নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

নবীন আনন্দ

আবদুল্লাহ আল আমিন

আবদুল্লাহ আল আমিন › বিস্তারিত পোস্টঃ

যুক্তি, ধর্ম ও বাঙালি মুসলমান

১৭ ই জুলাই, ২০১৪ বিকাল ৪:১৯

যুক্তি, ধর্ম ও বাঙালি মুসলমান

আবদুল্লাহ আল আমিন

বিশ্ব বিশ্রুত ঔপন্যাসিক টলস্টয়ের বিখ্যাত মন্তব্য: বিশ্বের প্রতিটি ধর্মের রয়েছে তিনটি অপরিহার্য অংশ। প্রথমটি, ফিলসফি অব রিলিজিয়ন, দ্বিতীয়টি, রিচুয়ালস অব রিলিজিয়ন, শেষটি, এসেন্স অব রিলিজিয়ন। শেষটির অর্থ ধর্মের সারসত্য যার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে ধর্ম সমন্বয়ের সৌধ।

ধর্ম আলোচনায় যুক্তির প্রসঙ্গ অনস্বীকার্য। অনেকেই মনে করেন, ধর্ম ও যুক্তি পরস্পরবিরোধী; আরও মনে করা হয়, একই সঙ্গে ধর্ম ও যুক্তিবাদের চর্চা সম্ভব নয়। এমন ধারনা সঠিক তো নয়ই, বরং অসম্পূর্ণ ও অযৌক্তিক। যারা ধর্ম মানেন, পালন করেন তারা সবাই যুক্তিবিরোধী নন,তারা অনেকেই যুক্তির প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করেন না। এ প্রসঙ্গে রামমোহনের নাম স্মরণ করতেই হয়। পরবর্তী কালে আমরা আরো ক’জন মুক্তচিন্তার বাঙালি মুসলমান তরুণের সাক্ষাৎ পায় যাদের অন্তর্লোক ধর্ম, আধ্যাত্মিকতা ও যুক্তিবাদের আলোয় উদ্ভাসিত ছিল। ১৯২৬ সাল থেকে ঢাকায় যে ‘ বুদ্ধি মুক্তি আন্দোলনে’র সূচনা হয়, সেই আন্দোলনের প্রবক্তা,কর্মী, সংগঠকরা কেউ কেউ ধর্ম মানতেন, পালন করতেন; কিন্তু অস্বীকার করতেন না সেই আন্দোলনের মুখপত্র ‘ শিখা’র মর্ম শ্লোগান ‘ জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব’। ওই সময়ে যুক্তি ও ধর্মের সমন্বয়ে যারা জীবনাদর্শ গড়েছিলেন তাদের মধ্যে কাজী আবদুল ওদুদ, আবুল হুসেন, কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল ফজল,মোতাহার হোসেন চৌধুরী অন্যতম।

এদের উদ্যোগে ১৯ জানুয়ারি, ১৯২৬ ঢাকায় ‘ মুসলিম সাহিত্য- সমাজ ’ এর প্রতিষ্ঠা বাঙালি মুসলমানের সমাজ বিবর্তনের ইতিহাসে এক অনন্যসাধারণ ঘটনা। এই প্রতিষ্ঠানটি সে সময় যে ভাব আন্দোলনের সূচনা করে, তা বাঙালির সাহিত্য-সংস্কৃতির ইতিহাসে বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন নামে পরিচিত। এই আন্দোলনের অভিষ্ঠ লক্ষ্য ছিল বাঙালি মুসলমান সমাজের চিন্তার পরিধি বিস্তৃত করে তাদের জীবনবোধ উন্নতর করা এবং ধর্ম-অধ্যাত্ম চেতনা গভীরতর করা। ‘ বুদ্ধির মুক্তি’ মূলমন্ত্রকে সামনে রেখে এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত লেখকবৃন্দ সেদিন বাঙালি মুসলমান সমাজকে অন্ধ সংস্কার, শাস্ত্রাচার, সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতা, গোঁড়ামি থেকে মুক্ত করার জন্য এক দশকেরও বেশি সময় ধরে তাদের কর্ম প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছিলেন। নজরুল ইসলাম এ আন্দোলনের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জ্ঞাপন করেছিলেন, যদিও তিনি নিজেই তখনো পর্যন্ত মুসলমান সমাজে সেইভাবে গৃহীত হননি। এই আন্দোলনের সাথে যুক্ত অনেকের ওপর সেদিন মুসলিম রক্ষণশীলতার খড়গ নেমে আসে। মুসলিম সাহিত্য সমাজের দু’ প্রাণপুরুষ আবুল হুসেন ও আব্দুল ওদুদ সাহিত্য সমাজের কাজ বন্ধ রেখে ঢাকা ছাড়তে বাধ্য হন। তাদের মুখপাত্র শিখা’র দ্যুতিও ক্রমশঃ ম্লান হয়ে আসে। তারপরও এ কথা স্বীকার করতে হবে, তৎকালীন বাঙালি মুসলমান সমাজকে এ আন্দোলন নাড়া দিতে সক্ষম হয়েছিলো।

শিখা গোষ্ঠীর লেখকরা কেউই নাস্তিক বা ধর্মবিরোধী ছিলেন না, তাদের মনন চর্চা হযরত মুহাম্মদ ( সা.) এর জীবনাদর্শ দ্বারা যেমন অনুপ্রাণিত হয়েছে, তেমনি রামমোহন, ডিরোজিও, রবীন্দ্রনাথ, প্রমথ চৌধুরী, তুরস্কের কামাল আতার্তুক, পারস্যের শেখ সাদি, ফরাসি লেখক ও দার্শনিক রোমা রোঁলাও তাদের ভাবনার দিগন্ত প্রসারিত করেছে। প্রাচ্য- প্রতীচ্যের সুকৃতি ও শুভচেতনা সমূহ সঙ্গে নিয়েই স্ব সমাজ ও ধেের্মর মানুষকে আলোকিত করতে চেয়েছেন তারা। তারা ইসলামের বিধি বিধানসমূহ যুক্তি তর্কের কষ্টিপাথরে যাচাই করে গ্রহণ করতে চেয়েছেন। সাহিত্যিক ডা. লুৎফর রহমানের নাম শিখাগোষ্ঠীর পূর্বসূরি হিসেবে উল্লেখ করা যায়। তাঁর সাহিত্যচর্চার মূল উদ্দেশ্য ছিল মনুষ্যত্বের পূর্ণ বিকাশ। তিনি মানুষের মধ্যে অসীম সম্ভাবনার বিভিন্ন লক্ষণ শনাক্ত করেছিলেন। তাই সব মানুষের অন্তর্নিহিত মহৎ সত্তার বিকাশ সাধনের মধ্য দিয়ে তিনি উন্নতর ও মহত্তর সমাজ বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখেছিলেন। আমাদের সমাজে যখন ধর্ম নিয়ে প্রবল তর্ক-বিতর্ক চলছে, হিন্দু মুসলমানের মধ্যে বিভেদের রেখাটা স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠছে, তখনও তিনি উদার ও মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে ইসলাম ও তার সারাৎসার ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি মনে করতেন,‘ জ্ঞানের দ্বারা মনকে চাষ না করতে পারলে ধর্ম পালন হয় না।’( রায়হান। লুৎফর রহমান রচনাবলী, পৃ: ১৮২।) তিনি আরও বলেছেন, ‘ জীবনকে নির্মল, সত্যময়, সুন্দর, ঈশ্বরের যোগ্য, প্রেমময় নিষ্পাপ নির্দোষ করে তোলাই সমগ্র মানবজাতির একমাত্র ধর্ম।..এই সাধারণ ধর্মের নাম আমি ইসলাম দিতে চাই। ইসলাম অর্থ শান্তি, মহাশান্তি।’

১৯২৬ সালের সূচনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিম-লে জন্ম নেয়া মুসলিম সাহিত্য সমাজ তথা শিখা গোষ্ঠীর লেখক, সাহিত্যিক, সংগঠকরাও ছিলেন সে সময়ের সবচেয়ে প্রাগ্রসর চিন্তার মানুষ। তারা ইসলাম ও তার মর্মবাণীকে যথার্থ ধর্মবোধ ও যুক্তিবাদের রসায়ন দিয়ে যাচাই করে গ্রহণ করতে চেয়েছিলেন। এজন্য তাদের মুখপাত্রের নাম শিখা, তাদের মূলমন্ত্র ছিল বুদ্ধির মুক্তি। আর এই মন্ত্র তারা পেয়েছিলেন বহু জায়গা থেকেÑ কামাল আতার্তুকের কাছ থেকে, রামমোহন-রবীন্দ্রনাথ-রোমা রোঁলার কাছ থেকে, আর হযরত মোহাম্মদ(সা.) এর কাছ থেকে। এ আন্দোলনের প্রাণপুরুষ আবুল হুসেন ‘ ইসলামের দাবী’ নামক প্রবন্ধে নিঃশঙ্কচিত্তে বলেছিলেন, ‘ হজরত মোহাম্মদের নামের পূজা ও তাঁর মাহাত্ম্যের অন্ধ মোহ থেকে নিজেকে মুক্ত করে আমাদের জ্ঞানের রাজপথে এসে সাধনারত হতে হবে, এবং সমাজ জীবনে ‘তাখাল্লাকু বি- আখাবিল্লাহ’ ( হজরতের বাণী) সার্থক ও সফল কাে তুলতে হবে।’ আর আব্দুল ওদুদ তো আরও এক ধাপ এগিয়ে বলেন, ‘ আল্লার গুণাবলীতে বিভূষিত হও, আল্লার গুণাবলীতে বিভূষিত হওয়ার অর্থ অনন্ত সদগুণে ভূষিত হওয়া, কাজেই মানুষের উন্নতির অন্ত নেই- সে হজরতে মোহাম্মদের চাইতেও বড়ো হতে পারে।’ মুসলিম সাহিত্য সমাজের চিন্তাশীল লেখকগণ মহানবী ও ইসলাম ধর্মকে অন্তর দিয়েই মেনেছেন, তবে মানার সময় মুক্তবুদ্ধি দিয়ে বিচার করে মেনেছেন। রামমোহনের প্রিয় কবি ছিলেন পারস্যের শেখ সাদি, তিনি শিখা গোষ্ঠীর লেখকগণেরও প্রিয় কবি। সাদির রচিত দুটি অমর পঙক্তি রামমোহন খুবই পছন্দ করতেন:

‘ তরিকত বজুজ খেদমতে খলক নিসত/ বতসবিহ ও সাজ্জাদাও দলকনিসত।’ অর্থাৎ সৃষ্টির সেবা ভিন্ন আর কিছু নেই। তসবিহ জায়নামাজ ও আলখাল্লায় ধর্ম নাই।

শিখা’র অন্যতম প্রাণপুরুষ কাজী আব্দুল ওদুদেরও প্রিয় কবি ছিলেন শেখ সাদি। সাদির কবিতার মর্মকথা ওদুদকেও অনুপ্রাণিত করেছে। মহানবীর প্রশস্তিসূচক নি¤œ বর্ণিত পঙক্তিমালা তিনি বারবার আওড়াতেন:

‘ বালাগাল উলা বে কামালিহি। / কাশাফাদদুজা বে জামালিহি।’অর্থাৎ উৎকর্ষে তিনি মহৎ ও মহীয়ান। তাঁর সৌন্দর্যে সব অন্ধকার দূর হয়েছে। মুসলমান সমাজকে কুসংস্কারের অন্ধগলি থেকে জ্ঞান ও বুদ্ধি বিভাসিত রাজপথে নিয়ে আসার প্রত্যয়েই শিখা গোষ্ঠীর সকল সাধনা ও কর্মপ্রয়াস পরিচালিত হয়েছে। ইতোপূর্বে বাঙালি মুসলমান সমাজের সামগ্রিক উন্নয়নের অনেকেই কাজ করেছেন, কিন্তু সে সব ছিল কেবলই ব্যক্তি পর্যায়ের, আর শিখা গোষ্ঠীর তৎপরতার মধ্যে ছিল সামষ্টিক ও সমন্বিত উদ্যোগ। সাহিত্য চর্চার মাধ্যমে স্ব সমাজ ও ধর্মের দায় শোধ করতে চেয়েছিলেন তারা, কিন্তু বাঙালি মুসলমান সমাজকে নব যুগের নবীন আলোয় উদ্ভাসিত করতে গিয়ে তারা ধর্ম সম্পর্কিত তর্কে জড়িয়ে পড়েন।

ইসলাম ধর্ম, আল্লাহ, নামাজ, মহানবী প্রভৃতি সম্পর্কে যে ভ্রান্ত ধারণা সমাজে প্রচলিত ছিল তা থেকে তারা বাঙালি মুসলমানকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন। তারা মনে করতেন, ইসলাম সার্বজনীন ধর্ম, মুক্তবুদ্ধির ধর্ম, তাই এ ধর্মে কোনো অন্ধত্ব, গোঁড়ামি, সংকীর্ণতা, যুক্তিহীনতা থাকতে পারে না। আর তাই আব্দুল ওদুদ, কাজী মোতাহার হোসেন মহানবী( সা.) কে পথ-প্রদর্শক, মনুষ্যত্বের আধার,‘ একজন উঁচুদরের যুগ প্রবর্তক মহাপুরুষ’, দিব্যকান্তি সুদর্শন পুরুষ হিসেবে মান্য করতে চেয়েছেন। ইসলামের আচার আনুষ্ঠানিকতা সম্পর্কেও প্রশ্ন তুলেছেন। আবুল ফজল তো আরবি ভাষায় খোতবা পাঠের সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘ ..আরবে আরবিতে খোতবা পড়া হয়। সেই ধুয়া ধরিয়া আমরাও চলিয়াছি তাহাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করিয়া। মনে করি, সুন্নত পালন করিতেিেছ। আর ভুলিয়া যাই আরবি আরবদের মাতৃভাষা, আরবি তাহারা বুঝে, আমরা তাহা বুঝি না অথচ পুণ্যলাভের দুরাশায় বুঝিবার ভান করিয়া হাহুতাশ করিয়া বুক ভাসাই।’( তরুণ আন্দোলনের গতি, শিখা, তৃতীয় বর্ষ,১৯২৯।পৃ:১৩৭।)

কাজী মোতাহার হোসেন আরবি ভাষায় নামাজ পড়া ও সংস্কৃতে মন্ত্রপাঠ সম্পর্কে তার নিজ উপলব্ধি ব্যক্ত করেন ‘ ধর্ম ও শিক্ষা’ শীর্ষক প্রবন্ধে:

‘ সংস্কৃতে স্তোত্র পাঠ করা আর আরবিতে নামাজ পড়াই নিয়ম। যার অর্থবোধ হয় না, যে কথার সহিত প্রাণের যোগ নাই, সেইসব কথায় ভগবানের প্রার্থনা করায় কতটা হৃদয় মনের তৃপ্তি হয়, তা বুঝে ওঠা কঠিন।’ ( শিখা, চতুর্থ বর্ষ,১৩৩৭। পৃ:৪৮।)

সাধারণ মানুষ যাতে কোরআন হৃদয়ঙ্গম করতে পারে, সেজন্য কাজী আবদুল ওদুদ পবিত্র কোরআন বাংলায় অনুবাদ করেন , অনুবাদের ক্ষেত্রেও তিনি স্বকীয়তার স্বাক্ষর রেখেছেন। তারপরও তিনি সারাজীবন আবেগের চেয়ে যুগ ও যুক্তিধর্মের প্রতি ছিলেন প্রবলভাবে আস্থাশীল। ধর্মচর্চাকে তিনি ‘ আদর্শের বা শ্রেষ্ঠ চিন্তার আনুগত্য’ বলে মানতেন। তিনি তার ‘ হযরত মোহাম্মদ ও ইসলাম’ গ্রন্থে ধর্ম সম্পর্কে বলেন: ‘ একালের ধর্ম বলতে জ্ঞান ও মনুষ্যত্ব সাধনাই মুখ্যভাবে বুঝতে হবেÑধর্মের আচার অনুষ্ঠানের দিক তার তুলনায় গৌণ,Ñজীবনে কোনটি মুখ্য কোনটি গৌণ এই বিচার আমাদের মধ্যে যেন কখনো শিথিল না হয়, বিশেষ করে একালের জটিল জীবনায়োজনের দিনে।’(হযরত মোহাম্মদ ও ইসলাম, কলিকাতা, ১৩৭৩। পৃ: ৩০৫।) আর কাজী মোতাহার হোসেন,আবুল ফজল, মোতাহার হোসেন চৌধুরীরা ধর্মকে যুগের প্রেক্ষিতে বিশ্লেষণ করে গ্রহণ করার পক্ষে মত দিয়েছেন। তারা মনে করতেন, বাঙালি মুসলমান বহুদিন থেকেই যুগধর্ম উপেক্ষা করে সৃষ্টিশীলতার পথ থেকে দূরে সরে গেছে। বাঙালি মুসলমানের ধর্মবোধ ও উপলব্ধি, অধ্যাত্মচেতনা মোতাহার হোসেন চৌধুরীকে বেদনার্ত ও হতাশ করেছে। তার মনে হয়েছে, বাঙালি মুসলমান ধর্মকে যুক্তি-বুদ্ধি দিয়ে গ্রহণ করতে পারে না বলেই সৎ,সুস্থ,সুন্দর ও আনন্দময় জীবনযাপন করতে পারে না । আচারিক ধর্মের ডোবাতে হাবুডুবু খাচ্ছে বলে আমাদের সমাজ ধর্মান্ধ হয়ে উঠেছে, গভীর ধর্মবোধসম্পন্ন হতে পারেনি। অথচ ধর্মবোধ ছাড়া প্রকৃত ধর্মের মর্মমূলে পৌঁছানো সম্ভব নয়। তিনি অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় উচ্চারণ করেছেন:

‘ অনুষ্ঠানের মধ্যে ধর্ম নেই, আছে মর্মের উপলব্ধিতে।.. শাস্ত্র পঠনের আবশ্যকতা তার থেকে অনুপ্রেরণা গ্রহণ করবার জন্যই, তাকে হুবহু নকল করবার জন্য নয়। .. শাস্ত্রকে উপেক্ষা করতে বলছিনে, মানুষকে শাস্ত্রের কাজে না লাগিয়ে, শাস্ত্রকে মানুষের কাজে লাগানোর কথা বলছি। অন্তরের অন্তস্থল হতে উৎসারিত প্রেম আর সমস্ত বিশ্ব-ব্যাপী অখ- অদ্বৈতের অনুভূতিই ধর্ম।’



পশ্চাদপদ,দুর্দশাগ্রস্ত মুসলমান সমাজকে সেবা করার প্রত্যয় নিয়েই গত শতকের তৃতীয় দশকের মাঝামাঝিতে ‘ মুসলিম সাহিত্য সমাজে’র অভ্যুদয় তথা‘ বুদ্ধির মুক্তি’ আন্দোলনের সুচনা। রবীন্দ্রনাথের ধর্মবোধ তাদের অনেককেই অনুপ্রাণিত করেছে। রবীন্দ্রনাথের মতো তারাও মনে করতেন, ‘ যাহা বিশ্বাস্য তাহাই শাস্ত্র,যাহা শাস্ত্র তাহাই বিশ্বাস্য নহে।’ এতে যুক্তির সুরই প্রবলভাবে ধ্বনিত হয়েছে। রামমোহনেরও ধর্মে আস্থা ছিল, কিন্তু কোনোভাবেই যুক্তিবিরোধী ছিলেন না। ‘বুদ্ধির মুক্তি’ আন্দোলনের সংগঠকরা ধর্মকে যুক্তির সাথে মিশিয়ে এগিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কালের বৈরী প্রতিক্রিয়া পদে পদে বাধা সৃষ্টি করে তাদের সব স্বপ্ন সফল হতে দেয়নি। কারণ তৎকালীন বাঙালি মুসলমান তাঁদের মুক্ত ,স্বচ্ছ, প্রাগ্রসর চিন্তাধারা ধারণ করার মতো উপযোগী হয়ে উঠেছিল না। প্রসঙ্গত একটি বিষয় আমাদের স্বীকার করতে হবে যে, সাধারণ মানুষের মধ্যে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করে মানবতাবিরোধী তৎপরতা চালানোর জন্য ধর্মব্যবসায়ী ফেরেব্বাজরা যেমন দায়ী, তেমনই তথাকথিত প্রগতিশীল ও কট্টরপন্থী যুক্তিবাদীরাও ধর্মের বিরোধিতা করে ধর্মান্ধতাকে উসকে দিতে কম ভূমিকা রাখেনি।তারাই সাধারণের মাঝে ধর্মকে অধিকতর আকর্ষণীয় ও প্রয়োজনীয় করে তুলেছেন। কিন্তু শিখা গোষ্ঠীর লেখকরা ধর্ম ও যুক্তির মধ্যে সমন্বয় সাধন করে ইসলাম ধর্মের একটি যুক্তিসিদ্ধ ও শাশ্বত রূপ সাধারণের মধ্যে তুলে ধরার চেষ্টা করে গেছেন। ধর্ম ও যুক্তিকে দুই বিপরীত মেরুতে দাঁড় করিয়ে ধর্মযুদ্ধ করতে চাননি তারা। আধুনিক বাঙালি মুসলমানকেও ধর্ম ও যুক্তির মধ্যে দ্বন্দ্ব না বাধিয়ে, বরং উভয়ের মধ্যে সার্থক সংলাপের আয়োজন করেই এগোতে হবে। আর বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে সমন্বয়ের ক্ষেত্রেও সংলাপের আবশ্যকতা উপেক্ষা করা যাবে না।







মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.