![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের এনসাইক্লোপিডিয়া: মেহেরপুর সদর উপজেলা
আবদুল্লাহ আল আমিন
১। উপজেলার নাম: মেহেরপুর সদর, মেহেরপুর। [১৯৭১ সালে বৈদ্যনাথতলা গ্রামটি মেহেরপুর সদর থানার অন্তর্গত ছিল, বর্তমানে গ্রামটি মুজিবনগর উপজেলার অন্তর্গত।]
২। উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি: ষাটের দশক থেকে মেহেরপুরে আওয়ামী লীগ, ন্যাপ(ভাসানী), কৃষক সমিতি, ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের সাংগঠনিক ভিত্তি শক্তিশালী হতে থাকে। ১৯৬৭ সালে মেহেরপুর কলেজ ছাত্র-সংসদ নির্বাচনে শাহাবাজউদ্দিন নিজ্জু ও আব্দুর রবের নেতৃত্বে ছাত্রলীগের প্যানেল বিজয়ী হলে আওয়ামী লীগের রাজনীতি জোয়ার আসে এবং সহিউদ্দিন,ইসমাইল হোসেন, আ কা ম ইদ্রিস,ডা. আবু আব্দুল্লাহ, নুরুল হক, জালালউদ্দিন, ডা. ইসমাইল প্রমুখের নেতৃত্বে গ্রামে-গঞ্জে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কার্যক্রম জোরদার হয়। ১৯৬৮ সালের শেষার্ধে আবু বক্কর, মোজাম্মেল, আনোয়ারুল হুদার নেতৃত্বে লালটুপি পরা ভাসানীপন্থী কৃষক সমিতির সাংগাঠনিক তৎপরতা বৃদ্ধি পায়। এসময় মহকুমা ন্যাপের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন আহাম্মদ আলী ও আ ক ম শহীদুল্লাহ। আওয়ামী লীগ ও ভাসানী ন্যাপের সাংগাঠনিক কর্মকা-ের মাধ্যমে শহরকেন্দ্রিক রাজনীতি গ্রাম-গঞ্জে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগ প্রার্থী সহিউদ্দিন এবং প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগ প্রার্থী নুরুল হক বিজয়ী হন। এরপর থেকে আওয়ামী লীগ হয়ে ওঠে মেহেরপুরের জনগণের আশা আকাক্সক্ষার একমাত্র প্ল্যাটফর্ম।নির্বাচর বর্জনের কারণে সংগঠন হিসেবে ভাসানী ন্যাপ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং গণ প্রত্যাখাত হয়ে মুসলিম লীগ ও জামায়াতে ইসলামীর মত সাম্প্রদায়িক দলগুলির অস্তিত্ব প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যায়।
মার্চ জুড়ে মেহেরপুরের রাজপথ ছিল ছাত্র,কৃষক,জনতার স্বতঃস্ফূর্ত মিছিলে উত্তাল। ১ মার্চ সরকারি দমন পীড়ন ও হত্যাকা-ের বিরুদ্ধে মেহেরপুরের ছাত্রসমাজ তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। ২ মার্চ মেহেরপুর শহরে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ উদ্যোগে বিশাল মিছিল বের হয়। ৩ মার্চ মেহেরপুর শহরে সর্বত্মক হরতাল পালিত হয়। ৪ মার্চ প্রতিটি ইউনিয়নে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ হয়। ৪ থেকে ৬ মার্চ প্রতিদিন শহরে অর্ধদিবস হরতাল পালিত হয়। হরতাল চলাকালে স্কুল-কলেজ, অফিস আদালত, দোকান পাট, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে। হরতাল চলাকালে প্রতিদিন গ্রাম-গঞ্জ থেকে শহরে মিছিল আসে। বেতারে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ শোনার পর মেহেরপুরের ছাত্র-জনতা জয়বাংলা ধ্বনি দিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ে। সেদিন মুক্তিকামী জনতার গগনবিদারী শ্লোগানে মেহেরপুর শহর ছিল প্রকম্পিত। বেলা তিনটায় মেহেরপুর মহকুমা আওয়ামী লীগের সভাপতি সহিউদ্দিনের সভাপতিত্বে শহরে এক জরুরী সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা মোতাবেক মহকুমা, থানা, পৌর এলাকা, ইউনিয়ন পর্যায়ে এবং সম্ভব হলে প্রত্যেক গ্রামে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। জাতীয় পরিষদ সদস্য সহিউদ্দিনকে আহবায়ক করে মেহেরপুর মহকুমা সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। সংগ্রাম কমিটির অন্যান্য সদস্যরা ছিলেন প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নুরুল হক, ইসমাইল হোসেন, আব্দুল মান্নান মাস্টার, আ কা ম ইদ্রিস , হিসাবউদ্দিন,জালালউদ্দিন, শাহাবাজউদ্দিন নিজ্জু, ডা. আবু আব্দুল্লাহ, আব্দুর রশিদ, এনামুল হক, ডা. মহিউদ্দিন, খাদেমুল ইসলাম, আব্দুর রহমান, নঈমউদ্দিন প্রমুখ। ডা. আবু আব্দুল্লাহ, নঈমউদ্দিন, ফইমউদ্দিন, এ কে আশকারী পটল, আতাউল হাকিম, মানিক মিয়া, শাজাহান খান বিশুর নেতৃত্বে মেহেরপুর শহর সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। সলেমান মিয়া ( গহরপুর), ডা. আব্দুল মান্নান (টুঙ্গি), ফণিভূষণ সাহা (রাজনগর)’র নেতৃত্বে পিরোজপুর, আব্দুল মান্নান মাস্টার ( গোপালপুর),ডা.আব্দুল মান্নান এর নেতৃত্বে মহাজনপুর, ডা. মহিউদ্দিন (আমঝুপি), শামসুজ্জোহা, আব্দুস সাত্তার এর নেতৃত্বে আমঝুপি, আহাম্মদ আলী ( আমদহ) এর নেতৃত্বে আমদহ, আবুল কাশেম ( গোভীপু) এর নেতৃত্বে বুড়িপোতা, ডা. আহসানউল্লাহ ( কুলবাড়িয়া) এর নেতৃত্বে কুতুবপুর, আ কা ম ইদ্রিস (দারিয়াপুর), ডা. কমরউদ্দিন (ভবানীপুর) মোনাখালি, আব্দুল মোমিন চৌধুরী, দোয়াজ আলী মাস্টার ( ভবরপাড়া) এর নেতৃত্বে বাগোয়ান ইউনিয়ন সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়।
১৫ মার্চ মেহেরপুরের ছাত্রজনতার বিক্ষুব্ধ মিছিল থানায় গিয়ে মানচিত্র খচিত স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে এবং এরপর থেকে বিভিন্ন অফিস থেকে জিন্নাহ’র প্রতিকৃতি নামিয়ে ফেলা হয়। সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ গ্রহণের আহবান জানিয়ে এমএনএ সহিউদ্দিন, আ কা ম ইদ্রিস, আব্দুল মান্নান মাস্টার ও ইসমাইল হোসেনের নেতৃত্বে বিভিন্ন ইউনিয়নে জনসভা অনুষ্ঠিত হয়।
৩। মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি, এর সংগঠক ও প্রথমিক প্রশিক্ষণ:
কুষ্টিয়া ও চুয়াডাঙ্গা জেলা দখলদার বাহিনীর দখলে চলে যাবার পর একাত্তরের ১৮ এপ্রিল তারা চুয়াডাঙ্গা থেকে মেহেরপুর অভিমুখে রওনা হয় এবং আমঝুপিতে বর্বরোচিত হামলা চালায়। এতে ৩৮জন মানুষ গণহত্যার শিকার হয় এবং প্রতিরোধ ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পড়ে। আক্রান্ত জনসাধারণ ভিটেমাটি, ঘর-বাড়ি ছেড়ে পশ্চিবঙ্গের নদীয়া ও মুর্শিদাবাদ জেলার বিভিন্ন গ্রামে আশ্রয় নেয়। দেশত্যাগী যুবক-তরুণরা প্রশিক্ষণের জন্য বেছে নেয় ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার হৃদয়পুর যুব অভ্যর্থনা ক্যাম্প, বেতাই ক্যাম্প, শিকারপুর ক্যাম্প এবং করিমপুর ক্যাম্পে। ১৯ এপ্রিল মেহেরপুর জেলার মুজিবনগরের নিকটবর্তী পশ্চিমবঙ্গের চাপড়া থানার সীমান্তবর্তী গ্রাম হৃদয়পুরে যে ক্যাম্পটি খোলা হয় সেখানেই মূলত মেহেরপুরসহ বৃহত্তর কুষ্টিয়ার ছাত্র-যুবকরা আশ্রয় নেয়। নদীয়া জেলা প্রশাসকের সার্বিক সহযোগিতায় পরিচালিত এ্ই ক্যাম্পের ইন চার্জ ছিলেন চুয়াডাঙ্গার আওয়ামী লীগ নেতা এডভোকেট ইউনুছ আলী। মেহেরপুর মহকুমা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জাতীয় পরিষদ সদস্য সহিউদ্দীন, এ কে আসকারী পটল, রমজান আলী ও খাদেমুল ইসলাম বেতাই যুব ক্যাম্প; প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য ও গাংনী থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি নুরুল হক শিকারপুর যুব ক্যাম্প; গাংনী থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসাবউদ্দীন, জালালউদ্দীন করিমপুর ক্যাম্পের দায়িত্ব পালন করেন। এরা ছিলেন মেহেরপুর জেলা ও সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা ও মুক্তিযুদ্ধের মূল সংগঠক এবং এদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে বিশাল মুক্তিবাহিনী । মুক্তিবাহিনীর এই সদস্যরা মেহেরপুর জেলা এবং জেলার বাইরে দূরবর্তী রণাঙ্গণে লড়াই করেছেন, কেউ কেউ শহীদ হয়েছেন। দখলদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে এই বাহিনীই বীরত্বপূর্ণ লড়াই এখন ইতিহাসের অংশ।
এছাড়াও আওয়ামী লীগ নেতা আ কা ম ইদ্রিস আলী, আব্দুল মান্নান মাস্টার, ইসমাইল হোসেন, শাহাবাজউদ্দিন নিজ্জু,ডা. আবু আব্দুল্লাহ, ডা. মহিউদ্দিন আহমেদ, মফিজুর রহমান, প্রসেনজিৎ বোস বাবুয়া, আব্দুর রব, আতাউল হাকিম লালমিয়া মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে অনন্য ভূমিকা পালন করেন।
৪। পাকহানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রাথমিক প্রতিরোধ: ২৫ মার্চ কালোরাত্রিতে ঢাকাসহ দেশের প্রধান প্রধান শহরে পাকহানাদার বাহিনী পরিচালিত গণত্যার খবর মেহেরপুরে আসে নুরুল হক এমপি’র মাধ্যমে মহকুমা প্রশাসক তৌফিক ই- এলাহীর কাছে। খবর পাবার পর মহকুমা প্রশাসক তৎক্ষণাৎ জাতীয় পরিষদ সদস্য সহিউদ্দিন ও মেহেরপুরের আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দকে অবহিত করেন। ২৫ মার্চের গভীর রাতেই পাক হানাদার বাহিনীর বর্বরতা,অগ্নিসংযোগ, গণহত্যার খবরটি মাইকে প্রচার করে মেহেরপুর শহরসহ পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের মানুষকে জানিয়ে দেয়া হয় সেই সাথে জনগণকে প্রতিরোধযুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতে আহবান জানানো হয়। মহকুমা প্রশাসক তৌফিক ই এলাহীর নির্দেশনা মোতাবেক আমঝুপি, রাজনগর, বারাদি প্রভৃতি গ্রামের আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীসহ মুক্তিকামী জনগণ পাকবাহিনীর সম্ভাব্য আক্রমণ মোকাবেলার সর্বাত্মক প্রস্তুতি নেয়। পাকবাহিনীর আক্রমণ থেকে মেহেরপুরের জনগণকে রক্ষার জন্য ২৫ মার্চের রাতেই মেহেরপুর-কুষ্টিয়া সড়কের মাথাভাঙ্গা নদীর ওপরের খলিশাকুন্ডির ব্রিজ ভেঙ্গে ফেলা হয় এবং মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গা সড়কে বড় বড় গাছের গুড়ি ফেলে ব্যারিকেড সৃষ্টি করা হয়। সেইসাথে ট্রেনিং প্রাপ্ত আনসার,মুজাহিদ, ইপিআর, অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্যদের একত্রিত কওে সশস্ত্র প্রতিরোধযুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়। প্রশিক্ষণ প্রদান, সশস্ত্র প্রস্তুতি ও সামরিক আয়োজনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এস এম আল আমিন, বশির আহমেদ, আনসার এডজুটেন্ট হাশেম খান প্রমুখ। যুদ্ধকালীন সময়ে জ্বালানি তেলের প্রায়োজনীয়তার কথা বিবেচনায় রেখে পার্শ্ববর্তী চুয়াডঙ্গা ও পশ্চিমবঙ্গের করিমপুর পেট্রোল পাম্প থেকে জ্বালানি তেল আনিয়ে রাখা হয়। ২৬ মার্চ মহকুমা প্রশাসকের কার্যালয়ে প্রতিরোধযুদ্ধ পরিচালনার জন্য কন্ট্রোল রুম স্থাপন করা হয়। মহকুমা প্রশাসক যুদ্ধের সাংগাঠনিক কাজে ব্যস্ত থাকায় কন্ট্রোল রুমে পর্যায়ক্রমে দায়িত্ব পালন করতেন ইসমাইল হোসেন, এ কে আশকারী পটল,শাহবাজউদ্দিন নিজ্জু, খাদেমুল্ ইসলাম, মেহেদী বিল্লাহ প্রমুখ। মেহেরপুরের অধিকাংশ বন্দুক মালিকদের নিয়ে হানাদার বাহিনী প্রতিরোধে বন্দুক বাহিনী গঠন করা হয়। ২৬ মার্চ সকালে মহকুমা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে মহকুমা প্রশাসক তৌফিক ই এলাহী চৌধুরী স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। এরপর থেকে তিনি গাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা ব্যবহার করতেন। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা-শুশ্রুষা ও চিকিৎসার জন্য আওয়ামী লীগ নেতা ডা. আবু আব্দুল্লাহ’র নেতৃত্বে একটি মেডিকেল টিমও গঠন করা হয়।
৫। উপজেলায় পাকহানাদার বাহিনীর অনুপ্রবেশ ও ক্যাম্প স্থাপন: ১৮ এপ্রিল মেহেরপুর উপজেলায় পাকহানাদার বাহিনী অনুপ্রবেশ করে। ওইদিন আমঝুপি ও মেহেরপুর শহরের ওয়াপদা মোড়ে গণহত্যা চালানোর পর মেহেরপুর সিও অফিসে ( বর্তমান উপজেলা পরিষদ) ক্যাম্প স্থাপন করে। ১৯ ও ২০ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গা থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিশাল বহর এসে শহরের মেহেরপুর-কুষ্টিয়া সড়ক সংলগ্ন মেহেরপুর সরকারি কলেজের বিশাল এলাকা দখল করে মূল ঘাঁটি স্থাপন করে। পরবর্তীতে ভোকেশনাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, কবি শিক্ষা মঞ্জিল, কালাচাঁদপুর ঘাট, নূরপুরে ক্যাম্প স্থাপন করে।
৬। পরিচিতিসহ উজেলায় পাকবাহিনীর সহযোগী ব্যক্তিবর্গ, দল/ সংগঠনের-রাজাকার/ আলবদর/ আলশামস/শান্তি বাহিনী গঠন ও এদের তৎপরতা: ১৯৭১ সালের মে মাসের প্রথমদিকেই মেহেরপুর সদর উপজেলায় শান্তি বাহিনী গঠনের নামে স্বাধীনতা বিরোধী ঘাতক, দালালদের সংগঠিত করা হয়। এরা অধিকাংশই ছিলেন মুসলিম লীগ ও জামায়াতে ইসলামীর স্থানীয় নেতা, কর্মী ও সমর্থক। সাফদার আলী বিশ্¦াসকে সভাপতি ও এ্যাডভোকেট আব্দুল মতিনকে সম্পাদক করে মেহেরপুর মহকুমা শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অন্যান্য সদস্যরা ছিলেন আওলাদ হোসেন কনট্রাক্টর, আক্তার খান, মাহাতাব আলী খান, আব্দুল কাদের বিশ্বাস (বুড়িপোতা), মেহেরপুর পৌরসভার চেয়ারম্যান এলাহীদাদ ভিখু মিয়া, কাওসার মিয়া, এ্যাড. খালেদুজ্জামান, হাশেম খান, আব্দুল গনি বিশ্বাস, আদম আলী বিশ্বাস প্রমুখ। মেহেরপুর সদর থানা শান্তি কমিটির সভাপতি ও সম্পাদক ছিলেন যথাক্রমে আওলাদ হোসেন কনট্রাক্টর, আক্তার খান এবং মেহেরপুর শহর কমিটর সভাপতি ছিলেন মাহাতাব খান। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে জাতীয় পরিষদে এ্যাড. আব্দুল মতিন জামায়াত প্রার্থী এবং এ্যাড. খালেদুজ্জামান কনভেনশন মুসলিম লীগের প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। নির্বাচনে উভয়ের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়ে যায়। ১৯৭১ সালে শান্তি কমিটি গঠনের পর এ্যাড. আব্দুল মতিন হয়ে ওঠেন মেহেরপুর মহকুমার দ-মু-ের কর্তা। তারই নেতৃত্বে মেহেরপুর সদর থানার গ্রামে গ্রামে গড়ে ওঠে রাজাকার-আলবদর বাহিনী।
২২ এপ্রিল সদর থানার পিরোজপুর গ্রামে স্থানীয় জামায়াত ও মুসলিম লীগ নেতাকর্মীদের সহযোগিতায় পাকহানাদার বাহিনী নলীন রাজবংশীর পুত্র ভেজাল রাজবংশী, কালিপদ দত্তের পুত্র জীবন দত্ত, বিশ্বনাথ রাজবংশী, মধাব কু-ুকে হত্যা করে। ৫০/৬০ টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয় এবং ব্যাপক লুটতরাজ চালানো হয়।
২৯ এপ্রিল পাকহানাদার বাহিনী স্থানীয় দালালদের সহযোগিতায় ভৈরব নদীর পশ্চিম তীরের যাদবপুর, গোভীপুর, কামদেবপুর প্রভৃতি গ্রামে অগ্নিসংযোগ, লুঠতরাজ, নারী নির্যাতন করে। এই লুঠপাট ও অগ্নিসংযোগে নেতৃত্ব দেন স্থানীয় মুসলিম লীগ নেতা মাহাতাব খান। ৮জন সাধারণ মানুষকে ধরে এনে মেহেরপুর কোর্ট বিল্ডিং এর সামনে হত্যা করে।
মে মাসের ১০/ ১১ তারিখে পাকবাহিনী ও তাদেও দোসররা পিরোজপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা ফণীভূষণ সাহার রাজনগরের বাড়িতে হামলা চালায় ও লুঠতরাজ করে। এদিন রাজনগর গ্রামের দু’জন নারী সম্ভ্রম হারায়।
১৭ মে পাকবাহিনী ও তাদেও স্থানীয় দোসররা শালিকা গ্রামে হামলা চালায় ও তিনজনকে হত্যা করে। সেদিনের অভিযানে নেতৃত্ব দেন রাজাকার কমান্ডার লতিফ মোল্লা, ঝাউবাঢ়িয়ার সালাউদ্দিন, গোভীপুরের বাদল প্রমুখ।
মে মাসের শেষার্ধে রাজাকার ক্যাপ্টেন লতিফ মোল্লা, গোভীপুরের আওলাদ, বাদলসহ ১৫ সদস্যের রাজাকার বাহিনীর সহযোগিতায় পাকহানাদার বাহিনী রাজাপুর গ্রামে হামলা চালায় এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। মুক্তিযোদ্ধা বজলুর রহমানের বড়ভাই আকছেদ আলী, চাচাত ভাই হানিফসহ পাঁচজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
১৮ আগস্ট জাতীয় পরিষদ সদস্য সহিউদ্দিন এবং ৩ সেপ্টেম্বর প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নুরুল হককে সামরিক আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ জারি করা হয়। এ সংবাদটি টিনের চোঙ দিয়ে শহরে প্রচার করেন মুসলিম লীগ নেতা কাদের মিয়া।
৭। পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের হত্যা, গণহত্যা, নারীনির্যাতন, অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠনের ঘটনা:
মেহেরপুর সদর উপজেলায় যেসব গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে সেগুলির বিবরণ নি¤েœ উল্লেখ করা হ’ল:
ক) আমঝুপি গণহত্যা: মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলা আ¤্রকাননে মুজিবনগর সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের পরের দিন অর্থাৎ ১৮ এপ্রিল পাকহানাদার এক বিশাল বহর চুয়াডাঙ্গা থেকে মেহেরপুরে আসার পথে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালায়। পাকহানাদার বাহিনীর এলোপাথাড়ি গুলিতে সেদিন ৩৮ জন মুক্তিকামী মানুষ গণহত্যার শিকার হয়।
খ) ওয়াপদা মোড় গণহত্যা: ১৮ এপ্রিল মেহেরপুর ওয়াপদা মোড়ে পাকবাহিনী আরও একটি গণহত্যা চালায়। সেদিনের বেপরোয়া গুলিবর্ষণে ১৭ বাঙালি প্রাণ হারায়। গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত ছিন্নভিন্ন লাশ ওয়াপদা মোড়ের বিভিন্ন স্থানে ২/৩ দিন পড়ে থাকে।
গ) পিরোজপুর গণহত্যা: ২২ এপ্রিল পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা সদও উপজেলার পিরোজপুর গ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের ৪জনকে হত্যা করে।
গ) বুড়িপোতা গণহত্যা: ২২ এপ্রিল মেহেরপুরের সীমান্তবর্তী গ্রাম বুড়িপোতায় পাকবাহিনী ২জন সাধারণ মানুষকে হত্যা করে।
ঘ) গোভীপুর গণহত্যা: ২৯ এপ্রিল পাকবাহিনী ও তাদের স্থানীয় দোসররা গোভীপুর থেকে ৮ জন লোক ধরে এনে মেহেরপুর কোর্ট বিল্ডিং এর সামনে হত্যা করে। ঐ দিন ভৈরব নদের পশ্চিম তীরবর্তী গ্রামগুলিতে অগ্নিসংযোগ,নারীনির্যাতন, লুটপাট করে।
ঙ) শালিকা গণহত্যা: ১৭ মে পাকহানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা শালিকা গ্রামে ৩ জনকে হত্যা করে।
চ) কোলা গণহত্যা: পাকবাহিনীর দোসরদের সহায়তায় পাকসৈন্যরা মুজিবনগর উপজেলার মহাজনপুর গ্রামের ৪ জন মুজাহিদকে ধরে এনে মেহেরপুর কলেজ ক্যাম্পে নির্যাতনের পর কোলা গ্রামে নিয়ে গিয়ে ঐ গ্রামের আরও ২ জনের সাথে তাদের গুলি করে হত্যা করে।
ছ) বাড়িবাঁকা গণহত্যা: ১০ আগস্ট পাকবাহিনী স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় বাড়িবাঁকা থেকে ৪ জন গ্রামবাসীকে ধরে এনে তিনদিন নির্যাতনের পর মেহেরপর কলেজ ক্যাম্পের পেছনে হত্যা করে
৮। পাকবাহিনীর নির্যাতন কেন্দ্র, বন্দিশিবির
পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী গোটা বাংলাদেশকেই পরিণত করে এক বিশাল নির্যাতন কেন্দ্রে। ১৮ এপ্রিল পাকবাহিনী মেহেরপুরে ঢোকার পর যে সব নির্যাতন কেন্দ্র গড়ে তোলে তা নি¤œরূপ:
মেহেরপুর থানা পরিষদ: এটি জেলার প্রথম নির্যাতন কেন্দ্র, মেহেরপুর সরকারি কলেজ : জেলার সর্ববৃহৎ নির্যাতন কেন্দ্র, ভোকেশনাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট ( বর্তমান সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজ), কবি নজরুল শিক্ষা মঞ্জিল ও কালাচাঁদপুর ঘাট।
৯। বধ্যভূমি ও গণকবর: পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা ন’মাসব্যাপী নির্বিচারে লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করে। একই দিনে একই স্থানে নির্বিচারে গণহত্যা চালিয়েছে। মেহেরপুর সদর উপজেলার যেসব গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে সেগুলির মধ্যে ১৮ এপ্রিলের আমঝুপি গণহত্যা, ওয়াপদা মোড় গণহত্যা, ২২এপ্রিল পিরোজপুর গণহত্যা, ২৯ এপ্রিল গোভীপুর গণহত্যা, ১৭ মে শালিকা গণহত্যা, মে শেষার্ধে রাজাপুর গণহত্য, ২ জুন বুড়িপোতা গণহত্যা, ১০ আগস্ট বাড়িবাঁকা গণহত্যা উল্লেখযোগ্য।
মেহেরপুর সদর উপজেলায় যেসব গণকবর চিহ্নিত করা রয়েছে : মেহেরপুর সরকারি কলেজ মোড়, মেহেরপুর কোর্ট বিল্ডিং,কোলা ও সোনাপুর।
মেহেরপুর উপজেলায় যেসব স্থানকে বধ্যভূমি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে : মেহেরপুর সরকারি কলেজের উত্তরে বিস্তৃত খোলামাঠ, মেহেরপুর সরকারি কলেজ হোস্টেল ও এর সংলগ্ন উত্তরপূর্বের বিস্তৃত খোলামাঠ এবং কালাচাঁদপুর ঘাট।
১০। মুক্তিযুদ্ধের কমান্ডার/ কমান্ডারবৃন্দ: বশির আহমেদ, পিতা: গরীবুল্লাহ, ম-লপাড়া, ৫নং ওয়ার্ড, মেহেরপুর। এস এম আলামিন, পিতা: নজর আলী, যাদবপুর, মেহেরপুর। আব্দুল ওয়াহাব,আমঝুপি, মেহেরপুর।
১১। শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকা ও পরিচয়:
১. মো. ফজলুর রহমান, পিতা: মো. নাসিরউদ্দিন, স্টেডিয়ামপাড়া, মেহেরপুর।
২. মো. মনসুর আলী, পিতা: শমসের আলী, গ্রাম: বন্দর, মেহেরপুর। তিনি ৩১ মার্চ কুষ্টিয়ার প্রতিরোধযুদ্ধে আহত হন এবং ২৮ নভেম্বর মৃত্যু বরণ করেন।
৩. মহরম আলী, পিতা: আয়েন উদ্দিন, মেহেরপুর । ৩ মে তেরঘরিয়ায় সম্মুখযুদ্ধে শহীদ হন।
৪. রফিকুল ইসলাম, পিতা: মনসুর আহমেদ, গড়পাড়া, মেহেরপুর। ৬ জুলাই মেহেরপুরে বিদ্যুৎ লাইন বিচ্ছিন্ন করতে গিয়ে পাক হানাদার বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে শহীদ হন।
৫. আব্দুল জব্বার, পিতা: মাহাতাব উদ্দিন বিশ্বাস,আমঝুপি, মেহেরপুর। জুলাই মাসের মাঝামাঝিতে তিনি পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে শহীদ হন।
৬. নাসির উদ্দিন, পিতা: আয়েনউদ্দিন জোয়ার্দ্দার , মদনাডাঙ্গা, মেহেরপুর। ৮ জুলাই ইছাখালি সীমান্তে সম্মুখযুদ্ধে শহীদ হন।
৭. আসগর আলী, পিতা: গয়েছ উদ্দিন, আমঝুপি, মেহেরপুর। পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে শহীদ হন।
৮. মো. খয়ের উদ্দিন, পিতা: মো. নছরউদ্দিন, আমঝুপি, মেহেরপুর।
৯. আব্দুস সাত্তার, পিতা: জিন্দার বকসো, আমঝুপি, মেহেরপুর। ১৮ এপ্রিল পাকবাহিনীর গুলিতে শহীদ হন।
১০. জালাল হোসেন, পিতা: কালু ম-ল, বড়শিবাড়ি, মেহেরপুর। জুলাই মাসে নিজ বাড়ি থেকে পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে শহীদ হন।
১১. আব্দুস সালাম পিতা: আব্দুল হামিদ বিশ্বাস, পিরোজপুর, মেহেরপুর।সাতক্ষীরার সম্মুখযুদ্ধে শহীদ হন।
১২. আবু জাফর, পিতা: ফজল শেখ, পিরোজপুর, মেহেরপুর।
১৩. কাসেদ আলী, পিতা: ফজল শেখ, , গোভীপুর, মেহেরপুর। ১৩ আগস্ট বুড়িপোতা এলাকায় সম্মুখযুদ্ধে শহীদ হন।
১৪. আব্দুল মান্নান, পিতা: হেকমত আলী, কুতুবপুর, মেহেরপুর। ২২ জুলাই বুড়িপোতার সম্মুখযুদ্ধে তিরি শহীদ হন।
১৫. খয়ের উদ্দিন, পিতা: কছিমউদ্দিন, , পিরোজপুর, মেহেরপুর। ১৩ অক্টোবর আমঝুপিতে পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে শহীদ হন।
১৬. আবুল হোসেন, পিতা: পাঁচু শেখ, মেহেরপুর। ২৬ আগস্ট মেহেরপুরে পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে শহীদ হন।
১৭. খয়েরউদ্দিন, পিতা: নছর শেখ, রাজনগর, মেহেরপুর। মোহাম্মদপুরে রাজাকারের গুলিতে শহীদ হন।
১৮. সাদেক আলী , পিতা: হোসেন আলী ম-ল, উজলপুর, মেহেরপুর। কালাচাঁদপুরে সম্মুখযুদ্ধে আহত হন, পরে ১৭ ডিসেম্বর মারা যান।
১৯. মুন্সি ঈমান আলী, পিতা: মুন্সি মিনাজউদ্দিন, বুড়িপোতা, মেহেরপুর। কালাচাঁদপুরে সম্মুখযুদ্ধে শহীদ হন।
২০. সিরাজুল ইসলাম, পিতা: খেলাফত আলী, বন্দর, মেহেরপুর। কালাচাঁদপুরে সম্মুখযুদ্ধে শহীদ হন।
২১. আরজ আলী, মেহেরপুর। মেহেরপুর কোর্ট বিল্ডিং এ গ্রেনেড নিক্ষেপের পর ভৈরব নদ পার হবার সময় নদীতে ডুবে শহীদ হন।
২২. আব্দুল হামিদ, পিতা: আব্দুর রশীদ, মল্লিকপাড়া, মেহেরপুর। নিজ বাড়িতে পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে শহীদ হন।
২৩. লোকমান হোসেন, পিতা: ইশাব ম-ল, পিরোজপুর, মেহেরপুর।শালিকার খালপাড়ার যুদ্ধে শহীদ হন।
২৪. আলাউদ্দিন, পিতা: পঞ্চা শেখ, শালিকা, মেহেরপুর।
২৫. আফসার আলী, পিতা: দেলবার ম-ল, পিরোজপুর, মেহেরপুর। ৭ সেপ্টেম্বর বাগোয়ান যুদ্ধে শহীদ হন।
২৬. আলিমউদ্দিন ম-ল, দিঘিরপাড়া, মেহেরপুর। ১১ জুন সাতক্ষীরা জেলার সম্মুখযুদ্ধে শহীদ হন।
১২। পাকবাহিনীর সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধের ঘটনা:
২১ এপ্রিল বুড়িপোতা পুকুরপাড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকবাহিনীর সম্মুখযুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১জন নিহত হয় এবং শালিখা গ্রামের আনসার ইউনুছ আলী ও গোভীপুরের আবুল কাশেম শহীদ হন। ২২ এপ্রিল ভারতীয় বাংলা পত্রিকা যুগান্তওে খবরটি ছাপা হয়।
৩ মে তেরঘরিয়া রুদ্রনগরে পাকবাহিনীর সঙ্গে নিয়মিত বাহিনীর রক্তক্ষয়ি যুদ্ধে শোলমারীর আনসার সদস্য মহরম আলী শহীদ হন।
৫ মে রাত ১২:০০টায় মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গা সড়কের বারাদি গ্রামে শালিকার আব্দুর রশিদ ও আমঝুপির রমজান আলীর নেতৃত্বে ২০ সদস্যের মুক্তিবাহিনীর একটি দল পাকসেনাদের গাড়িবহরে আক্রমণ করে। কয়েকজন পাকসেনা নিহত হয় বলে খবর পাওয়া যায়। এ যুদ্ধে পাকবাহিনীর মেজর মহব্বত আলী খান নিহত হয়।
৬ জুন ইচাখালিতে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পাকবাহিনীর সম্মুখযুদ্ধে ২/৩ জন পাকসেনা নিহত হয় এবং পাকসেনাদের গুলিতে একজন সাধারণ মানুষ শহীদ হয়। নায়েক মতিনের নেতৃত্বে ১৫/২০ সদস্যের একটি এ যুদ্ধে অংশ নেয়।
২২ জুলাই কালাচাঁদপুরে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিসেনাদের প্রচ- গুলিবিনিময় হয়। মুক্তিবাহিনী মেহেরপুর পাওয়ার হাউজের ওপর হামলা চালিয়ে ট্রান্সফরমারটি সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেয়। খবরটি ভারতীয় পত্রিকা ‘যুগান্তরে’ ২৩ জুলাই ১৯৭১ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়।
১২ আগস্ট মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল যাদবপুরে পাকসেনাদের অস্থায়ী ক্যাম্পে হামলা চালায়। পরদিন পাকবাহিনীর বিশাল বহর মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর আক্রমণ করে এবং মুক্তিযোদ্ধারাও প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এদিনের সম্মুখযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা আবুল কাশেম শেখ শহীদ হন।
১৯ সেপ্টেম্বর মুক্তিবাহিনী কামদেবপুরে একজন পাকসেনাকে খতম করে।
২০ অক্টোবর মেহেরপুরের পশ্চিমে ভৈরব তীরবর্তী গ্রামগুলিতে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকবাহিনীর প্রচ- লড়াই হয়। ২১ অক্টোবর মেহেরপুরের পশ্চিমে ভৈরব তীরবর্তী কামদেবপুর ও কালাচাঁদপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকবাহিনীর সংঘর্ষে ৬ জন পাকসেনা নিহত হয়।
২৪ নভেম্বর মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা মেহেরপুর শহর ঘিরে ফেলে এবং ভীতু সন্ত্রস্ত হয়ে পাকবাহিনী পিছু হটতে থাকে। খবরটি ২৫ নভেম্বর ১৯৭১ সংখ্যায় আনন্দবাজার পত্রিকায় ছাপা হয়।
৬ ডিসেম্বর মেহেরপুর জেলার মানুষের জন্য অবিস্মরণীয় দিন। এই দিন মেহেরপুর সদর উপজেলাসহ সমগ্র জেলা হানাদার মুক্ত হয়।
১৪। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিসৌধ ও সড়ক:
মুক্তিযুদ্ধে মেহেরপুর জেলার অবদান অসামান্য। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলা (গস্খামটি বর্তমানে মুজিবনগর উপজেলায় অবস্থিত) গ্রামের আম্রকাননে বাংলাদেশের প্রথম সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণ করে। পাশাপাশি এদিন স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ ও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা অনুমোদন করা হয়। সেদিন থেকে মেহেরপুর সদর থানার বৈদ্যনাথতলা নামের অখ্যাত গ্রামটি মুজিবনগর নামে পরিচিতি লাভ করে। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দিন আহমেদকে প্রধানমন্ত্রী এবং ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, এ এইচ এম কামরুজ্জামান ও খন্দকার মোশতাক আহমেদকে মন্ত্রীসভার সদস্য করে বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠিত হয়। এই সরকারের নেতৃত্বে ন’মাসব্যাপী সশস্ত্র যুদ্ধ পরিচালিত হয় এবং অর্জিত হয় বিজয়।
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারের আনুষ্ঠানিক শপথ গ্রহণের ঐতিহাসিক স্মৃতিকে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য বঙ্গবন্ধুর সরকার একটি স্মৃতিসৌধসহ কমপ্লেক্স প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করে। ১৯৭৪ সালের ১৭ এপ্রিল তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী সৈয়দ নজরুল ইসলাম মুজিবনগরে একটি জাদুঘর নির্মাণের জন্য ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এম. মনসুর আলী ‘বঙ্গবন্ধু তোরণ’ এর ফলক উন্মোচন করেন। ১৯৮৮ সালে নির্মিত হয় ‘মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ’। স্থপতি তানভীর কবির পাকিস্তানি শোষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে বাঙালির গৌরবময় সংগ্রামের ২৩ বছরকে প্রতীকায়িত করেছেন উদীয়মান সূর্যের আদলে নির্মিত এই স্মৃতিসৌধের ২৩ রশ্মির দেয়ালে। কেন্দ্রে রয়েছে স্বাধীনতার প্রতীক লাল সূর্য। এই লাল সূর্য একই সঙ্গে ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যূত্থান ও একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের সংগ্রামী চেতনাকে ধারণ করে।
আর দ্বিতীয় প্রধান স্থাপত্য নিদর্শন হচ্ছে মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গা সড়কের দক্ষিণে মেহেরপুর সরকারি কলেজ মোড়ে অবস্থিত ‘শহীদ স্মৃতিসৌধ’। মুক্তিযুদ্ধের এই স্মারক বা স্মৃতিসৌধটি নির্মিত হয় মুক্তিযুদ্ধে নাম না জানা শহীদদের গণকবরের ওপর। মেহেরপুর পৌরসভার অর্থায়নে নির্মিত এই স্মৃতিসৌধের মূল থিম‘ প্রজ্বলিত শিখা’। এছাড়াও মেহেরপুর শহরে রয়েছে শহীদ গফুর সড়ক, শহীদ হামিদ সড়ক, শহীদ আরোজ সড়ক ও শহীদ রফিক সড়ক।
১৫। উপজেলা হানাদার মুক্ত হবার দিন: ৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ এ মেহেরপুর সদর উপজেলা হানাদার মুক্ত হয়।
১৬। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিল থানা/ জেলা কমান্ডারের নাম ও ফোন নং- বশির আহমেদ, কমান্ডার, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, জেলা কমান্ড কাউন্সিল, মেহেরপুর। ফোন: ০১৭১৭-০০৮৩৫০ ।
মো. সিরাজুল ইসলাম, কমান্ডার, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, উপজেলা কমান্ড কাউন্সিল, মেহেরপুর সদর, মেহেরপুর। ফোন: ০১৭২৪-১৩৫৮৪৫।
১৭। বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা / রাজৈৈনতিক ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ: মো. হিসাব উদ্দিন, সাবেক সভাপতি, মেহেরপুর জেলা আওয়ামী লীগ। যাদবপুর রোড, হোটেল বাজার, মেহেরপুর।
বশির আহমেদ, কমান্ডার, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, জেলা কমান্ড কাউন্সিল, মেহেরপুর। ম-লপাড়া, মেহেরপুর।
গবেষকের নাম: আবদুল্লাহ আল আমিন
সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান
মেহেরপুর সরকারি কলেজ, মেহেরপুর।
ফোন নং ০১৮১৬-০৫৬৯৩৪।
©somewhere in net ltd.