নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

নবীন আনন্দ

আবদুল্লাহ আল আমিন

আবদুল্লাহ আল আমিন › বিস্তারিত পোস্টঃ

আবদুল কাদির ও বাঙালি মুসলমান সমাজের‘বুদ্ধির মুক্তি’

০৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৩:২৮

আবদুল কাদির ও বাঙালি মুসলমান সমাজের বুদ্ধির মুক্তি
আবদুল্লাহ আল আমিন
ঊনিশ শতকের প্রারম্ভে ভাগীরথীর পশ্চিমে সরস্বতীর তীরে যে সূর্য অস্তমিত হল- তার নাম মধ্যযুগ। ভাগীরথীর পূর্বে কলকাতা শহরে আর এক নতুন যুগের সূর্য ঊদিত হল। নতুন যুগে নতুন শক্তির আঘাতে নিস্তরঙ্গ সমাজের বুকে জেগে উঠলো প্রাণের স্পন্দন, অনুরণিত হলো ঘুমিয়ে থাকা নগর-বন্দর- লোকালয়। ঊনিশ শতকের প্রথম দশক থেকেই প্রাণহীন গ্রামবাংলার বুকেও এই অনুরণন ধ্বনিত হতে লাগলো। নবযুগের নতুন আলোয় উদ্ভাসিত কনকপ্রভার নাম বোধ হয়, কলকাতা। কালের গর্ভে হারিয়ে যায় এক যুগ, আর এক নতুন যুগের আবির্ভাব হয় ইতিহাসের গর্ভ হতে। নতুন যুগের নবীন আলোর ঝলকানিতে পুরোনো যুগের অনেক স্মৃতিচিহ্ন মুছে যায়, তারপরও হারিয়ে যাওয়া যুগের অনেক স্মৃতি, স্মারক ও ঐতিহ্য রয়ে যায় নতুন যুগের গায়ে। ভাগীরথীর পূর্বতীরে দাঁড়িয়ে নবযুগের নতুন সূর্যকে যারা অভিবাদন জানিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে প্রধান ছিলেন রামমোহন রায়। ঊনিশ শতকের প্রথমদিকে রাজা রামমোহন বাঙালির ভাবলোকে এক নতুন ধারার প্রবর্তন করলেন। তিনি যে ধারাটি প্রবর্তন করলেন সেটি হল ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে যুক্তিবাদের মেলবন্ধন রচনা। সংস্কৃত, আরবি ও ফারসি ভাষার এই সুপণ্ডিত হিন্দু, বৌদ্ধ ও ইসলামের শ্রেষ্ঠ ঐতিহ্য ও সুকৃতিসমূহ আত্মস্থ করে ভারতবাসী তথা বাঙালি সমাজকে জানালেন যে, বিশ্বের প্রতিটি ধর্মের লক্ষ্য অভিন্ন অর্থাৎ মানবজাতির নৈতিক উৎকর্ষ সাধন, মানুষের ভেতর শ্রেয়োবোধ জাগিয়ে তোলা। সুতরাং পরিবর্তিত পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে , যুগের প্রয়োজনে প্রতিটি ধর্মের পুনর্মুল্যায়ন ও পুনর্ব্যাখ্যা হওয়া আবশ্যক। তিনি গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন যে, আত্মিক বা পারত্রিক মুক্তির জন্য স্ব-ধর্ম বা স্ব-সম্প্রদায় পরিত্যাগ করার প্রয়োজন নেই। বরং অন্ধত্ব, গোঁড়ামি, কূপম-ুকতা ও কুসংস্কার ত্যাগ করে প্রতিটি ধর্মের ভিতর যে মানবিক ও নৈতিক দিকগুলো রয়েছে সেই সব দিকগুলো গ্রহণ করা দরকার। এতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই যে, ধর্ম সম্পর্কে রামমোহনের মতামত তার নিজ সমাজ সেসময় আন্তরিকভাবে গ্রহণ করেনি বা করতে পারেনি। তারপরও হিন্দুর সমাজভাবনায় রামমোহনের প্রভাব রয়ে গেল, আজ অবধি কোনভাবেই কেউই তা উপেক্ষা করতে পারলো না। তার চিন্তাধারা বাঙালি তথা ভারতীয় চিন্তাধারায় ও ঐতিহ্যে এক নতুন ধারার সূচনা করলো- ধর্মের সাথে যুক্তির মেলবন্ধন রচনা। তবে রামমোহনের সমকালে বাঙালি মুসলমানের ভাবজগতে সেই ধরনের পরিবর্তনের কোন আভাস লক্ষ করা গেল না। যদিও ইসলামি ধর্মবিশ্বাস অপরিবর্তনীয়, তথাপি খ্রিস্টিয় নয় শতকে মুসলিম মুতাজিলা দার্শনিকরা প্রাচীন গ্রিক দর্শনের সৃজনশীল যুক্তিবাদিতা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন গভীরভাবে। ধর্মবিশ্বাসের সাথে কীভাবে যুক্তিবাদকে মেলানো যায়, সে চেষ্টাও করেছিলেন। কিন্তু মুসলিম সম্প্রদায়ের একটি বিরাট অংশের গোঁড়ামির কারণে তাদেও সেই চেষ্টা সফল হয়নি। ঊনিশ শতকে বাঙালি মুসলিম সমাজের কেউ যুক্তির সঙ্গে ধর্মবিশ্বাসের মেলবন্ধনের চেষ্টা করেছেন বলে জানা যায় না, আর করলেও সমাজ মননে তার প্রভাব ছিল একেবারেই ক্ষীণ। বাঙালি মুসলমনের ভাবজগতে অগ্রগামী ও আধুনিকতামুখী চিন্তার সন্ধান পাওয়া যায় বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে ঢাকার শিখা গোষ্ঠীর চিন্তানায়কদের মধ্যে। বুদ্ধি ও যুক্তির আলোকে এবং সমকালীন যুগের প্রয়োজনের তাগিদে ধর্ম, সাহিত্য ও সাহিত্য-ব্যক্তিত্বদের পুনর্মূল্যায়ন ছিল এই গোষ্ঠীর প্রধান লক্ষ্য। ১৯২৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবুল হুসেন ( ১৮৯৭- ১৯৩৮), ঢাকা কলেজের অধ্যাপক কাজী আব্দুল ওদুদ (১৮৯৪- ১৯৭০), কাজী আনোয়ারুল কাদির (১৮৮৭- ১৯৪৮), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন (১৮৯৭- ১৯৮১), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক শ্রেণির ছাত্র আবুল ফজল (১৯০৩- ১৯৮৩), ঢাকা কলেজের ছাত্র ইন্টারমিডিয়েট শ্রেণির ছাত্র আবদুল কাদির (১৯০৬- ১৯৮৪) প্রমুখ মুসলিম বুদ্ধিজীবী ও চিন্তানায়কদের উদ্যোগে ঢাকা শহরে ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ নামে একটি মননশীল সাহিত্য- সংগঠন গড়ে ওঠে। এই সংগঠনের মূলমন্ত্র ছিল বুদ্ধির মুক্তি। সংগঠনের মুখপত্র শিখার প্রথম-সংখ্যায় প্রকাশকের নিবেদনে বলা হয়:‘ শিখার প্রধান উদ্দেশ্য বর্তমান মুসলমান সমাজের জীবন ও চিন্তাধারার গতির পরিবর্তন সাধন’। এ জন্য প্রয়োজন বুদ্ধির মুক্তি, নইলে মুসলমান সমাজের চলার পথ রুদ্ধ হয়ে পড়তে পারে। এ প্রসঙ্গে শিখাগোষ্ঠীর প্রাণপুরুষ আবুল হুসেনের মন্তব্য : ‘মুসলমান জগৎ বুদ্ধির ঘরে তালা লাগিয়ে কেবল শাস্ত্রের দোহাই দিয়ে মুসলমানের চলার পথে বিঘ্ন ঘটাচ্ছে’। (আবুল হুসেন, নির্বাচিত প্রবন্ধ, মোরশেদ শফিউল হাসান সংকলিত, ঢাকা, ১৯৯৭, পৃষ্ঠা: ৬৯)। কোনো রকম ভণিতা না পেড়ে স্পষ্টভাবে বলা যায়, বয়োস্বল্পতা সত্তেও ¡ঢাকা কলেজের ইন্টারমিডিয়েট শ্রেণির আবদুল কাদির ছিলেন ঢাকার যে বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন, তার নেতৃস্থানীয় উদ্যোক্তা ; অন্যতম শীর্ষতম ব্যক্তিত্ব।

মুসলিম সাহিত্য সমাজের মুখপাত্র হিসেবে শিখা’র যে প্রথম সংখ্যা ( চৈত্র ,১৩৩৩) বের হয় তার সম্পাদক ছিলেন অধ্যাপক আবুল হুসেন এবং প্রকাশক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন আবদুল কাদির। মুসলিম সাহিত্য সমাজে’র অন্যতম প্রাণপুরুষ এবং শিখার প্রথম সংখ্যার প্রকাশক ও পরিকল্পক হিসেবে তিনি ছিলেন একাধারে কবি, ছান্দসিক, প্রাবন্ধিক, গবেষক, সাহিত্য-সমালোচক ও সাময়িকপত্র- সম্পাদক। ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ প্রতিষ্ঠার পরিকল্পক ও শিখা’র প্রকাশক হিসেবে আবদুল কাদিরের নামও আবুল হুসেন ও কাজী আবদুল ওদুদের সঙ্গে শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হয়। তার জন্ম ১ জুন, ১৯০৬ ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আড়াইসিধা গ্রামে। আফসার উদ্দীন ও আরজউন-নিসা তার জনক-জননী। তার প্রাথমিক শিক্ষা সূচনা গ্রামের চারতলা মধ্য ইংরেজি স্কুলে। স্কুলের প্রধান শিক্ষকের নিকট মাইকেল মধুসূদনের ‘মেঘনাদ বধ’ এর পাঠ করে কৈশোরেই তার মধ্যে সাহিত্যপ্রীতি জন্মায়। বৃহত্তর কুমিল্লার এই ভূমিপুত্র ১৯২৩ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া আনন্দ হাইস্কুল থেকে পাঁচ বিষয়ে লেটারসহ প্রথম বিভাগে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় পাশ করেন। ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএ কোর্সে ভর্তি হন। ঢাকা কলেজে ছাত্রাবস্থায় সান্নিধ্য লাভ করেন কলেজের বাংলা ও ইংরেজির শিক্ষক মনস্বী চিন্তক আবদুল ওদুদ ও পরিমলকুমার ঘোষের (১৮৮৮-১৯৬০)। পরবর্তীকালে কাদির হয়ে ওঠেন আবদুল ওদুদের অকৃত্রিম অনুরাগী ও বুদ্ধিবৃত্তিক-সাহিত্যিক অভিযাত্রার সহযাত্রী। গভীর সাহিত্য-অনুরাগ এবং কাব্য-চর্চা, পত্রিকা প্রকাশনায় জড়িয়ে পড়ার কারণে তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বিএ পাশ করার আগেই পরিসমাপ্তি ঘটে।
শিক্ষাজীবন অসমাপ্ত রেখেই কর্মজীবন শুরু করেন আবদুল কাদির। কর্মজীবনের সূচনায় সাহিত্যচর্চাকে বেছে নেন জীবন-জীবিকার একমাত্র অবলম্বন হিসেবে। কবিতা চর্চার পাশাপাশি সাহিত্য সাময়িকপত্র সম্পাদনায় যুক্ত হন বেশ জোরেসোরে। “ ছাত্রজীবনেই তার বহু কবিতা দীপিকা, কোহিনূর, ইসলাম-দর্শন, নকীব, মোহাম্মদী, কল্লোল, উত্তরা, উপাসনা, প্রগতি, মানসী ও মর্মবাণী, সওগাত, নওরোজ, আত্মশক্তি, নবশক্তি, নবশক্তি, যুগের আলো প্রভৃতি সাময়িকপত্রে প্রকাশ লাভ করে।”( ড. খোন্দকার সিরাজুল হক, মুসলিম সাহিত্য সমাজ: সমাজচিন্তা ও সাহিত্যকর্ম )। আবদুল কাদিরের সাংবাদিক জীবনের সূচনা ১৯২৬ সালে কলকাতার বিখ্যাত ‘সওগাত’ পত্রিকার সম্পাদনা বিভাগে চাকরি লাভের মাধ্যমে। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ১ ডিসেম্বর তিনি কলকাতা কর্পোরেশনের একটি প্রাইমারি স্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি কমরেড মুজাফফর আহমদের কন্যা আফিয়া খাতুনের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। আবদুল কাদির ছিলেন কৈশোর থেকে সাহিত্য-প্রাণিত, তাই নিতান্ত আন্তর প্রেরণায় প্রবুদ্ধ হয়ে নিজ উদযোগ ও অর্থায়নে বাংলা ১৩৩৭ সনে বের করেন মাসিক পত্রিকা ‘জয়তী’। একই সঙ্গে সাপ্তাহিক ‘নবশক্তি’র সম্পাদনা বিভাগেও দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। ‘জয়তী’ তাকে এনে দেয় সাহিত্যিক পরিচিতি, যশ ও খ্যাতি। জয়তী মাত্র দু বছর টিকে ছিল , তারপরও স্বল্পসময়ের মধ্যে বাঙালির সারস্বত সমাজে পত্রিকাটি বিপুল সমাদর লাভে সমর্থ হয়। শিখা গোষ্ঠীর ভাবযোগী কাজী আবদুল ওদুদ পত্রিকার প্রশংসা করেছেন বিভিন্ন সময়ে। আবুল ফজল পত্রিকাটি সম্পর্কে এক প্রবন্ধে লেখেন:
“ জয়তী বের হল বৈশাখ ১৩৩৭ থেকে অর্থাৎ কল্লোল বন্ধ হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই । কাজেই কল্লোলের কিছুটা সুর জয়তীতেও প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো। এমন কি কল্লোল গোষ্ঠীর কারো কারো যেমন অচিন্ত্য সেনগুপ্ত, প্রেমেন্দ্র মিত্র, প্রবোধ সান্ন্যাল প্রভৃতির লেখাও জয়তী’তেই স্থান পেতে লাগলো। প্রবীনদের মধ্যে জয়তীতে লেখা দিয়েছেন প্রমথ চৌধুরী, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মোহিতলাল মজুমদার, ধুর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, দিলীপকুমার রায় প্রভৃতি। আর ঢাকা সাহিত্যসমাজকে কেন্দ্র করে যারা বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন চালিয়ে ছিলেন- যেমন , কাজী আব্দুল ওদুদ, আবুল হুসেন, কাজী মোতাহার হোসেন, আনওয়ারুল কাদির প্রভৃতিও লিখতে লাগলেন জয়তীতে নিয়মিত। আর স্বয়ং নজরুল তো আছেন প্রতি সংখ্যায়।” ( কয়েকটি স্বল্পায়ু সাহিত্য পত্রিকা সম্পর্কে, সমকাল,শ্রাবণ ১৩৬৮।) জয়তী বন্ধ হবার পর ( শেষ সংখ্যা বৈশাখ ১৩৩৯) আবদুল কাদির কলকাতার দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার বার্তা বিভাগে যোগ দেন। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে তিনি কাজী নজরুল ইসলাম সম্পাদিত ‘ দৈনিক নবযুগ’ পত্রিকায় বার্তা সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন কয়েক মাস। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষদিকে তিনি কলকাতা কর্পোরেশন স্কুল থেকে ছুটি নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রচার সংস্থার অনুবাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্তির পর তিনি কিছুদিনের জন্য বাংলা সরকারের প্রচার বিভাগে সহকারী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পরেও পাঁচ বছর তিনি কলকাতায় অবস্থান করেন। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি সাপ্তাহিক মোহাম্মদী’তে সম্পাদকীয় বিভাগে ও সাপ্তাহিক পয়গাম এ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার কর্পোরেশন স্কুলের চাকুরি ছেড়ে ঢাকায় চলে আসেন এবং ওই একই বছরের জুলাই মাসে তিনি পূর্ববঙ্গ স্ট্যাটিসটিক্যাল বোর্ড অফিসে ইনসপেক্টর হিসেবে যোগদান করেন। আড়াইমাস কাজ করার পর তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়ের অধীনে আঞ্চলিক পাবলিসিটি অফিসার হন ও সরকারের মুখপত্র ‘মাহেনও’ পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব নেন। ১৯৬৪ সালে তিনি কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়নে বোর্ডে প্রকাশন অফিসার হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের ১ জুন তিনি সরকারি চাকুরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন।

আবদুল কাদির মূলত কবি; সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় কাজ করলেও কবি হিসেবেই তিনি সর্বাধিক পরিচিত। তিরিশের দশক থেকেই তিনি কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত এবং আমৃত্যু তিনি তার কবি অভিধাটি বুকের ভিতর আগলে রেখেছিলেন। কবি শব্দটি আজ অবধি তার নামের সাথে এমন গভীীরভাবে জড়িয়ে আছে যে, প্রয়াণের (মৃত্যু: ১৯৮৪) তিন দশক পরেও তিনি কবি হিসেবে খ্যাতিমান ও প্রতিষ্ঠিত। ছান্দসিক কবি হিসেবেও তার খ্যাতি ও পরিচিতি রয়েছে। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘দিলরুবা’ (১৯৩৩) কবি হিসেবে তার প্রতিষ্ঠা এনে দেয়। ঊনিশটি কবিতার মালায় গাঁথা এই কাব্যগ্রন্থটি তিনি উৎসর্গ করেন কবি শাহাদাৎ হোসেনের উদ্দেশ্যে। গ্রন্থভুক্ত কবিতাগুলোতে মানুষের যাপিত জীবনের নানাদিক এমন বলিষ্ঠভাবে বিম্বিত হয়েছে যে, গ্রন্থটি প্রকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গে কবিতানুরাগী সারস্বত সমাজের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ লাভে সমর্থ হয়। শিখাগোষ্ঠীর অন্যান্য লেখক- চিন্তকদের মত আবদুল কাদির ছিলেন আমৃত্যু রবীন্দ্রানুরাগী।‘মুসলিম সাহিত্য সমাজে’র প্রথম অধিবেশনে ‘রবীন্দ্রকাব্যের স্বরূপ’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ পাঠ করেন এম তাহেরউদ্দীন। চারুচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই অধিবেশনে পঠিত প্রবন্ধের ওপর যে আলোচনা হয় তাতে অংশ নেন আবদুল কাদিরসহ শিখাগোষ্ঠীর অন্যান্য লেখক- চিন্তানায়করা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে ১৯২৬ সালে রবীন্দ্রনাথ ঢাকা সফরে এলে, ১০ জানুয়ারি মুসলিম হলে যে সংবর্ধনা তাকে প্রদান করা হয়, হল প্রভোস্ট এ এফ রহমানের কথা বাদ দিলে , তার প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন অধ্যাপক আবুল হুসেন, কাজী আবদুল ওদুদ, অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল ফজল এবং আবদুল কাদির । রবীন্দ্রনাথকে প্রবল ভালবেসেছিলেন তারা; রবীন্দ্রনাথের অতুল বৈভবম-িত কাব্যভুবনের দিকে তাকিয়েই তাদের নন্দন-যাত্রা। কাব্যযাত্রার প্রারম্ভেই কাদির ধন্য হন রবীন্দ্রনাথের সপ্রশংস অভিনন্দন লাভ করে, রবীন্দ্রনাথ তার ‘দিলরুবা’ কাব্যগ্রন্থটি পাঠ করে পত্র মারফত আশীর্বাদ জানিয়ে লিখেছিলেন:
“ তোমার দিলরুবা বইখানি পড়ে খুশি হলুম। ভাষা ও ছন্দে তোমার প্রভাব অপ্রতিহত। তোমার বলিষ্ঠ লেখনীর গতিবেগ কোথাও ক্লান্ত হয় না। বাংলার কবি সভায় তোমার আসনের অধিকার অসংশয়িত, বিষয় অনুসারে যে কবিতায় তুমি মাঝে মাঝে আরবী পারসি শব্দ ব্যবহার করেছ আমার কানে তা অসঙ্গত বোধ হয়নি।”(আবদুল কাদিরকে লিখিত রবীন্দ্রনাথের পত্র, ১০ জানুয়ারি ১৯৩৮।)
প্রথম যৌবনেই কাদির ‘দিলরুবা’র অধিকাংশ কবিতা রচনা করেন, তারপরও এই কাব্যগ্রন্থে তার সত্যিকারের কবিমানসটি স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। এই কাব্যেই পাওয়া যায় একজন ঐতিহ্যপ্রেমী নিবেদিতপ্রাণকবি ও সাহিত্যশিল্পীকে যিনি বাঙালি মুসলমান সমাজের দৈন্য-দুরবস্থায় কাতর। অপরিসীম উচ্চাকাক্সক্ষা নিয়ে সাহিত্যচর্চা করতে আসা কাদির পথে নেমেই দেখলেন মুসলমান সমাজে সমস্যার শেষ নেই। প্রথম যৌবনে চেয়েছিলেন বিশুদ্ধ সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করবেন, কিন্তু বাঙালি মুসলমান সমাজের মানসিক দৈন্য , হীনমন্যতা সেই চর্চায় বাধা হয়ে দাঁড়াল। কারণ যে সমাজ থেকে তারা এসেছিলেন, সেই সমাজ ছিল বড়ই অকরুণ, বন্ধ্যা এবং শিল্পচর্চায় অনাগ্রহী ও মুক্ত জ্ঞানচর্চায় বাধাদানে তৎপর। এই বিরূপ-বিরুদ্ধ পরিবেশের মধ্যে দাঁড়িয়েও তিনি ও তার-বুদ্ধির মুক্তিপন্থী অগ্রজ সহযাত্রীদের নিয়ে বিশুদ্ধ সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি বাঙালি মুসলমান সমাজের মানসিক দৈন্য ঘোচানোর অভিপ্রায়ে সংস্কারমুক্তির তৎপরতা অব্যাহত রেখেছিলেন। প্রথম কাব্যযাত্রাতেই স্বসমাজের সর্বাঙ্গীণ মুক্তির প্রাণপণ সাধনা আকাক্সক্ষা পরিলক্ষিত হয়:
‘ মোস্লেম আজি নব ভাগ্য বিবর্তন।/ শতাব্দীর তন্দ্রা ভাঙি জাগি সেই দুরন্তেরা করিছে নর্তন/ প্রভাতের আলোর উল্লাসে;/ সম্মুখের যাত্রাপথে চলি’ তারা রক্ত-রাঙা বসে / গাহিছে নির্ভয়- /শিরায় শিরায় নাচে যৌবন দুর্জ্জয়!’ (অভ্যুত্থান, পৃ: ৩৩)
কবি গভীরভাবে উপলব্ধি করলেন যে, তার সমাজ বিশেষত বাঙালি মুসলমান সমাজ নানা কারণেই স্থবির, বদ্ধ, পশ্চাদমুখিন। বাংলার মুসলমান সমাজে উল্লেখ করার মতো শিল্প-সাহিত্য ও মননচর্চা নেই। যে সমাজে মননচর্চা হয় না, সে-সমাজ গৌরবের আসন লাভ করতে পারেনা। তিনি উপলব্ধি করলেন যে, বাঙালি মুসলমান সমাজের সামগ্রিক মুক্তির জন্য প্রয়োজন মনুষ্যত্বের বিকাশ ও চর্চা, আর তা সম্ভব নতুন নতুন সাহিত্য সৃজনের মাধ্যমে। তিনি আরও উপলব্ধি করলেন যে, একটি উৎপীড়িত, বঞ্চিত, শোষিত ও পশ্চাদপদ সম্প্রদায়ের মানবিক বিপর্যয় রোধ ও ভাগ্যোন্নয়নের জন্য কেবল ঐতিহ্যপ্রীতি ও অতীতাশ্রয়ী দৃষ্টিভঙ্গি যথেষ্ট নয়, পরিবর্তনশীল বাস্তবতা ও রূঢ় পারিপার্শ্বিকতাকে অনুধাবন করে যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণও জরুরি। কবি কাদির যৌবনেই রাশিয়া থেকে ভেসে আসা মানবমুক্তির নহবত শুনেছিলেন অপার বিস্ময়মাখানো মুগ্ধতা দিয়ে। বলশেভিক বিপ্লবের চেতনা ও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ঢেউ তার কবিতাতেও আছড়ে পড়েছিল বিপুল তরঙ্গে।
‘ ধূলি কাদা-মাখা মানুষের শিশু দলে দলে আজ করিছে ভিড় ।/ আপন প্রাপ্য অধিকার চায়- তার লাগি দিবে লাল রুধির।/ বঞ্চিত আর রহিবে না তারা , সহিবে না বসি অত্যাচার;/ উৎপীড়কের উত্তর দিবে, এসেছে সহসা প্রাণে জোয়ার।’ ( আজাদ, পৃ.২৭)
কবি হিসেবে কাদির কেবল শিল্প-সচেতন ছিলেন না , তার কাব্যযাত্রার অভিমুখ ছিল প্রেম ও সৌন্দর্যের দিকে। তার কবিতার মধ্যে প্রেমের জন্য হাহাকার নেই, আবার বেসামাল উচ্ছ্বাসও নেই। তার কবিতা রোমান্টিক উচ্ছ্বাসে টলটলায়মান, তবে সেখানে হৃদয় সংবেদর চেয়ে চেতনার অনুরণন ঢের বেশি। রবীন্দ্রনাথের রোমান্টিকতা ও সৌন্দর্যবোধ তার কাব্যভাবনাকে সমৃদ্ধ করলেও তীব্র আবেগ, মর্ত্যপ্রীতি,ইহজাগতিক ভোগবাদ, জৈব আকুতি, শরীরী সংরাগ তার কাব্য ভুবনকে স্বাতন্ত্র্যম-িত করে তুলেছে। তার কাব্যপ্রয়াসে মোহিতলাল মজুমদারের ধ্রুপদ সংগঠন, ঐতিহ্যপ্রেম, ছন্দোমনস্কতা এবং নজরুলের বাঁধভাঙা আবেগের অপূর্ব সমন্বয় লক্ষ করা যায়। কবির অন্তর্জগৎ বিনির্মাণে রবীন্দ্রনাথ, দেবেন্দ্রনাথ সেন, মোহিতলাল, নজরুল প্রমুখের প্রভাব কোনভাবেই অস্বীকার করা যায় না, তবে তিনি কাউকে অন্ধভাবে অনুকরণ করেননি। আর এসব কারণে দিলরুবা প্রকাশের পর ব্যাপকভাবে তা পাঠক-সমাদৃত হয়। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, মোহিতলাল, জসীমউদ্দীন, কাজী আবদুল ওদুদ প্রমুখ কবি-সাহিত্যিক দিলরুবার অন্তর্গত কবিতাগুলোর জন্য আবদুল কাদিরকে অভিনন্দন জ্ঞাপন করেন এবং এই কাব্যগ্রন্থ যে তাকে বাংলা কাব্যভুবনে স্থায়ী ও শক্তিশালী আসন করে দেবে, সে কথাও তারা স্বীকার করেন।
আবদুল কাদিরের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘ উত্তরবসন্ত’ প্রকাশিত হয় ‘দিলরুবা’ প্রকাশের ত্রিশ বছর পরে। কাদের থেকে কাদির হয়ে ওঠা এক দীর্ঘ পরিক্রমা, অব্যাহত চর্চা ও সাধনার মধ্য দিয়ে তিনি নিজেকে পরিণত করে তুলেছিলেন বিরলপ্রজ কবিদের একজনে। কেন যে তিনি নিজেকে বাংলার কাব্যভুবন থেকে সরিয়ে রেখেছিলেন, তা কবি তার নিজের জবানিতে জানান দিয়েছেন। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন:
‘ সৌন্দর্য ও আনন্দ আমার অন্তরে সঞ্চার করেছিল কবিতা প্রণয়নের প্রেরণা, কিন্তু স্বদেশ ও স্ব-সমাজের মূঢ় ও নির্যাতিত মানুষের জীবন ও মন কিরূপে মুক্ত ও বিকশিত হতে পারে এই ভাবনা ক্রমশ আমাকে করে অধিকতর ব্যাকুল; ফলে আমাদের রাষ্ট্রনীতিক অর্থনীতিক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকা- ও তৎপরতার ইতিহাস সন্ধানের দিকে আমার মনোনিবেশ বৃদ্ধি পায়; আমার বিবিধ প্রবন্ধে আছে তার বিচিত্র পরিচয়। আমার জীবনে কবিতার অনুশীলন অপেক্ষা সাহিত্যের গবেষণা ও সম্পাদনার পরিমান এই কারণেই হয়েছে তুলনায় অধিক।’ (শামসুজ্জামান খান কর্তৃক গৃহীত আবদুল কাদিরের সাক্ষাৎকার। চরিত্র, প্রথম সংকলন, বৈশাখ ১৩৮৬ , পৃ: ৪৯।)


বাংলা কবিতায় আবদুল কাদিরের অবদান অসামান্য, তবে গবেষক, সাময়িকপত্র-সম্পাদক, প্রবন্ধিক ও ছান্দসিক হিসেবে তার কৃতিত্ব অতুলনীয়। বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী এই বিরলপ্রজ মানুষটির অনবদ্য মননকর্ম ‘ছন্দ সমীক্ষণ’ (১৯৭৯), যে গ্রন্থে তিনি বাংলা ছন্দ সম্পর্কে মৌলিক ধারণা ব্যক্ত করেছেন। তার ছন্দ সম্পর্কে জ্ঞান ছিল অতুলনীয়। তিনি বাংলা ছন্দ নিয়ে প্রায় চার দশক ধরে কাজ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ, প্রবোধ সেন (১৮৯৭-১৯৮৬), দিলীপকুমার রায় (১৮৯৭-১৯৮০), অমূল্যধন মুখোপাধ্যায় (১৯০২- ১৯৮৪) ছন্দ-আলোচনায় যে বিজ্ঞানসম্মত ধারা প্রবর্তন করেন, সেই ধারা সুদৃঢ় ভিত্তি পায় কাদিরের হাতে। একজন ছান্দসিক কবি হিসেবে তিনি তার কবিতায় যেমন ছন্দ নৈপুণের কৃতিত্ব দেখিয়েছেন, তেমনি ছন্দ বিষয়ে বহু নিবন্ধ রচনা করেছেন। তার ছন্দ বিষয়ক প্রথম প্রবন্ধ ‘ছন্দ জিজ্ঞাসা’ প্রকাশিত হয় ছায়াবীথি (ফাল্গুন ১৩৩৮) পত্রিকায়। ছন্দ বিষয়ে প্রবন্ধ-নিবন্ধ ও গ্রন্থ রচনার জন্য তিনি ছন্দবিজ্ঞানী প্রবোধ সেনেরও প্রশংসা লাভ করেন। একজন ছান্দসিক কবি ও ছন্দ বিশারদ হিসেবে এখানেই তার কৃতিত্ব ও সাফল্য। সাহিত্য-সম্পাদক হিসেবেও তিনি ছিলেন মেধাবী, সৃজনশীল ও শ্রমী। তিনি সম্পাদনা করেন কাব্য সঙ্কলন ‘কাব্যমালঞ্চ ’(১৯৪৫), ‘মুসলিম সাহিত্যের সেরা গল্প’, ‘নজরুল রচনাবলী’, ‘রোকেয়া রচনাবলী’, ‘সিরাজী রচনাবলী’, ‘লুৎফর রহমান রচনাবলী’, ‘ইয়াকুব আলী চৌধুরী রচনাবলী’, ‘আবুল হুসেন রচনাবলী’, ‘কাব্যবীথি’ ইত্যাদি। শিকড় সন্ধানী, ঐতিহ্যপ্রেমী বিদ্যাজীবী বলতে যা বোঝায় কবি কাদির ছিলেন আক্ষরিক অর্থে তা-ই। সম্ভবত এ কারণে জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় পার করেছেন বাঙালির জাতীয় ইতিহাসের উপাদান সংগ্রহের নিমিত্তে।‘ কাব্যমালঞ্চ’ এই ভাবনার সোনালী ফসল। বাঙালি মুসলমান সমাজের কাব্যসাধনার প্রথম আকরগ্রন্থ হিসেবে বিবেচনা করা যায় সংকলনটিকে। এতে ষোড়শ শতকের কবি শেখ ফয়জুল্লাহ থেকে সৈয়দ আলী আহসান ( ১৯২২-২০০২) পর্যন্ত মোট ১১৭জন মুসলমান কবির ১৭৪টি কবিতা সংকলিত হয়েছে। কাব্য সংকলনের ভূমিকায় বলা হয়:
‘ সংকলনের কবিতাগুলি বাংলাদেশের মুসলিম সংস্কৃতির অবদান স্বরুপ। মধ্যযুগ হইতে বর্তমান যুগ পর্যন্ত কাব্যালোচনা দ্বারা বাঙলা সাহিত্য ও ভাষার উপর মুসলিম মানসিকতার যে একটা স্থায়ী ছাপ দিতে পারিয়াছেন, এই কবিতাগুলি তাহার উৎকৃষ্ট প্রমাণ। আমরা আশা করি, হিন্দু-মুসলিম সংস্কৃতি সমন্বয়ের সাধকগণ মুসলিম কবি ও সাহিত্যিকগণের এই অমর অবদানের কথা অগ্রাহ্য করিবেন না।’ ( বাঙলা সাহিত্য ও মুসলমান, কাব্যমালঞ্চ)
উদ্ধৃত বক্তব্য থেকে এ কথা প্রতীয়মান হয় যে, কোন সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি বা সম্প্রদায়গত ভাবনা থেকে কাব্যমালঞ্চ সম্পাদনা বা প্রকাশনার উদযোগ গ্রহণ করা হয়নি। বাঙালির সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাস-ঐতিহ্যকে অখ-রূপে তুলে ধরবার অভিপ্রায় ও বাসনা-ই এই মহৎ উদযোগের পেছনে কাজ করেছে। গবেষক রেজাউল করীমের অবদান স্বীকার নিয়েও বলা যায় যে, এই সংকলনের প্রায় সব দায়িত্ব পালন করেছেন সম্পাদক আবদুল কাদির। তিনি কেবল বাঙালি মুসলমান কবিদের কবিতার নমুনা সংগ্রহ করেই ক্ষান্ত হননি, সাথে সাথে সংকলনে অন্তর্ভুক্ত করেছেন ৫২ পৃষ্ঠার এক দীর্ঘ ইতিহাসনিষ্ঠ ভূমিকা, যেখানে বিধৃত হয়েছে বাঙালি মুসলমান কবি ও তাদের কবিতার ইতিহাস। এই মননধর্মী ও তথ্যনিষ্ঠ রচনাটি সাহিত্য-সমালোচক ও গবেষক হিসেবে তাকে বাংলা সাহিত্যে স্থায়ী আসন পাইয়ে দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে বলে অনেকে সাহিত্য-সমালোচক মনে করেন। তিনি এই উঁচুমানের রচনায় মুসলমান কবিদের কবিতাগুলি সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করে দেখান যে, বাঙালি মুসলমান- সমাজ শিল্প সাহিত্য বিকাশের জন্য কোনকালেই তেমন অনুকূল ছিলনা। এই সমাজ সৃজনশীল কর্মপ্রয়াসকে সেইভাবে অনুপ্রাণিত করেনি বা করতে চায়নি। বিরূপ- বৈরী পরিবেশের কারণে প্রতিভাধর বলতে যা বোঝায় সে রকম কবি-সাহিত্যিক বা সৃষ্টিশীল ব্যক্তিত্ব এই সমাজে জন্ম গ্রহণ করেননি। রাখঢাক না করে স্পষ্টভাবেই তিনি জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, বাঙালি মুসলমান তার প্রতিবেশ, পুরাণ, ঐতিহ্য কিংবা চারদিকের বহমান বিচিত্র জীবনধারা থেকে প্রাণরস সংগ্রহ করতে পারেনি, তাই তার পক্ষে সন্ধান পাওয়া সম্ভব হয়নি অমৃত, অমরত্ব, আনন্দ কিংবা জীবনের চরিতার্থতার। অতিরিক্ত ভাববিহবলতা, অন্ধ অনুবর্তিতা, সম্মোহিত দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বড়মাপের বা মানের কিছু যে হওয়া যায় না, তা তিনি নিজে মেনেছেন এবং অপরকে মানতে বলেছেন। তার মনে হয়েছে , ‘সবল মনুষ্য-প্রকৃতি আর উদার বিচার-বুদ্ধির’ অভাবে বাঙালি মুসলমান সম্প্রদায় বুদ্ধি-বিচার-আত্ম-আনন্দ- এই সব কিছুর আস্বাদ থেকে বঞ্চিত। সে কারণে বোধ হয়, শেখ ফয়জুল্লাহ থেকে ফররুখ আহমদ পর্যন্ত আমাদের মুসলমান সমাজের যে কাব্যজগৎ সেখানে আলাদা বা স্বাতন্ত্র্য্যম-িত কিছু পাওয়া যায় না। কাদিরের মনে হয়েছে, মাটি-মানুষ-প্রকৃতির সঙ্গে সহজ ও সুনিবিড় সম্পর্কের অভাবে বাঙালি মুসলমান পূর্ণরূপে বিকশিত হতে পারেনি। জীবন রূপায়ণের জন্য যে অশেষ আত্মবিশ্বাস ও আত্মিক শক্তির প্রাখর্য দরকার, তার কোন কিছুই মুসলমান কবিদের মধ্যে ছিল না। সত্যি বলতে কি: কাচ রোদ্দুর, ছায়া অরণ্য, পুকুর, ছোটনদী, সবজি বাগান, নিকিয়ে- নেয়া উঠোন, তেঁতুলের ডাল থেকে উড়ে আসা মাছরাঙা, মাদারের ডালে বসা শঙ্খচিলের সঙ্গে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ছাড়া কেউ মহৎ কবি হয়ে উঠতে পারেনা। এটা অন্য কবিদের ক্ষেত্রে যেমন সত্য, মুসলমান কবিদের ক্ষেত্রেও সত্য। এই সত্য তখনকার মুসলমান কবিরা কী অনুধাবন করতে পেরেছিলেন ? তবে হ্যাঁ, বিষয়টি কাদির অনুধাবন করেছিলেন, তার সম্পাদিত কাব্যমালঞ্চ’র মাধ্যমে বাঙালি সারস্বত সমাজ আরো উপলব্ধি করালেন যে, হিন্দু-মুসলমানের মিলিত সাধনার মাধ্যমে বাংলা ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির বুনিয়াদটি নির্মিত হয়েছে। বাংলা সাহিত্যে হিন্দুর যেমন দান রয়েছে, তেমনি মুসলমানের অবদানও কম নেই।কিন্তু বিভেদের রাজনীতি মুসলমান সমাজকে সৃজন-মনন চর্চার সর্বক্ষেত্রে পিছিয়ে দিয়েছে, আর সে কারণে ‘বাংলার মুসলমানের জীবনায়োজন মারাত্মক ত্রুটিতে পরিপূর্ণ’ হয়ে ওঠে; তার ছায়া সাহিত্য ক্ষেত্রেও পড়ে। এ প্রসঙ্গে সংস্কৃতি-তাত্ত্বিক গোপাল হালদারের মন্তব্য পাঠ করা যেতে পারে। তিনি বলেছেন:
‘ বাঙালি জাতি মোটের উপর এক; বাঙলার প্রাচীন সংস্কৃতিও মোটের উপর হিন্দু মুসলনের দানে এক হয়ে উঠেছে, বাঙলার বর্তমান সংস্কৃতিতে মুসলমানের দানে যে ঘাটতি পড়েছেতার কারণ ঐতিহাসিক, সে ঘাটতি পূরণে নতুন মুসলমান কবিরা উদগ্রীব হয়ে উঠেছেন, কিন্তু সমসাময়িক নানা বিক্ষোভে এদিকে তারা সুস্থ ও সবল আত্মবিকাশের সুযোগ লাভ করছে না, আর না করাতে বাঙলার বর্তমান সংস্কৃতিও সুস্থ ও সবল হয়ে উঠতে পারছে না।’ (পুস্তক-পরিচয়: কাব্যমালঞ্চ, পরিচয়। দশম সংখ্যা, বৈশাখ ১৩৫২।) আবদুল কাদিরের কাব্য সংকলন ‘কাব্যবীথি’ প্রকাশিত হয় ‘কাব্যমালঞ্চ’ প্রকাশের ন বছর পরে। তিনি মুসলমান কবিদের কবিতায় যে দেশপ্রেম,মানবপ্রেম, নিসর্গপ্রীতি, সৌন্দর্য ও মানবিকতার প্রতি নিবিড় অনুরাগ, সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার আকাক্সক্ষা, সত্যজ্ঞান ও শ্রেয়োচেতনা, স্বাধীনতা লাভের বাসনা, নতুন সৃষ্টির স্বতোৎসারিত আবেগ ও উন্মাদনা লক্ষ করেছেন, সে সব কবিতা এ কবিতা-সংকলনে অন্তর্ভুক্ত করেছেন।


নজরুল প্রয়াণের অনেক আগে দেশভাগের পর পরই ঢাকায় প্রথম প্রথাগত নজরুলসংগীত শিক্ষাদানের সূচনা করে বুলবুল ললিতকলা একাডেমি। ষাটের দশকে নজরুলের অনুরাগী মহল নজরুলের গানের বিশুদ্ধ চর্চার জন্য ঢাকায় কাজী মোতাহার হোসেনের বাসভবনে গড়ে তোলেন ‘ছায়ানট সংগীত বিদ্যায়তন’। ১৯৬৮ সালে কবির জন্মদিনে নজরুল একাডেমী প্রতিষ্ঠিত হয়। এখান থেকে প্রকাশিত হত নজরুল একাডেমী পত্রিকা নামে একটি মূল্যবান পত্রিকা। তবে, সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে নজরুল চর্চায় পথিকৃতের ভূমিকা রাখে বাঙলা উন্নয়ন বোর্ড ( ১৯৬৪-১৯৬৫)। পরে অবশ্য, প্রতিষ্ঠানটি বাংলা একাডেমির সঙ্গে মিলে যায়। সেখান থেকে ১৯৬৬ সালে প্রথম প্রকাশিত হয় আবদুল কাদির সম্পাদিত নজরুল রচনাবলী। মোট তিনটি খ-ে: প্রথমখ-,দ্বিতীয় খ- ও তৃতীয় খ-ে, তা প্রকাশিত হয়েছিল যা নজরুল চর্চার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ঘটনা। স্বাধীনতার পর এর আরো খ- প্রকাশিত হয়। নজরুল-রচনাবলীর সম্পাদনার মধ্যদিয়ে কবি, প্রাবন্ধিক আবদুল কাদির নজরুল গবেষক, সম্পাদক ও বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠেন। তিনি নজরুলের সাহিত্যকর্মকে সময়কাল অনুযায়ী কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করে প্রত্যেক যুগের সৃজন সম্ভারকে ভিন্ন ভিন্ন খ-ে বিন্যাস্ত করে প্রকাশ করেন। এই গ্রন্থের ‘সম্পাদকের নিবেদন’ পাঠ করে নজরুলের সাহিত্য-জীবনের এমন সব অনালোকিত দিক জানা যাবে, যা সত্যিকার অর্থে বিস্ময়কর। প্রথম খ-ে সংকলিত হয়েছে নজরুলের সাহিত্য জীবনের প্রথম যুগের রচনাবলী। নজরুলের দেশপ্রেম বিষয়ক রচনাবলী এই খ-ে স্থান পেয়েছে। সাহিত্যিক জীবনের প্রথম পর্বে তিনি স্বদেশপ্রেমের অগ্নিমন্ত্রে উজ্জীবিত ও অনুপ্রাণিত হয়ে মহাত্মা গান্ধীর চরকাতত্ত্ব, সিআর দাশের নিয়মতান্ত্রিকতা, দেশমাতৃকার জন্য ক্ষুদিরামের আত্মদান, কামাল আতাতুর্কের সুশৃঙ্খল সংগ্রাম নিয়ে লিখেছেন অসংখ্য কালজয়ী কবিতা ও গান, যা প্রথম খ-ে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। নজরুল তার সাহিত্যিক-জীবনের দ্বিতীয় পর্বে গণতান্ত্রিক সমাজবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েন,‘ ডেমোক্রাটিক সোস্যালিজমের প্রতি নজরুলের মনের প্রগাঢ় অনুরাগ তাঁর সাম্যবাদী, সর্বহারা , ফণি-মনসা’র বহু কবিতা গানে সুপরিস্ফুট।’ সাহিত্য-জীবনের তৃতীয় পর্বে কবি সঙ্গীতকার ও সুর¯্রষ্টা হিসেবে আবির্ভূত হন। এ পর্বের সৃষ্টিসমূহ কাদির তৃতীয় খ-ে অন্তর্ভুক্ত করেন। নজরুল ইসলামের সাহিত্য জীবনের চতুর্থ যুগের সমুদয় রচনা আবদুল কাদির সম্পাদিত নজরুল-রচনাবলীর ৪র্থ খ-ে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। কবি-জীবনের এই পর্বে তিনি আধ্যাত্মিক কবিতা ও মরমি গান রচনায় মনোনিবেশ করেন। একটি কবিতায় নজরুল বলেছেন:
‘ আল্লা পরম প্রিয়তম মোর, আল্লা তো দূরে নয়;
নিত্য আমারে জড়াইয়া থাকে পরম সে প্রেমময়।’
এ কথা সুস্পষ্টভাবে বলা যায়, কাদির সম্পাদিত নজরুল-রচনাবলীতে নজরুল আবিষ্কৃত হয়েছেন নতুন রূপে, পাঠকের সামনে উদিত হন নতুন অবয়বে। আমার উপলব্ধি ও যৎকিঞ্চিৎ পর্যালোচনা এই যে, কাদিরের নজরুল পাঠ যদিও ব্যক্তিক মুগ্ধতায় ভরা, তারপরও তিনি নজরুল-সাহিত্যের চাপাপড়া দিকগুলি টর্চ ফেলে আলোকিত করেছেন। আর সে কারণে এই গ্রন্থ স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে নজরুল চর্চার দিগন্ত প্রসারিত করেছে। এ সম্পাদনা গ্রন্থের মাধ্যমে আগ্রহী ও জিজ্ঞাসু পাঠক নজরুলের কবিমানসের গতিপ্রকৃতি ও ভাবধারার সঙ্গে পরিচিত হয়েছে নতুন করে। তিনি খানিকটা প্রতœতাত্ত্বিকের মতোই আবিষ্কার করেছেন সমগ্র-নজরুলকে এবং তার মণিকাঞ্চনের আভায় উদ্ভাসিত সাহিত্যের নানাদিক, যা পাঠ করতে গিয়ে বিস্ময়ের মুখোমুখি হতে হয় অ-বিশেষজ্ঞ পাঠককে।
আবদুল কাদির যে বহুমুখী ও বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী এক বিরলপ্রজ সাহিত্য-ব্যক্তিত্ব ও চিন্তানায়ক ছিলেন, তা বলাই বাহুল্য। সাহিত্যের প্রায় সব শাখাতেই যে, তার সহজ ও অনায়াস বিচরণ ছিল, তাও সকলের জানা। তিনি জীবনভ’র স্বীয় কর্মক্ষেত্রে নিজ দায়িত্বটুকু পরমনিষ্ঠা সহকারে স্বচ্ছন্দ আনন্দে উদযাপন করে গেছেন। আবদুল ওদুদের চিন্তা ও সাহিত্যযাত্রার ঘনিষ্ঠতম সহযাত্রী ছিলেন কাদির। কিন্তু ওদুদের সব মতের সঙ্গে একমত পোষণ করতে পারেননি, এমনকি শিখা’র দলের সঙ্গেও না। তিনি কেবল সাহিত্যশিল্পী ছিলেন না, ছিলেন সমাজভাবুক ও রাজনীতি-চিন্তক। তার কবিতা, প্রবন্ধ, সাহিত্য-সমালোচনা তার সমকালেরকবি-সাহিত্যিক- ভাবুক-চিন্তকদের ভাবিত,জারিত , বিস্মিত ও আনন্দিত করেছে; ভাবীকালকেও যে করবে, তা দৃঢ়তার সঙ্গেই বলা যায়। কারণ কাদিরের মননবিশ্ব ছিল সর্বঅর্থেই স্বাতন্ত্র্যম-িত। তিনি যে ভিন্ন মতাবলম্বী ও বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের সত্যিকারের ধারক-বাহক ছিলেন, তা এ সময়ে উচ্চকণ্ঠে উচ্চারণ করা চলে।

আবদুল্লাহ আল আমিন: লোকগবেষক ও প্রাবন্ধিক। সহযোগী অধ্যাপক, মেহেরপুর সরকারি কলেজ, মেহেরপুর।


মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৪:৩৭

রূপক বিধৌত সাধু বলেছেন: চমৎকার প্রবন্ধ! মনোযোগ দিয়ে পড়লাম । অনেককিছুই জানা হলো । অাবদুল কাদিরের লেখা অামারও ভালো লাগে ।

১১ ই জানুয়ারি, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:৩২

আবদুল্লাহ আল আমিন বলেছেন: আপনাকে ধন্যবাদ। ভাল থাকবেন।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.