নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

নবীন আনন্দ

আবদুল্লাহ আল আমিন

আবদুল্লাহ আল আমিন › বিস্তারিত পোস্টঃ

মেহেরপুর মালোপাড়ার সাধক গায়ক শৈলেন হালদার: মুর্শিদরূপে দেখ তারে আল্লাহ হয় কোনজন

২২ শে মার্চ, ২০১৫ রাত ২:০৮

মেহেরপুর মালোপাড়ার সাধক গায়ক শৈলেন হালদার:
মুর্শিদরূপে দেখ তারে আল্লাহ হয় কোনজন
আবদুল্লাহ আল আমিন
আঠারো শতকের শেষের দিকে মেহেরপুর শহরে ভৈরব তীরবর্তী মালোপাড়ায় জন্মেছিলেন লৌকিক গৌণধর্ম বলরামী সম্প্রদায়ের প্রবর্তক বলরাম হাড়ি। হাড়ি ধর্মে দীক্ষিত বিপুল সংখ্যক অন্ত্যজ-অস্পৃশ্যজনের তীর্থভূমি বলরামী সম্প্রদায়ের আখড়ার ঠিক পিছনে জন্মগ্রহণ করেন সুগায়ক ও পদকর্তা শৈলেন হালদার (১৯৪৯-২০১২)। তাঁর পিতা নিবারণ হালদার ছিলেন জেলে, মাতা বীণাবালা ছিলেন গৃহিনী। শৈলেন হালদার উত্তরাধিকার ও জন্মসূত্রে পান দারিদ্র্য, অভাব-অনটন, জাল-নৌকার পাশাপাশি বাউল-বৈষ্ণবদের সহজিয়া ধর্মসাধনা ও বলরামী সম্প্রদায়ের মানবিক চেতনা। পারিবারিক অভাব-অনটন আর জীবন-জীবিকার তাগিদে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গন্ডির মধ্যেই শেষ হয় তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও বৈষ্ণবসাহিত্য, অবতারবাদ, নবীতত্ত্ব, জন্মান্তরবাদ সম্পর্কে বিভিন্ন সাধকের সাহচর্য পেয়ে লাভ করেন গভীর জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা। দু’কন্যা ও এক পুত্রের জনক শৈলেন হালদার সংসার করেছেন চার যুগ ধরে, কিন্তু সংসারী হতে পারিনি। আশৈশেব উদাসী এই গায়ক ও সাধক আমাকে একদিন জানান, ‘সংসারের চেয়ে আখড়া-আশ্রমের প্রতি টান অনুভব করেছি ঢের বেশি। আমি প্রায় পনের বছর লাফা সাধুর (জন্মেঞ্জয় মজুমদার) আশ্রমে কাটিয়েছি।’ তিনি নিজেকে বাউল ভাবাদর্শের একজন ভক্ত বলে দাবি করতেন। বাউল-বৈষ্ণব ধারার সাধকদের মতো তিনি ছিলেন গুরুবাদে বিশ্বাসী। গুরু ছাড়া আত্মার পরিশুদ্ধি ও ভগবানের সান্নিধ্যলাভ সম্ভব নয় বলে তিনি মনে করতেন। ‘আমি গুরু পূজা ছাড়া, কোন দেব-দেবতার পূজা করি না’-এ কথা তিনি আত্মবিশ্বাসের সাথে উচ্চারণ কওে গেছেন। গুরুর প্রতি ভক্তি জানিয়ে তিনি গেয়ে উঠতেন; ‘অনুমানে খুঁজে পেয়েছে কি তারে,। মসজিদ কি মন্দিরে, গীর্জায় কি বনবাসে-। কে পেয়েছ বল আমারে। গুরু কৃষ্ণ শাস্ত্রতে নির্ণয়/কৃষ্ণরূপে গুরু ভজিতে হয়,/তবে সে দেখিতে পায় স¦রূপ মন্দিরে। ঈশ্বর খোদা গড ভগবান/মানুষ রূপে জগতে প্রমাণ,/মানুষ ছাড়া নাই অন্য বিধান/দেখ তুমি বেদ বিধি পড়ে।/ফুলের মূল নাহি পাওয়া যায়, জগৎগুরু কল্পতরু তাহার অন্ত নাই।’ তিনি মনে করেন ঈশ্বর মানুষরূপে ধরাধামে বার বার আবির্ভূত হন মানবের কল্যাণে। মুর্শিদরূপে ভজলেই কেবল তাকে পাওয়া যায়। রুহানি জগতে তিনি নিরাকার ছিলেন, পার্থিব জগতে মুর্শিদ রূপে মানবের কাছে ধরা দিলেন। কথায় কথায় গান বাঁধতে পারার অসাধারণ ক্ষমতা তার ছিল। একদিন ভরাট কন্ঠে, প্রাঞ্জল ভাষায় তার পর্ণকুটিরে আমাকে শুনিয়েছিলেন:
‘নীরেতে নিরঞ্জন বলি শোন মন/মুর্শিদরূপে না ভজিলে মিলবে না তার দরশন। আল¬াহ বলে ডাকলে পারে পাবে না ভবের পরে। মুর্শিদরূপে দেখ তারে, আল¬াহ হয় কোনজন।’
শৈশবে লালন ঘরানার সাধক মেহেরপুরের সাহেবপুর গ্রামের নাসিরুদ্দীন শহের কাছে তিনি চাল-পানি নেন। ১২বছর পর বায়াত হন মেহেরপুরের বাউল সাধক জামাল শাহের কাছে। বৈষ্ণব ধারায় দীক্ষা নেন অনিল দাসের নিকট। শৈলেন হালদার মন্ত্রকে সার করে গুরু ধরেছেন শত শত। তাঁর মতে, ঈশ্বরকে সরাসরি পাওয়া যাবে না, এর জন্য গুরু ধরা প্রয়োজন। তবে, গুরু কখনও সাধারণ মানুষ নন, গুরু হলেন স¦য়ং কৃষ্ণ নিজে। তাঁর গানে বাউল সহজিয়া ধারার পাশাপাশি বৈষ্ণব ধারার ছাপ লক্ষ্য করা যায়। বৈষ্ণব রসে স্নাত এই সাধক গায়ক গাইলেনঃ
‘ধর্ম সনাতন করগো অনে¦ষণ, তবে তো জানিতে পারো গুরু লোকজন। জীবের পরিত্রাণ লাঠি, নন্দসূত হরি হলেন ভূবনে আগমন। গোলকে মূল থুয়ে প্রভু ধরাতে এলেন, জগত মাঝে এসে প্রভু জীবে শিক্ষা দিলেন।’
রাত যত গাঢ় হত, তার গানের ভাব সমুদ্রেও তত তুফান বয়ে যেত । কত না সাধুসঙ্গ আখড়া, আশ্রমে গান গেয়েছেন তার ইয়ত্তা নেই। তবে ভাগলপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাতত্ত্বের অধ্যাপক বিমল মুখোপাধ্যায় এর আমন্ত্রণ ও সহায়তায় কলকাতার শিশিরমঞ্চে গান গাওয়া তাঁর জীবনের দুর্লভ স¥ৃতি; কথাগুলো আমাকে গর্বের সাথে জানিয়েছিলেন। প্রথাগত শাস্ত্রাচারে বিমুখ, মানব প্রেমের উপাসক এই সাধক বাউল দর্শনের সারবত্তা শোনলেন একদিন গানে গানে ‘ফুলে জলে করলে পূজা তরে হয় না তারে। দীপ-ধূপ নৈবেদ্য লাগে না পূজার দ্বারে। পূজায় পূজি যে জন করে সে কি আর খোঁজে বাহিরে/ দেখে সে স¦রূপ দ্বারে/, নয়ন নজরে।’
গানের এই সাধক গান গাওয়ার জনা বিভিন্ন আখড়া-আশ্রমে নিগৃহীত হয়েছেন কিন্তু গান ছাড়বেন না আমৃত্যু, এ ছিল তাঁর ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা। চাঁদবিলের আখড়ায় আজ লালন স্মরণোৎসব। কতজন কত মহতের পদ কতভাবেই তো গাবে, কিন্তু শৈলেন হালদারকে পাওয়া যাবে না। সবকুল ছেড়ে গুরুকূলকে সার ভেবে যিনি জাতকূল মান ত্যাগ করেছিলেন, তাকে আর কোনোদিন পাওয়া যাবে না। সব ত্যাগ করে এখানে, এ আশ্রমে তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন। তার প্রয়াণের দিবসটি আমার মনে নেই, নশ্বর দেহ ত্যাগের পর তাকে এই আখড়াবাড়িতে সমাহিত করা হয়।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.