নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

নবীন আনন্দ

আবদুল্লাহ আল আমিন

আবদুল্লাহ আল আমিন › বিস্তারিত পোস্টঃ

রবীন্দ্রনাথ : কবি ও কর্মযোগী

০৯ ই জুলাই, ২০১৪ সকাল ১০:১৯

রবীন্দ্রনাথ : কবি ও কর্মযোগী

আবদুল্লাহ আল আমিন



ঊনিশ শতকের ভারতীয় নবজাগৃতির অন্যতম পথিকৃৎ দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন জ্ঞানে, ধ্যানে, মননে, বিষয়বুদ্ধিতে এক অনন্যসাধারণ পুরুষ। তাঁর পুত্র-কন্যার সকলেই ছিলেন ঊনিশ শতাব্দের রেনেসাঁ¯œাত মননশীল ও বিদগ্ধজন, তবু জমিদারি তালুক দেখাশুনা করার জন্য কাউকে পাওয়া যায়নি। জ্যেষ্ঠপুত্র দ্বিজেন্দ্রনাথ বিদ্বান ও দার্শনিক, কিন্তু স্বভাবে একেবারে উদাসীন, বিষয়কর্মে প্রতি মোহহীন; দ্বিতীয় পুত্র সত্যেন্দ্রনাথ ডাকসাইটে সিভিলিয়ানÑ জীবিকা হিসেবে ব্যবসায় কিংবা জমিদারি নয়, চাকুরি বেছে নেন।

হেমেন্দ্রনাথ অকাল মৃত, দুটি পুত্র বিকৃত মস্তিস্ক। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ চিত্রকর সঙ্গীতজ্ঞ, নাট্যকার, পাশ্চাত্য সঙ্গীতের সমঝদার। কিন্তু স্ত্রী কাদম্বরী দেবীর অপ্রত্যাশিত মৃত্যু এবং জাহাজ ব্যবসায়ে ভরাডুবির পর তিনি ‘যেন বতির্কা শূন্য এক বাতিদান, কোন কিছুতেই তার উদ্যাম নেই’ একেবারে নি¯প্রভ। দ্বিজেন্দ্রনাথের ছেলে দ্বিপেন্দ্রনাথ বড় হওয়ার পর পরিবারের অনেক দায়-দায়িত্ব পালন করেন; মহর্ষি এই পৌত্রটিকে পছন্দ করতেন। কিন্তু কলকাতার অভিজাত নাগরিক পরিমন্ডলে বেড়ে ওঠা দিপেন্দ্রনাথ, খাজাঞ্চিখানায়, হিসেবপত্র দেখতে রাজি ছিলেন, কিন্তু পূর্ববঙ্গের গ্রামবাংলায় জমিদারি তালুক দেখাশুনা তার পছন্দ নয়। বাধ্য হয়ে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ কনিষ্ঠপুত্র রবীন্দ্রনাথকে পূর্ববঙ্গের সবকটি জমিদারি দেখাশুনার ভার প্রদান করেন। পিতার আদেশে তিনি ১৮৮৯ সালে পূর্ববঙ্গে তথা বর্তমান বাংলাদেশে আসেন। পরবর্তী এক দশকের বেশির ভাগ সময় কাটে পদ্মা-যমুনা-গড়াই-নাগর বিধৌত বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে। পূর্ববঙ্গে তাঁদের তিনটি পরগণা ছিলÑ ‘নদীয়া জেলার কুষ্টিয়া মহকুমার বিরাহিমপুর, তার কাছারি শিলাইদহে; পাবনা জেলার সদর মহকুমার সাজাদপুর, তার কাছারি সাজাদপুর গ্রামে; আর রাজশাহী জেলার নওগাঁ মহকুমার কালিগ্রাম, তার কাছারি চলনবিলের কাছে নাগর নদের ওপরে পতিসরে।’

(আনিসুজ্জামান, রবীন্দ্রনাথ ও পূর্ববঙ্গের অন্তর্লোক দেশ, ২মে ২০১১)

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর উপনিষদের পরমব্রহ্মে বিশ্বাসী ‘মহর্ষি’ অভিধায় খ্যাত হলেও বিষয়বুদ্ধিতেও প্রখর ছিলেন। তাই ভেবে চিন্তেই তিনি কনিষ্ঠপুত্র রবীন্দ্রনাথকে জমিদারি দেখ ভালের দায়িত্ব অর্পণ করেন। যদিও তাঁকে বাইশ বছর বয়স থেকে জমিদারি সেরেস্তার সব ধরনের কাজ আয়ত্ত করতে হয়েছে, তবু জমিদারি দেখাশুনার কাজ তাঁর কাছে গুরুভার মনে হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ জমিদারি তদারকির দায়িত্ব গ্রহণ করতে প্রথম দিকে অমত করেছিলেন। কিন্তু পিতা বললেন, ‘ তা হবে না; তোমাকে একাজ করতে হবে।’

(আনিসুজ্জামান, পূর্বোক্ত)



তাই ১১ অগ্রাহায়ণ (২৫-নভেম্বর ১৮৮৯) রবীন্দ্রনাথ মৃণালিনী দেবী, তার একজন সহচরী, বেলা ও রথীন্দ্রনাথকে নিয়ে শিলাইদহে যাত্রা করেন। বলেন্দ্রনাথও তাদের সঙ্গে হন। (প্রশান্তকুমার পাল, রবিজীবনী, ৩য়, পৃঃ ১১৯)

এ যাত্রা কেবল ভ্রমণের জন্য নয় - জমিদারি তদারকি, রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘রাজকার্যে’। এরপর ১৮৯০ সালের জানুয়ারি মাসে সাজাদপুরে এবং ১৮৯১ সালে নওগাঁর পতিসরে আসেন। দীর্ঘ জীবনে রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহ, সাজাদপুর, পতিসর ছাড়াও নান্দনিক সূত্রে ঢাকা, সিলেট, পাবনা, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, রাজশাহী, নাটোর আসেন। বারবার আসার ফলে বাংলাদেশের মাটি মানুষের সাথে গড়ে ওঠে নিবিড় সম্পর্ক। শিলইদহ-পতিসরের নদী, নিসর্গ, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর তার সাথে বিশাল মানব জীবনের গভীর সম্পর্ক দেখে কবি মুগ্ধ হয়ে বলেন ঃ ‘পৃথিবী’ যে কী আশ্চর্য সুন্দরী তা কলকাতায় থাকলে ভুলে যেতে হয়’। (ছিন্নপত্র) তিনি আরও বলেছেন ,‘আর কতবার বলব এই নদীর উপরে, মাঠের উপরে ,গ্রামের উপরে সন্ধেটা কী চমৎকার,কী প্রকান্ত, কী অগাধ।’ বাংলাদেশের রুপৈশ্বর্যে মুগ্ধ হয়ে তিনি বারবার এ ভূখন্ডে জন্ম গ্রহণের ব্যাকুলতা প্রকাশ করেছেন। তবে জমিদারি দেখতে এসে তিনি কেবল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যই উপভোগ করেননি, গভীরভাবে দেখে নিয়েছেন গ্রামীণ জনজীবন, দারিদ্র প্রজাদের দুঃখ-কষ্ট, বাঙালি মুসলমানদের পশ্চাদ পদতা, মহাজন-সামন্ত শ্রেণীর দাপট। তিনি লিখেছেন ঃ উলঙ্গ পেট মোটা, পা সরু রুগ্ন ছেলে মেয়েরা যেখানে সেখানে জলকাদায় মাখামাখি-ঝাপাঝাপি করে থাকে, মশার ঝাঁক স্থির জলের উপরে একটি বাষ্পস্তুপের মতো সারবেঁধে ভেসে বেড়ায়, গৃহস্থের মেয়েরা ভিজে শাড়ী গায়ে জড়িয়ে বাদলার ঠান্ডা হাওয়া বৃষ্টির জলে ভিজতে ভিজতে হাঁটুর ওপর কাপড় তুলে জল ঠেলেঠেলে সহিষ্ণু জন্তুর মত ঘরকন্নার নিত্যকর্ম করে যায়, তখন সে দৃশ্য কোন মতে ভাল লাগে না। ঘরে ঘরে বাত ধরছে, পা ফুলছে, সদ্দি হচ্ছে, জ্বর ধরছে, পিলে ওয়ালা ছেলেরা অবিশ্রাম কাঁদছে, কিছুতেই কেউ তাদের বাঁচাতে পারছে না; এত অবহেলা, অস্বাস্থ্য অসৌন্দর্য কি এক মুহুর্তে সহ্য হয়।’

বাংলাদেশের প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যে কবি কখনো বিমোহিত হয়েছেন, আবার তার ‘খেড়ো ঘর চালশূন্য মাটির দেয়াল, উলঙ্গ স্বাস্থ্যহীন ছেলেমেয়ে’দের দেখে ব্যথিত হয়েছেন। এরই মধ্যে তিনি আবিস্কার করেছেন চিরায়ত বাংলাদেশকে, খুঁজে পেয়েছেন পথের দু-ধারে ‘দেবালয়’কে।



শিলাইদহ ঃ পথের দুধারে আছে মোর দেবালয়

ভ্রমণ পিপাসু, বিশ্ব পরিব্রাজক রবীন্দ্রনাথ ‘নিজেকে মাঝে মাঝে ঘরের কোণের একলা মানুষ ভেবেছন’। ‘ঠাকুরবাড়ির মস্তবাড়ির, বহু মানুষের ব্যস্ততা ও কর্মশীলতা’র মাঝেও নিজেকে বড় নিঃসঙ্গ, বড় একা মনে হয়েছে তাঁর। তাই আকাশ, নদী, নিসর্গ, বাঁশির সুর তাঁকে টেনেছে বারবার দূরে বহুদূরে।

সুধীর চক্রবর্তীর ভাষায় ঃ ‘সারাজীবন ধরে বাইরের নিসর্গ, দূরের অজানা দেশ আর অজ্ঞাত সব মানুষের টান এত যে প্রবল হয়েছিল তাঁর মনে, তার কারণ ছেলেবেলা থেকে তাঁকে পেতে হয়েছিল এক সুদৃঢ় অন্দর। জোড়াসাঁকো বাড়ির আঁটসাট বন্ধন, ভৃত্যরাজকতন্ত্রের নিñিদ্র দেখনদারি আর বাবা-মায়ের নিকট সান্নিধ্যের বাইরে এক নিঃসঙ্গ পরিপার্শ্ব তাঁকে সদূরের পিপাসী করে তুলেছিল। (সুধারী চক্রবর্তী, ‘পথিক রবীন্দ্রনাথ ঃ ভ্রমণ ও মাধুকরী,’ দেশ ২মে ২০১১, পৃঃ ৫৫)



সদূরের পিপাসী, বিশ্ব পরিব্র্রাজক রবীন্দ্রনাথের সাথে বাংলাদেশের মানুষ এবং প্রকৃতির পরিচয় হয় মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে। প্রশান্ত কুমার লিখেছেন ঃ ‘দেবেন্দ্রনাথ ২১ অগ্রাহায়ণ ১২৮২ সোমবার (৬-ডিসেম্বর, ১৮৭৫) সালে নৌকায় করে শিলাইদহ যাত্রা করেন। এ যাত্রায় তিনি রবীন্দ্রনাথকেও তার সঙ্গী করেন।’ (পাল, প্রাগুক্ত) পিতার সাথে এ যাত্রায় শিলাইদহে অবস্থান দীর্ঘ হয়নি। ১৮৯১ থেকে মূলত এক দশক কাল শিলাইদহে অবস্থান স্থায়ী হয়। শিলাইদহে পদ্মার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে রোমান্টিক রবীন্দ্রনাথ কতটা যে অভিভূত হয়েছিলেন তার প্রমাণ ধরা হয়েছে ‘ছিন্নপত্রাবলী’তে। তিনি লিখেছেন ঃ ‘এ বার নদীর জলে প্রফুল্ল নবীন পৃথিবীর উপর শরতের সোনালী আভা দেখে মনে হয় যেন আমাদের এই নব যৌবনা ধরনী সুন্দরীর সাথে এক জ্যোতির্ময় দেবতার ভালবাসা চলছে।’ (ছিন্নপত্র, পৃঃ ১০২)।



শিলাইদহ কবিকে সুখ-দুঃখ দুইই দিয়েছে, তবে সুখই দিয়েছে বেশি। বাংলাদেশের এই প্রান্তিক গ্রামে তাঁর নবজন্ম হয়; এখানেই তিনি পান ‘মহাকবির পদবি’। এতদিন তিনি ছিলেন নাগরিক ‘খাঁচার পাখি’ শিলাইদহে খাঁচা থেকে মুক্ত হয়ে তিনি হলেন ‘বনের পাখি’। শিলাইদহের মোহময় প্রকৃতি গীতাঞ্জলির রসভান্ডার কে পূর্ণ করে দেয়। তিনি শিলাইদহ থেকে খোকসা-জানিপুরে যাওয়ার সময় বোটে বসেই গেয়ে ওঠেন ঃ ‘জগতে আনন্দ যজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ।’ এই অখ্যাত অজ্ঞাত পল্লীতেই তিনি রচনা করেন ঃ ‘আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে’ ‘আলো আমার আলো ও গো,’ ‘সীমার মাঝে অসীম তুমি বাজাও আপন সুর’, ‘আমরা চাষ করি আনন্দ’র মত বিচিত্র রসের গান। এ কারণে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘আমার যৌবন ও পৌঢ় বয়সের সাহিত্য-রস-সাধনার তীর্মস্থান ছিল পদ্মা প্রচুম্বিত শিলাইদহ পল্লীতে’



রবীন্দ্রনাথের জীবন ও শিল্পসাধনা ছিল মূলত; মানবিকতা ও মনুষ্যত্বের সাধনা। আর এ সাধনার মন্ত্র পেয়েছিলেন তিনি মরমি সাধক, বিশেষ করে শিলাইদহ অঞ্চলের বাউল, বৈষ্ণবদের নিকট থেকে। তাঁর মনুষ্যত্ব ও মানব ধর্ম যতটা না রামমোহন-বিদ্যাসাগরদের দ্বারা প্রভাবিত তাঁর চেয়ে বেশি প্রভাবিত বাংলাদেশের মরমি সাধকদের দ্বারা। শিলাইদহে এসে তিনি সান্নিধ্য লাভ করেছিলেন গগন হরকার, গোসাঁই রামলাল, গোসাঁই গোপাল, সর্বক্ষেপি বোষ্টমি’ ও লালন শাহের শিষ্যদের। বাউলদের অন্তরঙ্গ সান্নিধ্য ও লালন শাহের গান রবীন্দ্রনাথকে দারুণ ভাবে মুগ্ধ করে। গগন হরকরার ‘কোথায় পাব তারে। আমার মনের মানুষ যে রে!’ গানটির উদ্ধৃতি বিভিন্ন লেখায় রবীন্দ্রনাথ দিয়েছেন। ‘হারামনি’র ভূমিকায় গানটি সম্পর্কে তিনি বলেন ঃ ‘কথা নিতান্ত সহজ, কিন্তু সুরের যোগে এর অর্থ অপূর্ব জ্যোতিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল।’



গগনের গানের সুরকে তর্জমা করে ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সময় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন ঃ ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।’ গত শতকের ষাটের দশকে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার উজ্জ্বল উদ্ভাসনে অনবদ্য ভূমিকা রেখেছিল এ গানের সুর। এই সুরের ধারায় ¯œাত হয়ে বাঙালি মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করে। রবীন্দ্রনাথের অনেক গানেই বাউলদের বিশেষ করে, বাউল ভাবুকতার অগ্রগণ্য পুরুষ লালন সাঁই এর ভাব-দর্শনের অভাস লক্ষ্য করা যায়।

লালন গেয়েছেন ঃ

‘খ্যাপা তুই না জেনে তোর আপন খবর যাবি কোথায়?’

রবীন্দ্রনাথ ও ঐ একইভাবে বলেছেন ঃ

‘খ্যাপা তুই আছিস আপন খেয়াল ধরে।’



রস তীর্থের পথিক রবীন্দ্রনাথ ঈশ্বরকে সাথে নিয়ে রসের পথে চলেছেন সারাজীবন। তবে সে ঈঁশ্বর দূরের বহুদূরের ঈশ্বর, যে কেবলি জীবন নাথ, ভুবনেশ্বর এবং কখনও কখনও অনিদ্র, আকস্মিক, নিঠুর ভীষণ। তাই তাঁকে তিনি গভীরভাবে পেতে চেয়েছেন। ঈশ্বর সান্নিধ্য লাভে অভিলাষী কবি গেয়েছেন ঃ ‘অনেক দিয়েছ নাথ .........। আমার বাসনা তবু পুরিল না.......। তোমারে না পেলে আমি আমি ফিরিব না, ফিরিব না।’ অবশেষে ঈশ্বরকে পেলেন- জীবননাথ কিংবা ভুবনেশ্বর হিসেবে নয় পেলেন ‘প্রাণের মানুষ’ হিসেবে। তাই লালনের ভাবে ভাবিত হয়ে রবীন্দ্রনাথ গেয়ে ওঠেন ঃ ‘আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে,। তাই হেরি তাই সকল খানে।



শিলাইদহ অঞ্চলের জনজীবন, নিসর্গ ও বাউল সাধকদের প্রভাব কেবল তাঁর গানেই প্রতিবিম্বিত হয়নি, কাব্য, নাটক ও ছোট গল্পেও তা ফুটে উঠেছে। রবীন্দ্রনাথ যিনি পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছোটগল্পকার, তাঁর শিল্প-রসোত্তীর্ণ নানা গল্প পূর্ব বাংলা বিশেষতঃ শিলাইদহের প্রেক্ষাপট ও অভিজ্ঞাতা নিয়ে লেখা। ‘পোষ্টমাস্টার’, ‘খোকাবাবুর’ প্রত্যাবর্তন, ‘ছুটি’, ‘সমাপ্তি’ প্রভৃতি গল্পে পদ্মা তীরের অববাহিকার প্রভাব লক্ষ করা যায়। রবীন্দ্রনাথ কেবল কবি ছিলেন না, তিনি ছিলেন এক অসাধারণ কর্মীপুরুষ। তাঁর শিল্পসাধনা ও কর্মসাধনার অন্যতম উৎসভূমি ছিল শিলাইদহ। এই প্রান্তিক জনপদই তাঁর কবি সত্তার সাথে কর্মীসত্তার ফলে মিলন ঘটিয়েছে।



সাজাদপুর ঃ ‘গল্পের দুপুরবেলা’

রবীন্দ্রনাথ ১৮৯০ সালের ১৩ জানুয়ারি পাবনা জেলার সাজাদপুরে আসেন জমিদারি তদারকির উদ্দেশ্যে। সাজাদপুরের নদীমাতৃক জনজীবন, মাঠ, নদী, আকাশ গল্পরচনার পেছনে সহায়ক হয়েছিল। সাজাদপুর হয়ে উঠেছিল তাঁর ‘গল্পের দুপুর বেলা’। ‘সাজাদপুরে কুঠিবাড়িতে যখন দরজা-জানালা খুলে রেখে লিখতে বসেন, তখন সমস্ত প্রকৃতি তার সত্তার সাথে মিশে যায়’। (আহমদ রফিক, পূর্ব বাংলায় রবীন্দ্রনাথ ঃ তাঁর সৃষ্টি ও কর্মে, কালি ও কলম, জ্যৈষ্ঠ ১৪১৮)



এই কঠিবাড়িতে বসে তিনি রচনা করেন নানা শিল্প-বসোত্তীর্ণ ছোট গল্প। জমিদারি করতে এসে তিনি প্রজা, আমলা, ভৃত্য ছাড়াও অনেক নারী-পুরুষকে গভীরভাবে অবলোকন করেন। সাজাদপুরের পোষ্টমাস্টার ও বোষ্টমীর মত অনেকের সাথেই তাঁর নিবিড় যোগযোগ গড়ে ওঠে এবং তাদের সাথে নিয়মিত কথাবার্তা চলতে থাকে। এদের কাছ থেকেই তিনি সংগ্রহ করেন গল্পলেখার মসলা। কবি বলেছেন ঃ ‘আমার গল্প গুচ্ছের ফসল ফলছে আমার গ্রাম-গ্রামান্তরের পথে ফেরা এই বিচিত্র অভিজ্ঞতার ভূমিকায়।’



সাজাদপুরের নদীবর্তী জনজীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা কবিকে যেমন গল্প লেখার রসদ যুগিয়েছে, তেমনি এর ফসলভরা মাঠ, নক্ষত্র খচিত আকাশ, নদী, সূর্যাস্ত, জ্যোৎ¯œারাত কবির ভাবুক হৃদয়কে অভিভূত করেছে। কবি ২২ জুন, ১৮৯১ সাল সাজাদপুর থেকে জ্যোৎ¯œা প্লাবিত আকাশের দিকে দিয়ে চেয়ে মুগ্ধ হয়ে এক চিঠিতে লিখেছেন ঃ ‘আজকাল আমার এখানে এমন চমৎকার জ্যোৎ¯œারাত হয় সে আর কি বলল। ........আমার এই নিস্তব্ধ রাত্রি ছাড়া আর কিছুই নেই। একলা বসে বসে আমি যে এর ভিতর কি অনন্ত শান্তি ও সৌন্দর্য দেখতে পাই সে আর ব্যক্ত করতে পারিনে।’ শুধু জ্যোৎ¯œারাত নয় সাজাদপুরের সন্ধ্যাকালীন প্রকৃতিও কবির সৌন্দর্য পিপাসু সত্তাকে বিমোহিত করেছে। তিনি ১৮৯১ সালে লেখেন ঃ ‘আজ সন্ধ্যেবেলার নদীর বাঁকের মুখে ভারি একটি নিরালা জায়গায় বোট লাগিয়েছে। পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে, জলে একটিও নৌকা নেই-জ্যোৎ¯œা জলের উপর ঝিকিমিকি করছে- পরিস্কার রাত্রি, নির্জন তীর, বহুদুরে ঘনবৃক্ষ বেষ্টিত গ্রামটি সুষুপ্ত-কেবল ঝিঁ ঝিঁ ডাকছে আর কোন শব্দ নেই।’ (ছিন্নপত্র, পত্র সংখ্যা-১৯)



রবীন্দ্রনাথ ১৮৯১ থেকে ১৮৯৫ সার পর্যন্ত জমিদারি দেখভালের জন্য সাজাদপুরে আসতেন এবং সাময়িক ভাবে বসবাস করতেন। এ সময় পর্বটি কবির সাহিত্য সৃষ্টির পূর্ণ জোয়ারের সময়। সৃজন নৈপুণ্যে এ সময় তিনি একলব্যের মত এক বিষয়ী ছিলেন না; ছিলেন অর্জুনের মত সব্যসাচী। তাঁর সোনার তরী ভরে ওঠে অসামান্য সব গল্প, কবিতা ও সঙ্গীতের উজ্জ্বল সমারোহে। আর এসব সৃষ্টিতে সাজাদপুরের নিস্তব্ধ ও বিষণœ দুপুরবেলা ভূমিকা রেখেছে। উত্তরকালে তিনি সুদূরের পিপাসী ও অসীমের অভিলাসী হওয়ার যে আকাঙ্খা ব্যক্ত করেছেন তার মূলে ছিল মধ্যাহ্ন প্রীতি- এই কালপর্বে যার সূচনা হয়। ১৮৯৭ সালে কবির বাবা জমিদারি ভাগাভাগি করে দিলে সাজাদপুরের দায়িত্বপান পিতৃব্য জ্ঞানেন্দ্রনাথ ঠাকুর। এরপর থেকে আর তাঁর সাজাদপুরে আসা হয়নি।





পতিসর ঃ সচ্ছ্বল ও আলোকিত গ্রাম

রবীন্দ্রনাথ প্রথম ১৮৯১ সালে কালি গ্রাম পরগণা দেখাশোনার উদ্দেশ্যে পতিসারে আসেন। পূর্ববঙ্গে ঠাকুর এস্টেটের জমিদারি ভাগ হয়ে গেলে কবির ভাগে পড়ে পতিসর পরগণা। কবি কখনো শিলাইদহ থেকে বোটে করে পদ্মা। করতোয়া,আত্রাই,নাগরনদ এবং চলন বিলে পেরিয়ে জমিদারি তদারকির জন্য পতিসর আসতেন। প্রথম দিকে পতিসর তাঁর ভাল না লাগলেও পরবর্তীতে এই পতিসরই হয়ে ওঠে তাঁর গ্রামোন্নয়ন ভাবনা ও উন্নয়ন পরিকল্পনার প্রাণকেন্দ্র। তিনি এখানে গড়ে তুলতে চান তার স্বপ্নের সচ্ছ্বল, আলোকিত ও স্বনির্ভর গ্রাম। শিলাইদহের বাউল বৈষ্ণবদের গানের মত পতিসরের লোকগান তাঁকে মুগ্ধ করেছিল। ১১ আগস্ট ১৮৯৩ সালে এক চিঠিতে উল্লেখ করেন রাতজাগা মাঝিদের গান গানটি হলো ঃ

‘যোবতী ক্যান বা কর মনভারি?

পাবনা থেকে থেকে এনে দেব ট্যাকা দামের মোটরি।’

(সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, প্রথম আলো, ২য় খন্ড পৃঃ ২১)



হিন্দু-মুসলমান সমপ্রীতির অভাব শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথের পল্লী উন্নয়ন ভাবনা ও কর্মকান্ড বাধাগ্রস্ত হয়েছিল খানিকটা। পতিসরে সম্প্রদায়িক সম্প্রীতি থাকায় তিনি পুরোদমে সচ্ছ্বল, স্বনির্ভর, আলোকিত গ্রাম গঠনে মনোনিবেশ করেন। শিক্ষাকে অগ্রাধিকার প্রদান করে পতিসরে একটি হাইস্কুল স্থাপন করেন। শিক্ষার পর প্রাধান্য পায় চিকিৎসা, এ উদ্দেশ্যে একটি দাতব্য চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠা হয়। এছাড়াও জনস্বাস্থ্য নিশ্চিত করার জন্য মজা ডোবা সংস্কার, পুকুর পুনঃখনন, বিশুদ্ধ পানীয় জলের জন্য কূপ খনন প্রভৃতি জনহিতকর উদ্যোগ গ্রহণ করেন। শিক্ষা বিস্তার ও স্বাস্থ্য সেবার পাশাপাশি তিনি পতিসরের কৃষকদের সার্বিক মুক্তির কথা ভেবেছেন। এজন্য তিনি ‘গ্রামের অভাব দূর করার জন্য গ্রাম্য শিল্প প্রচলন, চাষের উন্নতি, মাছের ব্যবসা, রাস্তাঘাট প্রস্তুত, সালিশের বিচার, জলকষ্ট নিবারণ, দুর্ভিক্ষের জন্য ধর্মগোলা স্থাপন ইত্যাদি’ উদ্যোগ গ্রহণ করেন। রবীন্দ্রনাথ জানতেন, পল্লী সমাজের প্রধান সমস্যা ছিল ঋণ। এ সমস্যা তাঁকে পীড়িত ও চিন্তিত করতো। কিন্তু এর প্রতিবিধানের কোন উপায় তিনি অনেকদিন পর্যন্ত খুঁজে পাননি। তবুও প্রজাদের দুঃখ নিবারণের জন্য কিছু চেষ্টা না করে পারলেন না। বন্ধু-বান্ধব ও দু’একজন মহাজনের কাছ থেকে টাকা ধার করে পতিসরে একটা ব্যাংক খুলে বসলেন।’ (রবীন্দ্রনাথ, পিতৃস্মৃতি, পৃঃ ২৩৫)

পতিসরে কৃষি ব্যাংক স্থাপন রবীন্দ্রনাথের গ্রামোন্নয়ন ও গ্রাম পুনর্গঠন প্রচেষ্টায় এক অসামান্য উদ্যোগ। ১৯০৫ সাল থেকে ১৯২৫ সাল পর্যন্ত এ ব্যাংকটি চলছে। ড. ইউনুস এর গ্রামীণ ব্যাংকের ধারণা মূলত; রবীন্দ্রনাথের গ্রামোন্নয়ন ভাবনা দ্বারা প্রভাবিত। শান্তিনিকেতনের বিদ্যালয়ে দেওয়ার ইচ্ছে থাকলেও রবীন্দ্রনাথ তার নোবেল পুরস্কারের ১লক্ষ ৮হাজার টাকা পতিসরের কৃষি ব্যাংকে জমা দিয়েছিলেন প্রজাদের কল্যাণে। এই ব্যাংকের কল্যাণে প্রজাদের আর্থিক সচ্ছলতা ফিরে আসে।



চলার পথে তিনি নানা প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়েছেন,কিন্তুু হাল ছেড়ে দেননি। পতিসরে এসে কল্পনা বিহারী কবি হিসেবে পরিচিত রবীন্দ্রনাথ রূপান্তরিত হন পূর্ণ কর্মী পুরুষে এবং মাটি ও মানুষের কাছাকাছি কবিতে। হিন্দু-মুসলমান নমঃশূদ্র’যাদের শিক্ষা নাই,কৃষি ছাড়া ব্যবসায় নাই, ‘চিকিৎসার ব্যব¯্থা নাই’ তাদেকে তিনি মানুষ কবে তুলতে মনোনিবেশ করেন। চাল শূন্য মাটির দেয়াল, খড়ের স্তুপ, উলঙ্গ ছেলেমেয়ে, বিধ্বস্ত শিশুর দৃশ্য তাঁকে বিষণœ ও পীড়িত করেছে। এজন্যই বোধ হয় তিনি লিখেছিলেনঃ ‘বড় দুঃখ,বড় ব্যাথ, সম্মুখেতে কষ্টের সংসার বড় দারিদ্র, শূন্য,বড় ক্ষুদ্র,বদ্ধ অন্ধকার / অন্ন চাই,প্রাণ চাই,আলো চাই, চাই মুক্ত বায়ু / চাই বল,চাইস্বাস্থ্য,আনন্দ,উজ্জ্বল পরমায়ু / সাহস বি¯তৃত বক্ষপট। (এবার ফিরাও মোওে,চিত্রা) তবে কষ্ট,দুঃখ-দৈন্য তাঁকে নিরাশ করতে পারেনি, বরং সাহসের সাথে উচ্চারণ করেছেন,এই সব মূঢ় ম্লান মূক মুখে/ দিতে হবে ভাষা, এই সব শ্রান্ত শুষ্ক ভগ্ন বুকে / ধ্বনিয়া তুলিতে হবে আঁশা।’



পতিসর এবং শিলাইদহের মত প্রান্তিক জনপদে রবীন্দ্রনাথের গ্রামোন্নয়ন চিন্তার উম্মেষ ও বিকাশ ঘটে। তিনি যা করতে চেয়েছিলেন শিলাইদহ ও পতিসরে, তার আলোকেই উত্তরকালে প্রতিষ্ঠা করেন শান্তিনিকেতন-শ্রীনিকতেন। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সময় কলকাতায় জাতীয় রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত না থেকে তিনি গ্রামোন্নয়ন কর্মযজ্ঞে অধিকতর মনযোগী হয়ে ওঠেন। ‘মাটির টানে’ তিনি বারবার গ্রামে ফিরে গেছেন। আশি বছরের জীবন পরিক্রমায় শহরে-গ্রামে, নদীর বুকে, উদ্দাম সাগরে, আকাশ পথে কিংবা পায়ে হেঁটে কত না স্থানে তিনি ভ্রমণ করেছেন। কবি হিসেবে, কখনোও কর্মযোগী হিসেবে বিভিন্নমুখি রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মে তিনি নিজেকে যুক্ত করেছেন। সবই তাঁকে দিয়েছে তীর্থরেণু আর অন্তর ভরে দিয়েছে প্রাপ্তির পূণ্যে। কিন্তু শিলাইদহ-পতিসর-সাজাদপুুর সহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থান সফর ও অবস্থান তাঁর জীবনের এক আলোকিত অধ্যায়। বাংলাদেশ তাঁর শিল্পীসত্তার সাথে কর্মযোগী সত্তার মিলন ঘটিয়েছে। বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের কাছাকাছি না এলে ‘জন্মের তীর্থদর্শনতাঁর অসমাপ্ত থাকত।





আবদুল্লাহ আল আমিন

লেখক ও প্রাবন্ধিক

মোবাইল ঃ ০১৮১৬-০৫৬৯৩৪





মন্তব্য ৪ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ০৯ ই জুলাই, ২০১৪ সকাল ১০:৩১

আহসানের ব্লগ বলেছেন: +

২| ০৯ ই জুলাই, ২০১৪ সকাল ১০:২৬

রাজিব বলেছেন: ১লক্ষ ৮হাজার টাকা পতিসরের কৃষি ব্যাংকে জমা দিয়েছিলেন প্রজাদের কল্যাণে"
আজ থেকে ১০০ বছর আগের এক লক্ষ টাকা দিয়ে তো ছোট খাট জমিদারী কিনতে পাওয়া যেত। রবীন্দ্রনাথ অনেক মহৎ হৃদয়ের অধিকারী ছিলেন।

৩| ০৯ ই জুলাই, ২০১৪ দুপুর ১:৩৪

ডি মুন বলেছেন: চমৎকার রচনা। ভালো লাগলো।

কবিগুরুকে নিয়ে অনেক কিছু জানা হলো। মনে পড়ছে তাঁরই লেখা 'কাব্য' কবিতার শেষাংশ -

"জীবন মন্থন বিষ নিজে করি পান
অমৃত যা উঠেছিল করে গেছ দান। "

রবীন্দ্রনাথ সত্যিকার অর্থেই এক মহাবিস্ময় ।

ভালো থাকবেন সর্বদা।

৪| ৩০ শে নভেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৫:১১

খালিদ১৪ বলেছেন: বুঝিনা কবিরা আমাদের কতটুকু নৈতিক শিক্ষা দিয়েছে। এ বিষয়ে আপনার সাথে একদিন আলোচনা হবে।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.