নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

নবীন আনন্দ

আবদুল্লাহ আল আমিন

আবদুল্লাহ আল আমিন › বিস্তারিত পোস্টঃ

বাঙালির আত্ম পরিচয়ের সন্ধান ও রবীন্দ্রনাথ

০৫ ই আগস্ট, ২০১৪ রাত ১:৫৩

বাঙালির আত্ম পরিচয়ের সন্ধান ও রবীন্দ্রনাথ

আবদুল্লাহ আল আমিন



ধর্ম ও মত-পথের ভিন্নতা বাঙালির আত্ম পরিচয় ও চিরায়ত জীবন ভাবনাকে খন্ডিত, বিভক্ত ও সংকটাপন্ন করতে পারেনি কখনই। ধর্মপরিচয় অক্ষুন্ন রেখে এবং ধর্মের আবশ্যকীয় আচার-আচরণ পালন করে এ ভূখন্ডের অধিকাংশ মানুষ নিজেদের বাঙালি হিসেবে পরিচয় দিতে গৌরব অনুভব করেছে চিরকাল। ধর্ম নয়; ভাষা, শিল্প সাহিত্য, ইতিহাস-ঐতিহ্য এ ভূখন্ডের মানুষের আত্মপরিচয় নির্মাণে ভূমিকা রেখেছে। ১৯৪৭ সালে দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান সৃষ্টি হলে বাঙালি বিশেষ করে, বাঙালি মুসলমানের আত্ম পরিচয় এক গভীর সংকটের মুখোমুখি হয়। তারা বাঙালি না মুসলমান, অথবা কতখানি বাঙালি ও কতখানি মুসলমানÑ এই প্রশ্নে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে বেশ কিছু সময়ের জন্য। প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে কেউ কেউ নিজেদের বাঙালিত্ব অর্থাৎ সাংস্কৃতিক সত্তা বিসর্জন দিয়ে ইসলামের সর্বব্যাপক আবর্তের মধ্যে নিজেদের বিলীন করে বিশুদ্ধ মুসলমান হতে চেয়েছেন। আবার কেউ কেউ ইসলামের প্রভাবকে উপেক্ষা করে সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞানের আলোয় নিজেদের সত্তা ও অস্তিত্ব আবিস্কার করতে চেয়েছেন। অবশেষে বাঙালি সংস্কৃতির অবিনাশী শক্তিই দ্বিধাগ্রস্ত বাঙালি মুসলমানকে পথে র সন্ধান দেখায় এবং সে খুঁজে পায় তার আত্ম পরিচয়কে। বাঙালি মুসলমাননের আত্ম পরিচয়ের সংকট মোচনে বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬১’র রবীন্দ্র জন্ম শতবর্ষ উদযাপন গুরুত্বপূর্ণ মাইল ফলক হিসেবে কাজ করেছে। যে বাঙালি মুসলমান স্বদেশেই ছিল পরবাসী, নিজ সংস্কৃতি ঐতিহ্য উপেক্ষা করে বিদেশি বিভাষী সংস্কৃতি ও ভাবাদর্শের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েছিল বেশি করে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সেই বাঙালি মুসলমান ফিরে আসে মাটির কাছাকাছি । তার চিত্ত জেগে ওঠে স্বদেশ প্রেমের অগ্নিমন্ত্রে এবং বাঙালিত্বের মহিমায় তারা গর্ব অনুভব করতে শুরু করে। অবশ্য পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পর ১৯৪৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর কার্জন হলে আয়োজিত এক সাহিত্য সম্মেলনে বাংলার প্রখ্যাত মনীষী ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ গভীর সংস্কৃতিবোধ নিয়ে বলেছিলেন, ‘আমরা হিন্দু-মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি। মা প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারায় ও ভাষায় বাঙালিত্বের এমন ছাপ মেরে দিয়েছেন যে, মালা-তিলক টিকিতে কিংবা টুপি লুঙ্গি-দাড়িতে ঢাকার জোটি নেই।’ এই উপলব্ধি ও সচেতনতার উপর ভিত্তি করে ভাষা আন্দোলন, যুক্তফ্রন্টের বিজয়, বাষট্টির ছাত্র-আন্দোলন, রবীন্দ্র জন্মশত বার্ষিকী উদযাপন, ৬৬’র ছয়দফা আন্দোলন, ৬৭’র রমনার বটমূলে পহেলা বৈশাখ বর্ষবরণ উৎসব উদযাপনের মধ্য দিয়ে জন্ম লাভ করে এক নতুন বাঙালি জাতীয়তাবাদ। দ্বিজাতিতত্ত্ব ভিত্তিক ধর্মাশ্রয়ী জাতীয়তাবাদের বিপরীতে বাঙালি জাতীয়তাবাদ সর্ব অর্থেই ছিল ভিন্নতর ও নুতন। এই জাতীয়তাবাদের ভিত্তি ছিল এ ভূখন্ডের মানুষের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য যা সম্পূর্ণরূপেই লোকায়ত, ভূভিত্তিক ও সমন্বয়ধর্মী। তবে বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনা মজবুত হয় রবীন্দ্রনাথের শুভবুদ্ধি, মানবিক কল্যাণ চিন্তা ও আনন্দবাদী দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হয়ে। পাকিস্তানী শাসকদের বিরুদ্ধে বাঙালির স্বাধীকার লড়াই থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ হয়ে ওঠেন বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার মূল ভিত্তি, প্রেরণার বাতিঘর। পাকিস্তানী কৃর্তত্ববাদী রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে বাঙালির মুক্তির পথ রচনার সংগ্রামে তাঁর গান পরিণত হয় ধারালো হাতিয়ারে। সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়ে রবীন্দ্রনাথ এত প্রাসঙ্গিক ও প্রেরণাদায়ক হয়ে উঠেছিলেন যে, তার হাতে হাত রেখে বাঙালি মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে।



গত শতকের পঞ্চাশ ও ষাটের দশকজুড়ে বাঙালি মুসলমান চিত্তে এক অভূতপূর্ব পরিবর্তনের সূচনা হয়। ‘শুরু হয় বাঙালি মুসলমানের মোহমুক্তির পালা। বদরুদ্দীন উমরের ভাষায় বাঙালি মুসলমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন’ (সালাহউদ্দীন আহম্মদ: ‘বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ’। প্রথম আলো, ৩ এপ্রিল ২০০৯)। আর তা সম্ভব হয় বাঙালির অসাম্প্রদায়িক উদার, মানবতাবাদী সংস্কৃতি চর্চা ও প্রসারের ফলে। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে জাতি চেতনার উন্সেষ ঘটে তার পথ রেখা বেয়ে ফিরে আসে বাঙালির চিরায়ত গৌরব গাথা ও ঐতিহ্য। বাঙালির সংস্কৃতির সুকৃতি বৃহত্তর তাৎপর্যে ফুটে উঠতে থাকে জনচিত্তে। চৈতন্যের ভক্তিবাদ, লালনের মরমীবাদ, মুসলিম সূফি-সাধকদের আধ্যাত্মিক মানবতাবাদ, চ-িদাস- আবদুল হাকিমের সমন্বয়বাদী ভাবনা বাঙালি নতুন করে মূল্যায়ন করার সুযোগ লাভ করে। বাঙালি প্রমাণ করতে সক্ষম হয় যে, তারা ধর্মনিষ্ঠ, ধর্মান্ধ মৌলবাদী নয়। তারা ধর্মান্ধ ও রক্ষণশীল মৌলবাদীদের দ্বারা প্রচারিত ইসলামকে গ্রহণ করেনি, তারা গ্রহণ করেছে পীর- দরবেশ- সাধকদের দ্বারা প্রচারিত ইসলামকে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, মধ্যযুগ থেকে বাঙালির লোকজীবন এক মহৎ ও সহনশীল ভাবের দ্বারা উজ্জীবিত হয়েছে। পনের শতকের বৈষ্ণব কবি চ-ীদাস উচ্চারণ করেছিলেন ঃ

‘শুনহ মানুষ ভাই,/সবার উপরে মানুষ সত্য/তাহার উপরে নাই।’ এই অমর বাণীতে ছিল মানবতার জয়গান যা বাঙালির ভাবজগতে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। সতের শতকের মুসলিম কবি আব্দুল হাকিমের ‘নূর নামা’য় মানবতা ও অসাম্প্রদায়িকতার প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়। তিনি সকল ধর্মের সারাৎসারের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে গেয়েছেন :

‘য়াল্লা (আল্লাহ) খোদা গোঁসাই/সকল তান (তার) নাম/সর্বগুণে নিরঞ্জন প্রভু গুণধাম’।

বাঙালি সংস্কৃতির এই সমন্বয়বাদী ও অসাম্প্রদায়িক ধারাটি বহমান ছিল বিশ শতকের চল্লিশের দশকে পাকিস্তান আন্দোলনের পূর্ব পর্যন্ত। বস্তুতঃ নানামুখী রাজনৈতিক অভিঘাতের মধ্যেও বাংলার সমাজ ও লোকজীবনের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দিক ছিল ধর্মীয় সহনশীলতা। বাঙালির এই সহনশীল সংস্কৃতির উপর প্রথম আঘাত আসে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর তরফ থেকে। তারা বারবার আমাদের সংস্কৃতিকে রক্তাক্ত ও নির্মূল করতে চেয়েছে। বাঙালি সংস্কৃতি কে তারা ধর্ম বিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করে শাসকগোষ্ঠীর ফরমায়েসি সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করতে অপপ্রয়াস চালিয়েছে। তবে তাদের এই ঘৃণ্য অপতৎপরতা সফল হয়নি। বাঙালি তার সংস্কৃতির শক্তিতে বলীয়ান হয়ে প্রবল আত্মশক্তি নিয়ে পাকিস্তানী ধর্মান্ধ ও সাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম পরিচালনা করেছে। আর এ সংগ্রামে রবীন্দ্রনাথের গান, কবিতা, দর্শন হয়ে ওঠে লড়াই- সংগ্রামের ক্ষুরধার হাতিয়ার। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের বাঙালির মানসলোকে যে পরিবর্তন সূচিত হয়, তাতে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যের একটি বিশেষ ভূমিকা ছিল। আয়ুবখানের সামরিক শাসন ও নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের গান, কবিতা, নাটক এর পরিবেশনা বৃহত্তর সামাজিক রাজনৈতিক পটভূমিকায় এক বিশেষ অর্থময়তা ও তাৎপর্য খুঁজে পায়। সেই সময় ‘তাসের দেশ’ ও ‘রক্তকরবী’র মঞ্চায়ন সমাজে যে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের চেতনা সঞ্চার করে, তা যেন বিরুদ্ধ রাজনৈতিক প্রতিবেশের কারণে আরও তাৎপর্যময় হয়ে ওঠে। ষাটের দশকে তাঁকে ঘিরে সূচিত হয় বাঙালির সাংস্কৃতিক উজ্জীবন। এ জনপদের মানুষ যেন নতুন করে ফিরে পায় তাদের চিরায়ত বাংলা ও বাঙালিত্বকে। রবীন্দ্রনাথ ন্যাশনালিজম বিরোধী ছিলেন এবং একে তিনি সভ্যতার সংকট হিসেবে চিহ্নিত করেন, তথাপি রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে বাঙালির জাতিসত্তা ও চেতনা সুসংহত হয়। বলা নি®প্রয়োজন যে, রবীন্দ্রনাথ সারাজীবন মানবিকতা ও মনুষ্যত্বের জয়গান গেয়েছেন। সে কারণে তিনি মানবতাবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে জাতীয়তাবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, বর্ণবাদ, পুরুষতন্ত্রের ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। ‘ইম্পিরিয়ালিজম’ (১৯০৫) ‘ক্যাথলিক সোশ্যালিজম’ (১৮৯২), ‘আমেরিকানের রক্ত পিপাসা’ (১৮৯২) শীর্ষক প্রবন্ধে তিনি উগ্র জাতীয়তাবাদকে ধিক্কার জানিয়ে মানবতার অখ-তা ও সমগ্রতাকে নমস্কার জানিয়েছেন। বিশ্বসভ্যতা ও মানবের সাথে যোগসূত্র স্থাপন ছিল তার জীবন ও সাহিত্য সাধনার মূলমন্ত্র। তিনি সব সময় ন্যাশনালিজমের উগ্ররূপ ও ক্ষতিকর দিক পরিহার করতে চেয়েছেন। তিনি ভাল করেই জানতেন ফ্যাসিবাদের আক্ষরিক অর্থ যাই হোক, তা কোনভাবে মানব সভ্যতার জন্য হিতকর নয়। উগ্র জাতীয়তাবাদ যে ফ্যাসিস্টরূপ ধারণ করতে পারে তার বিস্তর দৃষ্টান্ত ইউরোপ সহ আফ্রো-এশীয়-লাতিন আমেরিকার দেশ গুলোতে রয়েছে। এজন্য রবীন্দ্রনাথ উগ্র জাতীয়তাবাদের সমালোচনা করেছেন নানাভাবে। তবে তিনি সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদী ধ্যান-ধারণা পরিহার করেননি কখনই। আর এই কারণে এডওয়ার্ড সাঈদ তাঁর ‘কালচার এন্ড ইম্পিরিয়ালিজম’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথকে তৃতীয় বিশ্বের লড়াকু ও বিপ্লবী তাত্ত্বিক ফ্রাৎন্স ফানো, এমে সেজেয়ারদের কাতারে দাঁড় করিয়েছেন। এরা সবাই আন্তর্জাতিকবাদের অনুগামী এবং জাতীয়তাবাদের উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী উপাদান সংগ্রহ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ চেঁচিয়ে বা চিৎকার করে উপনিবেশবাদের বিরোধীতা না করলেও একে ধিক্কার জানিয়েছেন নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে। ১৯৪১ সালে লেখা ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ উপনিবেশ বিরোধীতায় নেমেছেন প্রত্যক্ষভাবে। এজন্য প্রবন্ধটিকে উপনিবেশবাদ বিরোধীতার দলিল হিসেবে গণ্য করা হয়। এতে তিনি বলেছেন, ‘ইরেজকে একদা মানবহিতৈষী রূপে দেখেছি এবং কী বিশ্বাসের সঙ্গে ভক্তি করেছি! য়ুরোপীয় জাতির স্বভাবগত সভ্যতার প্রতি বিশ্বাস ক্রমে কী করে হারানো গেল তারই এই শোচনীয় ইতিহাস আজ আমাকে জানাতে হল।’ প্রত্যাশাভঙ্গের বেদনায় কাতর হয়ে তিনি আরও বলেছেন, ‘জীবনের প্রারম্ভে সমস্ত মন থেকে বিশ্বাস করেছিলুম য়ুরোপের অন্তরের সম্পদ ওই সভ্যতার দানকে। আর আজ আমার বিদায়ের দিনে সে বিশ্বাস একেবারে দেউলিয়া হয়ে গেল।’ গভীর বেদনায় কাতর হয়ে দুঃখ ভারাক্রান্ত চিত্তে জীবন সায়াহ্নে রবীন্দ্রনাথ এ ভাষণ দেন। এ ভাষণে তিনি যে দুঃখের কথা উল্লেখ করেন তা একেবারে ইহজাগতিক দুঃখ। এ দুঃখ কোন রোমান্টিক কবির ভাব বিলাস নয়। এ দুঃখ ‘মনুষ্যত্বের অন্তহীন প্রতিকারহীন পরাভবকে’ সহ্য করতে না পারার দুঃখ। এর সাথে সীমা অসীমের বিরহজনিত কোন দুঃখ নেই। কৈশোর থেকে তিনি মানুষের জাগতিক দুঃখ বেদনার সাথে পরিচিত ছিলেন। আর তা দুর করতে তিনি রচনা করেছেন অসংখ্য দুঃখ জাগানিয়া গান। স্পৃশ্য-অস্পৃশ্য দ্বন্দ্বে বিভক্ত সমাজের পটভূমিকায় দাঁড়িয়ে প্রবল দায়বোধ নিয়ে লেখেন ‘চ-ালিকা’। হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠাকে তিনি পবিত্র কাজ বলে জেনেছেন অমৃত্যু। আর এসব ধারণাকে পাথেয় করে পথ চলেছেন সারাজীবন। অহিংসা, অখন্ড মানবতা, সত্যানুরাগ, সম্প্রীতি সাধনা থেকে কখনও তিনি বিচ্যুত হননি। তাই তিনি উগ্র জাতীয়তাবাদ ও সম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন আমৃত্যু।



১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন ছাড়া রবীন্দ্রনাথ তেমন সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে অংশ নেননি। তবে ‘তিনি ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা ও মূল চেতনার একজন আবেগ প্রবণ প্রহরী।’ তার পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরও বাংলা রেনেসাঁর অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন। ‘গান্ধীবাদী রাজনীতির সুনির্দিষ্ট কিছু দিক, যেমনÑ পশ্চিমা সভ্যতার সামগ্রিক বর্জন এবং বিদেশি বস্ত্র ও পণ্যের বহ্নি উৎসব ইত্যাদি নিয়ে কবির সমালোচনা ছিল।’ (অক্তাভিও পাজ : ‘কবি ও সাধু’। প্রথম আলো ৮ মে ২০১১)। জাতীয়তাবাদের এই রক্তলোলুপ ও অহমিকাপূর্ণ দিকটা তিনি মেনে নিতে পারেননি কোনভাবেই। এজন্য তিনি মনে করতেন, ‘অশুভের মূল নিহিত আছে ন্যাশনালিজমের মধ্যে কিংবা এও বলা যায় যে এই অশুভের মূল রয়েছে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর কাঠামোর যা পুরাপুরি জাতীয়তাবাদ এবং এর রক্তাক্ত ছায়া সাম্রাজ্যবাদের জন্ম দেয়।’ (হোর্হে লুইস বোর্হেস: ‘মন্তব্য মালা’। প্রথম আলো ৮ মে ২০১১)। জাতীয়বাদের রক্তাক্ত ছায়া থেকে সৃষ্ট সাম্রাজ্যবাদ মানুষ কে সৃজনশীল চেতনা থেকে পথভ্রষ্ট করে দেয় বলে রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন। পুঁজিবাদ যেমন কাউকে দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রের মধ্যে নিক্ষেপ করে আর কাউকে করে ক্লান্ত । তেমনি সাম্রাজ্যবাদ উৎপীড়ক ও উৎপীড়িত উভয়কেই হীন করে দেয়। জর্জ বার্নাড শ পূঁজিবাদকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন আর রবীন্দ্রনাথ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন সাম্রাজ্যবাদকে। তারপরও রবীন্দ্র সৃষ্টি সম্ভার বাঙালির জাতি চেতনা ও সত্তাকে সুসংহত করতে অসামান্য ভূমিকা পালন করেছে। পাকিস্তানী কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রযন্ত্রের চাপিয়ে দেওয়া মত ও দর্শনের বিপরীতে রবীন্দ্রনাথের গান, কবিতা, দর্শন, বাণী হয়ে ওঠে শাণিত হাতিয়ার। ধর্মীয় উন্মত্ততা, কুপমন্ডুকতা, অন্ধত্ব, গোঁড়ামি, ভেদবুদ্ধির বিরুদ্ধেই তো তিনি মানবতার জয়গান গেয়েছেন। ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, সম্প্রদায়ের নামে মানুষে মানুষে যাতে কোন বিভেদ সৃষ্টি না হয়, তা ছিল তার আরাধ্য। সম্প্রীতির এই মন্ত্র তিনি পেয়েছিলেন বাংলার বাউল সমাজের জীবন চর্যা ও দর্শন থেকে। ফলে যা কিছু পাকিস্তানী ভাবধারার অনুগামী তাই ছিলো রবীন্দ্র সাহিত্যের প্রবল বিরোধী। পাকিস্তানী আমলে রবীন্দ্রনাথ কে ঘিরে এক অভূতপূর্ব সাংস্কৃতিক জাগরণের সূচনা হয়, আর এই সাংস্কৃতিক জাগরণ বাঙালি জাতিসত্তাকে সুসংহত করে।

বাঙালির জাতি চেতনা বিকাশে তাঁর গান পালন করে উজ্জীবনী ভূমিকা। গানই রবীন্দ্রনাথকে সাধারণ মানুষের কাছাকাছি নিয়ে আসে। সাধারণতঃ কবিতা, প্রবন্ধ বা চিন্তাশীল রচনা শিক্ষিত সমাজের বাইরে খুব বেশি যেতে পারে না। কিন্তু গানের আবেদন তো সার্বজনীন, পন্ডিত-অপন্ডিত, সাক্ষর-নিরক্ষর নির্বিশেষে সকলেই গানের বাণী ও সুর মুর্চ্ছনায় আলোড়িত হয়। তাঁর গানও বাঙালি চিত্তকে আলোড়িত করতে কী অসামান্যই না ভূমিকা পালন করেছিল, তা বলাই বাহুল্য। পাকিস্তানী জামানায় এদেশের মানুষ একুশে ফেব্র“য়ারির মিছিলে রবীন্দ্রনাথের গান গেয়ে প্রভাত ফেরি করেছে। ‘‘তখনকার প্রধান গানটি ছিলÑ ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’। শহিদ দিবস উপলক্ষে অনুষ্ঠান মঞ্চে একটি গান গাওয়া হতো:

কে এসে যায় ফিরে ফিরে আকুল নয়ন নীরে।/কে বৃথা আশা ভরে চাহিছে মুখ পরে।/সে যে আমার জননী রে।।/ কাহার সুধাময়ী বাণী মিলায় অনাদর মানি।/কাহার ভাষা হায় ভুলিতে সবে চায়। সে যে আমার জননীরে।।”

(সানজীদা খাতুন: ‘মুক্তি সংগ্রাম, সংস্কৃতি ও রবীন্দ্রনাথ।’ উত্তরাধিকার, বৈশাখ’ ১৪১৮। বাংলা একাডেমী, ঢাকা। পৃষ্ঠা-২৩)।

ব্রিটিশ বিরোধী স্বদেশি আন্দোলনের প্রেক্ষিতে রচিত এ গানটি বাঙালির চিত্তে এক মহৎ ভাবের অনুরণন সৃষ্টি করে। আর সেই মহৎ ভাবের পথ বেয়ে বাঙালির মুক্তির সংগ্রাম এগিয়ে যায় আরও একধাপ। একাত্তরে যখন বাঙালির ওপর নেমে আসে পাকিস্তানী বর্বরতা, হত্যা আর ধ্বংসের তান্ডব, তখন এদেশের শিল্পীরা রবীন্দ্রনাথের গান গেয়ে প্রতিরোধ সংগ্রামে নামে এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্ব জনমত গড়ে তোলে। তখন গাওয়া হতো:

‘দেশে দেশে ভ্রমি তব দুখ গান গাহিয়ে/নগরে প্রান্তরে বনে বনে।/অশ্র“ ঝরে দু’নয়নে/পাষাণ হৃদয় কাঁদে/সে কাহিনী শুনিয়ে।’

আমাদের শিল্পীরা এ গান শুনিয়ে বাঙালি জাতিকে দেশপ্রেম বোধ ও মানবিক চেতনায় উদ্দীপ্ত করে তোলে। আর এভাবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ পায় ভিন্ন মাত্রিক তাৎপর্য যা সর্ব অর্থেই মানিবক। সেই সাথে বাঙালি সংস্কৃতির পুনরুত্থান ঘটে, অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি শক্তিশালী হয়। তবুও আমাদের এ ভূখ-ে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির উত্থান ও ধর্মীয় উন্মত্ততার ফলে বাঙালি মুসলমান এলিটদের একটি বিরাট অংশ রবীন্দ্রনাথকে স্বাভাবিক ভাবে গ্রহণ করতে পারেন নি। চল্লিশ, পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের রাজনীতির ডান ও বামপন্থী তাত্ত্বিক ও অ্যাক্টিভিস্টরা সুস্থবোধ ও মানিবক চেতনার আলোকে তাঁকে যথাযথ ভাবে বরণ করতে পারেন নি। তবে উদার, অসাম্প্রদায়িক ও মানবতাবাদী, কবি, শিল্পী, বুদ্ধিজীবীরা রবীন্দ্রনাথকে গ্রহণ করে নেন দ্বিধাহীন চিত্তে। দুই বাংলার মার্কসবাদী তাত্ত্বিকরাও রবীন্দ্রনাথ কে খারিজ করতে চেয়েছে সাহিত্য বির্তকের সুবাদে। এদের মতে, ‘যে সাহিত্যে শোষিত মানুষের স্বীকৃতি নেই ভাবী সমাজের ইঙ্গিত নেই তাকে তারা বর্জনের পক্ষপাতী। .........রামমোহন থেকে রবীন্দ্রনাথ সমগ্র উনিশ শতকের সাহিত্যই একান্তভাবে বুর্জোয়া সৃষ্টি। সুতরাং বর্জনীয় (সুধীর রায় চৌধুরী : ‘মার্কসবাদী রবীন্দ্র সমালোচনার ইতিহাস’। নতুন সাহিত্য, বৈশাখ আষাঢ় ১৩৬৮, কলকাতা। পৃ: ১৫০)।

তৎকালীন পূর্ববঙ্গের বামপন্থীরাও রবীন্দ্রনাথ কে খারিজ করতে চেয়ে ঐ একই ভাবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ হলে আয়োজিত এক সাহিত্য সভায় মুনীর চৌধুরী, আখলাকুর রহমান, আবদুল্লাহ আল মুতী প্রমুখ তরুণ তুর্কিরা রবীন্দ্রনাথকে ‘প্রতিক্রিয়াশীল ও বুর্জোয়া লেখক’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তবে কমিউনিস্ট পার্টির এই অ্রতিবিপ্লবী অংশের এই মূল্যায়ন বেশিদিন স্থায়ী হয়নি, পশ্চিমবঙ্গের পার্টি নেতাদের মত পূর্ববঙ্গের নেতারাও এই ধরণের মূল্যায়ন প্রত্যাহার করে নেয়। কিছুদিন পর ঢাকার মাহবুব আলী ইনস্টিটিউটে অনুষ্ঠিত রবীন্দ্র জয়ন্তীর সভায় নাট্যকার মুনীর চৌধুরী বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অধিকার থেকে পূর্ব বাংলার বাঙালিদের বঞ্চিত করার এক গভীর ষড়যন্ত্র চলছে। (সরলানন্দ সেন, ঢাকার চিঠি)। এই ষড়যন্ত্রের আভাস মেলে ১৯৫১ সালে ‘মাহে নও’ পত্রিকায় প্রকাশিত সৈয়দ আলী আহসান এর এক প্রবন্ধে। তিনি লেখেন : ‘মনে রাখতে হবে যে, পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছিল স্বাতন্ত্র্যবোধের উপর ভিত্তি করে। .............. আমাদের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখবার এবং জাতীয় সংহতির জন্য যদি প্রযোজন হয়, হযতোবা আমরা রবীন্দ্রনাথকেও অস্বীকার করতে প্রস্তুত রয়েছি। সাহিত্যের চাইতে রাষ্ট্রীয় সংহতির প্রয়োজন আমাদের বেশী (সৈয়দ আলী আহসান: ‘ পূর্ব পাকিস্তানের বাংলা সাহিত্যের ধারা’। মাহে নও, আগস্ট ১৯৫১। পৃ: ৫৩-৫৪)।

পাকিস্তান নামক উদ্ভট ধর্ম রাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়াশীল শাসকরা জাতীয় সংহতির দোহাই পেড়ে কেবল রবীন্দ্রনাথকে নয়, পূর্ব বাংলার মানুষের মাতৃভাষা বাংলাকে অস্বীকার করতে চেয়েছে। পাকিস্তানবাদী বুদ্ধিজীবীদের প্রতিনিধি হিসেবে সৈয়দ আলী আহসান যে প্রস্তুতির কথা বলেন তাই সিদ্ধান্ত আকারে প্রকাশ পায় ১৯৬৭ সালের ২১ জুন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে খাজা শাহাবুদ্দিনের দেয়া ভাষণে। তিনি বলেন, ‘‘ভবিষ্যতে পাকিস্তান রেডিও থেকে পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধে পরিপন্থী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান প্রচার করা হবে না এবং এ ধরনের অন্যান্য গানের প্রচারও কমিয়ে দেওয়া হবে। ’’ পাকিস্তানবাদী সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন শাসক গোষ্ঠী ও তাদের সুবিধাভোগী বুদ্ধিজীবীরা রবীন্দ্রনাথকে বিসর্জন দিয়ে পাকিস্তানকে রক্ষা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাদের সেই প্রয়াস সফল হয়নি। ইতিহাসের পিছনের দিকে মুখ ফেরানোদের বক্তব্য এদেশের মানুষ গ্রহণ করেন নি। ২৫ জুন ১৯৬৭ দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকায় প্রকাশিত যৌথ বিবৃতিতে ১৮ জন বৃুদ্ধিজীবী স্পষ্ট ভাবে জানিয়ে দেন যে, ‘রবীন্দ্রনাথ বাংলা ভাষা ও পাকিস্তানীদের সাংস্কৃতিক সত্তার অবিচ্ছেদ্য অংশ’। ১৯৬৮ সালের ৫ জুলাই আবুল হাশিম বলেন, ‘‘ যাহারা ইসলাম ও পাকিস্তানী আর্দশের নামে রবীন্দ্র সঙ্গীত বর্জনে ওকালতি করিতেছে, তাহারা শুধু মুর্খ নহেন, তাহারা দুষ্টবুদ্ধি প্রণোদিত ও তাহারা না বোঝেন রবীন্দ্রনাথ, না বোঝেন ইসলাম।’’ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্র“য়ারি রেসকোর্স ময়দানের বিশাল জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘আমরা রবীন্দ্রনাথের বই পড়িবই, আমরা রবীন্দ্র সঙ্গীত গাহিবই এবং রবীন্দ্র সঙ্গীত এদশে গীত হইবেই।’

এভাবে রবীন্দ্রনাথ বাঙালি মুসলমানের চিত্তে ফিরে আসে, ফিসে আসে বাঙালির মুক্তি সংগ্রাম ও জাতি চেতনা নির্মাণের সংগ্রামে অশেষ প্রেরণার উৎস হয়ে। ১৯৬৯’র ৬ দফা আন্দোলনের সময় তার গান আমাদের বরাভয় মন্ত্র হয়ে উঠেছিল, গানের ভিতর দিয়ে বাঙালি ফিরে পেয়েছিল তার হারানো বাংলাকে। রবীন্দ্রনাথের সুরের আগুন ছড়িয়ে পড়ে শহর থেকে গ্রামে, বিশ্ববিদ্যালয়ের বুদ্ধিবৃত্তিক পরিমন্ডল থেকে গ্রামের চায়ের আড্ডায়। গানের ভিতর দিয়ে বাঙালি এমন ভুবনের সন্ধান পেল যে, ‘আমার সোনার বাংলা’ হয়ে উঠল আত্মসত্তা নির্মাণের প্রতীক এবং স্বাধীন বাসভূম প্রতিষ্ঠার প্রতি অঙ্গীকারের প্রকাশ। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষিতে রচিত এ গান ভিন্ন বাস্তবতায় পেল এক নতুন অর্থময়তা। রবীন্দ্রনাথ আত্মশক্তির মাধ্যমে ভেতর থেকে স্বদেশকে নির্মাণের কথা বলেছিলেন, এ গান জাতিকে সেই স্বদেশ সৃষ্টির প্রেরণা যুগিয়েছিল। রুশো, ভলতেয়ার, দিদেরোর বাণী ফরাসি বিপ্লবে সংগ্রামীদের অনুপ্রাণিত করেছিল। আর রবীন্দ্রনাথের গান, কবিতা, নাটক বাঙালির শুকনো গাঙে জোয়ার এনেছিল। খ-িত ভাবনার অবসান ঘটিয়ে বাঙালির জাতি চেতনতাকে সংহত করেছিল। সেই চেতনার অগ্নিমশাল জ্বালিয়ে রক্ত সমুদ্র মন্থন করে বাঙালি স্বাধীন জাতি রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছিল একাত্তরে। সংকট-সমস্যায় রবীন্দ্রনাথ ছিলেন আমাদের চিরসখা, চির বন্ধু, চির নির্ভর। আগামী দিনের সচ্ছল ও আলোকিত বাংলাদেশ গড়ার সংগ্রামে রবীন্দ্রনাথকে অবশ্যই অবলম্বন ও সারথি হিসেবে প্রয়োজন হবে।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.