নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

নবীন আনন্দ

আবদুল্লাহ আল আমিন

আবদুল্লাহ আল আমিন › বিস্তারিত পোস্টঃ

বাঙালির ধর্মসমন্বয় ভাবনা

১৬ ই জুলাই, ২০১৪ সকাল ১০:০১

বাঙালির ধর্মসমন্বয় ভাবনা

আবদুল্লাহ আল আমিন

ভাগবত গীতায় আছে:



‘ অসতো মা সদ্গময়, তমসো মা জ্যোতির্গময়,/ মৃত্যোর্মামৃতং গময়।/ আবিরাবর্ম এধি,রুদ্র যত্তে দক্ষিণং মুখং/ তেন মাং পাহি নিত্যম।।’

অর্থ: আমাকে অসত্য থেকে সত্যে নিয়ে যাও, অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে যাও। হে স্বপ্রকাশ জ্যোতিঃস্বরূপ রুদ্র, তুমি আমার নিকট আবির্ভূত হও, তোমার যেটি কারুণ্যপূর্ণ দক্ষিণমুখ তৎদ্বারা আমাকে নিত্য রক্ষা করো।

কোরআন শরিফে আছে : আমাদের সরল পথে চালাওÑ তাদের পথে যাদের তুমি অনুগ্রহ করেছ; তাদের পথে নয় যারা তোমার রোষের পাত্র, তাদের পথেও নয় যারা পথহারা।’(সূরা ফাতিহা: ৫-৭) অর্থাৎ সব ধর্মের মধ্যে এমন সব মহৎ ভাব নিহিত আছে যা মানুষকে কেবল অন্ধকার থেকে আলোর দিকে ধাবিত করে। বিশ্বের সব ধর্মের মহৎ ভাবনাগুলি মূলত এক ও অভিন্ন। তবে বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে যেমন মিল রয়েছে তেমনি অমিলও কম নেই। যেখানে অমিল সেখানে অসামঞ্জস্যও রয়েছে দারুণভাবে। তারপরও প্রায় সব ধমর্ই একই ধরণের নৈতিকতা ও পরার্থপরতার কথা বলেছে, যদিও সেমেটিক ধর্ম ও পৌত্তলিকতাবাদী ধর্মগুলির মধ্যে কিছু মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। যেমন- হিন্দু ও বৌদ্ধধর্মে জন্মান্তরবাদ স্বীকার করেছে কিন্তু ইসলাম ও খ্রিস্টান সেখানে মৃত্যুর পর পনরুত্থানের কথা বলেছে। ইসলাম যেখানে একেশ্বরবাদের বাণী দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করেছে, সেখানে হিন্দুধর্ম বহুদেবতাবাদে, খ্রিস্টানধর্ম ত্রিত্ববাদে আস্থা স্থাপন করেছে আর গৌতম বুদ্ধ তো ঈশ্বর আছে কি নেই এই প্রশ্নে ছিলেন একেবারে নীরব। এসব অমিল স্বীকার করে নিয়েও বিভিন্ন ধর্মের শাশ্বত বাণী বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে, সব ধর্মের মর্মার্থ ও উদ্দেশ্য এক ও অভিন্ন। আর এর বাইরে যেসব বিধান, পালা-পার্বণ,আচার-আচরণ রয়েছে যেগুলির কোন সার্বজনীন মূল্য নেই। বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে যে বিরোধ বা অমিল তাও মূলত আনুষ্ঠানিকতা ও আচার বিচারকে কেন্দ্র করেই সংঘটিত হয়। ধর্মের প্রাত্যহিক আচার পালন করেও আমরা সমাজের বৃহত্তর স্বার্থে বিভিন্ন ধর্মের গভীরতর উপলব্ধির উপর ভিত্তি করে এক ধর্মের সঙ্গে অন্য ধর্মের সমন্বয় সাধন কতে পারি। আমাদের দেশে চৈতন্য থেকে লালন; রামমোহন, বিদ্যাসাগর থেকে রবীন্দ্রনাথ প্রচলিত ধর্মের বিধান, লোকাচারকে অতিক্রম করে সব ধর্মের ভিতর যে স্থায়ী তত্ত্ব রয়েছে সেখানে মিল খোঁজার চেষ্টা করেছেন। আসলে সব ধর্মের মধ্যেই লুকায়িত আছে গভীর সত্য উপলব্ধি বা সার্বজনীন সত্য যা দিয়ে মানুষে মানুষে মেল বন্ধন রচনা করা যায়। মোঘল স¤্রাট আকবর তার দীন ই-ইলাহি দিয়ে ভারতবষের্র সকল ধর্ম সম্প্রদায়ের মধ্যে সমভাব প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, তিনি কোনো ধর্মীয় কাল্ট প্রতিষ্ঠা করতে চাননি। আকবরের ধর্মমত প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করতে না পারলেও বাংলাদেশ ও ভারতের সংবিধানে দিন ই ইলাহির যে ছাপ রয়ে গেছে তা অস্বীকার করা যাবে না। দু’ দেশই স্বাধীনতার পর রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা অন্তর্ভুক্ত করেছে। আর ভারতবর্ষে সেক্যুলার ভাবনার উৎপত্তি মোঘল স¤্রাট আকবরের দিন ই- ইলাহি থেকে,একথা অমর্ত্য সেন তাঁর দি আরগিউমেন্টেটিভ ইন্ডিয়ান গ্রন্থে তুলে ধরেছেন যুক্তি দিয়েই। অবশ্য মহাত্মা গান্ধী বলেছেন , আকবরের স্বপ্ন সার্থক হয়নি; কারণ সব ধর্মের নিজস¦ সত্তা আছে। তবে নেহেরু তার ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’তে আকবরের দিন ই ইলাহি সম্পর্কে কিছু ইতিবাচক কথা বলেছেন। বাঙালির নবজাগৃতির পথিকৃৎ রাজা রামমোহনও স¤্রাট আকবরের মতো নানা ধর্মমতের মধ্যে সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করে গেছেন। তাঁর বলিষ্ঠ জীবন ভাবনা ও ধর্মসমন্বয়ী প্রত্যয় আজও বাঙালিকে পথ দেখায় - প্রভাবিত করে। সেই প্রভাব লক্ষ্য করা যায়, কলকাতার সেন্ট পলস কলেজের অধ্যাপক বহুভাষাবিদ ড. মকবুল ইসলামের লেখা ‘ ভাগবত গীতা এ্যান্ড আল কোরআন’ ( ইযধমনধঃ এরঃধ ধহফ অষ-ছঁৎধহ ) গ্রন্থে। আরবি ও সংস্কৃত ভাষায় প-িত উদারপন্থি এই লেখক সংস্কারমুক্ত মন নিয়ে ভাগবদগীতা ও কোরআন শরিফের অনুপুক্সক্ষ পাঠ গ্রহণ করেন এবং দুই পবিত্র ধর্মগ্রন্থের উপদেশ ও বিষয়বস্তুর মধ্যে উল্লেখ করার মতো যেসব মিল অমিল রয়েছে সেগুলি উদ্ধৃতিসহ তুলে ধরেন। যারা আলোচ্য ধর্মগ্রন্থ দুটি তেমন গভীরভাবে পড়েননি তারাও বিষয়টি ভালভাবে বুঝতে পারবেন।

কোরআন শরিফে বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ, সম্পত্তির অধিকার সম্পর্কিত কিছু বিধান রয়েছে, অন্যদিকে ভাগবদগীতায় এ ধরণের প্রসঙ্গের কোনো উল্লেখ নেই। আবার গীতায় চতুর্বর্ণ প্রথার সপক্ষে কিছু শ্লোক রয়েছে যা কোরআন শরিফে নেই। এই হচ্ছে দু’ ধর্মগ্রন্থের মধ্যে অমিলের উদহারণ। এ রকম অমিলের উদহারণ আরও দেখানো যেতে পারে , তবে মূল আলোচনার জন্য সেটা তেমন প্রয়োজন হবে না। ড. মকবুল ইসলাম তাঁর গ্রন্থে ধর্মগ্রন্থদ্বয়ের অমিলগুলি যেমন উদ্ধৃতিসহ তুলে ধরেছেন, তেমনি কোথায় কোথায় মিল রয়েছে তাও দেখিয়ে দিয়েছেন। দু ’ চারটি উদহারণ দিয়ে আলোচনা করা হলে বিষয়টি পাঠকের কাছে খোলসা হবে বলে আমার মনে হয়।

ইসলাম ধর্মের মূল কথা হল, আল্লার ইচ্ছার কাছে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ। যেমন সুরা আল ইমরানে বলা হয়ে, ‘ লো! রিলিজিয়ন উইথ আল্লাহ ইজ দ্য সারেন্ডার টু হিজ উইল এ্যান্ড গাইডেন্স’ ( ৩/১৯) এবং এটাই হচ্ছে ইসলামের সারসত্য। আবার এ রকম পূর্ণ আত্ম সমর্পণের কথা ভাগবদগীতাতেও অসংখ্যবার বলা হয়েছে গভীরভাবে। যেমন, গীতার দ্বাদশ অধ্যায়ে শ্রীকৃষ্ণ বলছেন , যিনি সকল প্রাণীর প্রতি দ্বেষহীন, মিত্রভাবাপন্ন,দয়ালু, মমত্ববুদ্ধি সম্পন্ন, নিরহংকার, সুখে দুঃখে সমভাবাপন্ন, ক্ষমাশীল সদাসংযত স্বভাব, সদা তত্ত্ববিষয়ে দৃঢ়নিশ্চয় এবং যার মন ও বুদ্ধি আমাতে সমর্পিত সেই ভক্তই আমার প্রিয়। ( ১২/১৪) মর্মার্থের দিক থেকে এখানে কোরআন ও গীতা নিবিড়ভাবে ঘনিষ্ঠ। বিষয়মোহ ত্যাগ করার কথা গীতাতে বারবার বলা হয়েছে, তেমনি কোরআন শরিফেও আছে, ‘লোভ থেকে যিনি নিজেকে মুক্ত করতে পেরেছেন তিনিই সফল।’ (৬৪/১৬) যিনি নিজেকে বিষয়মোহ থেকে মুক্ত করতে পারেননি তিনি কীভাবে আল্লাহ বা ঈশ্বরে আত্মসমর্পিত হবেন!

কোরআন শরিফ ও গীতার মধ্যে আরও অনেক জায়গায় মিল খুঁজে পাওয়া যাবে, যেসব বিষয় ধর্মনিষ্ঠ কিংবা ধর্মচিন্তক ব্যক্তিকে ভাবিত করতে পারে। ধর্মযুদ্ধের প্রতি দু’ ধর্মগ্রন্থই সমর্থন জানিয়েছে। ভাগবদগীতায় বলা হয়েছে, ‘ ধর্মযুদ্ধ ক্ষত্রিয়ের শ্রেষ্ঠ কর্তব্য’। (২/৩১) কোরআন শরিফেও ধর্মযুদ্ধের নির্দেশনা রয়েছে। ‘ ইসলাম আক্রান্ত হলে সমস্ত বিশ্বাসী মুসলমানেরই কর্তব্য সর্বশক্তি দিয়ে সেই আক্রমণ প্রতিহত করা। যেমন গীতায় তেমনই কোরানে কোনও নিষেধ নেই ধর্মযুদ্ধে হত্যার বিরুদ্ধে। কিন্তু একই সঙ্গে আরও একটা কথা বুঝে নেওয়া দরকার। ধর্মযুদ্ধে যেমন ভয়ের স্থান নেই তেমনি ব্যক্তিগত বিদ্বেষেরও স্থান নেই। ধর্মযোদ্ধা আল্লাহ অথবা ঈশ্বরের ইচ্ছার সাধক মাত্র। গীতা ও কোরানে তাই, অবিশ্বাসীদের স্তম্ভিত করে দিয়ে, যুদ্ধের পাশাপাশি অহিংসা ও ক্ষমার কথা বলা হয়েছে।’ (অম্লান দত্ত, ধর্মসমন্বয় চিন্তা। দেশ। ২ সেপ্টেম্বর ২০০৪।পৃ: ৩৭) ইসলামের সার্বজনীন সত্যের মর্মার্থ যারা বোঝেনা বা বুঝেও ভিন্ন ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে তারাই জেহাদের সঙ্গে বিদ্বেষ যুক্ত করে। কিন্তু আল্লাহ তায়ালার স্পষ্ট নির্দেশ ‘ যে তার লোভ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারবে, সে সফলকাম হবে’ (৭/১৯৯) ভাগবদগীতাতেও অহিংসা, সত্য ও অক্রোধের কথা বলা হয়েছে ষোড়শ অধ্যায়ে। হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়কে বিষয়গুলি ভাবতে হবে আমাদের বৃহত্তর স্বার্থে,বিশেষ করে উপমহাদেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর সামগ্রিক বিকাশ ও অস্তিত্বের স্বার্থে। আমার বিশ্বাস, আর কেউ না ভাবুক বাঙালি ভাববে। বাঙালিই পারবে সকল ধর্মের সারাৎসার আত্মায় ধারণ করে সামনে এগিয়ে যেতে।



বিশ্বের সকল মহৎ ধর্মের মিলগুলো দিয়ে আকবর কিংবা রামমোহন মানুষে মানুষে সেতু বন্ধন রচনা করতে চেয়েছিলেন। ধর্মসমন্বয়ের ভাবনা শিখগুরু গোবিন্দের মধ্যেও ছিল, আর তাই তিনি বলতে পেরেছিলেন,‘ গির্জা আর মসজিদ দুই-ই সমান; হিন্দুদের পূজা অর্চনা আর মুসলমানদের নামাজ রোজা উভয়ই অভিন্ন; সকল মানুষই এক, বিচারের ভ্রান্তির জন্য এদেরকে ভিন্ন বলে মনে হয়। সকল মানুষের একই রকম চোখ, একই রকম কান, একই রকম দেহ, একই রকম আকার- ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ এর সংযোগ। কোনো মানুষকে যেন ভাবতে দেয়া না হয় যে, মানুষের মধ্যে কোন পার্থক্য আছে।’ ( ঘরযধৎধহলধহ জধু বফ. ঝযরশযরংস ধহফ ওহফরধহ ঝড়পরবঃু, ঝরসষধ, ১৯৬৭,ঢ়. ১৭)

ইসলামও বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে সমন্বয় সাধনে ও তাদের পরস্পরের মধ্যে সম্প্রীতি স্থাপনে প্রবলভাবে বিশ্বাসী। এ ধর্ম বিভিন্ন ধর্মের মানুষের প্রতি বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার হাত প্রসারিত করে দিয়েছে। পবিত্র কোরআন শরিফে বলা হয়েছে:

‘ নিশ্চয় যারা বিশ্বাস স্থাপন করেছে এবং যারা ইহুদি ও সাবেইন ও খ্রিস্টান যে আল্লাহ ও পরকালের উপর বিশ্বাস স্থাপন ও সৎকর্ম করে বস্তুতপক্ষে তাদের কোনো ভয় নাই এবং তারা দুঃখিত হবে না (৫/৬৯)।

একথা সত্য যে, বিশ্বে অসংখ্য ধর্ম আছে এবং এসব ধর্মের মধ্যে বিভেদও আছে আর থাকাটাই স্বাভাবিক। তারপরও প্রত্যেক ধর্মই মানুষকে ভালবাসতে ও শ্রদ্ধা করতে শিখিয়েছে। বস্তুত ধর্মের মহৎ ভাবনার মধ্যে নিহিত আছে সাম্য, মৈত্রী,মানবিকতা ও উদারতার মর্মবাণী। ধর্ম কখনো নিচুতা শেখায়নি বরং ধর্মান্ধতাই মানুষকে বর্বর, নিষ্ঠুর, গোঁড়া, হৃদয়হীন পশু করে তোলে। বিভিন্ন ধর্মে ঈশ্বরকে নানা নামে, নানা বিশেষণে বিশেষায়িত করে ডাকা হয়। সৃষ্টিকর্তাকে যে নামে, যে ভাব-ভাবুকতা দিয়ে ডাকা হোক না কেন, ঈশ্বর সম্পর্কিত অনুভূতি সব ধর্মসম্প্রদায়ের কাছে প্রায় একই রকমের। কেউ ঈশ্বর ভাবনাকে যুক্তিবাদের ওপর স্থাপন করেছেন, আবার কেউ স্থাপন করেছেন ভক্তি ও বিশ্বাসের ওপর। আল্লাহ বা ঈশ্বর কে যে শব্দপ্রতিমা ব্যবহার করে ডাকা হোক, তার নাম উচ্চারিত হলে মনের ভেতরে এক ধরনের পবিত্রতা, শুদ্ধতা, অপার্থিব ভাবনার অনুভূতি জেগে ওঠে। আর এটাই অধ্যাত্মবোধ যা সব ধর্মের নির্যাস। সব ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল বলে শিখধর্মগুরু নানক কোরআন শরিফ আত্মস্থ করতে সক্ষম হয়ে ছিলেন। হিন্দুধর্ম ও ইসলামের মৌল ভাবনা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি শিখধর্ম প্রবর্তন করেন। শিখদের স্বর্ণমন্দিরের জন্য জায়গা দান করেন স¤্রাট আকবর। পবিত্র কোরআন বাংলা ভাষায় প্রথম অনুবাদ করেন গিরিশচন্দ্র সেন। আবার হিন্দুদের পবিত্র গ্রন্থ ভাগবদগীতা প্রথম বিদেশি ভাষায় অনুবাদ করেন স¤্রাট শাজাহান পুত্র দারাশিকো। বাঙালি মনীষার অন্যতম প্রধান পুরুষ রামমোহন তাঁর যুক্তিশীলতা, আত্মেআপলব্ধি,আত্মজ্ঞান দিয়ে বিভিন্ন্ ধর্মে মধ্যে মেলবন্ধন রচনা করতে চেয়েছেন। ‘ হিন্দু চিত্তের গভীরতা, ইসলামের আধ্যাত্মিকতা ও জীবনমুখিতা এবং খ্রিস্টধর্মের সহৃদয়তা’র যে অপূর্ব সম্মিলন তার চিন্তাধারায় ও ব্যক্তিচরিত্রে স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে তা দিয়েই তিনি ধর্মসমন্বয়ের মতো অসাধ্য কাজটি সম্পন্ন করতে চেয়েছিলেন। তিনি মেজাজে মননে যুক্তিশীল, জিজ্ঞাসু মানুষ ছিলেন, কিন্তু কোনভাবেই নিরীশ্বরবাদী কিংবা শাস্ত্রবিমুখ ছিলেন না। যুক্তির আলো দিয়ে তিনি ঈশ্বরের পথে হেঁটেছেন,যুক্তি ও প্রজ্ঞা দিয়ে বিভিন্ন ধর্মের মর্মভাবনা ও শাস্ত্রের নিগূঢ় তত্ত্ব বিশ্লেষণ করেছেন। ত্রিশ বছর বয়সে রচিত তুহফাৎ উল মুওয়াহিদীন( ১৮০৪) গ্রন্থে রামমোহন ধর্মবিষয়ক চিন্তা তুলে ধরেন। গ্রন্থটির নামের অর্থ: যারা ঈশ্বরের একত্বে বিশ্বাস করেন তাদের উপহার । এ গ্রন্থে তিনি শাস্ত্রনিরপেক্ষ যুক্তি দিয়ে একেশ্বরবাদ প্রমাণ করেন। যুক্তিবাদিতার প্রতি বরাবরই তাঁর প্রবল ঝোঁক ছিল, কিন্তু কোনভাবেই সেটা তাঁর অধ্যাত্মভাবনার বিরোধী হয়ে ওঠেনি। তিনি যুক্তিও নিয়েছেন এবং অতীন্দ্রিয় অনুভূতি ও ঈশ্বরভাবনাও জীবনের অবিভাজ্য অংশ বলে মেনেছেন আমৃত্যু। স্বাভাবিক ধর্মানুভূতির প্রতি প্রবল আস্থা থাকলেও ধর্মোন্মত্ততাকে তিনি সারাজীবন সন্দেহের চোখেই দেখেছেন। তিনি বলেছেন, সর্বধর্মের মধ্যে যে সারবস্তু বিদ্যমান তার একটা স্বাধীন সত্তা আছে। আরও বলেছেন, ‘ পবিত্রতাই ভগবানের গ্রহণযোগ্য’। তারপর বলেছেন, ‘ এই বৃত্তিটাই সৃষ্টিকর্তা মানুষের অন্তরে গভীরভাবে প্রোথিত করেছেন।’ রামমোহন ফন্দিবাজ ধর্মধ্বজিদের ফেরেব্বাজি ও প্রতারণা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন প্রথম যৌবন থেকে, তাই ধর্মের শুদ্ধতা রক্ষার জন্য তৎপর ছিলেন সব সময়। তিনি উপলব্ধি কিেছলেন, অন্তর্নিহিত এক বৃত্তির অস্তিত্ব যা ধর্মের সার্বজনীন সত্যের সঙ্গে যুক্ত এবং যেখান থেকে পবিত্রতাবোধ উৎসারিত হয়,যেটা ঈশ্বরের কাছেও গ্রহণযোগ্য। এই পবিত্রতাবোধে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা গেলে ধর্মের শুদ্ধতা যেমন রক্ষা সম্ভব হবে, তেমনি ধর্মসমন্বয়ের পথে কোনো বাঁধা থাকবেনা।

এই গভীরতম বৃত্তি মানুষের চিত্তকে কামনা-বাসনার অস্থিরতা থেকে আনন্দ-কল্যাণ-মানবিকতা-সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির পথে নিয়ে যায়, মূল্যবোধ ও চেতনার স্তরকে উন্নতর করে। একে মেনে, আত্মস্থ করে অহংকে অতিক্রম করতে হয়। রামমোহন গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন, যুক্তির সঙ্গে ধর্ম, বিশ্বাস কিংবা অন্তরের গভীরে যে আবেগ নিহিত তার কোন বিরোধ বা সংঘর্ষ নেই; আর তা থাকাও উচিৎ নয়। তবে সব আবেগ বা বিশ্বাসের যে স্বাধীন সত্তা রয়েছে, তা তিনি অস্বীকার করেননি। এ জন্যই তিনি নবজাগৃতির পথিকৃৎ-রেনেসাঁসের আলোক ধারায় ¯œাত মুক্তচিন্তার মুক্তমানব।

চিন্তার স্তরটা স্বচ্ছ করে আরও সরল করে বলা যায়, যুক্তি পথ হারিয়ে বিপথগামী হতে পারে; প্রেম, ভালবাসা, আবেগ অন্ধ হতে পারে। তারপরও সুস্থ, সুন্দর, আনন্দময় জীবনের জন্য যুক্তি ও আবেগ দুয়ের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। এদের সুসমন্বয় ছাড়া কোনো সিস্টেম চলবে না, কোনো ধর্মই পূর্ণতা পাবেনা। বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে সমন্বয় সহজসাধ্য বিষয় নয়, অন্য পথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান সম্ভবপর নয়। তাই সব কাজের মাঝে আমাদের অবশ্যই সমন্বয়ের চিন্তাটা উচ্চে তুলে ধরে রাখতে হবে, যেমন রেখেছিলেন রামমোহন এবং তারও আগে মধ্যযুগের বাঙালি মুসলমান কবি ও পদকর্তারা। একুশ শতকের বাঙালিকেও সমন্বয়ের আল ধরেই সামনে এগুতে হবে, নতুবা তার সব কিছুই বিপন্ন হবে।





মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.