গানে বলা হয়েছে:
‘এই মানুষকে করবে বিশ্বাস/ এই মানুষ জানিও সত্য নির্যাস।/ এই মানুষ বিনা হবে নাকো/ সেই সহজ মানুষের করণ।। / এই মানুুষে আছে সেই মানুষ/ তার ভাব অগম্য পরমব্রহ্ম পরমপুরুষ।’
মেহেরপুরের ইছাখালি গ্রামের আরজান শাহ নামের এক সাধক মহাজন কুবিরের সুরে গেয়েছেন:
‘মানুষ বিনে আর কিছু নাই
নৈরাকারে ডি¤¦ পরে ভেসেছে এই মানুষ গোঁসাই।।
ধন্ধকারে অন্ধকারময় সাকারেতে আকার ধেয়ায়
দীপ্তাকারে হয়ে উদয় মানুষরূপে নীলা দেখায়।।
মানুষে মানুষ কারবার আশুক নাম দুহাকার।।
মানুষ আকার মনসুর হাল্লাজ
সে ফুকারিয়া আল্লাহ কবলায়
চাঁদপতি কয় আরজানকে, ভজো বর্তমান এই মানুষ ধরে
এই মানুষ অটল বিহারে অখ- গোলকে আশ্রয়।।
বাউল গান ও দর্শনে সাহেবধনী সম্প্রদায়ের ধর্মবিশ্বাস, আচার-অনুষ্ঠানের চেয়ে কর্তাভজাদের প্রভাব বেশি। আঠারো শতকের মাঝামাঝিতে এ সম্প্রদায় প্রসিদ্ধি লাভ করে। আউল চাঁদ নামক একজন মুসলমান দরবেশ কর্তাভজা সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা। জনশ্র“তি আছে যে, আঠারো শতকের দ্বিতীয়ার্ধে আউলচাঁদ ফকির ঘোষপাড়ায় আসেন এবং এই ধর্মের অন্যতম গুরু রামশরণকে দীক্ষা দেন এবং আউল চাঁদের ২২ জন শিষ্য মিলে কর্তাভজা সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠা করেন। রামশরণ পালের সহধর্মিনী সরস¦তী বা সতীমা এবং পুত্র দুলালচাঁদ কর্তাভজা সম্প্রদায়কে সংগঠিত করেন। দুলালচঁাঁদ ‘ভাবের গীত’ নামে এক ধরনের গান বাঁধেন। ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে দুলালচাঁদের প্রয়াণের পর সতীমা এ সম্প্রদায়ের গুরু হিসেবে স¦ীকৃতি পান। কর্তাভজাদের কোন আখড়া কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা জেলায় নেই। তারপরও বাউলদের একটি ঘরানার নাম সতীমার ঘরানা। বর্তমানে বাংলাদেশে বাউলদের মধ্যে পাঁচটি ঘর আছে। সেগুলো হল: ছেঁউড়িয়ার ঘর বা লালনের ঘর,হরিশপুরের ঘর বা পাঞ্জু শাহ’র ঘর, চৌধুরীর ঘর বা উজল চৌধুরীর ঘর, দেলবার সাঁই এর ঘর এবং ঘোলদাড়ির পাঁচু শাহের ঘর। পাঁচু শাহ মূলতঃ সতীমার ঘরের অনুসারী ছিলেন। বাউল দর্শনের সমৃদ্ধিতে কর্তাভজাদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। লালন শাহ কর্তাভজাদের অনুসরণে দোল পূর্ণিমায় উৎসব করতেন, যা আজও চালু আছে। মেহেরপুরের সীমান্তবর্তী গ্রাম ইছাখালিতে আরজান শাহের সমাধিপ্রাঙ্গণে দু’বাংলার বাউলরা দোল পূর্ণিমা উপলক্ষে সাধুসঙ্গ করে।
কর্তাভজাদের দু’শবছরের ইতিহাসকে ঘিরে নানা সব কিংবদন্তী, অলৌকিক কাহিনী গড়ে উঠেছে এবং তা বাউলদের প্রভাবিত করেছে। কর্তাভজা সম্প্রদায়ের সাধনপীঠ ঘোষপাড়াকে বাউলরাও পবিত্র স্থান বলে মনে করেন। বাউলরা বিশ্বাস করেন, ঘোষপাড়ার হিমসাগরের জল আর ডালিমতলার মাটি অঙ্গে স্পর্শে করানো হলে অন্ধ, পঙ্গু, প্রতিবন্ধী মানুষ স¦াভাবিক জীবন ফিরে পায়। দোল পূর্ণিমা উপলক্ষে কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা অঞ্চলের বাউলরা ঘোষপাড়ায় জমায়েত হয়। ঝিনাইদহের অমূল্য শাহ; মেহেরপুরের চাঁদপতি, আরজান শাহ, আজাদ শাহ, আতাহার শাহ, আমীর চাঁদ প্রমুখ সতীমার ঘরানার সাধক ছিলেন। সতীমার অনুসারী তথা কর্তাভজাদের সমন¦য়বাদী ধর্মচিন্তা, অপৌত্তলিক ভাবদর্শন হিন্দু- মুসলমান নির্বিশেষে সকল সম্প্রদায়ের বাউলদের প্রভাবিত করে। কেবল বাউল নয়; কর্তাভজাদের উদার মানবিকতা, জাতিভেদহীন ধর্মাদর্শ শিক্ষিত সমাজকেও প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়। আউলচাঁদের শিক্ষা, রামশরণের ধর্মতত্ত্ব, দুলালচাঁদের ভাবের গীতে যে উদার, মানবিক, সুস্থ, সমন্বয়ী ধর্মচেতনা বিম্বিত হয়েছে তা অবশ্যই গ্রহণ করার মতো। কর্তাভজারা কেবল বেদ-ব্রাহ্মণ্যবাদ বিরোধী নয়, এরা সমন্বিত ধর্মচেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ইসলামের সূফিতত্ত্ব ও খ্রিস্টানধর্মের বেশ কিছু ইতিবাচক গ্রহণ করে নিয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা প্রয়োজন, তাদের সাপ্তাহিক সমাবেশ ও ধর্মলোচনার দিন শুক্রবার। বাঙালির নবজাগৃতির প্রধান পুরুষ রাজা রামমোহন রায়ও কৌতুহলী হয়ে ঘোষপাড়ায় গিয়েছিলেন। তবে রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব কর্তাভজাদের মতকে একেবারেই পছন্দ করতেন না, তাদের মত-পথকে ‘ গৃহপ্রবেশের পক্ষে সদর দরজা না বলে বলেছেন পায়খানার দরজা’। আর বাউলরা কর্তাভজাদের পৌত্তলিকতাবিরোধী, উদার ও মানবিক অধ্যাত্মচেতনা গ্রহণ করলেও কোন কোন বিষয়ে কর্তাভজাদের প্রতি তারা অপ্রসন্নও ছিলেন। লালন শাহের শিষ্য দুদ্দু শাহ একটি গানে বক্রভাবে বলেছেন:
‘কত মত দেখি এদেশে
ঘোষপাড়া শম্ভুচাঁদে এদেশ জুড়ে গেছে।’
দুদ্দু শাহ আরেকটি পদে কর্তাভজাদের অবাধ যৌনাচার, বহুগামিতায় ক্ষুব্ধ হয়ে বলেছেন:
‘ভবে কত মত দেখি/ শাক্ত শৈব বৈরাগ্যাদি ন্যাড়ানেড়ির নামে চালাকি।।/ জ্বেলে হোম করে আরতি/ মনে মনে দুষ্ট অতি/পেটের দায়ে বৃক্ষতলে বসতি সকলি ফাঁকি।।/শম্ভূচাঁদ গুরু সত্য মত/সতীমার শুনেছি বাত/শিষ্য বানায়ে সবাই, বেড়া ঘরে তিলক মাখি।। ’
লালনপন্থী বাউল সাধক ও পদকর্তা দুদ্দু শাহ যে কর্তাভজা সম্প্রদায়ের প্রতি অপ্রসন্ন ছিলেন তা তাঁর গানের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ করেছেন। তবে সব বাউল কর্তাভজা তথা ঘোষপাড়ার আচার- অনুষ্ঠানের বিরোধী নয়। তাদের গুরুবাদ, গূহ্যসাধন পদ্ধতি, অবতারবাদ বাউলদের মধ্যেও প্রবেশ করেছে। কর্তাভজাদের মতো বাউলরাও মূর্তি পূজা না, করে গুরু পূজা এবং উদার মানবধর্মে বিশ্বাস করে। সতীমার পুত্র দুলাল চাঁদ অর্থাৎ লালশশীর ‘ভাবের গীত’ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বাউল সাধক-কবিরা পদ রচনা করেছেন। ‘ভাবের গীত’ কে বাউলরাও ‘আইন পুস্তক’ ও সাধন সঙ্গীত বলে মান্য করেন। কুবির গোঁসাই তাঁর একটি গানে লালশশী সম্পর্কে গেয়েছেন:
‘দুলিছে দুলাল আনন্দ দুলাল লালশশী লাল ফাগুয়া খেলায়।
আবীরে আবৃত হেরি চন্দ্রচূড়া লালে লাল আভা রয়েছে ঘোষপাড়া।
লাল চন্দনে ছড়া লাল কুসুমে বেড়া
চারিদিকে মারে কুমকুমা আবীরা লালে লাল লালায়।।’
দুলালের ‘লাল’ আর ‘চাঁদের’ শশী মিলিয়ে দুলাল চাঁদ হয়েছেন ‘লাল শশী’। এই নামের ভণিতায় দুলাল প্রায় ৬৫০ টি পদ রচনা করেন, যেগুলি বাউলদের কাছে ধর্মতত্ত্ব, দর্শন ও সাধন সঙ্গীত হিসেবে বিবেচিত হয়।
বাংলাদেশের বাউল সম্প্রদায় বলরামী সম্প্রদায়ের দ্বারাও প্রভাবিত। এই সম্প্রদায়ের প্রবর্তক বলরাম হাড়ি আনুমানিক ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দে মেহেরপুর শহরের মালোপাড়ায় জন্ম গ্রহণ করেন।উচ্চধর্ম ও উচ্চবর্ণের বিরুদ্ধে বলরাম হাড়ি প্রতিবাদী লোকধর্ম হিসেবে বলরামি সম্প্রদায় গড়ে তোলেন। বাউলদের মতো এরাও শাস্ত্রের প্রাণহীন নিরস তত্ত্ব কিংবা গঙ্গাজলের মহিমা মেনে নেয়নি। ঊনিশ শতকের শেষের দিকে গড়ে ওঠা এই লৌকিক ধর্মমতের অনুসারীরা ছিলেন হাড়ি, ডোম, বাগদি, মুচি, বেদে, নমশূদ্র, মালো এবং কোন কোন ক্ষেত্রে মুসলমানও। কর্তাভজা , সাহেবধনী থেকে আরম্ভ করে বাংলার সকল লোকধর্মে ব্রাহ্মণ, কায়স্থ কিংবা বৈশ্যদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেলেও বলরামী সম্প্রদায়ে উচ্চবর্ণের লোকজন প্রবেশ করতে পারেনি। তবে এ লোকধর্মে হিন্দু-ও মুসলমান ধর্মের ভাবের সমন¦য় খুঁজে পাওয়া যায়। আর তাই হিন্দু ভক্তরা বলরাম হাড়িকে বলেন ‘হাড়িরাম’ আর মুসলমানরা বলেন, ‘হাড়ি আল্লাহ’। হাড়ি সম্প্রদায়ের একটি গানে ধর্ম সমন¦য়ের নিদর্শন খুঁজে পাওয়া যায়ঃ
‘ও হাড়ি আল্লা তোমার মত দয়াল আর কেউ নয়।/ জীবের দশা মলিন দেখে মেহেরাজে হলেন উদয়।।/ হাড়ি আল্লার বান্দা নবীন দুই রহমত/হাড়ি আল্লা হাড়ি আল্লা বলে সদাই করি ইবাদত।/আমি পাপী আমি অধম/ যেন তোমার নামটি বলি মুদম/ভুলি না রাম তোমার কদম/ দুর্দম তব গুণ নাই।’
বলরামীদের গানে যে সমন¦য়বাদী ভাবনার মর্মবাণী প্রকাশিত হয়েছে তা কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর অঞ্চলের বাউল ভাবনাকে প্রভাবিত করেছে গভীরভাবে। বাউলদের মতো বলরামীরাও জাতিভেদ মানে না। এরা কেউ গৃহস্থ, কেউ উদাসীন। উদাসীনেরা বিয়ে করে না অথচ ইন্দ্রিয় দোষে দোষী নয়। এদের কোন শাস্ত্র, কেতাব নাই, বিগ্রহ পূজাও তারা করে না। তারা কেবল বলরামকে ভগবানরূপে পূজা করে। বলরামীদের আবির্ভাব মূলতঃ শোষিত-বঞ্চিত, নিপীড়িত মানুষের সুস্থ,স্বাভাবিক জীবন প্রতিষ্ঠা ও বাঁচার তাগিদে। যেমন, তীতুমীরের বিদ্রোহ, বীরসা মু-ার নেতৃত্বে মু-ারীদেও আন্দোলন, লালনের ফকিরি ধর্ম, হরিচাঁদের মতুয়া আন্দোলন, রূপচাঁদ, মনমোহনের আন্দোলন ধর্মীয় মোড়কে উপস্থিত হলেও তা ছিল অন্ত্যজ-অস্পৃশ্য, শোষিত, নিগৃহীতদের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। কালের প্রবহমানতায় মেহেরপুরে বলরামী সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেলেও হালদারপাড়ার বলরাম হাড়ির সমাধিমন্দিরের আশেপাশের হালদার বাড়ির কুলবধূরা এখনও সন্ধ্যাকালে সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালে,ধূপ-ধুনো দেয় এবং বলরামের উদ্দেশ্যে প্রণাম জানায়।
প্রতি বছর বারুণী তিথি উপলক্ষে মালোপাড়ার বলরামের সমাধি প্রাঙ্গণে যে মহোৎসব বা মচ্ছব হয় তাতে লালন অনুরাগী বাউল, দরবেশ, বৈষ্ণব, নেড়ানেড়িরাও উপস্থিত হয়। তারাও প্রথম দিনের অন্ন মচ্ছব, দ্বিতীয় দিনের চিড়া মচ্ছব এবং তৃতীয় দিনের লুচি মচ্ছবে সেবা গ্রহণ করে। এবারের( ২০১৪) উৎসবের সমাপনী দিনে মেহেরপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য ফরহাদ হোসেন-দোদুল প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত হন। সাথে রাজনীতিক, লেখক,বুদ্ধিজীবীরাও ছিলেন।
বাউল দর্শন মূলতঃ সমন¦য়বাদী দর্শন। এই দর্শনে হিন্দু-মুসলমান মিলনের কথা অত্যন্ত স্পষ্টভাবে বারবার উচ্চারিত হয়েছে। বাউলদের মতো কর্তাভজা সাহেবধনী, বলরামী প্রভৃতি লোকধর্মের অনুসারীরা অসাম্প্রদায়িকতা ও অখ- মানবধর্মে প্রবলভাবে বিশ্বাসী। বাউল সাধনা ও দর্শনকে উচ্চতর স্তরে নিয়ে যেতে সবচেয়ে অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করেছেন মরমী সাধক লালন সাঁই । পরবর্তীকালে পাঞ্জু শাহ (১৮৮১-১৯১৪) দুদ্দু শাহ (১৮৪১-১৯১৯), জহরদ্দি শাহ (১৮৪২-১৯০৮), পাঁচু শাহ (১৮২৩-১৯২৮), ভোলাই শাহ (১৮৪৫-১৯৪০), মদন বাউল, মনিরুদ্দীন শাহ, হরিয়াঘাটের খোদাবকসো শাহ, অমূল্য গোসাঁই, শুকচাঁদ ফকির, বেহাল শাহ, মহিন শাহ (১৩১০-১৪০৩), গগন হরকরা, গোসাঁই গোপাল (১৮৬৯-১৯১২), মেহেরপুরের আরজান শাহ (১৮৮৫-১৯৫৮), গোলাম ঝড়ুশাহ (১৯২১-১৯৯৮), আলমডাঙ্গার খোদাবকসো শাহ (১৯২৭-১৯৮৯) প্রমুখের সুর ও বাণীর মাধ্যমে বাউল দর্শন ও সাধনা সমৃদ্ধ ও সুসংহত হয়।
৫
বাউল গানকে বৈষ্ণব পদাবলীর মতো কোন লোকসঙ্গীতের ধারায় অন্তর্ভূক্ত করা যায় না। বাউল গান বাউল সম্প্রদায়ের সাধন সঙ্গীত। বিশুদ্ধ শিল্পসৃষ্টির জন্য নয়, সাধকের সাধনার অপরিহার্য অংশ হিসেবে এ গান রচিত ও গীত হয়। বাউল গান মূলতঃ আখড়া-আশ্রমের গান হিসেবে পরিচিত ছিল। বাউলদের ধর্মবিশ্বাস, লোকাচার, জীবনচর্যা এ গানের মধ্য দিয়ে ফুটে ওঠে। লালন সাঁই, গগন হরকরা, পাঞ্জু শাহ, দুদ্দু শাহ, মদন বাউল প্রমুখ বাংলাদেশের বাউল গান ও ভাবনাকে সমৃদ্ধ করেছেন। প্রতিদিনই তাদের গান সারাদেশের গ্রামে গঞ্জে, আখড়া-আশ্রমে গাওয়া হয়।তবে এখন বাউল গান কেবল আখড়ার গান নয়, এ গান এখন আসরের গান এবং বিনোদনের বস্তুতে পরিণত হয়েছে। এ গানকে ইউনেস্কো ওহঃধহমরনষব ঐবৎরঃধমব ড়ভ ঐঁসধহরঃু ঘোষণা করে সংগ্রহ ও সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে। এর আদি সুর ধরে রাখার জন্য ইউনেস্কোর সহায়তায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী ‘অপঃরড়হ ঢ়ষধহ ভড়ৎ ঃযব ংধভবমধঁৎফরহম ড়ভ ইড়ঁষ ঝড়হমং’ নামে একটি প্রকল্প ইতোমধ্যে বাস্তবায়ন করেছে। এ প্রকল্পের আওতায় ১১-১২ ডিসে¤¦র ২০০৯ তারিখে জাতীয় নাট্যশালা সেমিনার কক্ষে ‘আন্তর্জাতিক বাউল মেলা ও সেমিনার’ অনুষ্ঠিত হয়। দুদিনের এ সেমিনারে আবুল আহসান চৌধুরী ‘ বাউল প্রসঙ্গ ’ এবং জাপানী গবেষক মাসাহিরো তোগাওয়া ‘ফকির লালন সাঁই ইন কনটেম্পোরারি বাংলাদেশ: এ্যান এ্যানথ্রোপোলজিক্যাল পারস্পেকটিভ’ শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। মেলায় গান গেয়ে শোনান পশ্চিমবঙ্গের পূর্ণ দাস বাউল, কুষ্টিয়ার আব্দুল করিম শাহ, পাগলা বাবলু, মেহেরপুরের আফসার ফকির সহ দু’বাংলার বাউল শিল্পীরা। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল যেমন-ঢাকা, খুলনা, যশোর, ফরিদপুর, রাজশাহী, ময়মনসিংহ, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, মাগুরা থেকে প্রায় দু’শ জন বাউল এ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী সাধুগুরু, বাউল ও প্রশিক্ষণার্থীদের থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্তসহ পারিশ্রমিক দিয়ে সহায়তা করে ইউনেস্কোর অর্থায়নে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, বাউল গান এখন আর সাধন সঙ্গীত নয়, এ গান এখন আসর ও অনুষ্ঠানের গান। আঁখড়া-আশ্রমের সাধকের গান এখন অর্থ উপার্জনের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। তাই এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, বাউল গান পরিবেশনায় দুটি ধারা লক্ষ্য করা যায়। একটি সাধু গুরুদের আখড়াকেন্দ্রিক সাধনসঙ্গীত আর অপরটি আখড়ার বাইরের গানের মাহফিলের ধারা যা চড়া সুরে গীত হয়। আখড়া ভিত্তিক বাউল গান শান্ত সমাহিত সুরে, মৃদুতালে গাওয়া হয়। আখড়ার সাধুসঙ্গে এ রীতি অনুসৃত হয়। আখড়ায় সাধুরা কখনও দাঁড়িয়ে, কখনও বসে এ গান পরিবেশন করেন। মেহেরপুরের শৈলেন হালদার, হারুন বাউল দাঁড়িয়ে এবং আফসার ফকির বসে গান করেন। মরমী সাধক,সুর¯্রষ্টা ও গায়ক অমূল্য শাহ, বেহাল শাহ, শুকচাঁদ ফকির, মেহেরপুরের গোলাম ঝড়ু শাহ, মকবুল ফকির দোতারা বাজিয়ে এবং জ্ঞানতুল্লাহ শাহ, আফসার ফকির একতারা বাজিয়ে গান করেন।
আখড়ার বাইরের বাউল গান একতারার সাথে ডুগি, খমক, প্রেমজুড়ি, ঢোলক, সারিন্দা কিংবা দোতারা বাজিয়ে চড়া সুরে পরিবেশন করা হয়। বাউল গান মূলতঃ দাদরা, কাহারবা কখনো ঝাঁপতালে হয়। এ গান এখন হারমোনিয়াম বাজিয়েও গাওয়া হচ্ছে। ফরিদা পারভীন হারমোনিয়াম বাজিয়ে বাউল পান পরিবেশন করেন।এছাড়াও কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর অঞ্চলের অনেক বাউল গায়ক আখড়া হোক কিংবা গানের জলসাতেই হোক বাউল গান হারমোনিয়াম বাজিয়ে পরিবেশন করছেন।
বাউল গানে এক ধরনের নাচের প্রচলন আছে। এই নৃত্য হয় এককভাবে, দ্বৈতভাবে কখনও বা ত্রয়ী হয়ে থাকে। এসব গানে নাচের কোন মুদ্রা প্রদর্শিত হয় না। একতারা বাজিয়ে শব্দ ঝংকারে তন্ময় হয়ে বাউল নেচে গেয়ে চলে এবং দেতারা বাদক পিছন থেকে সুর মিলায়। বাউল গান যেহেতু কোন উপলক্ষ বা উৎসবে গাওয়া হতো না, তাই এ গানের নাচ কোন বিশেষ ছক রীতি মেনে হয়না। বাউল যেখানে যে ছন্দ পেয়েছে তাকে গ্রহণ করে নৃত্যরূপ দেয়ার চেষ্টা করেছে। তবে সব সময় সব বাউল গানের নৃত্যরূপ দিতে চাননি। যার নাচতে ইচ্ছে হয়েছে, সে নেচেছে, যার নাচতে মন চায়নি, সে নাচেনি। তাই বাউল গানে নাচ কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। তাছাড়া এ গান তত্ত্ব ও দার্শনিকতা সমৃদ্ধ হওয়ায় নাচ তেমন প্রাধান্য পায় না। লালন সঁাঁই, পাঞ্জু শাহ, দুদ্দু শাহ, কুবির গোসাঁই যাদুবিন্দু, মদন বাউল, হাওড়ে গোঁসাই-এর গানকে বাউলরা আত্মার গান বলেই মনে করে, তাই গান পরিবেশনের সময় তারা ধ্যানীর ভূমিকা পালন করে। কিন্তু আখড়ার বাইরে গানের মাহফিল কিংবা জনসম্মুখে বাউল গান চড়া সুরে নৃত্যের তালে তালে পরিবেশিত হয়।
যশোরের মাহেন্দ্র গোসাঁই, কানাই ক্ষ্যাপা নেচে নেচে গান গাইতেন। এখন বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার বাউল শিল্পীরা এ গানকে নৃত্য সর্বস¦ গানে পরিণত করেছে।
রক মিউজিক বা ব্যান্ড সঙ্গীত যারা করছেন তারা বাউল গান নিজের মতো করে গাচ্ছেন, কখনওবা আদি সুরকে বিকৃত করে গাওয়া হচ্ছে। দর্শক-শ্রোতাদের উন্মত্ত, উত্তেজিত করার জন্য বিল¤ি¦ত তাল-লয়ের পরিবর্তে রিদমিক করে বাউল গান পরিবেশন করা হচ্ছে। অথচ আখড়া-আশ্রমে সাধকরা শান্ত সমাহিত অবস্থায় ভক্তি সহকারে এ গান গেয়ে থাকেন। বাউল সাধকরা এক সময় যে গানকে সাধনসঙ্গীত হিসেবে গেয়ে মনের মানুষ, ভাবের মানুষ, সাঁই নিরঞ্জন এর সন্ধান করতো; সেই গান এখন এক অনিবার্য কারণে চোখ ধাঁধানো আলোকোজ্জ্বল মঞ্চের গানে পরিণত হয়েছে।
বাউল গান তথা লালন-পাঞ্জু-দুদ্দু শাহের গানকে মঞ্চ বা আসরের গানে পরিণত করতে যিনি পথিকৃৎ হিসেবে ভূমিকা পালন করেছেন তিনি হলেন লালনের সাক্ষাৎ শিষ্য মনিরুদ্দীন শাহ। তিনি লালনের গান ভালভাবে গাইতে পারতেন। শিক্ষিত এই লালন-শিষ্য লালনের গান খাতায় লিখে রাখতেন। তিনি যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন তিনি লালনের শ্রুতি লিপিকর হিসেবে কাজ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ও জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে তাঁর যোগাযোগ ছিল বলে লোকশ্র“তি আছে। লালন সাঁই-এর তিরোধানের পর আখড়া বাড়ির কর্তৃত্ব নিয়ে ভোলাই ফকিরের সাথে তাঁর দ্বন্দ¦ হয় এবং তিনি আখড়াবাড়ি ত্যাগ করে নিজ গ্রামে চলে যান। আখড়াবাড়ি ছেড়ে মনিরুদ্দীন শাহ চলে আসার পর লালনের গান বাউল ঘরানার বাইরে সাধারণ মানুষের কাছাকাছি চলে আসে। লালনের গান তথা বাউল গানকে লোকপ্রিয় করে তুলতে মনিরুদ্দীন শাহ্ এর শিষ্য হরিণাকু-ু উপজেলাধীন হরিয়াঘাটার খোদাবক্সো শাহ, তাঁর শিষ্য শুকচাঁদ শাহ এবং শুকচাঁদ শাহ শিষ্য একুশে পদক জয়ী খোদা বকশো বিশ্বাস ওরফে খোদা বকশো শাহের রয়েছে বলিষ্ঠ ভূমিকা। এ গান এক সময় কোন সাঙ্গীতিক ছক মেনে গাওয়া হত না। লালন শিষ্য মনিরুদ্দীন শাহ এবং তঁাঁর শিষ্য হরিয়াঘাটার খোদা বকশো শাহ, মরমী সাধক ও গায়ক বেহাল শাহ এই গানের একটি ছক তৈরী করার চেষ্টা করেন। হরিয়াঘাটার খোদা বকশো শাহের শিষ্য সঙ্গীত সাধক অমূল্য শাহও লালন তথা বাউল গানের একটি সাঙ্গীতিক কাঠামো নির্মাণে ভূমিকা পালন করেছেন। অমূল্য শাহের মাধ্যমেই লালনের গান আসরের গানে পরিণত হয়। তিনি ছিলেন ভাবসঙ্গীত তথা লালন সঙ্গীত ভুবনের যুগ¯্রষ্টা। পরবর্তীকালে বেহাল শাহ, শুকচাঁদ ফকির, মহিম শাহ, আলমডাঙ্গার খোদা বকশো শাহ, মেহেরপুরের গোলাম ঝড়ু শাহ, কুষ্টিয়ার আবদুল করিম শাহ এর মাধ্যমে এ গানের জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তবে লালন ও বাউল গান শিখরস্পর্শী লোকপ্রিয়তা পায় মকসেদ আলী সাঁই ও ফরিদা পারভীনের মাধ্যমে। জননন্দিত গায়িকা ফরিদা পারভীন লালন ও বাউল গানে এক নতুন মাত্রা ও সুর যোজন করেছেন, যা বাস্তবিকই অনন্য। আমাদের জানা প্রয়োজন যে, এক সময় ছেঁউড়িয়ার আখড়ায় লালন শিষ্য-প্রশিষ্যদের মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণে লালন সঙ্গীত চর্চা ব্যাহত হয় মারাত্মকভাবে। অমূল্য শাহের সাঙ্গীতিক ঐতিহ্যের অনুসারী বেহাল-শুকচাঁদ নির্মিত আলমডাঙ্গার ফরিদপুর আখড়া ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকার মধ্যে লালন সঙ্গীত চর্চা পরিসীমিত হয়ে যায়। এখানে বেহাল শাহ-শুকচাঁদ শাহ ও তাদের শিষ্যম-লি অমূল্য শাহের সাঙ্গীতিক ধারা বজায় রেখে সঙ্গীত চর্চা চালাতে থাকেন। মকছেদ আলী সাঁই শিষ্য ফরিদা মূলতঃ অমূল্য-বেহাল-শুকচাঁদ-খোদা বকসো শাহের সাঙ্গীতিক ঐতিহ্যের ওপর দাঁড়িয়ে লালন তথা অন্যান্য মরমীদের গান বিশ্বের সঙ্গীত ও পিপাসু রসিকজনের কাছে পৌছে দেন। এই গানের মাধ্যমে আমাদের শিক্ষিত মধবিত্ত ও সম্ভ্রান্ত এলিট সমাজের লালনসহ অন্যান্য মরমীদের সম্পর্কে কিছুটা জানা- বোঝা হয়।
ব্রাত্য, মন্ত্রবর্জিত, অভিমানি লালন ফকির আমাদের সম্ভ্রান্ত সমাজের বাইরে থাকতে চেয়েছিলেন বা আমাদের শিষ্ট সমাজ তাকে অপাঙক্তেয় করে রাখতে চেয়েছিলেন। আর লালন কিংবা অন্যান্য লোকধর্মের ভক্ত-অনুসারীদের তো মানুষ বলেই মনে করা হয়নি। লালন বাস করতেন কুষ্টিয়া শহরের বাইরে কালীগঙ্গা তীরবর্তী কুমারখালির ছেঁউড়িয়ার আখড়ায়। তাঁর শিষ্যম-লিও ছিল। কিন্তু কোনো সম্প্রদায়ের বৃত্তে নিজেকে আটকাতে চাননি; কারণ সকল সম্প্রদায়ের ঊর্ধ্বে এক স্বপ্নময় রাজ্যে পৌঁছিয়েছিলেন তিনি। তিনি বক্তৃতা করতেন না, ধর্মের অমৃতবাণীও শোনাতনে না। তার একমাত্র অস্ত্র ছিল গান- বাউলের গান। এই গান দিয়েই সকলকে মুগ্ধ করতেন। তারপরও লালনের গান ও ভাবাদর্শ তার জীবনকালে এবং তিরোধানের পর নানাভাবে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হয়েছে। একসময় লালনচর্চা ঝিনাইদহের হরিণাকু-ু থানার হরিয়াঘাট, হরিশপুর, জোড়াদহ, পোড়াহাটি, হরিণাকু-ু ; কুষ্টিয়ার শংকরাদিয়া, অঞ্জনগাছি; চুয়াডাঙ্গার ফরিদপুর, জামজামি, ছত্তরপাড়া, ঘোলদাড়ি এবং মেহেরপুরের পিরোজপুর, বুড়িপোতার মধ্যে পরিসীমিত ছিল। আজ সেই নির্জন পথের সাধকের গান প্রাচ্য থেকে প্রতীচ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। তারপরও লালন ও অন্যান্য মরমীরা আমাদের শিক্ষিত এলিট সমাজে অচেনা, অচিহ্নিত ও রহস্যময় রয়ে গেলেন। চিরসখা, চিরবন্ধু ‘ মনের মানুষ’কে চিনতে যে লালনের সারাজীবন কেটে গেছে, তাকে আমরা চিনতেই পারলাম না। তার প্রতিকৃতির মতো আসল লালন আজ ধূসর হয়ে গেছে, তুলনায় অনেক উজ্জ্বল প-িত ,গবেষক ও সখের বাউলদের বানানো নকল লালন। এই অভিমানি সাধক সারাজীবন নিজেকে ও তার গানকে মিম হরফের মতো আড়াল করে রেখে গেছেন। আজ সময় এসেছে সেই আড়াল ভাঙার। সেই আড়াল ভাঙতে পারলেই কেবল ‘উপরি চটক আলগা ভড়ক ’ থেকে বাঁচানো যাবে লালন এবং বাংলাদেশের বাউল ও তাদের গান। নইলে সঙ সাজা , রঙ লাগিয়ে গান ধরা, জটা বানানো, খেলকা পরা হলকা ধরা শ্মশ্রুম-িত সখের বাউলদের দাপটে আসলটাই উবে যাবে,পড়ে থাকবে কবল নকলটা।
২| ০২ রা জুলাই, ২০১৪ দুপুর ১২:৩৬
আমি নী বলেছেন: ভাল লাগলো. ধন্যবাদ সুন্দর পওস্ট এর জন্যে.
©somewhere in net ltd.
১|
০১ লা জুলাই, ২০১৪ রাত ৯:৪১
ইলি বিডি বলেছেন: অনেক তথ্যবহুল পোস্ট। ভাললাগ্ল ধন্যবাদ।