![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
চিত্ত জেগে উঠুক মানবিক চেতনায়
আবদুল্লাহ আল আমিন
( ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রামু, উথিয়া, টেকনাফের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ওপর চালিত সাম্প্রদায়িক হামলার প্রতিবাদে এই লেখা।)
দশকের পর দশক স্বৈরতন্ত্র, ভোট সর্বস্ব গণতন্ত্র আর প্রতিক্রিয়াশীলতার গাঢ় ছায়ার নীচে থেকে থেকে আমরা বোধ হয় আজও অন্ধ প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে আছি; সভ্য- মানবিক হয়ে উঠতে পারিনি। চারিদিকে নৃশংসতা, অমানবিকতা, নির্মমতার ঘোর কালো অন্ধকার দেখে দেখে আমরাও নৃশংস, অমানবিক, নির্মম হয়ে গেছি। নিষ্ঠুর পীড়ন আর নির্মম অত্যাচার সয়ে সয়ে আমরাও মাঝে মাঝে উৎপীড়কের নিষ্ঠুর উল্লাসে মেতে উঠছি। মানবিকতা,অসাম্প্রদায়িকতা, সৌহার্দ-সম্প্রীতির বাণী ক্রমশঃ সমাজ-রাষ্ট্রে ব্রাত্য বাণীতে পরিণত হতে চলেছে। ধর্মব্যবসায়ী ফেরেব্বাজ আর ক্ষমতালোভী মতলববাজদের খপ্পরে পড়ে আমরা হারিয়ে ফেলতে বসেছি আমাদের সংবেদনশীলতা, প্রতিবেশীর প্রতি সহানুভূতি- সহমর্মিতা। বৌদ্ধ অধ্যুষিত রামু, উথিয়া, টেকনাফ, পটিয়া অঞ্চলের অস্বাভাবিক পরিস্থিতি দেখে ডব্লিউ বি ইয়েটসের ‘ দ্বিতীয় আগমন’ এর কালের ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে বাস করছি বলে মনে হয়: ‘চারিদিকে আপ্লাবিত নিষ্পাপ উৎসব, শ্রেষ্ঠরা সমস্ত বিশ্বাসরিক্ত, যখন নষ্টরা পরিপূর্ণ সংরক্ত উৎসাহে।’ কিন্তু এমন তো হবার কথা ছিল না, এমন বাংলাদেশ তো আমরা চাইনি। একাত্তরে আমাদের অজ¯্র স্বপ্ন ছিলÑগণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা,বঙালিত্ব আর শোষণ মুক্তির স্বপ্ন। স্বপ্ন ছিলÑ সামাজিক ন্যায়বিচার, আইনের অনুশাসন, সামগ্রিক উন্নয়ন, সুশাসন, সমবন্টন এবং সব মানুষের আর্থিক সচ্ছলতার।একাত্তরের অগ্নিক্ষরা দিনগুলিতে রক্তাক্ত হয়েও তো আমরা নিশঙ্কচিত্তে উচ্চারণ করেছিলামÑ‘ বাংলার হিন্দু, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খ্রিস্টান, বাংলার মুসলমানÑ আমরা সবাই বাঙালি।’ সব ক্ষুদ্রতা, সব সংকীর্ণতা ছাপিয়ে সেদিন আমরা বাঙালি এবং মানুষ হয়ে উঠেছিলাম।
২৯ সেপ্টেম্বর ২০১২ এ আমরা বোধ হয় আর একবার নুতন করে পরাস্ত হলামÑ পরাস্ত হ’ল আমাদের প্রিয় জন্মভূমি বেদনা পীড়িত সোনার বাংলা; পরাস্ত হ’ল বাঙালির হাজার বছরের অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদ। সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মান্ধতার লেলিহান আগুনে পুড়ে ছাই হ’ল রামু, পটিয়া,টেকনাফের বসতবাড়ি,বৌদ্ধ বিহার, ঐতিহ্যবাহী তালপাতার পুঁথি; ভেঙে চূর্ণ করে দেয়া হ’ল সহ¯্র বছরের সুপ্রাচীন বৌদ্ধ মূর্তি। এই সাম্প্রদায়িক সহিংসতার জন্য মুসলমান হিসেবে আমি লজ্জাবোধ করি। ওই দিন মুসলমান নামধারী একদল ধর্মোন্মত্ত দুর্বৃত্ত রামু, পটিয়া, উথিয়ায় বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বসত বাড়ি ও মন্দিরে অগ্নিসংযোগ করে এবং সেই সাথে সারা রাত ধরে চালায় লুটপাট। ভেবে বিস্মিত হতে হয় যে, এই অমানবিক কর্মকান্ডের সঙ্গে যারা জড়িত ছিল তারা অধিকাংশই তরুণ ও যুবক বয়সের এবং তাদের বেশির ভাগ মাদ্রাসার ছাত্র। ধর্মান্ধ ও অশুভ সাম্প্রদায়িক শক্তি মাদ্রাসা ভিত্তিক ছাত্রদের ধর্মীয় আবেগ ও অজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে এই বর্বরোচিত, অমানবিক, কান্ডজ্ঞানহীন কাজটি ঘটিয়েছে। এখানে বলতে দ্বিধা নেই যে, হামলা ঠেকাতে স্থানীয় প্রশাসন সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে। সরকারের ধর্মনিরপেক্ষ নীতিও এই নিরীহ সংখ্যালঘুদের জানমালের নিরাপত্তা বিধানে তেমন সহায়ক হয়েছে বলে আমাদের মনে হয়না। ‘ জেলা-উপজেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসনের ব্যর্থতা ক্ষমার অযোগ্য। কেননা পুরো ঘটনায় প্রশাসন শুধু নির্লিপ্ত নয়, অনেকাংশে উৎসাহ যোগানোর অভিযোগ সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিরা করেছেন।’( নাসির উদ্দীন ইউসুফ, এ পশু শক্তিকে আমরা রুখবোই। প্রথম আলো,৩ সেপ্টেম্বর ২০১২)। তবে এ ব্যর্থতা কেবল প্রশাসনের নয়, এ ব্যর্থতা বাংলাদেশের সকল শুভবুদ্ধিসম্পন্ন্ মানুষের ; সকল প্রগতিশীল রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তির ব্যর্থতাÑএ ব্যর্থতার দায় আমাদের সবাইকে নিতে হবে। আমাদের ব্যর্থতার জন্য সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাংলাদেশ পেয়ে গেল ধর্মান্ধ উগ্র সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের অপ-অভিধা। অথচ ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, বাংলাদেশে কখনও সাম্প্রদায়িকতা মাথা চাড়া দিতে পারেনি। অসাম্প্রদায়িকতা, মানবিক অধ্যাত্মবাদ ও পরমত সহিষ্ণুতার ঐতিহ্য সব সময় বাঙালিকে অনুপ্রাণিত করেছে। এখানে বিভিন্ন ধর্মের মানুষ কয়েক শতাব্দী ধরে সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে শান্তি-সম্প্রীতিতে বসবাস করে চলেছে, যা বলাই বাহুল্য। হয়তো কোনো কোনো সময় তাদের মধ্যে বিবাদ-বিরোধ দেখা দিয়েছে, কিন্তু তা হয়েছে কেবল স্বার্থান্ধ মতলববাজদের প্ররোচনায়। এদেশের অধিকাংশ মানুষ কোনোকালেই ধর্মীয় ভেদবুদ্ধি, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, হানাহানি সমর্থন করেনি। এসব কারণে বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক শক্তি ক্ষমতার মসনদ দখল করতে পারেনি এ পর্যন্ত। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ ইসলাম ধর্মের অনুসারী । তারা মনে প্রাণে ধর্মনিষ্ঠ ,কিন্তুু ধর্মান্ধ নয় কখনই। নিজ নিজ ধর্মের আচার –আচরণ পালন করেও অন্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল তারা । অন্য ধর্মের ভাব, আবেগ, দার্শনিকতা ও রিচ্যুয়ালস সমূহ তাদের মন ও মানসকে সব সময় প্রভাবিত করে আসছে । পৃথিবীর সব মহৎ ধর্মে মহৎ ভাবনার নির্যাসকে আত্মস্থ করে বাঙালি মুসলমান তার জীবন ভাবনা ও সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে । অন্য ধর্মের প্রতি বাঙালি মুসলমানদের দৃষ্টি মূলতঃ পবিত্র কোরআনের সারসত্য দ্বারা চালিত হয়েছে সবসময় । তারা অন্তর দিয়ে বিশ্বাস করেছে , ‘তোমার পথ তোমার, আমার পথ আমার ।’ অর্থাৎ যার যার ধর্ম তার তার। কাউকে ধর্ম পালনে বাধা দেওয়া বা নিজ ধর্ম অন্যের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার অধিকার কারো নেই। বলতে দ্বিধা নেই, কেবল অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই সকল ধর্মের মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করা সম্ভব। কারণ গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িকতা পরস্পর পরিপূরক, আর অসাম্প্রদায়িকতা ছাড়া গণতন্ত্র অর্থহীন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধও ছিল অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অভিপ্রায়ে সকল ধর্মের মানুষের সম্মিলিত প্রয়াস। সে কারণে বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌল দর্শন হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছে।
এ ভূখ-ের মানুষ যুগে যুগে বিভিন্ন ধর্ম ও মতপথ গ্রহণ করেছে, কিন্তু মানবিকতা ও হৃদয়ের ধর্ম পরিত্যাগ করেনি কখনও। তারা মনে করেছে বিশ্বের সব ধর্মই সত্য, সব ধর্মেই রয়েছে কিছু গভীরতর উচ্চারণ, যাকে বলা যেতে পারে চিরন্তন বাণী বা সারসত্য। আর এর বাইরে রয়েছে কিছু আচার-আচরণ ও সাময়িক বিধান, যার কোনো শ্বাশত মূল্য নেই। বাঙালি তার জীবনের প্রয়োজনে সব ধর্মের শ্বাশত দিকটাই গ্রহণ করেছে। সুস্থ,স্বস্থ জীবনের স্বার্থে ধর্ম মানার ক্ষেত্রে এদেশের মানুষ যুক্তিও নিয়েছে, আবেগও ত্যাগ করেনি। কারণ তারা জানে, যুক্তি ও আবেগের সুসমন্বয় ছাড়া জীবন সুন্দর হয় না। তাই ধর্ম বিষয়েও বাঙালি সমন্বয়ের পথ বেছে নিয়েছে, যদিও সমন্বয়ের পথ সহজ নয় বরং জটিল ও দুরধিগম্য। যুগে যুগে বিশ্বে যেসব ধর্ম এসেছে সেখানে সমন্বয়ের ভাবনাই প্রাধান্য পেয়েছে। তাই পবিত্র কোরআন ও গীতাতে অবিশ্বাসীদের স্তম্ভিত করে দিয়ে ধর্মযুদ্ধ বা জেহাদের পাশাপাশি অহিংসা, করুণা,সহমর্মিতা ও মানবিকতার বাণী দৃঢ়ভাবে উচ্চারণ করা হয়েছে। কোরআনে বলা হয়েছে, ইসলাম আক্রান্ত হলেই কেবল সব বিশ্বাসী মুসলমানের কর্তব্য ৃ সর্বশক্তি দিয়ে সেই অক্রমণ প্রতিহত করা। ধর্মযুদ্ধে ব্যক্তিগত বিদ্বেষের কোনো স্থান নেই, ব্যক্তিগত বিদ্বেষকে প্রচ-ভাবে ঘৃণা করা হয়েছে। কারণ ধর্মযোদ্ধারা আল্লাহ বা ঈশ্বরের ইচ্ছার নিকট সমর্পিত সাধক মাত্র, অন্য কিছু নয়। যারা ইসলামের মর্মার্থ বোঝে তারা পরধর্ম বিদ্বেষী হতে পারে না। যারা ইসলামের মর্ম দর্শন আত্মস্থ করতে পারেনি, তারাই ২৯ সেপ্টেম্বর বৌদ্ধ মন্দির, বসতবাড়ি, ঘরগৃহস্থালি ভেঙেছে; শান্তিপ্রিয় বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যাদিতে আগুন দিয়েছে। তারা যদি ইসলামের শ্বাশত বাণী উপলব্ধি করতো, তবে একজন বিকারগ্রস্ত ব্যক্তির ফেসবুকে বিকৃত ছবি ট্যাগ করাকে কেন্দ্র করে ধর্মের নামে উন্মাদনা ছড়াতো না, হিংসাশ্রয়ী কর্মকা-ে লিপ্তও হত না।
আমরা আর বাংলাদেশের নরম মাটিতে ১৯৪৬ এর সাম্প্রদায়িকতার লেলিহান শিখা দেখতে চাই না। অসাম্প্রদায়িকতা আর মানবিকতার চেতনা ও প্রেরণাই বাংলাদেশের মানুষের সবচেয়ে বড় শক্তি, এ নিয়ে আমাদের গর্বও কম নেই। এই শক্তিতে বলীয়ান হয়ে সবধর্মের মানুষ এক হয়ে সৌহার্দ্য- সম্প্রীতিতে বাস করছি। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশকে উজ্জ্বল, আলোকিত এবং সচ্ছল দেখতে চাই। মধ্যযুগীয় বর্বরতা আর প্রতিক্রিয়াশীলতার গাঢ় অন্ধকারে আমাদের মানবিকতা, অসাম্প্রদায়িকতা, আনন্দময়তা, সুগভীর আত্মোপলব্ধি, সহমর্মিতা হারিয়ে যাক, তা আমরা চাই না। আমাদের ব্যর্থতার খতিয়ান আর দীর্ঘতর করতে চাই না। যুক্তরাজ্যের জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী সাময়িকী ‘ দ্য ইকোনোমিস্ট’ বলেছে, অকার্যকর রাজনীতি, প্রতিকূল প্রাকৃতিক পরিবেশ, সামরিক অভ্যুত্থান, দুর্ভিক্ষ সত্ত্বেও বাংলাদেশের ‘ আশ্চর্যজনক অগ্রগতি’ হয়েছে। এ অগ্রগতির ধারা ত্বরান্বিত করে বাংলাদেশকে সামনের দিকে নিয়ে যেতে চাই আমরা। আর কোনো ধর্মান্ধতা নয়; নয় ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নয়; আমির হোসেন চৌধুরীর মত দাঙ্গা রুখতে চাই Ñযিনি ১৯৬৪ সালে দাঙ্গা রুখতে গিয়ে দাঙ্গাবাজদের হাতে নিহত হয়েছিলেন। ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা. ভেদবুদ্ধিও ঘূর্ণিজাল ছিন্ন করে বাংলার আকাশ ভরে দিতে চাই সম্প্রীতির উজ্জ্বল আলোয়। ধর্মের নামে ভেদাভেদ করে মনুষ্যত্বের অবমাননা আর নয়, মানবিক আধ্যাত্মিকতার জ্যোৎ¯œায় ভরে উঠুক বাঙালির চিত্ত-আঙিনা, এ আমাদের প্রতিদিনের পরম প্রার্থনা। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন, সব প্রতিকূল শক্তিকে পেছনে ঠেলে, সব সাময়িক অধঃপতন সত্ত্বেও মানুষ এগিয়ে চলেছে মঙ্গলের দিকে, সুন্দরের দিকে। রবীন্দ্রনাথের বিশ্বাসকে ধারণ করে, বাংলাদেশও এগিয়ে যাবে শুভ সুন্দর, আনন্দ- কল্যাণ ও মঙ্গলের দিকে।
©somewhere in net ltd.