![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
মরমি সাধক মাতু ফকির ও তার গান
আবদুল্লাহ আল আমিন
লালন-উত্তর মরমি ভাবুকতার অন্যতম প্রধান পুরুষ মাতু ফকিরের পিতৃদত্ত নাম গোলাম রহমান, উত্তরকালে সাধক জীবনে মাহাতাব চিশতি নামে পরিচিতি লাভ করেন। তিনি ছিলেন একাধারে অধ্যাত্ম সাধক, সুগায়ক ও পদকর্তা। যে সব সাধক-মহাজন মরমি দর্শন, ভাবুকতা ও সঙ্গীত জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে অনন্য ভূমিকা পালন করেন, মাতু ফকির তাদের মধ্যে অন্যতম। অমূল্য গোঁসাই, বেহাল শাহ, শুকচাঁদ ফকির, খোদা বকসো শাহ, গোলাম ঝড়– শাহ’র পরেই যার নাম অবশ্য উচ্চার্য, তিনি মাহতাব চিশতি ওরফে মাতু ফকির। তার জন্ম ১৯১৭ সালের ৩০ জানুয়ারি মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার মাথাভাঙ্গা বিধৌত আকুবপুর গ্রামে। পিতা হাজী এলাহী বক্সো বিশ্বাস ছিলেন মেদিনীপুর এস্টেটের জমিদার এবং ইসলামি শাস্ত্রে সুপ-িত। জন্মসূত্রে মাতু ফকির পেয়েছিলেন ঊনিশ শতকীয় সামন্ত সংস্কৃতি ও ওহাবি-ফরায়েজি আন্দোলন প্রভাবিত ইসলামী ভাবাদর্শের উত্তরাধিকার। কিন্তু পারিবারিক রক্ষণশীলতা ঘেরটোপের মধ্যে তাকে আটকিয়ে রাখা যায়নি। তার দ্রোহী মন শাস্ত্র-ধর্ম শাসিত সব ধরনের লোকাচার, আনুষ্ঠানিকতা এবং পারিবারিক রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে ওঠে।
তীক্ষ্ম অনুভব-অনুভূতি সম্পন্ন এই মানুষটি বিত্ত-বৈভব, প্রভাব-প্রতিপত্তির মধ্যে জন্মেছেন, কিন্তু সব সময় সহজ, সাদাসিধে জীবন যাপন করতে পছন্দ করেছেন। মানুষ হিসেবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত খাঁটি। মিথ্যা, ধোকাবাজি, প্রতারণা, ছলচাতুরি তার মধ্যে ছিল না। অসাধারণ গুরুভক্তি ও মানবতাবোধে পূর্ণ ছিল তার হৃদয়। একারণে পোশাক,আশাক ও অবয়বে তিনি তাঁর স্বনির্মিত ধর্মভাবনা ও অধ্যাত্ম চিন্তাকে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন সবসময়। তাঁর দীর্ঘ চুল এবং পুরুষ্ট গোঁফের তাৎপর্য ছিল বলেই মনে হয়। ইসলামি সূফি প্রবর্তনার সাধকদের মানবিক চেতনা এবং বাঙালি বাউল ধারার যোগী-সাধুদের সহজিয়া সাধনার সমন¦য়ে এক প্রতীকী প্রতিমূর্তিকেই তিনি তুলে ধরতে চেয়েছেন সারাজীবন। খোদা বকসো শাহ, বেহাল শাহ, মহিন শাহ, আরজান শাহ, মহেন্দ্র গোস্বামী যে অর্থে বাউল দর্শন,সঙ্গীতের ঐতিহ্য বাহক বা ট্র্যাডিশন বিয়ারার, ঠিক সেই অর্থে মাতু ফকির ছিলেন বাউল সঙ্গীত ও দর্শনের সক্রিয় ঐতিহ্য বাহক। বিত্ত-বৈভব থাকা সত্ত্বেও ব্যক্তিগত অনাগ্রহ ও তৎকালীন মুসলমান সমাজের পশ্চাদমুখী ভাবনার কারণে তঁাঁর প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া বেশিদূর এগোয়নি। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার আগেই পড়াশুনার পাট চুকে যায়। তবে আরবি, ফারসি ভাষার উপর বেশ দখল ছিল। কোরআন, হাদিস, ইসলামি ফিকাহ শাস্ত্র, হিন্দু পুরাণ, অবতারবাদ, বৈষ্ণব সাহিত্যে ছিল তাঁর অগাধ জ্ঞান।
মুসলমান সমাজের চিন্তার দীনতা, কূপমন্ডুকতা, ধর্মীয় বিষয়ে স্থূলতা কোনভাবেই মেনে নিতে পারেননি তিনি। পিতা এলাহী বকসো বিশ্বাস বাউল ধর্ম ও দর্শন বিরোধী ছিলেন প্রচ-ভাবে, তারপরও প্রথম যৌবন থেকেই তিনি আখড়া-আশ্রমে ঘুরেছেন এবং বাউলের আসরে বসে গান গুনেছেন। গানের তালিম নেন নিজ গ্রামের বাউল সাধক ও গায়ক আইজুদ্দীন ফকিরের কাছে। বাউল সাধক ও গায়ক বেহাল শাহ, অমূল্য গোসাঁই, শুকচাঁদ ফকির, নইমুদ্দীন শাহের গান শুনে তিনি মরমি ভাবনায় উদ্ধুদ্ধ হন। প্রথম যৌবন থেকে মৃত্যু অবধি তিনি ছিলেন সত্যের প্রতি প্রগাঢ়ভাবে অনুরাগী। তাই জগৎ-জীবনের সত্যকে আত্মস্থ ও উপলব্ধি করার জন্য ঘুরেছেন বিভিন্ন আখড়া-আশ্রম ও সিলসিলায়। মাতু ফকিরের ভাবশিষ্য হাটবোয়ালিয়া স্কুল ও কলেজের শিক্ষক আব্দুল মান্নান বলেন, ‘মাতু ফকির প্রথম জীবনে খলিসাকু-ির আব্দুল গফুর শাহের কাদেরিয়া তরিকায় বায়াত হন, পরবর্তীকালে কুষ্টিয়ার উদিবাড়ির চিশতিয়া তরিকার সাধক মনসুর আলী আল চিশতিয়ার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।’ চিশতিয়া তরিকার অন্যান্য সাধকদের মতো মনসুর আলী ছিলেন সঙ্গীতরসিক ও শক্তিমান পদকর্তা। তিনি ছিলেন বাতেনি ধারার সুফি সাধক। তিনি গান ভালবাসতেন এবং গানের মাধ্যমে আল্লাহ ও তার তার রসুলের ধ্যানে মগ্ন থাকতেন।
মনসুরের-শিষ্য মাতু ফকির ইসলামি প্রবর্তনার সূফি ধারার সাধক হয়েও গান ভালবাসতেন। গানশোনা ও গান গাওয়ার জন্য বিভিন্ন সময় বৈরী ও বিরূপ পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন, তবুও গান ছাড়েননি। তঁাঁর মেলামেশা ছিল বেহাল শাহ, আরজান শাহ খোদাবক্সো শাহ, আজাদ শাহ এর মত বাউল সাধকদের সঙ্গে। লালন সাঁই, পাঞ্জু শাহ, দুদ্দু শাহ, কুবির গোঁসাই, যাদুবিন্দু, পাগলা কানাই, মেছের শাহের উত্তরসূরী হিসেবে তাঁর গানে মানুষ ও মানবিকতার ধর্ম খুঁজে পাওয়া যায়। মাতু ফকিরের জ্যেষ্ঠ পুত্র রেজাউল করিম বান্টু বিশ্বাস এ প্রসঙ্গে বললেন, ‘বাবা চিশতিয়া তরিকার সাধক হলেও আসরে-আখড়ায়-সাধুসঙ্গে গান গেয়ে বেড়াতেন। আসরে বসে গান বাঁধার মত কবিত্ব শক্তি তাঁর ছিল। ছয় শতাধিক পদ তিনি রচনা করেছেন। অধিকাংশ গানে পীর-পয়গ¤¦র, মসজিদ, দেল-কোরান, চৌদ্দ ভুবন, আঠারো মোকাম, নামায-রোযা, কল্পতরু, গৌরাঙ্গ প্রভৃতি শব্দের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়।’ শরিয়ত, মারফত, হকিকত, তরিকত প্রভৃতি বিষয়ে তাঁর জানাশুনা ছিল। সব মরমি সাধকের মতো তাঁর গানের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় গুরুবাদ। গুরুবাদে তিনি গুরুকে জীবনদাতা, অন্তর্যামী, জগৎস¦ামী হিসেবে কল্পনা করেছেন। মাতু ফকিরের বাঁধা গুরুতত্ত্বের উপর একটি গান শুনে মুগ্ধ হয়েছিলাম আকুবপুরের আখড়ায় এক অনামী গায়কের কণ্ঠে। গানটি হলো:
‘গুরুকে চেন আগে সে মহাসাধনার ধন,
গুরু তোমার জীবনদাতা, গুরু তোমার প্রেমরতন।।
গুরু যার অন্তর্যামী, ঠিক জানে কে জগৎস¦ামী
না জেনে নাদানের ভ্রান্তি, পাতালগামী হয় সর্বক্ষণ।।
অন্তর্যামী সৃষ্টিকর্তা, গুরুবাক্য বিধানদাতা
সাধন পথে রূপ বিধাতা এরা তিন-এ তে হল একজন।।
তিন-এ একজন কেমনে হয় নিগূঢ় তত্ত্ব মুর্শিদের ঠাঁই
মাহাতাব না জানবে কোথায় মনসুর না জানায় যতক্ষণ।।’
সকল সাধকের মত তিনিও মনে করতেন, গুরু যেহেতু সার্বভৌম শক্তির আধার, কেবল গুরুই পারেন ভক্তকে ঘোর সংকট থেকে উদ্ধার করতে। তবে এর জন্য ভক্তকে গুরুর নিকট আত্মসমর্পণ করতে হয়। যেমন করেছিলেন হযরত আবুবক্কর (রা.) ও রাজা হরিশচন্দ্র। খলিসাকু-ির রব ফকিরের ভক্ত আরোজ ফকির একতারা ও ডুগিয়ে এমনই একটি গান গেয়ে শুনিয়েছিলেন আমাকে, মাতু ফকিরের মাজার প্রাঙ্গণের টিনের চালায় এক বৈকালিক আসরে:
‘গুরু দয়াল বটে, ঘোর সংকটে তরায় ভক্ত, ভক্ত হলে।। /হরিশ্চন্দ্র রাজা পেয়ে কত সাজা মরা পুত্র তাজা, ফিরে পায় কোলে।। / গুরু দক্ষিণার দায় রাজা-রাণীকে বিকায়/ শেষে নিজে বিক্রি হয় এক ডোমেরই দলে।। /পরে ডোম হতে পায় মুক্তি/গুরু পদে ছিল অটল ভক্তি / মনের মন দক্ষিণার শক্তি/ পুত্রতে জানালে।। / গুরু কী ফল পেতে চায়/ আবুবকর বুঝিলেন তাই/ সেই ফুল দিয়ে গুরুর দক্ষিণা দিলে।। / পেয়ে দক্ষিণার ফুল/ খুশি হল রসুল/ হলো মাহাতাবের ভুল/ ওই মনসুরের কালে।।’
মাতু ফকিরের অনেক গানই ভাব-ঐশ্বর্য ও ধ্বনি মাধুর্যে অনন্য। তাঁর গানগুলি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হলে হয়তো আরেকজন লালন-পাঞ্জু-দুদ্দু-মেছের শাহকে পাওয়া যেতো। ‘সুর দরিয়া এপার-ওপার’ অনুষ্ঠানের একটি পর্বে মাতু ফকিরের একটি গান শিশুশিল্পী গোলাম মোস্তফার কন্ঠে শুনে সঙ্গীতজ্ঞ ও সুরকার বাপ্পী লাহিড়ী এবং নন্দিত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা মুগ্ধ হয়েছিলেন। গানটি হলো:
‘মা তোর লীলা বোঝা কঠিন/ মাতৃরূপে এসব করো,/ ধাত্রীরূপে নাড়ি কাটো।/ মা তুমি সেজেছো কালি/ ধন ভান্ডার লক্ষ্মীও বলি/ কেন চাও মা পুত্র বলি। / ষষ্ঠিতে মা আসনে পায়/ আমার দেখি পতিতালয়/ বুঝতে সুজতে কেমন হয়/ একী তোর লীলা বোঝা ভার।’
মাতু ফকিরের জন্ম উচ্চ বংশে, উচ্চ ধর্মে ও বর্ণে। কিন্তু তিনি উচ্চ ধর্ম ও জাতের মহিমা মানেননি। মানব গুরুকে সার ভেবে আমৃত্যু গান গেয়ে বেড়িয়েছেন আখড়া-আশ্রম কিংবা বড় আসরে। তাঁর কাছে মানব জনম শ্রেষ্ঠ জনম, দেব-দেবতাগণ সবাই মানুষ হিসেবে জন্ম নিতে চায়। তাই তার ভিতরে হাহাকার জেগে ওঠে আর কি মানব জন্ম ফিরে পাবো, ‘আর কি ফিরে আসবো দুনিয়ায়।’ মাতু ফকির-পুত্র বান্টু বিশ্বাস বাবার প্রয়াণ দিবসে নিচের গানটি গাইতে গাইতে কেঁদে বুক ভাসালেন।
‘আর কী আসবো দুনিয়ায়।।/কি ভাগ্যে এই মানব জনম এসেছি হেথায়।।/ কোথায় ছিলাম, এলাম হেথায়,/আমার তো আর কিছুই জানা নাই,/ দেহ ছেড়ে যাবো কোথায়,/না-জানি কোন বিছানায়।।/অজানা অচেনা পথে, কে আমায় নিয়ে যাবে সাথে,/আমি ভেবে ভয়ে ভিতে, না জানি মোর কিবা হয়।।/ভাল ভেবে করলাম কুকাজ,/(করেছি) গর্হিত অপরাধ, বুঝিলাম আজ,/বুঝে মাহাতাব কাঁদে সদায়,/আমার শেষ ফলাফল কি দাঁড়ায়।।’
সৃষ্টির নিগূঢ় রহস্য মাতু ফকিরের কৌতূহলী ও অনুসন্ধিৎসু মনকে দগ্ধ করেছে সবসময়। পাপ-পূণ্য, স¦র্গ-নরক বিষয়েও তিনি প্রশ্ন তুলেছেন। ঈশ্বরের দোহাই দিয়ে তিনি শাস্ত্রমানা প-িতদের প্রতি সৃষ্টির রহস্য সম্পর্কে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন:
‘তুমি আর কতকাল দুঃখ দিবে হে আমায়,/ভবে এনে বারংবার।।/আমি কি কহেছি তোরে এই মানব আকারে/পাঠাও সংসার মাঝার।।/সকলেই এসেছি তোমারই ইচ্ছায়,/এখন কেন দেখাও নিকাশের দায়,/তখন মনে জেনে মিষ্টি করলে বান্দা সৃষ্টি/এখন কেন কর কষ্টি, একি তোমার অবিচার।।/ পির-পয়গ¤¦র, ফেরেশতা-জ্বিন, সকলের সাক্ষাতে,/অঙ্গিকার করেছ তুমি জানলাম কোরানেতে,/ তুমি না বললে হ’ত না তাই শোন হে রাব্বানা,/এখন কেন লেখ গোনাহ, তোমার এ কোন বিচার।/ অধম ও অজ্ঞানে, মাহাতাব তোর দীনহীনে,/ মনসুর কি আছ এখানে, ঘুঁচাও মনের অন্ধকার।।’
মরমি সাধকেরা নারীকে জগজ্জননী, মহামায়ারূপে কল্পনা করেন। নারী ছাড়া সাধকের সাধন ভজনে সিদ্ধি লাভ হয় না। মাতু ফকির নারীকে মাতৃরূপে, শান্তি ও শক্তিরুপে কল্পনা করেছেন। দেবী দুর্গার উদ্দেশ্যে নিবেদিত চ-িপাঠ শুনেই সম্ভবত তিনি এ গান গেয়েছেন। চ-িতে আছে : ‘যা দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরূপেন সংস্থিতা নমস্তৈস্য নমঃ নমঃ। যা দেবী শক্তিরূপেন সংস্থিতা নমস্তৈস্য নমঃ নমঃ।’ তবে মরমিদের গানের মর্ম কেতাবি জ্ঞান দিয়ে বোঝা যায় না, এর মর্মোদ্ধারের জন্য মর্মজ্ঞ কামেল সাধকের কাছে বায়াত হওয়া লাগে। মাতু ফকির সারাজীবন জীবন-জগতের রহস্য, ধর্ম-অধর্মের ফারাক বোঝার জন্য শুদ্ধ প্রেমের রসিক হয়ে বারবার বিভিন্ন কামেল মুর্শিদের কাছে ছুটে গেছেন। শিক্ষা-দীক্ষা নিতে কখনও ছুটে গেছেন বাউল ঘরানার সহজিয়া সাধকদের কাছে, আবার কখনও শরীয়তপন্থী মওলানা কিংবা কাদেরিয়া-চিশতিয়া ধারার সূফিদের কাছে। অবশেষে বাউল-বৈষ্ণবদের সহজিয়া লোকদর্শনে স্নাত হয়ে স্থিত হতে চেয়েছেন। তারপরও দিলের ধোঁকা কাটাতে পারেননি জীবন ভ’র। নানা ধর্মমত ও দর্শনের অভিঘাতে, নানা প্রশ্নবাণে নিজেকে বিদ্ধ করে সকল ধর্মের মর্মার্থ গানে গানেই প্রকাশ করেছেন:
‘ধর্ম যদি সবই ধর্ম/ অধর্ম আর থাকে না।। /কী করিলে হবে ধর্ম/ এই মর্মতো পেলাম না।। /কেউ কয় ধর্ম নামাজ- রোযা / কেউ কয় বলি কালি পূজা/ তাই ধর্ম গেল না বুঝা/আমার ধর্ম করা হলো না।। / কেউ কয় মর্ম ব্রহ্মচারী/কেউ কয় হয় না ত্যাজে নারী/কেবল গৌরাঙ্গ কয় বললে হরি/ ধর্ম বাকি থাকে না।। / কেউ কয় ধর্ম হজ্ব আর তীর্থ/ কেউ কয় এসব ভ্রমণ মাত্র /কি করলে হয় ধর্ম সত্য /মাহাতাব তা বোঝে না।।’
তিনি অমৃত-অমরত্ব কিংবা হাজার বছর বাঁচতে চাননি। তিনি এই জগতকে সত্য ও মধুময় বলে জেনেছেন, একে আনন্দময় ও মধুময় করে যেতে চেয়েছেন, তাই এ জগতের প্রতি ভালবাসা ব্যক্ত করেছেন দিল-জাগানো গানে গানে:
‘বায়ু বহ্নি জল মিলে তুমি অবতার।।/ পেয়েছে এই মাটির দেহ, কেমনে কোথা হবা পার।।/পারের কথা ভাবছে ভোগে, অবতার পার এই ভোগ ত্যাগে,/ দেহ লয়ে কোথায় যাবে, করেছ কি তার বিচার।। পরের কথা ভাবতে বহুদূর, যে পারে আছ তুমি সেই পারই মধুর,/মম কেনুল ছাড়িয়া ওয়াজেবুল পেতে/ কর সাধন এবার।।/ যে পারে আছ তুমি এপার মম কেনুল,/ওয়াজেবুল প্রাপ্তি হলে পাবা অপর কুল,/ মাহাতাব না বুঝে বিষয়, জগত দেখে অন্ধকার।।’
মাহাতাব চিশতি ওরফে মাতু ফকির আসরে বসেই গান বেঁধেছেন এবং সেই বাঁধা গান দিয়ে আসর জমিয়েছেন। তার গান শোনার জন্য আখড়ার শামিয়ানার নীচে রাত’ভর মানুষ জেগে থেকেছে। তিনি যে গান শুনিয়েছেন, সে গান দিল জাগানো, মন ভোলানো, মানুষের গান, প্রেম-মহব্বতের গান এবং পূর্ণ-মানুষ হয়ে উঠবার গান। তার এই গানগুলি আমরা লিখিতরূপে ধরে রাখতে পারিনি। তারপরও মেহেরপুর গাংনীর পথে-ঘাটে, আখড়া-আশ্রমে,সাধক-গায়কদের কন্ঠে ও তাদের মলিন-জীর্ণ খাতায় তার গান খুঁজে পাওয়া যাবে।
বাংলার বাউল ও মরমি সাধকরা চিরকাল ও অসাম্প্রদায়িকতা, মানবতা ও মানুষের গান গেয়েছেন। ধর্মের রূপক, উপমা ও প্রতীক ব্যবহার করে গান বাঁধলেও তাঁরা ছিলেন সম্পূর্ণরূপে অসাম্প্রদায়িক ও মানবতাবাদী। মানবতার সুউচ্চ মিনারে দাঁড়িয়ে তারা মানুষের মহিমার প্রচার করেছেন। তাই পাকিস্তানি রাষ্ট্রের দ্বি-জাতিতত্ত্বভিত্তিক ধর্মাশ্রয়ী, সাম্প্রদায়িক রাজনীতি মাহিন শাহ, খোদা বকসো শাহ, আবদুল করিম শাহ ও মাতু ফকিরেরা মানেননি। পাকিস্তানের দ্বিজাতিতত্ত্ব ভিত্তিক রাজনীতি ছিল মরমি ভাবনা ও ভাবাদর্শের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে মাতু ফকির ‘পলিটিক্যাল মোটিভেটর’ হিসেবে কাজ করেছেন। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা তার বসতবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। তিনি আমৃত্যু অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাজনীতির একনিষ্ঠ সমর্থক ও কর্মী ছিলেন। মহতের যে গানটি তাঁর হৃদয়ে সব সময় বাজতো সেটি হল:
‘এমন মানব সমাজ কবে গো সৃজন হবে
যে দিন হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান
জাতি গোত্র নাহি রবে।’
মানুষ ও মানবতার এই সাধক ১২-ডিসে¤¦র ২০০৮ (২৮ অগ্রহায়ণ) নিজ গৃহে দেহত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে উপস্থিত ছিলেন তাঁর সহধর্মিনী, পুত্র রেজাউল করিম, আনোয়ারুল করিম, এহসানুল করিম এবং অসংখ্য শিষ্য ভক্তবৃন্দ। মাতু ফকিরের অছিয়ত অনুযায়ী তাঁকে ইসলামী শরা শরিয়ত মোতাবেক নিজ জমিতে সমাহিত করা হয়। প্রতি বছরে তাঁর প্রয়াণদিবসে সমাধি প্রাঙ্গণে বসে সাঁই-দরবেশ, আউল-বাউল ও বিভিন্ন তরিকার সাধকদের মিলন মেলা।
আবদুল্লাহ আল আমিন
লোকগবেষক ও প্রাবন্ধিক। সহযোগী অধ্যাপক, মেহেরপুর সরকারি কলেজ,
মেহেরপুর।
১১ ই জানুয়ারি, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:৩৭
আবদুল্লাহ আল আমিন বলেছেন: সবকিছুকে নেগেটিভ দৃষ্টভিঙ্গি দিয়ে বিশ্লেষণ করা উচিৎ নয়। এটা করলে সমগ্র পৃথিবীকে মিথ্যে ও ভণ্ড মনে হবে।
©somewhere in net ltd.
১|
৩০ শে নভেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৫:০৮
খালিদ১৪ বলেছেন: স্যার সুফি ইজমের নামে একন আছে ভন্ডপীর, সুফি ইজম হারিয়ে গেছে। আছে শুধু তার অমীয় বাণী।