নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

নবীন আনন্দ

আবদুল্লাহ আল আমিন

আবদুল্লাহ আল আমিন › বিস্তারিত পোস্টঃ

মরীচীকার পিছে পিছে তৃষ্ণাতপ্ত প্রহর কেটেছে মিছে

০১ লা জানুয়ারি, ২০১৫ রাত ১২:০৯

মরীচীকার পিছে পিছে তৃষ্ণাতপ্ত প্রহর কেটেছে মিছে
আবদুল্লাহ আল আমিন
আনন্দময় গ্রামের শ্যামলছায়ায় আমার জন্ম। গ্রামে জন্ম এবং বেড়ে ওঠার সুবাদে নক্ষত্র খচিত আকাশ,নদী-বৃক্ষ, কার্তিকের নীল কুয়াশা, অগ্রহায়নের নবান্ন, নরম ঘাস,ফুল, পাখি,প্রজাপতি, সোনালি রোদে ধোয়া কুটির ইত্যাদির সঙ্গে যেমন একাত্ম হওয়ার সুযোগ হয়েছিল, ঠিক তেমনি স্বভাবিকভাবে পরিচয় হয়েছিল বাংলার ঐতিহ্যবাহী নাট্যরীতির সঙ্গে। যদিও তখন পর্যন্ত গ্রামের মানুষ এসবকে নাটক বলে শনাক্ত করতে শিখেনি: কারণ তখন গ্রামের সব প্রচলিত শিল্পই ছিল গীতাশ্রিত এবং গ্রামের মানুষের কাছে আজও যা গান হিসেবে পরিচিত। একটা গ্রাম বা এলাকার ভেতরেই সংস্কৃতির যে বৈচিত্র্য আছে তা শৈশবেই পরিপূর্ণ চোখ মেলে দেখার সুযোগ হয়েছিল আমার। মেলায়,পূজায়,ঈদে, মহরমের মিছিলে,দরগাহ তলার মানত শিরনিতে, কবি-পাঁচালির আসরে,মিলাদ-মাহফিলের বাহাসে, হাটে-বাজারে, পাঠশালা-মক্তবের জীণর্ পুঁথির পাতাতে চোখ মেলেই তো সেই শৈশবেই নিয়েছিলাম ইতিহাসের পাঠ; বলা যেতে জীবনপাঠ, দেশপাঠ,ঐতিহ্যপাঠ এবং শিল্পপাঠ, এবং কেন নয়? আমার পরম সৌভাগ্য যে, রূপকথাকল্প মাছ, কলাপাতার আড়ালে সলজ্জ গ্রাম্য কূলবধূ, ছোট নদীর বিভঙ্গ তরঙ্গ দেখে যেমন বড় হয়েছি, তেমনি নিজেকে ঋদ্ধ করেছি যাত্রা,কবিগান,জারিগান, আলকাপ,একদিল,মনসা-ভাসানের, বেহুলা-ভানুমতীর পালা-আসরের ভিড়ে মিলেমিশে একাকার হয়ে। মধ্যরাতে রূপবান যখন মঞ্চে গাইছেন, ‘আমার নিদারুণ শ্যাম কলস লয়ে ঘাটে আসিলাম...আমি ঢেউয়ে ঢেউয়ে কলস ভরিলাম’, তখন আর সব দর্শকের মতো আমিও আবেগ মথিত,বিহবল ও অশ্রুভারাক্রান্ত হয়েছি। কবে যে প্রথম যাত্রাগান শুনতে গিয়েছিলাম, তা আমার নিজেরই মনে নেই। কারণ সেময় আমাদের এলাকায় যাত্রাগান প্রায় সারা বছর লেগেই থাকতো। তবে সত্তর দশকের শেষদিকে ভাটপাড়ার নীলকুঠি প্রাঙ্গণে নেদারল্যান্ড থেকে আগত ডাচ সাহেবদের পৃষ্ঠপোষকতা ও অর্থায়নে যে যাত্রাপালার আয়োজন করা হয়, সেই আসরে বাবার সঙ্গে যাত্রার দেখার সুযোগ হয় আমার। সেবার সাহারবাটীর যাত্রাদল নবাব সিরাজউদ্দৌলা, নীল কুঠিরর কান্না,সতী না অসতী ইত্যাদি পালা সেই আসরে মঞ্চস্থ করে। ১৯৭৮ সালে আমঝুপি পাবলিক ক্লাব প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত যাত্রার সেই বড় আসরের কথা কতজনের কাছে কতভাবেই না শুনেছি! তারপর আবেগ মথিত হয়ে কতবার যে যাত্রার আসরে গেছি তার হিসেব মেলানো ভার। আর এভাবেই একদিন গভীর নিষ্ঠায় ও ভক্তিতে বাংলার হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী নাট্যধারারর সঙ্গে নিজের বুকের স্পন্দনকে মিলিয়ে নিতে তৎপর হই। যে ঐতিহ্যের মোহনরূপে আমি বা আমার সমসাময়িকরা সেদিন মজেছিল সেখানে যেমন শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের রাধাকৃষ্ণ, চৈতন্যদেব,রামায়ণ-মহাভারত, সোহরাব-রুস্তুম, লায়লা-মজনু,লালন ও তার ভক্ত-অনুরাগী ছিল; তেমনি ছিল কারবালার করুণ ইতিহাস, আছে সাধক-মহৎদের নিয়ে গড়ে ওঠা নানাসব আখ্যান। শত সহ¯্র কুরু- কারবালা পেরিয়েই যে মানুষকে মানুষ হতে হয়, সেই পাঠ ঐতিহ্যবাহী নাট্যধারার ¯্রােতে চোখ ধুয়েই শিখে নিয়েছিলাম। শৈশব-কৈশোরে যাত্রা দেখার অনন্য স্মৃতি রোমন্থন করে আজ অবধি আমি বিমোহিত হই, সেই শিল্পতরঙ্গের অভিঘাত এখনও গাঢ়ভাবেই শরীরে অনুভব করি।
আধুনিক নাটকের সাথে আমার পরিচয় ঘটে আশির দশকের শেষদিকে এস এম সোলাইমানের ‘ ক্ষ্যাপা পাগলার প্যাঁচাল’ দেখার পর। তখন আমি কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে একাদশ শ্রেণির ছাত্র। পরে নব্বইয়ের প্রথমদিকে অভিনেতা অগ্রজ আসলাম শিহিরের সঙ্গে কার্জন হলের একটি কক্ষে লিয়াকত আলী লাকীর লোকনাট্য দলের কঞ্জুস নাটকের মহড়া দেখার পর নাটক সম্পর্কে আমার পূর্বধারণা সম্পূর্ণ পালটে গেল, নাটক প্রতি আমি প্রবল আগ্রহী হয়ে উঠলাম সেই সময় পরিচয় ঘটে চার্লর্স ডিকেন্স, ব্রের্টল্ড বেশট, মলিয়ে, স্যামুয়েল বেকেটের কালজয়ী নাটকের সঙ্গে। নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় তখন ব্রেশটীয় নাট্যচর্চায় পথিকৃতের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। ব্রেশটের ছায়াবলম্বনে ‘সৎ মানুষের খোঁজে’, ‘ দেওয়ান গাজীর কিসসা’,গ্যালিলিও’ মঞ্চস্থ করে ‘নাগরিক’ তখন যশ-খ্যাতির শীর্ষবিন্দু ছুঁয়েছে। আর থিয়েটার মঞ্চস্থ করছে আবদুল্লাহ আল মামুনের সুবচন নিবার্সনে, এখন দুঃসময়, চারিদিকে যুদ্ধ, সেনাপতি, অরক্ষিত মতিঝিল, এখনও ক্রীতদাস,যুদ্ধ এবং যুদ্ধ এর মতো মঞ্চসফল নাটক। মেহেরপুরের সংস্কৃতি-কমীরা তখনও পর্যন্ত আধুনিক নাট্যচর্চা বলতে যা বোঝায় সেরকম কিছু শুরু করতে পারেনি এবং নাট্যদলও গড়ে ওঠেনি । যদিও সেসময় দেশের মফস্বল শহরগুলোতে বিভিন্ন প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে শক্তিশালী নাটকের দল গড়ে উঠছিল, সাথে সাথে থিয়েটার আন্দোলনও বেগবান হচ্ছিল, সেখানে মেহেরপুর এক রহস্যময় নিরব ভূমিকাই পালন করছিল। ১৯৯৭ সালের গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সম্মেলন উপলক্ষে যে পুস্তিকা প্রকাশিত সেখানে মেহেরপুরের কোন নাট্যদলের নাম ছিল না,অথচ কুষ্টিয়ার বোধন,গড়াই,নূপুর,কুমারখালি থিয়েটার এবং চুয়াডাঙ্গার অনির্বাণ সেই তালিকায় স্থান করে নেয় অনায়াসে। তবে নাটককে মঞ্চে উৎকীর্ণ করার অভিপ্রায়ে অপেক্ষমান নাট্যমনস্ক মানুষের অভাব মেহেরপুরে ছিল না। নাট্যানুরাগী মানুষ মেহেরপুরে সবকালেই ছিল।
মেহেরপুরে নাটকের দল গড়ে ওঠে বা আধুনিক নাট্যচর্চার সূচনা হয় মূলত স্বৈরশাসনবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে,যখন মানুষ তাদের মনের কথাগুলো বলিষ্ঠভাবে বলতে পারছিল না, দুঃশাসনের বিরূদ্ধে ঘৃণা প্রকাশের পথ পাচ্ছিল না, তখন সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ নাটকের মঞ্চকে বেছে নেয় প্রতিবাদ কিংবা প্রতিরোধের মঞ্চ হিসেবে। মাসুদ অরুন,কাজী হাফিজ, আনোয়ারুল হক কালু, কাজল প্রমুখের নেতৃত্বে মুক্তচিন্তার সৎ শুভচেতনাসম্পন্ন রাজনৈতিক কর্মীদের মিলিত প্রয়াসে গড়ে ওঠে অনুশীলন নামের সাংস্কৃতিক সংগঠন। এ সংগঠন মেহেরপুরে নাট্যচর্চা ও পঠন-পাঠনে নতুন মাত্রা যোগ করে। অনুশীলন সাফল্যের সঙ্গে মঞ্চস্থ করে সেলিম আলদীনের ‘ বাসন’, এসএম সোলাইমানের ‘ক্ষ্যাপা পাগলার প্যাঁচাল’, বাদল সরকারের ‘ মরা’র মত কালজয়ী সব নাটক। এছাড়াও গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে অজ¯্র পথনাটক করেছে তারা। অনুশীলনের সংগঠকদের কেউ কেউ সৈয়দ শামসুল হকের‘ নূরলদীনের সারাজীবন’ নাটকটি মঞ্চায়নের কথা ভেবেছিলেন। কিন্তু নানা প্রতিকূলতার কারণেই তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। অনুশীলনের নাট্য ও সংস্কৃতি-কর্মীরা সেদিন নাটককে স্বৈরশাসনবিরোধী সংগ্রামের হাতিয়ার হিসেবে বেছে নেয়। গণবিরোধী স্বৈরশাসকের বিরূদ্ধে যেকথাগুলো তারা বলতে পারছিল না, সেই কথাগুলো তারা নাটক,পথনাটকের সংলাপ কিংবা কবিতা পঙক্তিমালা দিয়ে উচ্চারণ করেছিল, মানুষকে জাগিয়ে রেখেছিল, সংঘবদ্ধ করে তুলেছিল। রাজনৈতিক দলের চেয়ে গভীরস্তরে মানুষকে প্রস্তুত করেছিল গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল রাজনীতির সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্যে। নব্বইয়ের গণজাগরণের পর গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সুসংহত করার জন্যও তারা কাজ করেছে।
অনুশীলনের পর মেহেরপুরে নাট্যচর্চায় বাঁকবদল ঘটায় মেহেরপুর থিয়েটার। ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বর মাসে যাত্রাভিনেতা মশিউজ্জামান বাবু, অধ্যাপক হাসানুজ্জামান মালেকের নেতৃত্বে মেহেরপুর থিয়েটার প্রতিষ্ঠিত হয়। নাট্যপ্রযোজনাকে বহুমাত্রিক বৈচিত্রময় করে তোলার অভিপ্রায় নিয়ে তারা যাত্রা আরম্ভ করেন। দেড় দশকের নাট্য পরিক্রমায় তারা কেবল বিনোদনমূলক নাটক মঞ্চস্থ করেনি, সামাজিক-রাজনৈতিক দায়বোধে উদ্বুদ্ধ থেকে মানুষকে জাগিয়ে রাখার কাজটিও করে চলেছে। মেহেরপুর থিয়েটারের নাট্যপ্রযোজনার লক্ষ বিশ্লেষণ করে স্পষ্ট করে বলা যায় যে,তারা একদিকে আবহমান বাংলার শেকড় সন্ধান করে চলেছে, অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মাণের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করছে। মেহেরপুর থিয়েটারের প্রযোজনায় হাসানুজ্জামান মালেকের ‘ একাত্তর’, ‘ এই দেশে এই বেশে ’,অরুণ মুখোপাধ্যায়ের ‘স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের প্যাঁচাল’, একেএম শামীমের ‘অমর একুশে’, মান্নান হীরার ‘ফেরারি নিশান’, মাসুম রেজার ‘তাহাদের কথা’, আবদুল্লাহ আল মামুনের ‘মেরাজ ফকিরের মা’ নাটক স্থানীয় দর্শক ও নাট্যসমালোচকদের দ্বারা প্রশংসিত হয়। ২০০৪ সাল থেকে এই নাট্যদলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। সাইদুর রহমানকে আক্ষরিক অর্থেই নাট্যজন বলতে হয়; কারণ নাট্যঅভিনয় তার পেশা না হলেও নাটক তার ধ্যান জ্ঞান, স্বপ্ন কল্পনা।
মুক্তিযুদ্ধোত্তরকালে একদল তরুণ থিয়েটার ভালবেসে কবীর চৌধুরী, আতাউর রহমান, আবদুল্লাহ আল মামুন, রামেন্দু মজুমদার,আলী যাকের, ফেরদৌসী মজুমদার, সারা যাকেরদের বলয়ের বাইরে এসে হঠাৎ করে ‘ঢাকা থিয়েটার’ নামে একটি নাট্যদল গড়ে তোলেন। দলের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে ছিলেন নাসিরউদ্দীন ইউসুফ, সেলিম আলদীন,রাইসুল ইসলাম আসাদ, পীযুষ বন্দোপাধ্যায়, ম.হামিদ,সুবর্ণা মুস্তাফা প্রমুখ। নব্বই দশকের মাঝামাঝিতে মেহেরপুরের প্রতিষ্ঠিত ও প্রভাবশালী নাট্য বলয়ের বাইরে বেরিয়ে এসে একদল তরুণ ও নবীন কিশোর অরণী থিয়েটার নামে একটি নতুন সাংস্কৃতিক সংগঠনের জন্ম দেয়। সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে ছিলেন নিশান সাবের, কাবেদুল হক মিলন, শেখ মোমিন, সামসুজ্জামান রন্টু, বেলাল ওসমান, কিশোর কুমার পাত্র, আবু তালেব, আতিক স্বপনদের মত এক ঝাঁক প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক কর্মী। মা মাটি মানুষের সঙ্গে মেল বন্ধন রচনার জন্যে জনপ্রিয় শিল্পমাধ্যম নাটককে তারা বেছে নেয় জীবনচর্যার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে। দু’ দশকের পরিক্রমায় তারা অসংখ্য নাটক মেহেরপুরে ও জেলার বাইরে মঞ্চস্থ করেছে। অরণী চির্ড্রেনস থিয়েটার ঢাকায় অনুষ্ঠিত দুটি আন্তর্জাতিক শিশু নাট্যোৎসবে অংশ নিয়েছে। প্রতিষ্ঠার প্রদোষ কাল থেকেই এ সংগঠনের প্রাণপুরুষ নিশান সাবের; তিনি একাধারে নাট্যসংগঠক, নির্দেশক ও নাট্যকার। তার লেখা ও নির্দেশিত ‘বোবা জননী’, ‘তামাশা’,‘ নীল বৈঠক’, ‘পাল তুলে দাও’ ছিল মঞ্চসফল নাটক; সেই সাথে দর্শক ও নাট্যসমালোচকদের প্রশংসাও কুড়িয়েছে।
জেলা শিল্পকলা একাডেমি নাট্যচর্চা ও প্রযোজনার ইতিহাসে এক বিরল উদহারণ সৃষ্টি করে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি ফাইন এন্ড পারফর্মিং আর্টস প্রশিক্ষণ প্রকল্পের অধীনে ২ অক্টোবর থেকে ২২নভেম্বর ১৯৯৭ পর্যন্ত দেড়মাস ব্যাপী প্রযোজনা কেন্দ্রিক নাট্য কর্মশালর আয়োজন এবং আন্তন চেখভের ‘ দি চেরি অর্চার্ড ’ অবলম্বনে ‘ আ¤্রকানন’ এর সফল মঞ্চায়নের মাধ্যমে। এ কর্মশালায় মুখ্য প্রশিক্ষক ও নির্দেশক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ড. মোস্তাফিজুর রহমান সৈয়দ। মেহেরপুরের আধুনিক নাট্যচর্চা এবং এর সোনার ধান কোন বিশেষ ব্যক্তি বা নাট্যদলের স্বেদ শ্রম মেশানো ফসল নয়। বহুদল, ব্যক্তি এবং নাট্যাদর্শের মিলিত চাষেই সম্ভব হয়েছে ও হচ্ছে। স্বল্প সময়ের জন্য, তারপরও সূচনা নাট্য গোষ্ঠী এবং বাংলাদেশ উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী, মেহেরপুর নাট্যচর্চায় যে অবদান রেখেছে তা অতুলনীয়। মেহেরপুর টাউন হলে বাদল সরকার রচিত ‘ চৌহদ্দি পেরিয়ে’ নাটকে শাশ্বত নিপ্পনের অনবদ্য অভিনয়ে হলভর্তি দর্শকের সঙ্গে আমিও মুগ্ধ হয়েছিলাম। সেই মুগ্ধতা থেকে আমাদের দু’জনের সম্পর্ক বন্ধুত্বে গাঢ় হয়। শাশ্বত নিপ্পনের নির্দেশনায় মেহেরপুরের উদীচী বেশ কয়েকটি নাটক মঞ্চস্থ করেছে, তার মধ্যে সমরেশ বসুর ‘ আদাব ’, বাদল সরকারের ‘মরা’ ও ‘চৌহদ্দি পেরিয়ে’ এবং রবীন্দ্রনাথের ‘শ্যামা’ নৃত্যনাট্য দর্শক নন্দিত হয়েছে।
চৈতন্যদেবের সময়কাল থেকে এ জনপদে নাট্যচর্চা শুরু হয় অর্থাৎ মেহেরপুরে ঐতিহ্যবাহী নাট্যধারার সূচনা পঞ্চদশ শতক থেকে; কারণ চৈতন্যদেব এ জনপদের মানুষ ছিলেন। চৈতন্যদেব নিজে রাধা- বিরহ জাতীয় নাটকে রাধা চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। সেই থেকে এ জনপদে নাট্যগীতি বা গীতিমময় নাট্যধারার মাধ্যমে নাট্যচর্চা অব্যাহত রয়েছে। উনিশ শতকের প্রারম্ভে মুখার্জি পরিবারের আনুকূল্যে ও পৃষ্ঠপোষকতায় সৌখিন যাত্রাদল শ্রী গোপাল অপেরা মেহেরপুরে গড়ে ওঠে। আনন্দ মুখার্জি, পাঁচু হালদার, হামদু বাবু, নিখিল বাগচী, বিজন অধিকারী ছিলেন সে সময়ের খ্যাতিমান অভিনেতা। গত শতকের বিশের দশকে জমিদার সুরেন্দ্র নারায়ণ রায় ওরফে রামবাবুর অর্থায়ন ও আনুকূল্যে গড়ে ওঠে আনন্দ বিহারী অপেরা নামে একটি অ্যামেচার নাট্যদল । এ দল তারাপদ দাস, নবকুমার ঘোষ, রাজকুমার ঘোষ, সতীশ বাইনের মতো বেশ ক’জন প্রতিভাবান অভিনেতার জন্ম দেয়। দেবতার গ্রাস, রজনন্দিনী, জীবন্ত পাপ,স¤্রাট অশোক, মোঘলে আজমের মত লোকপ্রিয় যাত্রাপালা মঞ্চস্থ করে বিপুল খ্যাতি অর্জন করে। মেহেরপুরের যে নাট্য ঐতিহ্য তা মূলত ঐতিহ্যবাহী নাট্যধারা তথা লোকনাটকের ঝরনা ধারায় ¯œাত হয়ে গড়ে উঠেছে। যদিও শিক্ষিত ও শিষ্ট সমাজ কর্তৃক ব্যবহৃত ‘লোকনাটক’ শব্দটি মূলত ইউরোপিয় উপনিবেশজাত। এই ঐতিহ্যবাহী নাট্যধারা আমাদের সমাজ মনন ও সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে গভীরতর অর্থেই। কালের বিরূপ প্রতিক্রিয়া ও বৈরী অভিঘাত সহ্য করেও এর প্রাণবন্ত ¯্রােত আজও স্বতঃস্ফূর্ত আবেগে নিত্য বহমান। এই ঐতিহ্যবাহী নাট্যধারায় ছেদ পড়ে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান কায়েম হবার পর। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বাঙালি সংস্কৃতি বিরোধী আচরণ বাঙালির যাপিত জীবন ও সংস্কৃতিচর্চাকে যেমন সংকটাপন্ন করে তোলে, তেমনি তারা নাট্য ও থিয়েটার চর্চাকেও বাধাগ্রস্ত করে। তারপরও সব বাধা ও প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে গত শতকের পঞ্চাশের দশকে মফিজুর রহমান, হাফিজুর রহমান, শিবনারায়ণ চক্রবর্তী, ননীগোপাল ভট্টাচার্য, সাখাওয়াত মুন্সি, প্রসেনজিৎ বোস, প্রশান্ত ভট্টাচার্য, হাফিজুর রহমানদের নেতৃত্বে ঐতিহ্যবাহী নাট্যধারার সঙ্গে হাত ধরাধরি করে থিয়েটার ফর্মের নাট্যচর্চা এগিয়ে যেতে থাকে। তারাই ছিলেন মূলত মেহেরপুরে আধুনিক নাট্যচর্চার পথিকৃৎ ও প্রবর্তক। পাকিস্তানি ফৌজি শাসন ও নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রের মধ্যে বাঙালির ঐতিহ্যবাহী নাট্যধারা ও আধুনিক নাটক নতুন করে প্রাণ পায়। ‘মাধবী মৃত্যুগাছে ফুল ফুটিয়ে’ শিল্পের সেই বরপুত্ররা, যাদের জন্ম শিল্পের আলোয়; যারা সমাহিত হয়েছেন শিল্পের মঞ্চে, তারা একে একে সব চলে গেছেন না ফেরার দেশে। রবীন্দ্রনাথ ব্যানার্জি,পাঁচু হালদার, মোনাখালির নীলমনি দাস, শিবনারায়ণ চক্রবর্তীরা নেই; মফিজুর রহমান, আবুল কাশেম, লাল মহম্মদরাও চলে গেছেন। মীর মোজাফফর, খোন্দকার আক্কাস আলিদের মতো সমঝদার সঙ্গীতজ্ঞদেরও পাওয়া যায় না আর। কদিন আগেই সকলকে কাঁদিয়ে শিল্প-সংস্কৃতির সংসার ছেড়ে অমৃতলোকবাসী হলেন ‘লারকানার নবাব’ খ্যাত ‘জল্øাদের দরবার’ নাটকের প্রসেনজিৎ বোস বাবুয়া। এখন বড় ধূসর, বড় বিবর্ণ মনে হয় এই শহর, এই জনপদকে। একদিন এই জনপদ প্রমত্তা ভৈরবের মত উত্তাল ছিল, আজ তাকে পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের মত বড়ই স্থির, তরঙ্গহীন মনে হয়। মনে হয়, ‘ ছায়াটিও জলে পড়ছে না আর, মরে গেছে জল যেন কার শাড়ি ছিঁড়ে ফালি ফালি, পড়ে আছে হাহাকার হয়ে, উধাও উজ্জ্বল ব্লু, চারদিকে গ্রে গ্রে ধূসরতা’। জানি না, কবে এই ধূসরতা কাটবে।
আবদুল্লাহ আল আমিন: লোকগবেষক ও প্রাবন্ধিক। সহযোগী অধ্যাপক, সরকারি শাহ সুলতান কলেজ, বগুড়া।

মন্তব্য ৩ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (৩) মন্তব্য লিখুন

১| ০১ লা জানুয়ারি, ২০১৫ সকাল ১০:০৪

অপূর্ণ রায়হান বলেছেন: আপনার বর্ণাঢ্য স্মৃতিকথা জেনে ভালো লাগলো +

ভালো থাকবেন সবসময় ।

শুভ ইংরেজি নববর্ষ !:#P

২| ০২ রা জানুয়ারি, ২০১৫ বিকাল ৪:০৫

কলমের কালি শেষ বলেছেন: অসাধারন তথ্য সমৃদ্ধ স্মৃতিচারন ।

৩| ০১ লা জানুয়ারি, ২০১৬ বিকাল ৫:৫৪

রুদ্র জাহেদ বলেছেন: দারুণ সব তথ্যে পরিপূর্ণ অসাধারন একটি লেখা।পড়ে খুব ভালো লাগলো।
অনেক ভালো থাকবেন স্যার...

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.