![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
বঙ্গবন্ধু ও কিছু সরল ভাবনা
মানবহিতৈষী, রাষ্ট্রদরদি, সংস্কৃতিমনস্ক এক মহানায়কের নাম শেখ মুজিব। তিনি ছিলেন প্রজাপ্রেমী, লোকদরদি,ভাবুক ও মানবমুক্তির স্বপ্ন দেখা- দেখানো এক সংগ্রামী জননায়ক। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলা যায়, মাটির কাছাকাছি কবি। তার নেতৃত্বে পরাধীন বাঙালি জাতি পেয়েছে মুক্তির স্বাদ । হাজার বছরের শোষণ- নিপীড়নের অবসান ঘটিয়ে বেদনাপীড়িত বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন তিনিই। একটি ভূখ- ও তার ভাষা-সংস্কৃতি-ঐতিহ্যকে ঘিরে যে সংগ্রাম করা যায় ও স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা যায় এমন দৃষ্টান্ত বিশ্বে তেমন পাওয়া যাবে না। শেখ মুজিবুর রহমান এক্ষেত্রে এক বিরল জননায়ক। নেহেরু পাশ্চাত্য মডেলের সেক্যুলার ভারতের কথা বলে মূলত সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু ভারতের স্বপ্নই প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। মহাত্মা গান্ধীর ‘রামরাজ্য’ হিন্দু ভারতবর্ষ ছাড়া আর কিছুই নয়। মাস মবিলাইজেশনের মাধ্যমে রামরাজ্যের স্বপ্ন দেখাতে গিয়ে এক অর্থে তিনি হিন্দু জাতীয়তাবাদের পাটাতনটা মজবুত করে গেছেন। বিশ্লেষক ও তাত্ত্বিকরা বলেন, গান্ধীজি আসলে অহিংসার আড়ালে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে গেছেন। গান্ধীর রামরাজ্যের এন্টিথিসিস হিসেবে জিন্নাহ’র দ্বিজাতিতত্ত্বের জন্ম; এ কথা এখন অনেকেই বলছেন। তবে তিনি কংগ্রেসকে অভিজাততন্ত্রের চক্রব্যূহ থেকে আমজনতার কাছাকাছি নিয়ে এসেছিলেন। এ কথা অতিশায়িত হবে না যে,পাকিস্তানি রাষ্ট্র ও ভাবাদর্শের বুনিয়াদ রচনা করে গেছেন নেহেরু-প্যাটেলসহ তথাকথিত সেক্যু কংগ্রেসিরা। আর বাঙালি মুসলমান এলিটরাও কম সাম্প্রদায়িক ছিলেন না। তারাও ছিলেন ছিলেন ঘোরতর সাম্প্রদায়িক ও প্রতিক্রিয়াশীল। তাদের রক্তে ও মজ্জায় ছিল হিন্দু তথা পরধর্ম বিদ্বেষ। স্যার সলিমুল্লাহ থেকে শেরেবাংলা, সোহরাওয়ার্দি, খাজা নাজিমউদ্দিরা কেবল বাঙালি মুসলমানের স্বার্থ প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই-সংগ্রাম করে গেছেন। তাদের মনস্তত্ত্বে বাঙালি হিন্দু জায়গা পায়নি। লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে পূর্ববঙ্গের হিন্দুদের কী হবে, তা একবারের জন্য শেরে বাংলাও ভাবেননি, সোহরাওয়ার্দিও না। মওলানা ভাষানী যে অখ- বাংলার কথা বলেছেন, সেখানে মানুষ ছিল না; ছিল কেবল মাটি। তার ভাবনাও আবর্তিত হয়েছে ওই চল্লিশ সালের লাহোর প্রস্তাবকে ঘিরে। কেবল বঙ্গবন্ধু এক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী ছিলেন। একমাত্র তিনিই হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ জাতিধর্ম নির্বিশেষে সকল বাঙালির সামগ্রিক মুক্তির কথা বলে গেছেন। তার ভাবনা ও ভাবুকতা জুড়ে ছিল কেবল বাঙালি এবং বাঙালি।মনুষ্যত্ব ও মানবিকতার উজ্জ্বল আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে তিনি সকল ভেদবুদ্ধি ও সংকীর্ণতা রুখতে চেয়েছেন সারাজীবন। তিনি এমন এক মানবদরদি, হৃদয়বান বাঙালি ছিলেন, যিনি একটি বাঙালিকে অবিশ্বাস করেননি, শত্রু ভাবেননি। রবীন্দ্রনাথ বলে গেছেন,‘ মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ’, বঙ্গবন্ধু এই আপ্তবাক্য অমৃত্যু অক্ষরে অক্ষরে মেনে গেছেন। কেউ যদি তাকে বাঙালি শভিনিষ্ট হিসেবে আখ্যায়িত করেন, তাতে আমি দ্বিমত পোষণ করবো না। অথচ কি আশ্চর্য, বাঙালি নামের একদল বিপথগামী নিকৃষ্ট কীট তাকে হত্যা করলো। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাকা- কেবলই একটি হত্যাকা- নয়, মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে জেগে ওঠা সাড়ে সাত কোটি মানুষের স্বপ্নগুলো হত্যা করার চক্রান্তও বটে। যারা বাংলাদেশকে স্বাধীন, সচ্ছল ও মানবিক রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চায়নি, তারাই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে। যারা বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক মানবিকতা, শোষণহীন রাষ্ট্র বিনির্মাণের স্বপ্ন, একাত্তরের ভাবকল্পের সাথে একমত হতে পারেনি, সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ধ্বজাধারী ও সা¤্রাজ্যবাদের সেই সব ক্রীড়ানকরাই বঙ্গবন্ধু তার পরিবারবর্গকে হত্যা করেছে। যারা ১৯৭২-এর সংবিধানের চার মূলনীতি বিশেষত বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা মেনে নিতে পারেনি, তারাই এই নৃশংস হত্যাকা- ঘটিয়েছে। ১৯৭৫ এর ৪ নভেম্বর জাতীয় চার নেতার হত্যাকা- ও ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউ এ শেখ হাসিনার সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে গ্রেনেড হামলা একই সূত্রে গাঁথা।
১৯৭৫ এর পনেরই আগস্টের পর শোকাহত জাতি বাকরুদ্ধ ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গিয়েছিল । থমকে দাঁড়ায় বাংলাদেশ ও বাঙালির গৌরবময় ইতিহাস। বঙ্গবন্ধুর জন্য কাউকে কাঁদতে পর্যন্ত দেয়া হয়নি। এ কথা কবি শামসুর রাহমান তার ‘ কালের ধুলোয়’ গ্রন্থে লিখেছেন। শোক-দুঃখ,শঙ্কা-আতঙ্কে জাতি সংবেদনহীন পাথরে পরিণত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর স্মরণে শোকসভা করা যায়নি- তার নাম নেয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, এই বর্বরোচিত হত্যাকা-ের প্রতিবাদ পর্যন্ত করতে দেওয়া হয়নি। এই শ্বাসরুদ্ধকর ও ভয়াল পরিস্থিতির মধ্যেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু অনুসারী কয়েকজন প্রগতিশীল শিক্ষক ১৫ আগস্টের হত্যার প্রতিবাদ জানিয়ে একটি লিফলেট বের করেন। ১৯৭৫ এর ৪ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা থেকে ছাত্র- শিক্ষক-জনতা মিলে বঙ্গবন্ধু স্মরণেবের করে শোক মিছিল । ওই একই দিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেটের সভায় বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয় এবং ১৫ আগস্টের হত্যাকা-ের বিচার দাবি করা হয় সর্বসম্মতিক্রমে। কিছু সাহসী কবি-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক কর্মীর উদ্যোগে প্রকাশিত হয় কবিতা সংকলন ‘এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়’। দুঃসময়ে কবি- সাহিত্যিক তথা সৃষ্টিশীল-সংবেদনশীল মানুষরাই যে পথহারা- বিভ্রান্ত জাতিকে পথ দেখায় তার উজ্জ্বল নিদর্শন এই কবিতা সংকলন। ১৯৭৬ সালে লন্ডনের কনওয়ে হলে আবদুল গাফফার চৌধুরী, স্থপতি মাযহারুল ইসলাম, রুহুল কুদ্দুস, গাউস খান- এর নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু স্মরণে শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৭৭ সালে বাংলা একাডেমির একুশ উদযাপন মঞ্চে কবি নির্মলেন্দু গুণ আবৃত্তি করেন ‘ আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি’। ১৯৭৯ সালে প্রফেসর মতিন চৌধুরীর নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু পরিষদ গঠিত হয়। ওই বছর বঙ্গবন্ধু পরিষদ টিএসসি চত্বরে বঙ্গবন্ধু স্মরণে শোকসভার আয়োজন করে। তারপর ধীরে ধীরে মানুষ জেগে ওঠে, আমরা ফিরে পায় আমাদের হারানো মুজিবকে – ফিরে পায় আমাদের প্রিয় জনককে। বাংলাদেশ ফিরে আসে তার ইতিহাসের কাছে। এ কথা ভেবে আনন্দিত হই যে, ৭৫ পরবর্তী বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী রাজনীতির কালো মেঘ অনেকেটাই কেটে গেছে। সমরনায়করা মুজিবকে একদিন ইতিহাসের খলনায়ক বানাতে চেয়েছিল, তাদের সেই অপচেষ্টা সফল হয়নি বরং বঙ্গবন্ধু আজ বাঙালি তরুণদের আইকনে পরিণত হয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, বিদ্যাসাগর, রামমোহন, শেরে বাংলা, সোহরাওয়ার্দিকে ছাপিয়ে তিনি সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, তিনিই বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের মহানায়ক। দিকে দিকে আজ তার মহিমা কীর্তন ধ্বনিত হচ্ছে। তারপরও শঙ্কা জাগে, ইতিহাসের কালোমেঘ যদি কোনদিন আবার ফিরে আসে, ঢেকে দেয় আমাদের প্রিয় আকাশটা- আমরা কী পারবো তা রুখে দিতে ? আমরা বঙ্গবন্ধুকে আমরা বাঁচাতে পারিনি, ৭৫-এর হত্যাকা-ের বিরুদ্ধে তেমন জোরালো প্রতিরোধও গড়ে তোলা যায়নি। প্রশ্ন জাগে, এখনও কী আমরা রাজনৈতিক, সাংগাঠনিক, সাংস্কৃতিক ও বৌদ্ধিকভাবে প্রস্তুত আছি পাকিস্তানি ভাবাদর্শের গণবিরোধী ষড়যন্ত্রমূলক রাজনীতি প্রতিহত করার জন্যে ? মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের মূলধারার রাজনীতিকে শক্তিশালী করার জন্য কোনো উদযোগ কী আমরা হাতে নিয়েছি ?
©somewhere in net ltd.