নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

নবীন আনন্দ

আবদুল্লাহ আল আমিন

আবদুল্লাহ আল আমিন › বিস্তারিত পোস্টঃ

অধ্যাত্ম সাধক ও গায়ক গোলাম ঝড়ু শাহ

০৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ রাত ১২:০৮

অধ্যাত্ম সাধক ও গায়ক গোলাম ঝড়ু শাহ



লালন সাঁই, পাঞ্জু শাহ, দুদ্দু শাহ, গোসাঁই গোপাল নির্মিত মরমি জগৎ ও ভাবনাকে গানে গানে তুলে ধরতে যে আধ্যাত্ম সাধক ও গায়ক অনন্য ভূমিকা পালন করেছেন, তিনি মেহেরপুরের গোলাম ঝড়ু শাহ ১৯২১Ñ১৯৯৮)। তিনি ছিলেন একাধারে গায়ক, সাধক, পদকর্তা ও মরমি দর্শনের বড় মাপের ভাষ্যকার। ঝড়ু শাহ’র জন্ম চুয়াডাঙ্গার আলোকদিয়া গ্রামের এক হিন্দু ব্যাধ পরিবার। জাত-ধর্ম ত্যাগ করে তিনি জোনাব আলী শাহ’র নিকট ভেক খিলাফত গ্রহণ করেন। জোনাব আলীর গুরু হরিয়াঘাটার খোদা বকসো শাহ আর খোদা বকসের গুরু লালনের জ্ঞানী শিষ্য মনিরুদ্দীন শাহ। মুলাজান ফকিরাীনার সাথে বিয়ে হওয়ার সুবাদে ঝড়ু শাহ’র মেহেরপুরে আসা। গত শতকের সত্তর দশক থেকে মৃত্যু অবধি তিনি মেহেরপুরের যাবদপুর গ্রামে বসবাস করেন। মৃত্যুর পর যাবদপুর গ্রামে সমাহিত করা হয়। ঝড়ু শাহ গান শিখেছেন সাধক ও গায়ক বেহাল শাহ’র কাছে। তাঁর কাছে ঝড়ু শাহ গান বাঁধাও শিখেন। বেহাল শাহ নাকি বলতেন ‘ভাবতে ভাবতে ভাবের মানুষ উদয় হয়।’। দেহতত্ত্ব, লীলাতত্ত্ব, গোষ্ঠতত্ত্ব, নবিতত্ত্ব, বেলায়েত তরিকত পর্যায়ের শতাধিক গান তিনি রচনা করেন। তাঁর সেবাদাসী মুলাজান এবং তিনি দুজনেই ছিলেন জাত বাউল। আর তাই ভিক্ষাবৃত্তিই ছিল জীবিকার মূল উৎস। ‘প্রেম করিয়া সুখ পাবা না মনের মানুষ বিনে’ ঝড়ু শাহ রচিত এই লীলার গান গেয়ে মুলাজান গাঁয়ে গাঁয়ে ভিক্ষা করতো। ঝড়ু শাহ’র গানের মধ্যে লীলার গান, দেহতত্ত্ব, প্রেমতত্ত্বের গানগুলোই জনপ্রিয়তা লাভ করেছে বেশি। এসব গানে লালন সাঁই, দুদ্দু শাহ, হাওড়ে গোঁসাই, উজল চৌধুরী, দেলবার সাঁই এর প্রভাব সুস্পষ্ট। ঝড়ু শাহ’র সঙ্গীত শিষ্য তৌহিদ সরকারের কাছ থেকে পাওয়া একটি প্রেমতত্ত্বের গানে ঝড়ু বলেছেনঃ

‘পিরিতে হয় পাগল পারারে আরে ও প্রেম করে যারা।।

না বুঝিয়ে প্রেম করিয়ে কাঁচা বাঁশে ঘুনে ধরা।।

পিরিতে যার এত আশা, ভেঙ্গে যায় তার আশার বাসা,

ঘটে কী দুর্দশা।

যেমন জল বিনে চাতকের দশা, প্রাণ থাকতে জানে মরা।।

প্রেম করো ভাই আত্মত্যাজে, স¦ার্থ-নাই যার প্রেমের মাঝে।

প্রেম দেখ ভজে।

প্রেমের রীতি শেখো পতঙ্গের কাছে, আগুন দেখলে পুড়ে সারা।

প্রেমের মানুষ আলোকলতা, নাইকো মূল তার নাইকো পাতা,

ধরে কী ক্ষমতা।

অধীন ঝড়ুর প্রেম হয় গো বৃথা, প্রেমে হয়ে দিশেহারা।।

বাউল সাধনায় গুরুর স্থান সবার উর্দ্ধে। তিনি সার্বভৌম শক্তির আঁধার। ঝড়ু শাহ মনে করতেন, স্রষ্টা থেকে দীক্ষাগুরু পর্যন্ত একই ধারা প্রবহমান। তাঁর গুরুবাদ একদিকে তন্ত্র অপরদিকে সূফিবাদ দ্বারা প্রভাবিত। তিনি মুসলমান পরিবারে জন্ম গ্রহণ না করেও অনায়াসে আরবি, ফারসি শব্দ ব্যবহার করেছেন গুরুতত্ত্বের উপর রচিত বিভিন্ন গানে। সঙ্গীত গুরু বেহলা শাহ, দীক্ষা গুরু জোনাব আলী শাহ, আলমডাঙ্গার একুশে পদক জয়ী খোদা বকসো শাহ সহ অসংখ্য মরমী সাধকদের সান্নিধ্য ও সাহচর্য তাঁকে আরবি ফারসি শব্দ রপ্ত করতে সাহায্য করেছে। তিনি গুরু সম্পর্কে বলেন:

মুর্শিদ তুমি আমার ভরসা।।

অকুল পাথারের পরে পাই যেন দিশা।।

প্রথম যৌবনের মাঝে, তোমাকে রেখেছি সাজে,

দ্বিগুন শক্তির আশে, না হয় নৈরাশ।।

মুর্শিদ ধর আমায় শক্ত করে, পিছলে যেন না যায় পড়ে

তুমি বিনে এ সংসারে কার আশা।।

সুখে দুখে রেখ পদে, ফেলনা যেন ঐ বিপদে

দীন ঝডুকে রেখ হৃদে, মিটাও প্রেম পিপাসা।

লালন সাঁই এর একটি গানে আছেঃ গুরু নাম সুধা সিন্ধু/পান করে তাহাতে বিন্দু/সখা হবে দীনবন্ধু/তৃষ্ণা ক্ষুধা রবে নারে’। লালনের গানে মুগ্ধ ও মগ্ন সাধক ঝড়ু শাহও গেয়েছেন:

ও দীনবন্ধু, পর্দার বিন্দু দিয়ে সিন্ধু করো পার।

তোমার অধম ডাকে পড়ে কূপে

শুনে কী আর শোন না আর।।

তোমার নামের মহিমা বেদে নাই সীমা

কী দিবো তুলনা জগৎ মাঝার।।

তোমার নামের জোরে যাবো তরে

এই ভব কারাগার।।

তোমার অধম তারণ নাম, তুমি গুণের গুণধাম

এই পাপীকে হইয়ো বাম, বল কে তরাবে আর।।

মাফ করো অপরাধ আমার মাথায় দিয়ে

তুমি তো দীননাথ দিন যায় আমার।।

অধীন ঝড়ু বলে জোনাব চাঁদ এর তলে,

কিঞ্চিৎ স্থান দাও একবার।।

ঝড়ু শাহ ছিলেন জনপ্রিয় গায়ক ও বয়াতি। দোতারায় সুর মুর্ছনা তুলে আর গান গেয়ে সারারাত আসর কিংবা আখড়া মাতিয়ে রাখতে পারতেন। যাবদপুর কালি শাহ’র আখড়ায় তিনি রাতের পর রাত পালা গেয়েছেন এবং দূর দূরান্তের সাধু দরবেশরা ছুটে এসেছেন এ আখড়ায় কেবল তার দোতারার সুর মুর্ছনা আর গান শ্রবণের জন্য। ঝড়ু শাহ এর শিষ্য-মোহিদুল ইসলাম এর নিকট থেকে সংগৃহীত ঝড়ুর কয়েকটি গানঃ



১.

মন মুর্শিদ হয়ে দেখি মুরিদ করতেন।

কী কারণে এই তনে মুর্শিদ ভজার প্রয়োজন।।

কোন তণ মুর্শিদের বলকা বলো

কোন মুর্শিদ হয়ে দাঁড়াল।

মনের মুর্শিদ কেবা হ’ল

বলো দেখি মহাজন।।

কোন তণে অজদ ভান্ডার আছে,

কী কী নাম বলো আমার কাছে

জাহের কি বাতন মাঝে,

শুনবো মনের আছে ভ্রম।।

শুনেছি দেহের অবাক বিধান,

সপ্তম মাসে মহামন্দ্র করে দান।

আবার কেন বায়েত বন্দির নাম

বল এহার বিবরণ।।

অজদ বিচে কয়টি আজদ রয়

কোন অজুদের কি নাম হ’ল বল মহাশয়।

দীন ঝড়ু বলে জোনাব চাঁদ সাঁই

খুলে বলো করে বর্ণন।।



২.

দেখনা খুঁজে অজদ মাঝে মুর্শিদ মূলাধার।

সেই জন্যে এ ভুবনে মুর্শিদ ভজার দরকার।।

মনের গুরু কল্পতরু শাস্ত্রে লেখা

সবার গুরু তিনি একা সেই চালায়

এ অজদ ভান্ডার।।

চারিতন আছেরে মন অজদ ভিতরে

লতিফা, কছিব, বাকা ফাণা দেখ বিচারে।

এসব বলতে পারে খন্ড খন্ড করে,

চেতন মুর্শিদ আছে যাহার।।

অন্যান্য সাধকদের মতো ঝড়ু শাহ মানব দেহকে ব্রহ্মান্ডের ক্ষুদ্র সংস্করণ মনে করতেন। দেহের উপাসনাকে তিনি সর্বসার মনে করেছেন। তিনি বলেছেনঃ

পাঁচটি আত্মা বেদান্তরে হয় লিখন

জীবাত্মা, ভূত আত্মা, আর আছে পরমাত্মা

আত্মারাম আরো আত্মরামেশ্বর স্থানে

বসায়ে সৃষ্টি ধর,

আত্মার সাধন আগে কর-

পরমাত্মা হয় মূলধারা-আরেক নাম তার হয় অধর

হাওয়াতে জল ফেরে।।

দ্বৈত-অদ্বৈত দেহ দুটি হয়

জীবাত্মা চতুর্দলে, ভূতাত্মা ষড়দলে-দশম দলে পরমাত্মা জানো,

দ্বাদশ দলে হৃদ কমলে আত্মারাম।

ষোড়শ দলে পদ্ম পরে আত্মা রামেশ্বর বিরাজ করে

উজল স্থান সহস্রারে আহলাদিনী শক্তি ধরে।।

দেহতত্ত্বের আরেকটি গানঃ

কই হল মোর তাস খেলা

বিবি দেখে আপ্ত সুখে হয়েছি বেভুলা।।

না জেনে খেলার ধারা, সাধের গোলাম গেল মারা,

করে অবহেলা।।

হাতে ছিল পিরাই দশ, সেও তো তাই নাই বশ,

টেক্কা কালুবালা।।

যখন খেলি রুইতন, হরতন, সব সময় করে হরণ,

হয়ে মাতুয়ালা।

সাধের ইস্কাপন, সদা সর্বক্ষণ, ঘটায় বিষম জ্বালা।।

ইস্তক কিস্তির খেলা হাতে, গুণে গুণে পিঠ তুলিতে,

হয়ে যায় আলাঝালা।।

জোনাব চাঁদ কয় ঝড়ু পাগলার বুদ্ধি নাই এক তোলা।।

১৯৯৮ সালে ঝড়– শাহ দেহত্যাগ করেন এবং মৃত্যুর পর তাকে যাদবপুর গ্রামে সূফিধারা মতে সমাহিত করা হয়। ঝড়ু শাহ’র তিরোধানের পর দেড় দশক পেরিয়ে গেছে, কিন্তু মেহেরপুরের আউল-বাউল সাঁই, দরবেশ এবং সঙ্গীত পিপাসু মানুষ তাঁকে ভোলেনি। সাঁইজির গানের পাখি বেহাল শাহ, মকছেদ শাহ, খোদা বকসো শাহ, মহেন্দ্র গোসাঁইকে যেমন ভোলেনি, তেমনি ভুলবে না লালনে নিবেদিত জাত বাউল ঝড়ু শাহক।ে

মন্তব্য ১ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ০৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ রাত ১২:০৯

করিম মিয়া বলেছেন: লেখক: ডক্টর আহমদ শরীফ
..‍'কামাচার বা মিথুনাত্মক যোগসাধনাই বাউল পদ্ধতি। বাউল সাধনায় পরকীয়া প্রেম এবং গাঁজা সেবন প্রচলিত। বাউলরা বিশ্বাস করে যে, কুমারী মেয়ের রজঃপান করলে শরীরে রোগ প্রতিরোধক তৈরি হয়। তাই বাউলদের মধ্যে রজঃপান একটি সাধারণ ঘটনা। এছাড়াও তারা রোগমুক্তির জন্য স্বীয় মূত্র ও স্তনদুগ্ধ পান করে। সর্বরোগ থেকে মুক্তির জন্য তারা মল, মূত্র, রজঃ ও বীর্য মিশ্রণে প্রেমভাজা নামক একপ্রকার পদার্থ তৈরি করে তা ভক্ষণ করে। একজন বাউলের একাধিক সেবাদাসী থাকে। এদের অধিকাংশই কমবয়সী মেয়ে। (বাংলাদেশের বাউল : পৃষ্ঠা ৩৫০, ৩৮২)

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.