![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ধর্ম ও দর্শন চর্চায় মেহেরপুর
আবদুল্লাহ আল আমিন।
ভাবপ্রবণ ও কল্পনাপ্রিয় বাঙালির যাপিত জীবনের সাথে ধর্মের সম্পর্ক নিবিড়। ধর্ম তার শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতি, সমাজ-সভ্যতা, রাষ্ট্র বিনির্মাণে ভূমিকা রেখেছে। তবে সে ধর্ম বিশুদ্ধ ইসলাম, ব্রাহ্মণ্য কিংবা বৌদ্ধ নয়, বরং সর্ব ধর্মের মিলনজাত রূপান্তরিত লোকধর্মই তার জীবন ও সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করেছে। বাঙালির সুদীর্ঘকালের সাংস্কৃতিক ইতিহাস ও ঐতিহ্যের দিকে দৃষ্টিপাত করলে আমরা দেখব, নানা ধর্ম, বিশ্বাস ও লোকাচার এবং দর্শনের প¬াবনে সমৃদ্ধ হয়েছে আমাদের সংস্কৃতি ও আধ্যাত্মিক চিন্তা।
‘সে (বাঙালি) তর্ক করে, যুক্তি মানে, কিন্তু হৃদয়বেদ্য না হলে সে জীবনে আচরণ করে না। তাই সে বৌদ্ধ ব্রাহ্মণ্য ও ইসলাম ধর্ম মুখে যতটা গ্রহণ করেছে, অন্তরে ততটা মানেনি। সে তার জীবন জীবিকার অনুকূল করে রূপান্তরিত করেছে ধর্মকে। এভাবে দেশে লৌকিক ধর্মই কালে কালে বাঙালির জীবন নিয়ন্ত্রণ করেছে।’ (আহমদ শরীফ: বাংলা বাঙালী বাঙালীত্ব, কলকাতা ১৯৯২, পৃষ্ঠাঃ ১৩১৪)
অবিভক্ত নদীয়ার প্রাচীন জনপদ হিসেবে মেহেরপুরের লোকজীবন, আধ্যাত্মিক চিন্তা, দর্শনচর্চা ও সংস্কৃতিতে নদীয়ার লোকধর্মগুলোর রয়েছে অনিবার্য প্রভাব। এসব লোকধর্মের প্রভাবে এ জনপদে বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান, রীতিনীতি গড়ে উঠেছে। ইতিহাস অনুসন্ধান করলে জানা যায়, ‘মহামানবের মিলন তীর্থ’ এই নদীয়ায় বাংলার অধিকাংশ লোকধর্মের উদ্ভব ও বিকাশ। ৩৪১৪ বর্গমাইল আয়তনের (১৮৭১ খ্রিঃ আদম শুমারী অনুযায়ী) এই জেলায় কর্তভর্জা (কল্যাণীর ঘোষপাড়া) সাহেবধনী (চাপড়া), বলরামী (মেহেরপুর), ‘খুশি বিশ্বাসী (দেবগ্রাম ভাগা), বৈষ্ণব (নবদ্বীপ), লালনিক বাউল (ছেঁউড়িয়া)দের সাধনক্ষেত্র অবস্থিত। এই নদীয়াতেই পঞ্চদশ শতকের শেষ দিকে নববৈষ্ণব ধর্মের প্রাণপুরুষ শ্রীচৈতন্যদেবের (১৪৮৬-১৫৩৩) আবির্ভাব। তিনি মানুষকে নতুন করে বাঁচার পথ দেখিয়েছিলেন, বলেছিলেন মানুষে মানুষে কোন ভেদ নেই, মানুষ অমৃতের সন্তান। তার প্রেম ভক্তিবাদ ষোড়শ শতকে নদীয়ার মেহেরপুরকে তো বটেই, সব বাঙালির চিত্তে ভাবের জোয়ার এনেছিল, সেই ভাবজোয়ারে বাঙািল ফিরে পেয়েছিল অভূতপূর্ব প্রাণশক্তি। চৈতন্যের জ্ঞান, ভক্তি ও মানবতার বাণী অবল¤¦নে পার্ষদেরা রচনা করেন চৈতন্যচরিতামৃত, চৈতন্যমঙ্গল প্রভৃতি গ্রন্থ ও অজস্র বৈষ্ণব ও পদাবলী। পরবর্তী প্রায় দুশ বছর চলে ভাবের জোয়ার, এই জোয়ারে ভাসে নদীয়ার মেহেরপুর, ভাসে বাংলাদেশ। চৈতন্যের ভাবরসের ধারায় সিক্ত মেহেরপুর নিবাসী কবি ও সাধক জগদীশ গুপ্ত রচনা ও সংকলন করেন ‘শ্রী চৈতন্যচরিতামৃত’, ‘লীলাস্তবক’, এবং ‘শ্রীচৈতন্য লীলামৃত’ প্রভৃতি বৈষ্ণব গ্রন্থ। তাঁর উত্তরসূরী কবি রমনীমোহন মলি¬ক রচনা করেন চন্ডীদাস, জ্ঞানদাস, বলরাম দাস প্রভৃতি। চৈতন্যকে ‘অনন্তরূপ অনন্তাবতার’ জেনে এ অঞ্চলের অসংখ্য নামগোত্রহীন পদকর্তা বৈষ্ণবপদাবলী রচনা করেছেন। বৈষ্ণবীয় ভাবরসের ধারাটি মেহেরপুরে আজও বহমান আছে। চৈতন্য প্রবর্তিত রসের ধারাটি টিকিয়ে রাখার জন্য এ অঞ্চলের বৈষ্ণব ও রসসাধকগণ মেহেরপুর শহরের কেন্দ্রস্থলে প্রতিষ্ঠা করেন হরিসভা মন্দির, এই মন্দিরে নিত্য চলে হরিনাম সংকীর্তন।
চৈতন্য প্রবর্তিত নব বৈষ্ণব ধর্মের প্রভাবে আঠরো শতকের শেষে মেহেরপুরে প্রতিষ্ঠিত হয় লৌকিক গৌণ ধর্ম বলরামী সম্প্রদায়। এই ধর্মের প্রাণ পুরুষ ও প্রবর্তক ছিলেন বলরাম হাড়ি। মেহেরপুর নিবাসী বিখ্যাত লেখক দীনেন্দ্রকুমার রায় লিখেছেনঃ ‘বাঙ্গালা ১১৯০ বা ১১৯৯ সালে বলরামের জন্ম হয়।’ ‘১২৫৭ সালের ৩০ অগ্রহায়ণ অনুমান পঁয়ষট্টি বৎসর বয়ঃক্রমে তাহার মৃত্যু হয়।’ (অক্ষয় কুমার দত্তঃ ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়, প্রথম খন্ড (১৮৭০)
এই ধর্মের অনুসারীরা অধিকাংশই ছিলেন হাড়ি, ডোম, বাগদি, মুচি, বেদে, নম শুভ্র, মুসলমান, মালো এবং মাহিষ্যা।’ এরা গঙ্গাজলের মহিমা কিংবা সংস্কৃত মন্ত্রের পবিত্রতা মানতো না। বলরামীরা সৎ শুদ্ধ জীবন যাপনে আগ্রহী এবং গুরুবাদে আস্থাহীন। এই সম্প্রদায় সংখ্যায় অল্প হলেও এখনও তাদের সাধন-ভজন নিয়ে বেঁচে আছে। এই সম্প্রদায়ই সম্ভবত বাংলার একমাত্র লৌকিক ধর্ম যারা তাদের সূচনাকাল থেকে আজ পর্যন্ত সমাজের নিম্ন বর্ণের শূদ্র ও অন্ত্যজ জাতি ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি ছাড়া কাউকে তাঁদের ধর্মবলয়ের ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়নি। ১৯৮৫ সালে বলরাম হাড়ির সর্বশেষ সেবাইত বৃন্দাবন হালদারের মৃত্যুর পর মেহেরপুর অঞ্চলে এই সম্প্রদায়ের অনুসারীদের আর দেখতে পাওয়া যায় না। তবুও প্রতিবছর বারুনী তিথিতে বলরামের সমাধি মন্দির প্রাঙ্গনে অনুষ্ঠিত হয় বলরামীদের মেলা। আর এই মেলার মধা দিয়েই বার বার ফিরে আসেন অন্ত্যজ ও অস্পৃশ্যদের এই মহান সাধক, যিনি ঊনিশ শতকের উচ্চ ধর্ম বিশেষত ব্রাহ্মণ, কায়স্থ এমনকি বৈষ্ণবদের বিরুদ্ধে তাঁর মতকে দাঁড় করিয়েছিলেন। কালের যাত্রায় বলরামী ধর্মের এই ধারাটি ক্ষীয়মান ও বিধ্বস্ত হয়ে গেছে, তবু অন্ত্যজ অস্পৃশ্যদের জীবন ও সংস্কৃতিতে বলরামের উপস্থিতি আছে প্রবলভাবে।
ঊনিশ শতকের শেষের দিকে মেহেরপুরের রাধাকান্তপুরে জন্মেছিলেন এক মহান সাধক ও সংস্কারক নিগমানন্দ সরস¦তী (১৮৮০-১৯৩৭)। তাঁর বাল্যনাম নলিনীকান্ত চট্টোপাধ্যায় এবং পৈতৃক নিবাস মেহেরপুরের কুতুবপুর গ্রামে। তিনি শঙ্করের মত ও গৌরাঙ্গের পথের সমন¦য়ে প্রতিষ্ঠা করেন এক নতুন ধর্মমত। তিনি নিজ গ্রামে একটি দাতব্য চিকিৎসালয় (১৯৩৩) এবং গাংনীর কাথুলী গ্রামে একটি বিদ্যালয় (১৯৩২) স্থাপন। তিনি গৃহী হয়েও ছিলেন সন্ন্যাসী; আশ্রমিক হয়েও ছিলেন মানবপ্রেমে ব্যকুল ও ব্রতী এক সাত্ত্বিক পুরুষ। তিনি বলেছেনঃ ‘সংসার আশ্রম কঠোর ও ভীষণতর জানি তথাপি সংসার-আশ্রম জীবের উন্নতির সোপান। ক্রোধের বশে, দুঃখে বা অভিমানে কাপুষের ন্যায় সংসার ত্যাগ সন্ন্যাসের সাধনা নয় স¦ার্থ-সাধনের নামান্তর।’ তাঁর ধর্ম ও দর্শন সংক্রান্ত বাণী আজও এ অঞ্চলের মানুষকে প্রভাবিত করে চলেছে। তাঁর ভাবাদর্শের অলোকে মেহেরপুর শহর ও কুতুবপুর গ্রামে দুটি সারস¦ত আশ্রম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
ব্রাহ্মণ্যবাদ ও বিভিন্ন লোকধর্মের পাশাপাশি ইসলাম ধর্মের একটি স্রোত চতুর্দশ শতক থেকে মেহেরপুর অঞ্চলে বহমান রয়েছে। ১২০৪ সালে বখতিয়ার খিলজি লক্ষণ সেনের রাজধানী নদীয়া দখল করে সর্বপ্রথম মুসলিম শাসনের সূচনা করেন এবং এরপর থেকে মেহেরপুরে ইসলাম ধর্মের প্রসার ঘটে। এ অঞ্চলে ইসলাম ধর্মের প্রচার ও প্রসারে মুসলিম শাসকদের চেয়ে পীর ও সুফিদের ভূমিকা ছিল বেশি। সুফি বা পীরদের অতুলনীয় ব্যাক্তিত্ব, উদার ধর্মমতে মুদ্ধ হয়ে এবং জাতিভেদ প্রথা থেকে মুক্তি পাওয়ার আকাক্সক্ষায় অশিক্ষিত ও দরিদ্র জনগোষ্ঠী দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করে। চতুর্দশ শতকের শেষের দিকে মেহেরপুরের প্রাচীন গ্রাম বাগোয়ানে সর্বপ্রথম ইসলাম ধর্মের প্রসার ঘটে। বাগোয়ান অঞ্চলে ইসলাম প্রচরে অগ্রগন্য ভূমিকা পালন করেন দরবেশ শেখ ফরিদ। তাঁর প্রচেষ্টায় ১৪শ শতকে বাগোয়ান পরগনা মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত হয়। তবে ইসলাম ধর্মের প্রসার ও প্রচারে সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন ষোড়শ শতকের দরবেশ শাহ্ভালাই। এছাড়াও শাহ্ এনায়েত, শাহ্ আলাই, হযরত বাগু দেওয়ানের মতো লৌকিক পীর এবং গাংনী থানার বাওট গ্রামের পীর সোলায়মান (১৮৮৫-১৯৮০) খন্দকার কেরামত হোসেন, বাদিয়াপাড়ার মোঃ মহসীন, মেহেরপুরের ভবানীপুরের মুন্সী নায়েবউদ্দীন এর মতো সাধকদের প্রচেষ্টায় মেহেরপুর অঞ্চলে ইসলাম ধর্মের প্রসার ও সমৃদ্ধি ঘটে। তাঁরা সাধারণ মানুষের কাছে ইসলামের বাণী, দর্শন ও রীতিনীতি প্রচার করতে গিয়ে বিভিন্ন গ্রামে ছুটে বেড়িয়েছেন এবং গড়ে তুলেছেন বিভিন্ন দরগাহ,আস্তানা, খানকাহ। শেখ ফরিদের দরগাহ্ (বাগোয়ান), শাহ ভালাই এর দরগাহ (কালাচাঁদপুর), শাহ আলাই এর মাজার (গোদি সুবিদপুর), বাগু দেওয়ানের মাজার (যাবদপুর), মহসীন পীরের খানকাহ্ (বাদিয়াপাড়া) প্রভৃতি আসলে পীর দরবেশদের একনিষ্ঠ ধর্মকৃত্যেরই পরিচয় বহন করে। তাঁদের মহত্ত্ব, আত্মত্যাগ, ধর্মানুরাগ ও মানবসেবায় সাধারণ মানুষ আকৃষ্ট হয়ে এবং ইসলামের সাম্য-মৈত্রীর বাণীতে উদ্বুদ্ধু হয়ে বায়াত গ্রহণ করেছে, মুরিদ হয়েছে। এসব পীর দরবেশ ও সূফিরা তাঁদের কর্মকান্ড কেবল ধর্মীয় গন্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি। তাঁরা নিজেদেরকে নানা জনকল্যাণমূলক কাজের সাথে যুক্ত করে মানুষের হৃদয়ের গভীরে প্রবেশ করেছেন এবং ‘নানা মত পথের সন্ধান দিয়ে’ সাধারণ মানুষের চিত্তে স্থায়ী আসন লাভ করেছেন। মেহেরপুরের লোকমানস ও লোকজীবনে এঁদের অবস্থান ও প্রভাব এত দৃঢ় যে এঁরা প্রায় দেবতায় পরিণত হয়েছে’। গোরচাঁদ যেমন হিন্দু-মুসলমান উভয়ের পীর, তেমনি মেহেরপুরের শাহভালাইও ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সকলের কাছে বিশেষ মর্যাদার অধিকারী। পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে যেমন পাঁচ পীরের পূজা দেয়, তেমনি মেহেরপুরে হিন্দু-মুসলমান সকলে শাহ ভালাই-এর দরগাহ, শাহ আলাই এর মাজারে মানত করে, সেজদা ও প্রণাম জানায়। ঊনিশ শতকের ওয়াহাবি, তরিকায়ে মহাম্মদীয়ার মতো ধর্ম সংস্কার আন্দোলন, শিক্ষার প্রসার, মৌলবাদী দল গুলির সূফিবাদ-বিরোধী প্রচারমূলক তৎপরতা সত্ত্বেও মেহেরপুরের লোকজীবন ও সংস্কৃতি থেকে এসব পীর দরবেশের বিস¥য়কর প্রভাব মুছে ফেলা যায়নি।
©somewhere in net ltd.
১|
১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ সকাল ৭:৩৯
অপূর্ণ রায়হান বলেছেন: দেশের বিভিন্ন অঞ্চল সম্পর্কে এরকম পোষ্টের আসলেই অনেক প্রয়োজন +
ভালো থাকবেন