![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
জাহানারার আত্মকথা: মানবিক সম্প্রীতির প্রসন্ন আলো অথবা সাম্প্রদায়িকতার অন্ধ গলি
আবদুল্লাহ আল আমিন
আধুনিককালের রাষ্ট্রে নানা মতপথ, ভাবাদর্শ ও সম্প্রদায়ের মানুষ বাস করে। তাই রাষ্ট্রকে অবশ্যই অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মসহিষ্ণু হতে হয়, অসাম্প্রদায়িকতা ছাড়া মানবিক ও সর্বজনীন রাষ্ট্র গড়ে তোলা সম্ভব নয়। আর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র তো সর্বঅর্থেই মানবিক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। গণতন্ত্রের সংগ্রামে ধর্মে আস্থাশীল মানুষের সমাগম থাকতে পারে, কিন্তু ধর্মব্যবসায়ী মতলববাজরা কখনোই সেখানে থাকে না। মওলারা আবুল কালাম আজাদ, মওলানা ভাষানীরা ধর্মনিষ্ঠ হলেও ধর্মনিরপেক্ষ ও অসাম্প্রদায়িক সমাজেই বিশ্বাস করতেন। আর একজন ব্যক্তি যিনি নিজ ধর্মের প্রতি আস্থাশীল, জ্ঞানী ও শ্রদ্ধাশীল সে স্বভাবতই উদার ও অসাম্প্রদায়িক হয়। সম্প্রতি প্রকাশিত সাবা নাকভির লেখা ‘ ইন গুড ফেইথ’ পড়ে সেই বার্তাটিই পাওয়া গেল। তিনি লিখেছেন, বিমান ভট্টাচার্য, কালীঘাটের এক পূজারী ব্রাহ্মণ যিনি কালীমায়ের পূজার পাশাপাশি তপসিয়ায় মানিকপুরের পিরের মাজারে শ্রদ্ধা জানাতে যান প্রতিদিন। আর এই কাজটি তিনি একই ভক্তিতে দীর্ঘ ৪৫ বছর ধরে করে চলেছেন। ভাবতে অবাক লাগে, যেখানে উপমহাদেশ জুড়ে সাম্প্রদায়িকতার অশুভ শক্তি মাথাচাঁড়া দিয়েছে, সেখানে একজন পূজারী ব্রাহ্মণ এই স্পিরিটটা পেলেন কোথায় ? বিমান ভট্টাচার্যের এই বহুমুখী আধ্যাত্মিক ও মানবিক সত্তার উৎসই বা কোথায় ? তিনি ঠিক করছেন, না- কী, অন্যায় করছেন সে বিতর্কে যাবো না, তবে এই সহিষ্ণুতা অর্জন করতে পারা বেশ কঠিনই বলতে হবে। তবে, বাঙালি ও ভারতীয় সংস্কৃতির ঐতিহ্যের মধ্যে এই সমন্বয়বাদিতা ও সহমর্মিতার অবস্থান রয়েছে সুপ্রাচীন কাল থেকেই। উপমহাদেশের সাংস্কৃতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলেও দেখা যাবে যে, বৈদিক সাহিত্যেও ছিল মানবিকতা, সমন্বয়বাদিতা ও সামাজিক ন্যায্যতার মর্মবাণী। সম্প্রতি কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর জন স্ট্রাটন হাউলে তাঁর ‘ আ স্টর্ম অব সংস: ইন্ডিয়া এন্ড দ্য আইডিয়া অব দ্য ভক্তি মুভমেন্ট’ গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে, প্রাচীনকাল থেকেই ভারতে ধর্মীয় সমন্বয়বাদের ঐতিহ্য ছিল। শাজাহানপুত্র দারাশিকোর বেদচর্চা, উপনিষদের অনুবাদকর্ম যেমন আমাদের মুগ্ধ ও বিস্মিত করে, তেমনি স¤্রাট অশোক থেকে আকবরের অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রনীতি আমাদের গৌরবান্বিত করে।
এ কালের রাষ্ট্রচিন্তক, ভাবুক, দার্শনিক থেকে রাজনৈতিক নেতৃত্ব, সংস্কৃতিসেবী থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি সচেতন শিক্ষার্থী সাম্প্রদায়িকতা ও সম্প্রীতির ইতিহাস নিয়ে যেমন ভাবছেন, তেমনি আগেও এ সব নিয়ে চিন্তা করা হয়েছে। তার প্রমাণ মিলেছে স¤্রাট শাজাহান-কন্যা জাহানারা রচিত আত্মজীবনী থেকে। অন্তঃপুরবাসিনী এই রাজনন্দিনী নিভৃতে আত্মজীবনী লিখতেন। পরবর্তীকালে এই আত্মজীবনী দুর্গের ভগ্নস্তুপ থেকে আবিস্কার করা হয়। মোঘল স¤্রাটদের মধ্যে আত্মজীবনী লেখার রেওয়াজ ছিল মোঘল রাজবংশ প্রতিষ্ঠার সূচনালগ্ন থেকে। মোঘল বংশের প্রতিষ্ঠাতা তৈমুর লেখেন ‘মালফুজাত ই- তৈমুরা’, স¤্রাট বাবর লেখেন ‘তুজুক ই বাবরী। স¤্রাট আকবর-কন্যা গুলবদন বেগম লেখেন ‘হুমায়ুন নামা’। জাহাঙ্গীর লেখেন ‘তুজুক ই- জাহাঙ্গীর’। জাহানারার আত্মজীবনী পড়ে গভীরভাবে জানা গেল যে, স¤্রাট আকবর মনে প্রাণে অসাম্প্রদায়িক ছিলেন। রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে তিনি স¤্রাট অশোকের সমন্বয়বাদী অনুসরণ করতেন। দিন ই- ইলাহী প্রতিষ্ঠাকালেও তিনি সর্বধর্ম সমন্বয়ের কথা বলেছেন বারবার, মুহুর্তের জন্যও তিনি অমুসলমান বিশেষ করে, হিন্দুদের নিরাপত্তার বিষয়টি বিস্মৃত হননি। শাহজাহান দুহিতা জাহানারার আত্মজীবনী থেকে জানা যায় যে, আকবরের জীবনচর্যা ও ধর্মচর্চায় ইসলামি সূফিবাদের প্রবল প্রভাব ছিল। তার সময়কালে ইসলামের উদার ও মানবিক দিকটার প্রসার লাভ করে ব্যাপকভাবে। সে আমলে ভারতের জনজীবন মুখর ছিল মানবিক সম্প্রীতির প্রসন্ন আলোয়।
মোঘল রাজবংশের এই স¤্রাট ছিলেন নানা গুণের অধিকারী এক বিরলপ্রজ ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন একাধারে প্রজাহিতৈষী, স্থিরপ্রাজ্ঞ, পরমতসহিষ্ণু,দয়ালু ও শিল্প-সাহিত্যানুরাগী। অন্যের মন জয় করার অলৌকিক ক্ষমতা তার ছিল। সম্ভবত তিনিই প্রথম নৃপতি যিনি বিশাল ভারতবর্ষকে একটি একক রাজনৈতিক কর্তৃত্বের অধীনে নিয়ে আসেন। রাজপুত জমিদাররা অন্য স¤্রাটদের কাছে বশ্যতা স্বীকার না করলেও, স¤্রাট আকবরের রাজাদেশ মেনে নিয়েছিলেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে। আকবরও রাজপুতদের সঙ্গে সখ্য সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য রাজপুত কন্যা যোধাবাঈ-এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। আকবর-পুত্র জাহাঙ্গীরের ধমনীতে ছিল অর্ধেক মুসলমান- মোঘল রক্ত এবং অর্ধেক হিন্দু রাজপুত রক্ত। জাহাঙ্গীরের স্ত্রী অর্থাৎ শাহজাহানের মাতাও ছিলেন রাজপুত কন্যা। রাজপুতরা স¤্রাট আকবরের গুণগ্রাহী ছিলেন; আকবর যেমন রাজপুতদের আপনজন মনে করতেন, তেমনি তারাও স¤্রাটের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখার জন্যে মুসলমানদের সাথে সম্প্রীতি বজায় রেখে চলতো। মোঘল-রাজপুত সুসম্পর্কের কারণে স¤্রাজ্যের রাজনৈতিক সংহতি সুদৃঢ় হয়, শাসনকার্য পরিচালনা, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, জীবনচর্যা, শিল্প-সংস্কৃতি চর্চায় ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। এক পর্যায়ে মোঘলরা ভারতীয় হয়ে ওঠেন আর রাজপুতরাও পারস্য সংস্কৃতির অনেক কিছুই আত্তীকরণ করে নেয়। রাষ্ট্র ও সমাজের উচ্চ থেকে নি¤œস্তর পর্যন্ত সর্বত্র উদার, সহনশীল, সমন্বয়বাদী চিন্তা ও ভাবুকতার বিস্তৃতি ঘটে। জওহরলাল নেহেরু তাঁর ‘ ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’ গ্রন্থে বলেছেন, তাঁর ( আকবর) রাজসভা সকল ধর্মের লোকের, এবং যারাই নতুন মতপ্রচার করেছেন কিংবা নতুন কিছু উদ্ভাবন করেছেন, তাদের মিলনের স্থান হয়ে উঠেছিল।’ তিনি সকল ধর্মমতের জন্য এতই উদার ছিলেন যে গোঁড়া মুসলমানরা তাকে অপছন্দ করতো। সব মানুষের জন্য গ্রহণীয় একটা ধর্মমত প্রবর্তন করার চেষ্টা করেছিলেন তিনি । তাঁর রাজত্বকালে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক জোরদার হওয়ায় পরস্পরের মধ্যে সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান বৃদ্ধি পায়। মোগল আমলে ‘রেকর্ডার অব ইনভেন্টস’ নামে একটি পদ সৃষ্টি করা হয়। এই রাজকর্মচারীর কাজ ছিল স¤্রাটের বাণী লিখে রাখা। মোঘল সংস্কৃতির অসাম্প্রদায়িক ও সহনশীল ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধতর করতে যিনি অনন্য ভূমিকা পালন করেছেন, তিনি স¤্রাট শাহজাহান-পুত্র দারাশিকো। উপনিষদের সারমর্ম অবলম্বনে তিনি রচনা করেন ‘ সর ই-আসবারে’। জাহানারা তারঁ আত্মকথা রচনা করেন কারাগারে বসে। বলতে দ্বিধা নেই, মোঘল আমলে অনেক হিন্দু মন্দির ধ্বংসের এবং হিন্দু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু হিন্দু নির্যাতনের সেই ইতিহাস তর্পণ করে মুসলমানদের ওপর নির্যাতন করা কী ঠিক হবে ? নিশ্চয় কোন বিবেকবান রাজনীতিক এমনকি উগ্র সাম্প্রদায়িক ব্যক্তিও তা সমর্থন করবে না। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, রন্তিদেব সেনগুপ্তের লেখা এক প্রবন্ধ থেকে জানা যায়, ১৯২৬ সালের ২৩ ডিসেম্বর দিল্লিতে নিজ বাসভবনে আব্দুর রশিদ নামের এক আততায়ীর গুলিতে নিহত হন আর্য সমাজের নেতা স্বামী শ্রদ্ধানন্দ। কোন নিষ্ঠাবান মুসলমান কী এই হত্যাকা- সমর্থন করবে ? না, করবে না, করতে পারে না। মহাত্মা গান্ধীর হত্যাকারীর প্রতি তীব্র ঘৃণা জানিয়েই বলছি, গান্ধীর হত্যাকা-ের পিছনে যারা হিন্দু মৌলবাদীদের সম্পৃক্ততা খুঁজে বেড়ান, তারা কিন্তু স্বামী শ্রদ্ধানন্দের হত্যাকা-ের বিরূদ্ধে প্রতিবাদ করেননি কোনকালেই। রবীন্দ্রনাথ অবশ্য এই হত্যাকা-ের বিরদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জাানিয়ে ‘স্বামী শ্রদ্ধানন্দ’ শীর্ষক একটি নিবন্ধ রচনা করেন। প্রবাসী’র মাঘ ১৩৩৩ সংখ্যায় প্রকাশিত এই নিবন্ধে তিনি লেখেন, ‘ যদি মুসলমান মারে আর আমরা পড়ে পড়ে মার খাই, তবে জানব এ সম্ভব করেছে শুধু আমাদের দুর্বলতা।’ কাজেই রবীন্দ্রনাথ কিন্তু কোন ধরণের ভীরুতা কিংবা কাপুরুষোচিত আচরণের পক্ষেও ছিলেন না। আজ ধর্মের নামে উগ্রতা সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে। ব্যাঙ্ককের ব্রহ্মা মন্দির চত্বরে বোমা বিস্ফোরণ হয়েছে, নিহত হয়েছে অসংখ্য মানুষ। এর জন্য বিশেষ কোন ধর্মীয় সম্প্রদায়কে দায়ী করে তাদের ওপর চড়াও হওয়া যায় না। এই পরিস্থিতিতে ইসলাম ও মৌলবাদকে যেমন গুলিয়ে ফেলা ঠিক হবে না, তেমনি হিন্দু ও হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিকে একাকার করে দেখাও ইতিহাসসম্মত হবে না। নির্মোহ ও বস্তুনিষ্ঠভাবে রাজনীতি ও ইতিহাসের বিশ্লেষণ হতে হবে। ইতিহাস ও রাজনীতির অপব্যাখ্যা ও বিকৃতি জাতিগত দাঙ্গা উসকিয়ে দেবে, সমাজে বিভেদ-বিভক্তি সৃষ্টি করবে।
মার্কসবাদী তাত্ত্বিক ও লেখক রাহুল সাংস্কৃত্যায়ন তার ‘ আকবর’ নামক গ্রন্থে ইতিহাসের নির্মোহ বিশ্লেষণই দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, অশোকের পর আমাদের দেশে দ্বিতীয় মহান ধ্রুবতারা আকবর। অশোকের মতোই আকবর ছিলেন সকল ধর্মের প্রতি উদার ও শ্রদ্ধাশীল। স¤্রাট আকবর প্রবলভাবেই আস্তিক ছিলেন, তার জীবনচর্যায় নাস্তিকতার স্থান ছিল না। তিনি বিশ্বের সব ধর্মকে সত্য ও মহৎ বলে জানতেন ও মানতেন। আর এটাই তো আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের অসাম্প্রদায়িকতার ভিত্তি, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গঠণের প্রেরণাও তো আমরা তাঁর কাছ থেকে পেয়েছি। বোধ হয় এসব কারণে, আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতি,দর্শন ও ভাবুকতা সব সময় ধর্মান্ধতা- গোঁড়ামি-সংকীর্ণতা ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, মানবিকতা ও অসাম্প্রদায়িকতার পক্ষে। আজ উপমহাদেশ জুড়ে এই প্রশ্নই বারবার উচ্চারিত হচ্ছে যে, আমরা কোন দর্শনের আলোকে চলবো? অশোক-আকবরের দেখানো অসাম্প্রদায়িক মানবিক চেতনার আলোকধারায় ¯œাত হয়ে, না-কী উগ্র ধর্মান্ধতার পূঁতিগন্ধ সর্বাঙ্গে লেপটে নিয়ে ? সবাইকে নিয়ে মিলেমিশে একসাথে চলবো, না-কী একা একা চলবো? আজ বংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানসহ বিশ্ব মানব সমাজ এক গভীর সংকটের মুখোমুখি, তাই আজকের এই সমস্যাদীর্ণ প্রেক্ষিতে জাহানারার গ্রন্থটি আলোকবর্তিকা স্বরূপ। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর জরহরলাল নেহেরু ভারতবর্ষের ভৌগোলিক অখ-তা, রাজনৈতিক সংহতি, স্থিতিশীলতার জন্য বহুত্ববাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদকে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। ভারতের বর্তমান শাসকদেরও ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে নেহেরুর দেখানো বহুত্ববাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার পথে হাঁটতে হবে। সকল প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য বাংলাদেশকেও অসাম্প্রদায়িকতা ও মানবিকতার পথেই চলতে হবে। দ্বিজাতিতত্ত্ব ভিত্তিক ধর্মাশ্রয়ী অপরাজনীতি পরিত্যাগ করে উদার অসাম্প্রদায়িক মানবিক দর্শনের ভিত্তিতে যে দেশের অভ্যুদয়, সে দেশ কেন সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের অন্ধগলির দিকে পা বাড়াবে? অমরা বিশ্বাস, অসাম্প্রদায়িকতা, মানবিকতা, সামাজিক ন্যায়বিচার ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা বিধানের প্রশ্নে বাংলাদেশ কোনদিন আপস করবে না। ১৯৪৭ সালের আগে ও পরে ধর্মের নামে কম সংঘাত হয়নি, আর এ সব সংঘাতের জন্য কেবল ইংরেজদের ভেদনীতিকে দায়ী করা হলে শুধু সত্যের অপলাপ হবে। প্রাক-ব্রিটিশ যুগেও সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি ও মানবিক ঐক্যতানের পাশাপাশি হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কে ফাটল ছিল। আসলে, এসব সংঘাতের জন্য আমাদের জেদ, অহমিকা, পারস্পরিক অবিশ্বাস, অন্ধত্বও কম দায়ী নয়। ঐতিহাসিক ও রাজনীতি-বিশ্লেষকরা বলেন, সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির বীজ আমাদের সমাজ ও রাজনীতির ভেতরেই নিহিত ছিল, ইংরেজরা কেবল তা উসকিয়ে দিয়েছিল।
ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে বিষয়টি স্পষ্ট হয় যে, এদেশের অধিকাংশ মুসলমান এই ভূখ-ের সন্তান, তারা বহিরাগত নন, তারা হিন্দু বা অন্য ধর্ম থেকে ধর্মান্তরিত মুসলমান। কাজেই শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এ ভূখ-ে যারা বসবাস করছেন তারা নিশ্চিতভাবেই মুসলমানদের আত্মীয় ও পূর্বপুরুষ। আত্মীয়ের সঙ্গে দ্বন্দ্ব-বিরোধ করতে নেই, বিরোধ বাধলেও তার মিটমাট জরুরি। আর উত্তরপুরুষ হিসেবে অতীতের শিল্প-সাহিত্য-স্থাপত্য-ভাস্কর্যে মুসলমানদের রয়েছে সমান উত্তরাধিকার। সুতরাং বখতিয়ার খিলজি কর্তৃক নবদ্বীপ জয়ের পর মুসলিম যুগের সূচনা আর নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের পর মুসলমান জামানার সমাপ্তি- এ ব্যাখ্যা আসলে ইতিহাসের ভ্রান্ত বিশ্লেষণ। হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক এবং তাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাস যৌক্তিকভাবে বিশ্লেষণ করা দরকার। তামাম দুনিয়ার মুসলমান সম্প্রদায়কে একপ্রাণ, একজাতি ভাবা যেমন বিজ্ঞানসম্মত নয়, তেমনি এক জল-হাওয়ায় পরিপুষ্ট, একই গাত্রবর্ণের হিন্দু-মুসলমানকে আলাদা ভাবাটাও অনৈতিহাসিক। ইতিহাস, ঐতিহ্য,ভুগোল,রাজনীতির নিরিখে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক দেখা দরকার। বেদনার্ত হতে হয়, শতাব্দীর পর শতাব্দী পাশাপাশি বাস করার পরও এক ধর্মের অনুসারীরা অপর ধর্মের লোকজনকে খুন করেছে ? এই খুনোখুনি করে কেউ কী লাভবান হতে পেরেছে ? আমার জানা নেই। তবে বিকৃত ও ভ্রান্ত ইতিহাসের দায় আমরা বয়ে বেড়াচ্ছি বছরের পর বছর ধরে। ভারতে মুসলমানরা হত্যার শিকার হয়েছে তো হিন্দুরা হয়েছে পাকিস্তানে। রবীন্দ্রনাথ পল্লীকবি জসীমউদ্দীনকে বলেছিলেন, ‘কেন যে মানুষ একের অপরাধের জন্য অপরকে মারল। ও দেশের মুসলমানেরা হিন্দুদের মারল। তাই এ দেশের হিন্দুরা মুসলমানদের মেরে তার প্রতিবাদ করবে, এই বর্বর মনেবৃত্তির হাত থেকে দেশ কী ভাবে উদ্ধার পাবে, বলতে পার?’ জানি না, কবে এই বর্বরতার অবসান হবে আর কবে যে উদ্ধার পাবো।
©somewhere in net ltd.