![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সম্প্রীতি ও সাম্প্রদায়িকতার দোলাচলে বাঙালি মুসলমান
আবদুল্লাহ আল আমিন
বাঙালি মুসলমানের বঞ্চনার ইতিহাস সুদীর্ঘকালের। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত পূর্ববাংলার জনগণ এবং বিশেষত বাঙালি মুসলমান বঞ্চিত হয় কলকাতাকেন্দ্রিক বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের দ্বারা।ভূমির মালিকানা ছিল মূলত হিন্দু জমিদারদের হাতে।মুসলিম সম্প্রদায় ছিল হিন্দু জমিদারদের রায়ত কিংবা ক্ষুদ্র চাষী। গ্রামীণ শিল্প,ব্যবসায়-বাণিজ্যও ছিল হিন্দুদের হাতে আর বড় বড় ব্যবসায়-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করতো মাড়োয়ারিরা।পঁজিবাদী শিল্পের মালিকানা ছিল ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রণে।আমলাতন্ত্র,শিক্ষকতা ও আইনপেশাতেও হিন্দুদের প্রধান্য ছিল। পূর্ববাংলর মুসলমানরা এই সুদীর্ঘ শোষণের পরম্পরা থেকে মুক্তির আকাক্সক্ষায় পাকিস্তান আন্দোলনে যোগ দেয়। তাদের স্বপ্ন ছিল ,পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলে হিন্দুদের অর্থনৈতিক প্রাধান্য খর্ব হবে এবং নিজেদের অর্থনৈতিক বঞ্চনার অবসান ঘটবে।কিন্তু তাদের সেই স্বপ্ন পূরণ হলো না, বরং বঞ্চনার ইতিহাস আরও দীর্ঘতর হলো। ‘ ১৯৪৭ সালর ১৪ আগস্ট পূর্ববাংলার বাঙালিরা যে রাষ্ট্রটির উত্তরাধিকার লাভ করে তার অংশীদার হয় উত্তর-পশ্চিম ভারতের মুসলিমরা এবং পশ্চিমবঙ্গের কিছুসংখ্যক লোকসহ ভারতের মুসলিম সংখ্যালঘু প্রদেশগুলো থেকে আগত উদ্বাস্তুরা’।(রেহমান সোবহান, ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদের অর্থনৈতিক ভিত্তি’।বাংলাদেশের অভ্যুদয়:একজন প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্য।ঢাকা,জুন১৯৯৮। পৃ:২০) বাঙালি মুসলমান যে অন্ধকারে ছিল সেই অন্ধকারেই রয়ে গেল। সত্যি বলতে কি, বাঙালি মুসলমান ১৯৪৭ পর্যন্ত কেবল হিন্দু জমিদার ও ব্রিটিশ শাসকদের দ্বারা শোষিত হয়নি, তারা উত্তর ভারতের মুসলমান ভূস্বামী , মুঘল ও তাদের অনুচররাও শোষণ করেছে। সুদীর্ঘ বঞ্চনার কারণে শিল্প সাহিত্যে,জ্ঞান-বিজ্ঞানে-প্রযুক্তিতে , রাষ্ট্রচিন্তা-দর্শনে বাঙালি মুসলমান উল্লেখ করার মত কোন অবদান রাখতে পারেনি। তবে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা তার অনন্য কীর্তি। এটাই বাঙালি মুসলমানের শ্রেষ্ঠতম কীর্তি ও মহত্তম অর্জন। এই অসামান্য কীর্তির পাশে অন্যসব কীর্তি তুচ্ছ, নগন্য।যদিও সকল ধর্মের মানুষের মিলিত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ সফল হয়েছে, তবুও স্বীকার করতে হবে এ যুদ্ধে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের ভূমিকা ছিল সবচেয়ে উল্লেখ করার মত। রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি মুসলমানের চিন্তন-মনন-সৃজনকর্মে এনে দেয় এক অভূতপূর্ব পরিবর্তন। ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে রূপান্তরিত বাঙালি মুসলমান স¦াধীনতা উত্তর বাংলাদেশকে একটি অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষে বাঙালি জাতীয়তাবাদ,গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রকে নতুন প্রজাতন্ত্রের সংবিধানে মূল স্তম্ভ হিসেবে গ্রহণ করে নেয়।কারণ বাঙালির ২৩ বছরের সংগ্রাম ছিল পাকিস্তানিদের নিষ্ঠুরতা,অমানবিকতা, শোষণ-নিপীড়ন আর তার দ্বি -জাতিতত্ত্ব ভিত্তিক ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্রদর্শনের বিরুদ্ধে।আরও বলে রাখা প্রয়োজন যে,মুক্তিযুদ্ধের প্রধান লক্ষ্য ছিল ন্যায়ভিত্তিক ও সুষম রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম করা। সংগ্রামের নেতৃত্ব বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের মত পাতি বুর্জোয়া দলের হাতে থাকলেও আমাদের মুক্তি সংগ্রামে নি¤œবিত্ত মানুষের অংশ গ্রহণ ঘটে ব্যাপকভাবে। মুক্তির লড়াই সার্বজনীন হওয়া সত্ত্বেও মুক্তির ফসল চলে যায় সুবিধাভোগী আর প্রতিক্রিয়াশীলদের হাতে। সে সুযোগে পাকিস্তানি ভাবধারায় পুষ্ট মডারেট মুসলিম শক্তি আর ধর্মান্ধ মৌলবাদীরা ক্রমাগতভাবে দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও ভাবাদর্শের জাল বিস্তার করতে থাকে। ফলে রাষ্ট্র,সমাজ ও সংস্কৃতিতে বিকৃত ও ধর্মীয় গোঁড়ামিতে ভরা সাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির বিস্তার ঘটে,বিপন্ন হয় বাঙালি সংস্কৃতির সুকৃতিসমূহ। বাঙালি সংস্কৃতির যে অবিনাশী শক্তি একাত্তরে আমাদের জাতি-ধর্মনির্বিশেষে এক সুতোয় গেঁথেছে সেই চিরায়ত মানবিক সংস্কৃতিকে সূহ্ম কৌশলে ইসলামি চেতনা বা ভাবাদর্শের বিরুদ্ধে দাঁড় করানো হয়। অথচ বাঙালিত্ব,অসাম্প্রদায়িকতা,মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে ইসলামি চেতনার কোন বিরোধ নেই;নেই কোন সাংঘর্ষিক সম্পর্ক। ‘ স্মরণ রাখা দরকার,ইসলামের দোহাই দিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র যে শোষণমূলক ব্যবস্থা কায়েম করেছিল,মুক্তিযুদ্ধ ছিল তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম, ইসলামের বিরুদ্ধে নয়।স্বাধীনতার পর মানুষের ধর্মীয় জীবনাচরণের
ওপর কোন বিধি নিষেধ তৈরি হয়নি,যেমন হয়েছিল কামাল আতার্তুকের তুরস্কে ।যিনি মুক্তিযুদ্ধ করেছেন,তিনি নির্বিঘেœ ইসলাম বা অন্য ধর্মচর্চা করেছেন।মুক্তিযুদ্ধের প্রতিশ্রুতি ছিল সব ধর্মাবলম্বীর সমান অধিকার নিশ্চিত করা।’(শাহাদুজ্জামান,‘মোড়কের রাজনীতি’। প্রথম আলো,৩০ জুন ২০১৩।)
১
বাংলাদেশের রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতার উপাদান সব সময়ই ছিল এবং আছে, কিন্তু এর সমাজ ও সংস্কৃতি চিরকাল উদার ও অসাম্প্রদায়িক। এই কারণে বোধ হয়, বিশ্বের চারটি প্রধান ধর্মের মানুষ কয়েক শতাব্দী ধরে পাশাপাশি বসবাস করছে সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির সাথে।বিপুল সংখ্যক জনগণ মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীর জনগণ নির্বিঘেœ ধর্মচর্চা করছে এবং মিলেমিশে বসবাস করছে যুগ যুগান্তর ধরে।যদিও ধর্ম ব্যবসায়ী ফেরেব্বাজরা বাঙালির এই সম্প্রীতি ভাবনাকে ধ্বংস করতে চেয়েছে বারবার, ধর্মকে রাজনীতিতে টেনে এনে মাঝে মাঝেই হানাহানির সৃষ্টি করেছে। তারা বোঝাতে চেয়েছে, ‘হিন্দু-মুসলমানের সংস্কৃতি মূলগতভাবে ভিন্ন।’ তারা আরও বোঝাতে চেয়েছে, ‘এই দুই সম্প্রদায়ের বেশভুষা,খাদ্যাভ্যাস,ভাষা,চলাফেরা,সাহিত্য-সঙ্গীত,ধর্মীয় আচার-আচরণ যেগুলোর মাধ্যমে মানুষের সাংস্কৃতিক জীবনের পরিচয় পাওয়া যায় সেগুলো একেবারে ভিন্ন।’ (বদরুদ্দীন উমর, ‘সাম্প্রদায়িকতা ’। রচনা সমগ্র-১।পৃষ্ঠা:৪১-৪২)।সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের এই দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের সমাজ,সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতার জন্ম দেয়।সাধারণত উচ্চশ্রেণির মুসলমান এবং হিন্দুরাই সংস্কৃতি ও রাজনীতিক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারে ভূমিকা রেখেছে বেশি ।হিন্দু মুসলমান সংস্কৃতির মধ্যে যে কোনো অনৈক্য ও বিভেদ নেই, এ কথা কোনভাবেই বলা যাবে না। তারপরও বাঙালি হিন্দুর সঙ্গে বাঙালি মুসলমানের সম্পর্ক গভীর ও সুদূরপ্রসারী। বিবাহের আচার-অনুষ্ঠান,শিল্প-সাহিত্য, পোশাক-আশাকে রয়েছে অসংখ্য মিল এবং সামাজিক ক্ষেত্রেও দু সম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পরিক প্রভাব সুস্পষ্ট ।অনৈক্যে ও বিভেদের বাঁকে বাঁকে যে মিলনের সুর লুকিয়ে আছে, সেই সুরই বাঙালির সমাজ, সংস্কৃতিকে উদার,অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক করে রেখেছে। আর তাই বাংলাদেশের সেক্যুলারিজম সর্ব অর্থেই অসাম্প্রদায়িকতা যা পাশ্চাত্যের ভাবাদর্শ থেকে সম্পূর্ণরূপে আলাদা।বাংলাদেশের সেক্যুলারিজম হল সকল ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা ও সহিষ্ণুতা প্রদর্শন এবং বিভিন্ন ধর্মের সার্বজনীন সত্যকে ব্যক্তিক ও সামাজিক জীবনে গ্রহণ করা। সেই সাথে ধর্মকে রাজনীতি থেকে পৃথক করে রাখা। ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ধর্মনিরপেক্ষতাকে প্রজাতন্ত্রের মূলনীতি হিসেবে গ্রহণের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, “ ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়।তাতে বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্ম-কর্ম করার স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে। আমরা আইন করে ধর্ম নিষিদ্ধ করতে চাই না এবং করবো না। মুসলমানরা তাদের ধর্ম পালন করবে।তাদের বাধা দিবার ক্ষমতা এই রাষ্ট্রের কারও নেই। হিন্দুরা তাদের ধর্ম পালন করবে,কারো বাধার দিবার মতো ক্ষমতা নেই। বৌদ্ধরা তাদের ধর্ম পালন করবে, খ্রিস্টানরা তাদের ধর্ম পালন করবে।তাদের কেউ বাধা দিতে পারবে না। আমাদের শুধু আপত্তি হলো, ধর্ম কেউ রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে না। ২৫ বছর আমরা দেখেছি ধর্মের নামে জুয়াচুরি, ধর্মের নামে বেঈমানি, ধর্মের নামে অত্যাচার,খুন,ব্যাভিচার বাংলাদেশের মাটিতে চলেছে। ধর্ম অতি পবিত্র জিনিস। পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না।যদি কেউ বলে যে ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়েছেÑÑআমি বলবো,ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়নি। সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মীয় অধিকার রক্ষার ব্যবস্থা করেছি। (গণপরিষদের ভাষণ,১২ অক্টোবর১৯৭২)
’৭২ এর সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাকে মূলনীতি হিসেবে গ্রহণের পর বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ এক বিরূপ পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়। সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী গোষ্ঠী প্রচার চালাতে থাকে এই বলে যে,ধর্মনিরপেক্ষতা আসলে ধর্মহীনতা ছাড়া কিছুই নয়: ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করা হলে স্বাধীনভাবে ধর্ম পালনের কোন সুযোগ থাকবে না। নাস্তিকতার প্রবল প্রতাপে ইসলামি চেতনা ও মূল্যবোধ বিপন্ন হবে।অন্যদিকে, মৌলবাদী নয়; মডারেটপন্থী বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিকদের সমালোচনা হল ,পাশ্চাত্য সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতি থেকে আমদানিকৃত মতবাদ বাংলাদেশের সমাজ ও রজনৈতিক ব্যবস্থায় অচল। তারা আরও বলেন, সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা অন্তর্ভূক্ত করে সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মপ্রাণ মানুষের অনুভূতিতে আঘাত করা হয়েছে। শতকরা ৮৫ ভাগ মুসলমানের দেশে এই মতবাদ গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
বঙ্গবন্ধু ও তার অনুসারীরা যারা ’৭২ এর সংবিধান প্রণয়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন তারা কেউই ধর্মবিরোধী কিংবা নাস্তিক ছিলেন না,বরং ব্যক্তিজীবনে ছিলেন প্রবলভাবে ধর্মবিশ্বাসী। তারা কেবল ধর্মকে রাষ্ট্র ও রাজনীতি থেকে পৃথক করার কথা বলেছেন। অন্যদিকে বামপন্থীরাও বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষতাকে গোঁজামিলের ধর্মনিরপেক্ষতা বলে শনাক্ত করেন। তাদের মতে,“ ধর্মনিরপেক্ষতার একমাত্র অর্থ রাষ্ট্র ও রাজনীতি থেকে ধর্মের পরিপূর্ণ বিচ্ছেদ;এবং ধর্মে বিশ্বস করা বা না করাসহ সব ধরনের বিশ্বাসের অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া।’৭২ এর সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার এই মূল বৈশিষ্ট্যের কোন সুস্পষ্ট ঘোষণা নেই। বরং একগুচ্ছ অস্পষ্ট ও বিমূর্ত বাক্য সন্নিবেশিত করা হয়েছে, যা প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতিনিধিত্ব করে না।”( মফিজুর রহমান লালটু, ‘৭২ এর সংবিধান প্রসঙ্গে।অক্টোবর-ডিসেম্বর২০১৩,নতুন দিগন্ত।) বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষতা সে সময় বিভিন্নভাবে সমালোচিত হয়েছে। কেউ কেউ একে মেকি ধর্মনিরপেক্ষতা বলেছেন। অথচ আমরা উপলব্ধি করছি যে, বঙ্গবন্ধু ব্যক্তি ও সমাজজীবনে ধর্মের অবস্থান মেনে নিয়ে রাজনীতি থেকে ধর্মকে আলাদা করার জন্য ধর্মনিরপেক্ষতার যে নতুন সংজ্ঞা দেন, তা আমাদের গৌরবময় সংস্কৃতি,ইতিহাস ও ঐতিহ্যবোধের সঙ্গে যুক্ত এবং সর্বতোভাবেই মানবিক।
২
পাকিস্তানের স্বপ্নদ্রষ্টারা গত শতকের চল্লিশের দশকে হিন্দু-মুসলমান দুই ভিন্নজাতি বলে দ্বি-জাতিতত্ত্বের যে সূত্র রচনা করেন, তা বাংলার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল না। কারণ বাংলায় হিন্দু-মুসলমান সংঘর্ষ কখনও সাম্প্রদায়িক রূপ নেয় নি। প্রাক ব্রিটিশ আমল থেকেই বাংলার মানুষ নিজেদের পৃথক সাংস্কৃতিক সত্তার অধিকারী বাঙালি জাতি হিসেবে ভাবতে শুরু করে। এ ভূখ-ের মানুষ গভীরভাবে বিশ্বাস করতো,“ অমরা হিন্দু মুসলমান যেমন সত্য,তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি।”(মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ,অভিভাষণ,ঢাকা,৩১ ডিসেম্বর ১৯৪৮)। আবার পাশাপাশি বসবাসের কারণে উভয় সম্প্রদায়ই পরস্পরকে প্রভাবিত করেছে। যেমন , ইসলামের প্রেম, মানবিকতা,সাম্য, ভ্রাতৃত্বের বাণী হিন্দু সম্প্রদায় বিশেষত গৌড়ীয় বৈষ্ণববাদকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। চৈতন্যদেব প্রবর্তিত বৈষ্ণবমতকে বাংলার বিভিন্ন ধর্ম ও লোক ভাবনার মিলিত রূপ হিসেবে গণ্য করেন সমাজতাত্ত্বিক ও গবেষকরা। ‘বৈষ্ণব সাধুদের জীবনকাহিনী প্রকৃতি ও বৈশিষ্টের দিক থেকে তাজকিরাহ ই-আউলিয়ার অনুরূপ,বৈষ্ণব পদাবলী বা গীতিকবিতাকে উপমার ব্যবহার,প্রকাশভঙ্গি বা সার্বিক আকৃতির দিক থেকে গজলের অনুকরণ বলে মনে করা হয়।(গ. ঊহধসঁষ ঐধয়,গঁংষরস ঈড়হঃৎরনঁঃরড়হং ঃড় ঃযব উবাবষড়ঢ়সবহঃ ড়ভ ইবহমধষর খধহমঁধমব ধহফ খরঃবৎধঃঁৎব,উযধশধ,১৯৬২,ঢ়.১০৯)
সুদীর্ঘকাল হিন্দুদের সংস্পর্শে থাকার কারণে মুসলমানরাও হিন্দুদের পালা-পার্বণ, আচার-ব্যবহার, যোগ-তন্ত্র-দর্শন,উৎসব-কৃত্যাচার দ্বারা প্রভাবিত হয়,যদিও তারা ধর্মের মূলনীতির প্রশ্নে ছিলেন অবিচল। গ্রামের সাধারণ মানুষের প্রাত্যহিক জীবনাচারে উল্লেখ করার মতো পার্থক্য ছিল না ,সে হিন্দু হোক অথবা মুসলমান অথবা অন্য ধর্মের। লোকজীবন ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে সমন্বয়ধর্মিতা ও পারস্পরিক প্রভাব স্স্পুষ্টভাবে ধরা পড়ে।‘গাজী কালু চম্পাবতী’ উপাখ্যানে দেবী দুর্গাকে মুসলমানের মাসী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।মুহাম্মদ আকবর তাঁর পুঁথি কাব্যে[১৬৫৭] ঈশ্বরকে আল্লার, কালীকে হাওয়ার,শ্রীকৃষ্ণের দ্বাদশ রাখাল সঙ্গীকে নবি করিম(সা.) এর সাহাবাদের সঙ্গে তুলনা করেন। তিনি হিন্দু দেবদেবীদের নবির মর্যাদা প্রদান করেন এবং চৈতন্যদেবকে মুহাম্মদ(সা.) এর অবতার হিসেবে বর্ণনা করেন। রামাই প-িত তাঁর শূন্য পুরাণে ইসলাম ধর্ম প্রসারকালের চিত্র বর্ণনা করেছেন এভাবে:
‘ জথেক দেবতাগণ/সবে হইয়া একমন/আনন্দেতে পরিল ইজারা ।।
ব্রহ্মা হৈলা মহামদ/বিষ্ণু হৈলা পেকাম্বর/আদম্ফ হইলা শূলপাণি ।।
গণেশ হইলা গাজী/কার্ত্তিক হইলা কাজী/ফকির হইলা যথ মুনি।।
তেজিআ আপন ভেক/নারদ হইলা শেক/ পুরন্দর হইলা মলানা।।
কেউ কেউ আবার মক্কা,মদিনার বন্দনা করতে গিয়ে গয়া,কাশী,বৃন্দাবনের প্রশস্তি রচনা করেছেন। ‘ময়মনসিংহ গীতিকা’র পালাগানেও অসাম্প্রদায়িক ও সমন্বিত জীবনভাবনা ফুটে উঠেছে। ‘ব্রাহ্মণকুমার হইল চ-ালে দূত’ এবং মুসলমান ‘পীরের অদ্ভুত কা- সকলি দেখিয়া,ক’কের পরান গেল মোহিত হইয়া...’। তারপর ‘ জাতিধর্ম সকলি ভুলিয়া পীরের প্রসাদ খায় অমৃত বলিয়া ’ প্রভৃতি উক্তির মধ্য দিয়ে মূলত বাঙালির সমন্বিত জীবন ভাবনা ফুটে উঠেছে।পীর-দরবেশরা জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকলের কাছে এত প্রিয় ছিলেন যে তাদের নিয়ে নানাসব পাঁচালি কাহিনী উপাখ্যান রচিত হয়েছে। মুসলমানের সত্যপির হ্ন্দিুর লোকজীবনে হয়ে ওঠে সত্যনারায়ণ এবং তাকে নিয়ে গড়ে নানা ধরনের কৃত্যাচার।সাধারণ মুসলমানরা সত্যনারায়ণকে সত্যপির ভেবে সত্যনারায়ণের পূজায় অংশগ্রহণ করতো।বাংলার হিন্দু মুসলমানের মধ্যে সৌহার্দ-সম্প্রীতি ও সহবত প্রতিষ্ঠায় মুসলমান সুফি-দরবেশরাও অসামান্য ভূমিকা পালন করেছেন। কারণ ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলকে তারা সমান দৃষ্টিতে দেখতেন।মধ্যযুগে মুসলমান সুলতানরা ছিলেন সর্ব অর্থেই উদার, অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মসহিষ্ণু। চ-ীদাস,বিদ্যাপতি,কৃত্তিবাস,বিজয় গুপ্ত,কবীন্দ্র পরমেশ্বর,শ্রীধর কবিরাজ সহ অসংখ্য কবি মুসলমান সুলতানদের সহয়তা পেয়েছে।আর কবীন্দ্র পরমেশ্বর ,শ্রীকর নন্দী প্রমুখ কবিরাও মুসলমান সুলতানদের প্রশস্তি রচনা করেছেন।এভাবেই সমগ্র মধ্যযুগের সাহিত্য,সমাজ, সংস্কৃতি হয়ে ওঠে অসাম্প্রদায়িক,মানবিক ও সমন্বয়ধর্মী। তাই বলা চলে,আধুনিক বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির শেকড় প্রোথিত আছে মধ্যযুগের অসাম্প্রদায়িক,মানবিক ও সমন্বয়ধর্মী সংস্কৃতি ও মানবিক অধ্যাত্মবাদের গভীরে।
৩
কয়েক শতাব্দী ধরে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে মিল ছিল এবং এই মিলনাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি বাংলায় অসাম্প্রদায়িক ভাবনা বিস্তারে ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু ঊনিশ শতক থেকে বাংলায় হিন্দু মুসলমান সম্পর্কে চিড় ধরতে শুরু করে। ঊনিশ শতকের শেষ দিক থেকে মুসলমান সংস্কারকরা সমন্বয়বাদী অতীন্দ্রিয়ভাবনা ও সংস্কৃতিকে মুসলমান সমাজের অবক্ষয় হিসেবে চিহ্নিত করেন। তরিকায়ে মোহাম্মদীয়া ও ফরায়েজি আন্দোলনের মাধ্যমে ইসলামি চিন্তাবিদ ও সংস্কারকরা মুসলমানদের মধ্যে শুরু করেন শুদ্ধি অভিযান। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল মুসলমানদের মধ্যে শুদ্ধ ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা। এছাড়াও মুসলমান সাহিত্যিকরাও মুসলমানদের ধর্মীয় বিশ্বাসকে জাগ্রত ও সুসংহত করতে ধর্মভিত্তিক সাহিত্য চর্চায় মনোনিবেশ করেন। সাহিত্যিক শেখ অবদুর রহিম(১৮৬১-১৯০৭) খ্রিস্টান পাদ্রিদের বিরুদ্ধে ‘মোহাম্মদের জীবনচরিত ও ধর্মনীতি’ নামে একটি বই লেখেন। মুন্সি মেহেরুল্লাহ ও তার ভাবশিষ্য শেখ জমিরুদ্দিন বিভিন্ন এলাকায় খ্রিস্টান পাদ্রিদের সাথে বাহাসে অবতীর্ণ হন। ইসলাম ও নবি করিম(সা.) এর বিরুদ্ধে পাদ্রিদের অভিযোগ খ-ন করে লেখেন ‘খ্রিস্টান ধর্মের অসারতা’ এবং মুুুুুুুুুসলমানদের মধ্যে শুদ্ধ ইসলাম ফিরিয়ে আনতে লেখেন‘ হিন্দু ধর্ম রহস্য’। উগ্র হিন্দুত্ববাদের বিকাশ ও হিন্দু ধর্মের সংস্কার আন্দোনের প্রতিক্রিয়া হিসেবে মুসলমান লেখক ও চিন্তকগণ স্ব-ধর্ম ও সম্প্রদায়ের স্বার্থ সংরক্ষণের তাগিদে এসব কাজে ব্রতী হন। অপরদিকে ঊনিশ এবং বিশ শতকে হিন্দু লেখক ও বুদ্ধিজীবীরা হিন্দুত্ববাদকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টায় ব্রতী হন। কোনো কোনো লেখক মুসলমান আমলকে অন্ধকার ও লজ্জ্বার যুগ হিসেবে চিহ্নিত করে। দয়ানন্দ সরস্বতীরা তো জাতীয়তাবদী আন্দোলনের নামে উগ্র হিন্দুত্ববাদ ও প্রতিক্রিয়াশীল ভাবনা ছড়াতে থাকে। সি আর দাস,বিপিনচন্দ্র পাল,মানবেন্দ্রনাথ রায়ের মতো বিপ্লবীরাও ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে হিন্দু দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখে আশা করেছিলেন যে মুসলমানরা ঐ জাতীয়তাবাদকে গ্রহণ করবে। ( মুজাফফর আহমদ,আমার জীবন ও ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি।কলকাতা,১৯৭১, পৃ:৪৩২-৪৩৩।) এইভাবে হিন্দুত্ববাদের বিকাশ ঘটে এবং মুসলমানরাও মনে করে যে,হিন্দু লেখকরা মুসলমানদের ইতিহাস ও ধর্মকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করছে।রঙ্গলাল বন্দোপাধ্যায় পদ্মিনী উপাখ্যানে,হেমচন্দ্র তাঁর বীরবাহুতে, নবীন চন্দ্র সেন পলাশীর যুদ্ধ কাব্যে মুসলমানদের কল্পিত অত্যাচারের কাহিনী তুলে ধরে হিন্দুদের সচেতন হবার আহবান জানান ভূদেব মুখোপাধ্যায় শিবাজীকে জাতীয় বীর হিসেবে আখ্যায়িত করেন। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মতো উঁচুমানের সাহিত্যিক নিজেকে হিন্দুত্ববাদের ভাষ্যকার ও প্রচারক হিসেবে তুলে ধরেন। তাঁর আনন্দ মঠ মুসলিম অনুভূতিতে আঘাত হানে প্রবলভাবে। বঙ্কিমের বন্দে মাতরমকে কংগ্রেসের জাতীয় সঙ্গীত করাকে কেন্দ্র করে ওঠে বিতর্কের ঝড়। দশপ্রহরণধারিণী হিন্দু দেবী দুর্গার প্রশস্তিতে ভরা বন্দে মাতরমকে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গ্রহণ করতে মুসলমানরা অস্বীকৃতি জানাই। বঙ্কিমের মতো রমেশ দত্তের উপন্যাস মাধবী কঙ্কনে হিন্দু- মুসলিম বিরোধ তুলে ধরা হয়েছে। মুসলমানদের হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য আওরঙ্গজেবকে নারীলোলুপ শয়তান হিসেবে চিত্রিত করা হয়।এসব কারণে ঊনিশ শতকের নব জাগ্রত প্রগতি আন্দোলন হিন্দুত্ববাদের অন্ধ গলিতে হারিয়ে যায়। তাই সংস্কৃতি তাত্ত্বিক গোপাল হালদার বলেছেন,রাম মোহন থেকে রাজনারায়ণ,বঙ্কিম,বিবেকানন্দ পর্যন্ত সকলেই সর্বভারতীয় হিন্দু ঐতিহ্যের প্রবল ধারাকে বাঙালি হিন্দু ঐতিহ্যের খাতে বহাতে সাহায্য করেছেন।
হিন্দু লেখকদের উপন্যাস ও প্রবন্ধের বিরুদ্ধে মুসলমানের প্রবন্ধ ও উপন্যাসে ওঠে প্রতিবাদের প্রচ- ঝড়।ইসমাইল হোসেন সিরাজী , শেখ আব্দুর রহিম,নুরুদ্দিন প্রমুখ বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্যের বিরুদ্ধে একটি আলাদা সাহিত্য ঘরানা নির্মাণে ব্রতী হন। তারা তাদের লেখায় দেখালেন যে, মুসলমান রমনী নয়;হিন্দু রমনীরা মুসলমান যুবকের প্রেমে পড়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করছে।সাহিত্য ক্ষেত্রে এ ধরনের চাপান উতরের ফল হলো সাহিত্যে সাম্প্রদায়িকতার উদ্ভব। আর এই সাম্প্রদায়িকতা সমন্বয়বাদী মুসলমান ও হিন্দুর মধ্যে কয়েক শতাব্দী ধরে গড়ে ওঠা ঐক্যকে দিল দুর্বল করে । ঊনিশ শতকের শেষ দিক থেকে হিন্দু মুসলিম সাম্প্রদায়িকতা প্রচ-ভাবে মাথাচাঁড়া দেয় । ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ ও ১৯১১ সালের বঙ্গভঙ্গ রদকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মীয় ভাবাবেগ উন্মাদনা ছড়িয়ে পড়ে।অবশ্য রবীন্দ্রনাথ ‘বাংলার মাটি, বাংলার জল ’গেয়ে , মুসলমান গাড়োয়ানের হাতে রাখি পরিয়ে দু’ সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন,কিন্তু বন্দে মাতরময়ালা আর শত শত সংকীর্তন দলের চিৎকারে তার সব চেষ্টাই যেন ভেস্তে যায়। ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ,পরবর্তীতে হিন্দু মহাসভা প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ভিত শক্তিশালী হয় এবং হিন্দু মুসলমানের মধ্যে ভেদরেখা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বিশ শতকের বিশ, ত্রিশএবং চল্লিশের দশকে নজবুল,জসিমউদ্দিন,প্রেমেন্দ্র মিত্র,সুভাষ মুখোপাধ্যায়,বিষ্ণু দে,অমিয় চক্রবর্তী,মানিক বন্দোপাধ্যায়,ওয়ালিউল্লাহু প্রমুখ সমগ্র ঊনিশ শতকের ভুল সংস্কৃতি ভাবনার অবসান ঘটিয়ে নতুন ধারার সাহিত্য ও সংস্কৃতি নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বড় বেশি বিলম্ব হয়ে যাওয়ায় মারাত্মক ভুলটাই সত্যরূপে মেনে নেয় বাঙালি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি। ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবে ধর্মভিত্তিক দ্বিজাতিতত্ত্ব রাজনৈতিক ও দার্শনিকভাবে স্বীকৃতি লাভ করে, যদিও এর উপস্থাপক নিজেকে সাম্প্রদায়িক নেতা হিসেবে মেলে ধরতে চাননি। তথাপিও হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় নিহত অসংখ্য মানুষের রক্তমাখা পথ পেছনে ফেলে ১৯৪৭ সালে দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে বাঙালি মুসলমানের বিপুল সমর্থনে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হল। গান্ধী, নেহেরু, রবীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ,জগদীশ বসু, সত্যেন বোস,সুনীতিকুমার,সুভাস বোস হয়ে উঠলেন হিন্দুর আর জিন্নাহ, ইকবাল, নজরুল, শহীদুল্লাহ ,কুদরত ই খুদা, শেরে বাংলা, সোহরাওয়ার্দি হয়ে গেলেন কেবল মুসলমানের। সাম্প্রদায়িকতার বটিকা আর ধর্মান্ধতার আফিম খেয়ে নেশার ঘোরে মধুসূদনের পাশে কায়কোবাদ, বঙ্কিমের পাশে মীর মশাররফ, বিদ্যাসাগরের পাশে হাজি মহসীনকে বসিয়ে উচ্চকণ্ঠে সংকীর্তন শুরু করে দেয়া হ’ল। বাংলা ভাগের সাথে সাথে বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে পর্যন্ত ভাগ করা হল। হিন্দু মধ্যবিত্ত ভিটেবাড়ি ত্যাগ করে উদ্বাস্তু হল আর সেই সাথে ভ্রান্ত রাজনীতির গোলক ধাঁধাঁয় পথ হারিয়ে বেপথু হল বাঙালির অসাম্প্রদায়িক -মানবিক ভাবনা,রাজনীতি এবং সংস্কৃতি।
৪
যে স্বপ্ন নিয়ে বাঙালি মুসলমান এলিট পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করে, তা ফিকে হয়ে যায় বছর ঘুরতে না ঘুরতেই। পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৫৪ ভাগ বাঙালি হওয়া সত্ত্বেও রাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রকি্রায়ায় বাঙালিদের কোন অংশগ্রহণই ছিল না। বস্তুত বঙালি মুসলমানের নিকট পাকিস্তান ছিল এক প্রভুর কাছে থেকে অন্য প্রভুর অধীনে যাওয়ার মতো। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে পাকিস্তান হয়ে ওঠে কর্তৃত্ববাদী,অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। ইসলামি রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান ইসলামের গৌরব বৃদ্ধি করতে না পারলেও গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় ষোলআনা। ক্রমাগতভাবে রাষ্ট্রটি পশ্চিমা মুসলমান মধ্যবিত্ত ও তাদের এদেশীয় তল্পিবাহকদের স্বার্থ রক্ষাকারী সফল প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠে। ১৯৫২ সালে পশ্চিমা মুসলমান মধ্যবিত্ত ও তাদের নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতিভ’রা প্রবলভাবে আঘাত হানে বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির ওপর ।উদার ও অসাম্প্রদায়িক ভাবধারায় পুষ্ট বাঙালি মুসলমান পাকিস্তানি রাষ্ট্রযন্ত্রের এই অগণতান্ত্রিক আচরণের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তৎকালীন পূর্ববাংলায় অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্ফূরণ ঘটে।“ ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই সর্বপ্রথম বাঙালি মুসলমান ‘মুসলমান বাঙালিতে’ রূপান্তরিত হতে শুরু করলো এবং সমস্ত সংস্কার বর্জন করে,উর্দুকে নিজের ভাষা হিসেবে বাতিল করে,বাংলাকে স্বীকার করল মাতৃভাষা রূপে। এই ভাবে মধ্যবিত্ত বাঙালি মুসলমানদের জীবনে সূত্রপাত হল এক অভ’তপূর্ব চেতনার।”(বদরুদ্দীন উমর,সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা,ফেব্রুয়অরি।)ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে ফিরে এলো পহেলা বৈশাখ, নবান্ন উৎসব,বসন্ত উৎসব;ফিরে এলো রবীন্দ্র-নজরুল-লালন-হাসন এবং মধ্যযুগের মরমি সাধকদের মানবিক অধ্যাত্মবাদ। এই ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে ‘বাঙালি মুসলমানের ঘরে ফেরা’ শুরু হল। বিরূপ ও বৈরী প্রতিবেশকে প্রতিহত করে এই ঘরে ফেরার সংগ্রাম অব্যাহত রইল। তারপর ধাপে ধাপে ৫২,৫৪, ৬২,৬৬,৬৯,৭০ পেরিয়ে এলো একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। ন’মাস ব্যাপী রক্তাক্ত যুদ্ধের মাধ্যমে অভ্যুদয় ঘটলো স্বাধীন বাংলাদেশের । মুক্তিযুদ্ধ ছিল আত্মসচেতন বাঙালি মুসলমানের অসাম্প্রদায়িক,শোষণমুক্ত,গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লড়াই। আর এই লড়াইয়ের প্রতিপক্ষ ছিল পাকিস্তান নামক প্রতিক্রিয়াশীল,সাম্প্রদায়িক ও মৌল-মানবাধিকার বিরোধী রাষ্ট্রযন্ত্র।তাই এ লড়াইয়ের মাধ্যমে জয়ী হয় গণতন্ত্র,অসাম্প্রদায়িকতা,শোষণমুক্তির স্বপ্ন আর পরাস্ত হয় দ্বি-জাতিতত্ত্ব,সাম্প্রদায়িকতা এবং সামরিক স্বৈরতন্ত্র।
যে স্বপ্ন নিয়ে স্বাধীনতা,মুক্তি,ন্যায্যতা,সমতা ও সম্প্রীতির পথে বাঙালির পথচলা, সেই পথচলার শেষ হয়নি আজও। জানি না ,পথের শেষ কোথায়! স্বাধীনতার পর চার দশকের বেশি সময় পার হয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশ এখনও উন্নত,আধুনিক রাষ্ট্র হয়ে উঠতে পারেনি। মৌলবাদ,সাম্প্রদায়িকতা,জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটেছে; ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক শক্তিসমূহ কখনও কখনও কাঁপিয়ে দিচ্ছে রাষ্ট্রের ভিতকে।তারপরও শঙ্কিত হবার কিছু নেই, বাংলাদেশ জয়ী হবে; বাঙালির স্বপ্নরথ পথ হারাবে না। তার দুর্মর স্বপ্নরথের যাত্রা সফল হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সাথে নিয়েই। ‘মুক্তিযুদ্ধকে পাশ কাটিয়ে, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নেই’(আহমদ ছফা)।কারণ মুক্তিযুদ্ধের ঔরসে বাংলাদেশের জন্ম এবং মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অবিভাজ্য সম্পর্ক। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের এগিয়ে যাবার কোনো সুযোগ নেই। আর তাই মুক্তিযুদ্ধের আলোক ধারায় ¯œাত চার মূলনীতিকে সঙ্গে নিয়েই বাংলাদেশেকে এগিয়েযেতে হবে গণতন্ত্র, সুশাসন,সামাজিক ন্যায়বিচার ও অসাম্প্রদায়িকতার পথে ।
আবদুল্লাহ আল আমিন: লোকগবেষক ও প্রাবন্ধিক। সহযোগী অধ্যাপক, মেহেরপুর সরকারি কলেজ, মেহেরপুর।
©somewhere in net ltd.