![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আবদুল্লাহ আল আমিন
মেহেরপুর জেলার সদর উপজেলার ভৈরবতীরবর্তী কুতুবপুর গ্রামে শ্রাবণী ঝুলন তিথিতে বসে নিগমানন্দের জন্ম তিথির মেলা। সারা দেশের নিগমানন্দের অনুসারীরা এই তিথিতে গুরুধাম কুতুবপুরে আসেন। এ উপলক্ষ্যে গুরুধামের চারপাশে একটি মেলা বসে। সাধক নিগমানন্দ সরস¦তী (১৮৮০-১৯৩৭) ছিলেন একাধারে অধ্যাত্মসাধক, ধর্মসংস্কারক, লোকহিতৈষী এবং শিক্ষানুরাগী। তিনি বাংলা ১২৮৭ সালের (১৮৮০ খ্রি,) শ্রাবণী ঝুলন পূর্ণিমায় মেহেরপুরের রাধাকান্তপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ভূবনমোহন চট্টোপাধ্যায় ছিলেন নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ এবং মাতা মানিক সুন্দরী দেবী ধর্মনিষ্ঠ মমতাময়ী নারী। নিগমানন্দের পিতৃদত্ত নাম নলিনীকান্ত চট্টোপাধ্যয় এবং পিতৃনিবাস কুতুবপুর। ঊনিশ শতকের এক রক্ষণশীল হিন্দু পরিবার ও প্রতিবেশে জন্মগ্রহণ করেও তিনি ছিলেন সৃজনশীল, যুক্তিবাদী ও মননশীল। বর্ণশাসিত সমাজের উত্তরাধিকার বহন করতে হয়েছে জন্মসূত্রে বাধ্য হয়ে, কিন্তু তাঁর মননের গভীরে ছিল মানবিকতা, মনুষ্যত্ব ও উদার অসাম্প্রদায়িকতা। যুববয়সে আর্তের সেবায় ছুটে গেছেন, অন্ত্যজ-অস্পৃশ্যদের অন্তেষ্টিক্রিয়া ও শব-সৎকারে অংশগ্রহণ করেছেন। ঢাকা ওভারসিয়ারী পাশ করে শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত হন। শৈশবেই সাক্ষাৎলাভ করেন অধ্যাত্মসাধক ভাস্করানন্দ, রামকৃষ্ণদেবের। তাঁরা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, ‘এই বালক সংসারী হলে ঐশ্বর্যবান হবে। আর সন্ন্যাসী হলে জগদ্বরেন্য সন্ন্যাসী হবে। তবে এই বালকের সন্ন্যাস যোগের বিশেষ সম্ভাবনা আছে।’
কৈশোরে মায়ের মৃত্যুতে শোকার্ত নিগমানন্দের মধ্যে এক ধরনের পরিবর্তনের সূচনা হয় এবং তিনি ধর্ম ও অধ্যাত্মসাধনায় অনুরাগী হয়ে ওঠেন। এ সময় তাঁর পিতা তাকে সংসারী করে তোলার জন্য বিবাহের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। চব্বিশ পরগনার হালিশহর নিবাসী বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের কন্যা সুধাংশুবালার সাথে নিগমানন্দের বিয়ে হয়। বিয়ের পর তিনি দিনাজপুরে চলে যান, প্রথমে দিনাজপুর ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের ওভারসিয়ার পদে এবং পরে রাসমনি এস্টেটের নায়ারণপুর কাছারির সুপারভাইজার পদে নিযুক্ত হন। জনশ্র“তি আছে ধর্ম, ঈশ্বর, পরকালে প্রগাঢ়ভাবে অবিশ্বাসী নিগমানন্দ নারায়ণপুরে চাকুরীকালীন অবস্থায় স্ত্রী সুধাংশুবালার অশরীরী ছায়ামূর্তি দেখে ভীত ও চিন্তিত হয়ে পড়েন। তিনি স্ত্রীকে গভীরভাবে ভালবাসতেন। টেলিগ্রাম বার্তা পেয়ে বাড়ি গিয়ে জানতে পারেন স্ত্রী মারা গেছেন। স্ত্রীর অপরূপ স্মৃতি ও প্রেমে মুগ্ধ নিমানন্দ এরপর অবিশ্বাসী থেকে বিশ্বাসীতে রূপান্তরিত হলেন এবং স্ত্রীর সান্নিধ্যলাভের আকাক্সক্ষায় পরকাল সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তিনি ঈশ্বর, পরকাল তত্ত্ব, দর্শন সম্পর্কে জানার অভিপ্রায়ে মাদ্রাজ, কলকাতা, কাশীসহ ভারতবর্ষের বিভিন্ন সাধনপীঠ ও তীর্থস্থান পরিভ্রমণ করেন। অবশেষে বামাক্ষ্যাপার কৃপায় বীরভূম জেলার দ্বারকানদী তীরবর্তী মহাশ্মশান তারাপীঠে সিদ্ধি লাভ করেন। কথিত আছে, এক রাত্রে তিনি স্ত্রী সুধাংশুবালাকে মহামায়ারূপে দেখতে পান এবং সেই সাথে বিশ্বরূপ দর্শন করেন। মেহেরপুরের এই সিদ্ধপুরুষ তান্ত্রিকসাধক শঙ্করাচার্য কর্তৃক ‘পরমহংস’ অভিধায় ভূষিত হন। নিগমান্দ ছিলেন কৌতূহলী ও সত্যানুসন্ধানী। তাই সত্য সন্ধান এবং জগৎ রহস্যের স¦রূপ অনে¦ষণ করতে গিয়ে ছুটে গেছেন এক আশ্রয় থেকে অন্য আশ্রমে, মাদ্রাজ থেকে কলকাতা, কাশী, তারাপীঠ, হিমালয়ের পাদদেশে। আসমুদ্র-হিমাচল পরিভ্রমণ করে নিজে হয়ে ওঠেন পরিব্রাজকাচার্য। জ্ঞান, যোগ, তন্ত্র, প্রেম সাধনায় সিদ্ধি লাভকারী এই অধ্যাত্মপুরুষের বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, আসামের বিভিন্ন অঞ্চলে রয়েছে অসংখ্য ভক্ত ও অনুরাগী। নিগমানন্দের ভক্ত ও অনুরাগীরা কুতুবপুরকে তীর্থস্থান মনে করেন। শ্রাবণী ঝুলন যাত্রায় নিগমানন্দের জন্মতিথি উপলক্ষে দু’বাংলার ভক্তরা কুতুবপুরে জড়ো হয়। এ উপলক্ষে মেহেরপুরের কুতুবপুর গুরুধামের আশেপাশের এলাকা মেলায় রূপ নেয়।‘ শ্রাবণী ঝুলন যাত্রা উপলক্ষে উৎসব ও মেলার প্রবর্তন ঠাকুর নিজেই করেছিলেন। ১৯৪৭ এর আগে এখানে প্রচুর লোক সমাগম হত। এখন আর তেমন হয়না।’ বললেন আশ্রমের প্রধান অখন্ডানন্দ মহারাজ। । অনুষ্ঠানে আসা প্রফেসর হাসানুজ্জামান বললেন, ‘নিগমানন্দ সরস¦তী কেবল অধ্যাত্মসাধক নন, তিনি ছিলেন মানব প্রেমে উদ্বুদ্ধ মহান পুরুষ। তাঁকে কেবল মঠ, আশ্রম আর সাধনপীঠের গন্ডিতে বন্দি রাখলে চলবে না, তাঁকে বের করে আনতে হবে মানব জীবনের বিশাল ক্ষেত্রে।’ শ্রাবণী ঝুলন যাত্রার উপলক্ষে আয়োজিত এই কুতুবপুরের মেলা মেহেরপুর জেলার লোক সংস্কৃতির অংশে পরিণত হয়েছে। এই মেলায় যারা আসেন তারা অধিকাংশই নিম্নবর্ণের মানুষ। কারণ নিগমানন্দ একদিন শঙ্করের যোগ, তন্ত্র, দর্শনের পাশাপাশি চৈতন্যদেবের নবপ্রেমবাদের বাণী শুনিয়েছিলেন। তাই তো মেলায় আসা ব্যাধ সম্প্রদায়ভূক্ত যাত্রা শিল্পী কমলারাণী বললেন, ‘এখানে এসে আমি জানলাম, আমি অচ্ছুৎ-অস্পৃশ্য নই, আমি মানুষ। লালনের মতো তিনিও মানুষ ও মানবতার কথাই বলেছেন।’
©somewhere in net ltd.