![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আবদুল্লাহ আল আমিন
বিশ শতকের একেবারে সূচনা পর্বে এক দারিদ্র্য পীড়িত , রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারে কবি কাজী নজরুল ইসলামের ( ১৮৯৯- ১৯৭৬) জন্ম। বাংলা সাহিত্যের কুলীন বয়ানে যখন রবীন্দ্রনাথ প্রধান স্তম্ভ হয়ে উঠেছেন; ঠিক তখন তাঁর সক্রিয় সাহিত্যকাল, এ কালপর্ব গত শতকের বিশের দশক থেকে ত্রিশের দশক পর্যন্ত বিস্তৃত। এ সময়কালে রচিত হয় তাঁর কালজয়ী শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকীর্তিগুলি। ১৯২২ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অগ্নিবীণা’, তখন নজরুল তেইশ বছরের এক টগবগে যুবক। এ কাব্যগ্রন্থে সংকলিত হয় ‘মোহরম’, ‘কোরবানী’, খেয়াপারের তরণী, ‘শাত- ইল- আরব’, এর মত ইসলামী অনুষঙ্গের কবিতার পাশাপাশি হিন্দুদেবী ও উৎসব নিয়ে রচিত রক্তাম্বর ধারিণী মা, ‘আগমনী । এ ছাড়াও অন্তর্ভূক্ত হয় ‘প্রলয়োল্লাস’, ‘বিদ্রোহীর’ মত অনবদ্য কবিতা- যে কবিতায় হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান পুরাণ ও অনুষঙ্গ অসাধারণ নৈপুণ্যে ব্যবহার করা হয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষ আধুনিক তুরস্কের প্রতিষ্ঠাতা কামাল আতার্তুককে নিয়ে লেখা ‘কামাল পাশা’ কবিতাও অন্তর্ভূক্ত হয়েছে এই কালজয়ী কাব্যগ্রন্থে। অগ্নিবীণা’র দ্বিতীয় কবিতা রচিত হয়েছিল ১৯২১ সালে ডিসেম্বর মাসে দুর্গা পূজার সময় , তখন উপনিবেশ বিরোধী সংগ্রামে উত্তাল সারা ভারতবর্ষ। অসহযোগ আন্দোলন, চরকা আন্দোলন. সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন, খিলাফত আন্দোলনের উম্মাদনায় প্রকম্পিত চারদিক। ভারতবষের্র অন্যান্য তরুণের মত নজরুলও সেই অগ্নিযুগের অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত হয়েছিলেন। মহাত্মাগান্ধী দেশমুক্তির জন্য যে সংগ্রামের ডাক দিয়েছিলেন তাতে তরুণ নজরুলের মন গভীরভাবে আকৃষ্ট হয়েছিল। কিন্তু খুব বেশিদিন তিনি গান্ধীবাদে আস্থা রাখতে পারেননি, কারণ গান্ধীর অহিংসতত্ত্বে তার তেমন আস্থা ছিল না। কারণ ইংরেজ আমলের যে রাষ্ট্র তার প্রবল-প্রতাপ ও সহিংস চরিত্র সম্পর্কে তিনি বেশ সচেতন ছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি গান্ধীবাদ ত্যাগ করে শোষিত মানুষের মুক্তির জন্য বিপ্লববাদের দিকে যাত্রা করেন। সেই সময়ের অগ্নি ও উত্তাপ ধারণ করে রচিত হয় ‘বিদ্রোহী’, কবিতা যেটি ক-ীনা বিপ্লবীদের ইশতেহারের সাথে তুলনীয়। ‘ এ কবিতা সে সময়ে তরুণ প্রজন্মকে সংগ্রামে সংঘবদ্ধ হতে, কারাগারের অন্ধকার আর ফাঁসির মঞ্চকে অগ্রাহ্য করতে এবং মৃত্যুকে তুচ্ছ করতে সাহস যুগিয়েছে’। অনন্য মহিমায় উদ্ভাসিত এই অসাধারণ কবিতার ভাব-ঐশ্বর্য বিশ্লেষণ করলে যুগান্তর, অনুশীলন সমিতির সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন তথা বিপ্লববাদের সঙ্গে গান্ধীজীর সমন্বিত ধর্মচেতনার সমন্বয় খুঁজে পাওয়া যায়। ‘বিদ্রোহী’তে তিনি কেবল তারুণ্যের জয়গান করেনি , বিভিন্ন ধর্মের মিথ ও সর্বজনীন সত্যও তুলে ধরেছেন অসামান্য দক্ষতার সাথে সবলভাবে।
নজরুলের আগে বাংলা সাহিত্যে আর কেউ এমনটি করেননি বা করতে পারেননি। এক্ষেত্রে তিনি নিশ্চিত ভাবেই পথিকৃতের দায়িত্ব পালন করেছেন। ‘ বিদ্রোহী’তে পাওয়া গেল এমন এক নজরুলকে যিনি সর্বঅর্থেই অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ সম্প্রীতি সাধক। বিদ্রোহী তথা অগ্নিবীণা কাব্যই তাকে নিয়ে যায় জনপ্রিয়তার শীর্ষে;তারপর থেকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে । অগ্নিবীণা প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে সম্ভবত কারণে অকারণে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে যুগলরূপে নজরুলের নামটিও উচ্চারিত হতে থাকে। উপনিবেশিত বাঙালি অভিজাত ও হিন্দু-মুসলিম রক্ষণশীলদের দ্বারা ব্যাপকভাবে নিন্দিত নজরুলের জন্য এ এক পরম প্রাপ্তিই বলতে হয়।
সুদূরের পিয়াসী নজরুল আজীবন ছিলেন কিঞ্চিৎ চঞ্চল ও অস্থির । কিন্তু সাম্প্রদায়িকত ও উপনিবেশ বিরোধিতার প্রশ্নে তিনি ছিলেন উচ্চকন্ঠ, দৃঢ় ও অবিচল। ধর্মীয় সম্প্রীতি চেতনা ছিল তার হৃদয়ের মর্মমূলে প্রোথিত । তাই তার প্রথম গ্রন্থ উৎসর্গ করেছিলেন ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামের বিপ্লবী বীর বারীন ঘোষকে। সাধারণভাবে প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ প্রিয়জনকে উৎসর্গ করা হয়, কিন্তু তিনি তা করেনি। সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি, গোঁড়ামি, ধর্মীয় সংকীর্ণতা তাকে আ”্ছন্ন করতে পারেনি বলে তিনি এ কাজটি করতে পেরেছিলেন। উৎসর্গ পত্রে তিনি লিখলেন,‘ভাঙা বাংলার রাঙা যুগের আদি পুরোহিত সাগ্নিক বীর বারীন্দ্রকুমার ঘোষ শ্রীচরণাবিন্দেষু’। নজরুল ইসলাম সকল ধর্মের প্রতি সহিষ্ণু ও শ্রদ্ধাশীল ছিলেন এবং মানবধর্ম ছিল তার কাছে সবচেয়ে বড় ধর্ম। তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন মানবপ্রেম বৈষম্য ও হিংসার অবসান ঘটায়। যে মানুষ নিজ ধর্ম গভীরভাবে জানে, সে অন্য ধর্ম ঘৃণা করে না বরং অন্য ধর্মের সত্য গ্রহণ করার চেষ্টা করে। তিনি ধর্মের ভিত্তিতে মানুষকে ভাগ করার নীতি কখনই সমর্থন করেননি। ‘ হিন্দু মুসলমান’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, ‘অবতার পয়গম্বর কেউ বলেনি আমি হিন্দুর জন্য এসেছি,আমি মুসলমানের জন্য এসেছি, আমি ক্রিশ্চানের জন্য এসেছি, তারা বলেছেন আমরা মানুষের জন্য এসেছি, আলোর মতন সকলের জন্য’। তিনি রাজনীতির মানুষ ছিলেন, রাজনীতি ও রাজনৈতিকতা তার কবিতার প্রধান অনুষঙ্গ ,তারপরও ধর্মভিত্ত্বিক রাজনীতির ছিলেন ঘোর বিরোধী। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা প্রয়োজন, ‘ কাজী নজরুল ইসলাম আগাগোড়া মি. জিন্নাহের দ্বিজাতিতত্ত্ব ও পাকিস্তান বিরোধী ছিলেন। স্বলিখিত সম্পাদকীয়র নীচে তাঁর স্বাক্ষর থাকত। একাধিক স্বাক্ষরিত রচনায় তিনি কঠোর ভাষায় পাকিস্তান পরিকল্পনা ও দ্বিজাতিতত্ত্বের সমালোচনা করিয়াছিলেন।’( আবু জাফর শামসুদ্দীন, ‘ আত্মস্মৃতি’)
ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রাম এক পর্যায়ে ধর্মীয় উগ্রতায় রূপ নেয় এবং এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে ধর্মীয় উন্মত্ততা হানাহানি, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ভয়াবহরূপে সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯২৬ সালের ২-এপ্রিল কলকাতার রাজারাজেশ্বরী মিছিলকে কেন্দ্র করে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা বেধে যায়। ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীর মদদপুষ্ট এই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নজরুলকে ভীষণভাবে পীড়িত করে। দাঙ্গাবাজদের বিরুদ্ধে সাবধান বাণী উচ্চারণ করে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প মাখানো বৈরী আবহাওয়ার মধ্যে ‘ কা-ারী হুশিয়ার’ কবিতায় লেখেন:
‘‘অসহায় জাতি মরেছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরণ/ কা-ারী। আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তিপণ/‘ হিন্দু না ওরা মুসলিম’? এই জিজ্ঞাসে কোন জন/ কা-ারী! বলো, ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মা’র।” ( সর্বহারা) কৃষ্ণনগরে কংগ্রেসের প্রাদেশিক সম্মেলনে গানটি প্রথম গাওয়া হয়। হিন্দু-মুসলমান ভেদবুদ্ধি ও উগ্রচিন্তার বিরুদ্ধে তার কবিতার পঙক্তিমালা সব সময়ই ঝলক দিয়ে উঠেছে। ধর্মান্ধ ও মুর্খ দাঙ্গাবাজদের প্রতি বিদ্রƒপ শেল নিক্ষেপ করে তিনি উচ্চাণ করেছেন:
‘ খালেদ আবার ধরিয়াছে অসি, অর্জুন ছোড়ে বাণ।/ জেগেছে ভারত, ধরিয়াছে লাঠি হিন্দু মুসলমান।’ হিন্দু মুসলমান সম্প্রীতি যখন দাঙ্গায় রূপ নেয় তখনও তিনি হিন্দু-মুসলমান মিলনের কথা বরেছেন, প্রচার করেছেন আকবরের দ্বীন ই-ইলাহি মতবাদ। মধ্যযুগের সন্ত কবীর-দাদু ধর্ম সমন্বয়ের জন্য যে পথে চলার সাধনা করেছেন ধ্যানে ও জীবনচর্যায়, সে পথে নজরুলও চলতে চেয়েছেন আমৃত্যু।
ওই একই সময়ে (১৯২৬) দাঙ্গার বিরূদ্ধে রচিত ‘মন্দির- মসজিদ’ প্রবন্ধেও তিনি লিখেছেন :‘ হিন্দু মুসলমানি কা- বাধিয়া গিয়াছে। প্রথমে কথা কাটাকাটি, তারপরে মাথা ফাটাফাটি আরম্ভ হইয়া গেল। আল্লাহ ও মা কালীর প্রেস্টিজ রক্ষার জন্য যাহারা এতক্ষণ মাতাল হইয়া চিৎকার করিতেছিল তাহারাই যখন মার খাইয়া পড়িয়া যাইতেছিল দেখিলাম, তখন আর তাহারা আল্লামিঞা বা কালী ঠাকুরানীর নাম লইতেছে না।’ ধর্মন্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতা কীভাবে মানুষের শুভবোধ, নৈতিকতা ও মানবিকতা ধ্বংস করে হিংসায় উন্মত্ত পশুতে পরিণত করে, তা তিনি ‘ মন্দির মসজিদ’ প্রবন্ধে ব্যাখ্যা করেছেন। নজরুল যে সাম্প্রদায়িক শক্তিকে ‘পশুর দল’ হিসেবে শনাক্ত করেছিলেন, সেই দল আজও বাংলাদেশে সক্রিয় রয়েছে। তারা আজও হিন্দু ও বৌদ্ধদের মন্দির, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বসতবাড়িতে হামলা চালাচ্ছে ও অগ্নি সংযোগ করছে। তারা ধর্মের নামে নৃশংসভাবে মানুষ হত্যা করছে, নানা ফ্রন্টে বিভক্ত হয়ে সমাজ-রাষ্ট্রে বিভেদ সৃষ্টি করে চলেছে। ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে মন্দিরের পুরোহিত, মঠের যাজক, আশ্রমের ঋত্বিক ও ভিন্ন ধর্মাবলম্বী দেশি-বিদেশি নাগরিকদের হত্যা করে চলেছে। রাজনীতির পাশাপাশি কেউ কেউ বুদ্ধিবৃত্তিক রাস্তায় খ-িত ও বিকৃত বক্তব্য উপস্থাপন করে হিংসা -বিদ্বেষ প্রচার করে চলেছে। নজরুল এই ধর্মান্ধ জাল জালিয়াত বদমায়েসদের মুখোশ উন্মোচন করে দিয়েছেন তার গানে-কবিতায়, সাথে সাথে তাদের বিরূদ্ধে তীব্র ঘৃণা ও বিবমিষা প্রকাশ করেছেন। ‘ জাতের নামে বজ্জাতি’ কবিতায় তনি জাতপাত,ছুঁৎমার্গ, ধর্মের নামে বাড়াবাড়িকে তিরস্কার করে বলেছেন, ঈশ্বরের কোনো জাত নেই, তার কাছে সকল ধর্ম ও মানুষ সমান,, টিকি-টুপির মূল্য নেই। ধর্মের নামে যারা খুনোখুনি করে, নজরুল তাদের ‘ ধর্ম-মাতাল’ বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর মতে,‘ ইহারা ধর্ম-মাতাল। ইহারা সত্যের আলো পান করে নাই, শাস্ত্রের এলকোহল পান করিয়াছে।’ মদ-মাতালদের যেমন হিতাহিত জ্ঞান থাকে না, তেমনই ধর্ম-মাতালদেরও স্বাভাবিক বোধ-বুদ্ধি থাকে না। তারা মানুষরুপী হিং¯্র জানোয়ারে পরিণত হয়। হিং¯্র জানোয়ারের পরিণতি যেমন এক পর্যায়ে করুণ মৃত্যু, তেমনই ধর্ম-মাতালের সামনেও করুণ মৃত্যু ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প থাকে না।
ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন যখন তুঙ্গবিন্দু ছুঁয়েছে, তখন জীবিকার তাগিদে নজরুল ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। পল্টন থেকে ফিরে তিনি বুঝতে পারেন যে, ব্রিটিশদের ভারতছাড়া করতে না পারলে এদেশের পূর্ণ স্বাধীনতা ও মানবতার মুক্তি আসবেনা। আরও বুঝলেন যে, ভারতবর্ষের শৃংখল মোচনের পথে সবচেয়ে বড় বাধা সাম্প্রদায়িকতা তথা হিন্দু মুসলিম বিরোধ। আর তাই হিন্দু মুসলমানকে এক সূত্রে গাঁথার অভিপ্রায়ে তিনি গানে গানে উচ্চারণ করেন মিলন ও মানবিক সম্প্রীতির বাণী:
‘ মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান/ মুসলিম তার নয়ন মনি হিন্দু তাহার প্রাণ।’
নজরুল রোমান্টিক অনুভবে সব সময় সুন্দর, সম্প্রীতিময়, কল্যাণময় সমাজ প্রত্যাশা করেছেন। তাই তার বিদ্রোহ অন্যায়, অসত্য, অসুন্দরের বিরূদ্ধে; কবিতায় বিদ্রোহ সামন্তপ্রথা, শাস্ত্রাচার ও সাম্প্রদায়িকতার বিরূদ্ধে। নজরুলের বলিষ্ঠ কন্ঠস্বর ঘুমন্ত জাতিকে উজ্জীবিত ও অনুপ্রাণিত করেছে। তারপরও কথা থাকে যে, তার অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদ ও সমন্বিত ধর্মচেতনা সমকালে সর্বতোভাবে প্রশংসিত হয়নি বরং নিন্দিত হয়েছে ঢেরবেশি। হিন্দু সমাজ বিশেষ করে, রক্ষণশীল হিন্দুরা তাকে উপেক্ষা করতে চেয়েছে। সংস্কৃতিবান হিন্দুরা তার গান পছন্দ করতেন, তাকে কখনও কখনও গৃহেও আমন্ত্রণ জানাতেন, কিন্তু ব্রাহ্মণ নয় জেনে নজরুলের উপস্থিতিতে অন্যরা অস্বস্তি বোধ করতেন। আর মুসলমান রক্ষণশীলরা তো তাঁকে ধর্মদ্রোহী, কুলাঙ্গার,শয়তান, নাস্তিক, ফেরাউনসহ নানা অপঅভিধায় অভিহিত করে। নজরুল তার সমালোচকদের আচরণ সম্পর্কে সচেতন ছিলেন, কিন্তু তাদের খুব একটা পাত্তা দিতে চাননি। বৈরী পরিবেশ, বিরূদ্ধ সমালোচনা সত্ত্বেও ধর্মীয় গোঁড়ামির কাছে অত্মসমর্পণ করেননি তিনি। বিরূদ্ধ পরিবেশে দাঁড়িয়ে ‘ আমার সুন্দর’ প্রবন্ধে নজরুল লিখেছেন, ‘ আমার কেবলই যেন মনে হত, আমি মানুষকে ভালবাসতে পেরেছি। জাতি, ধর্ম, ভেদ আমার কোন দিনও ছিল না আজও নেই।’ ( আব্দুল কাদির সম্পাদিত নজরুল রচনাবলী,চতুর্থ খ-, ১৯৯৬, বাংলা একাডেমি,ঢাকা।পৃ:৩৫।)
ধর্ম বা সম্প্রদায় নয়, মানুষই ছিল তার আরাধ্য। আর তাই ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষকে আপন করে নিতে পারতেন আর এ অলৌকিক ক্ষমতাও তার ভেতরে ছিল। তিনি যখন সাহিত্যচর্চা করেছেন তখন সারা ভারতবর্ষ জুড়ে চলছিল ধর্মের নামে হানাহানি। ব্রিটিশদের ভেদনীতির কারণে ধর্মীয় বিরোধ ও হানাহানি যখন চরম পর্যায়ে পৌঁছে তখনও তিনি আচার সর্বস্ব ধর্মের বিরূদ্ধে এবং মানব সম্প্রীতির সপক্ষে বলিষ্ঠভাবে উচ্চারণ করেন:
‘ আমি ব্রহ্ম চাই না, আল্লাহ চাই না, ভগবানও চাই না। এই সব নামের কেউ যদি থেকে থাকেন তিনি নিজে এসে দেখা দিবেন। আমার বিপুল কর্ম আছে। আমার অপার অসীম ধরিত্রী মাতার ঋণ আছে।’(প্রাগুক্ত,পৃ:৩৫)
সত্য,সুন্দর, সৌহার্দ্য, সম্প্রীতির ধ্যান ও স্তবগান ছিল নজরুলের জীবন ও সৃষ্টিবিশ্বের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তিনি মনে করতেন, ইসলাম বা কোনো ধর্মের শাস্ত্র নিয়ে সাহিত্য করা যায় না,তবে ধর্মের অন্তর্নিহিত নির্যাস বা সারসত্য নিয়ে করা যেতে পারে। তিনি সবার বা স্ব সম্প্রদায়ের কাছে প্রিয় হয়ে থাকার জন্য লোভ বা প্রলোভনের কাছে মাথা নত করেননি বরং ধর্মের বিষয়ে নির্মোহ ছিলেন সারাজীবন। তার অবস্থান ছিল চিরন্তন ও সত্যধর্মের সপক্ষে, অসুন্দরের ছেদন করে সুন্দরের পক্ষে।‘ যে পথে যেতে হবে সে পথে তুমি একা, নয়নে আঁধার রবে ধেয়ানে আলোক রেখা’ রবীন্দ্রনাথ একটি গানে এ কথা বলেছেন। সব সৃষ্টিশীল সাধককে আঁধার পেরিয়ে আলোর পথে একাই এগিয়ে যেতে হয়, নজরুলকেও একা যেতে হয়েছে ধর্মান্ধতা, শাস্ত্রাচার, গোঁড়ামি পেরিয়ে মানবিকতা ও সম্প্রীতির পথে। এই পথচলায় তিনি সন্ত্রস্ত, ক্লান্ত বা দ্বিধান্বিত ছিলেন না কখনও। কারণ তার সঙ্গে ছিল বাংলার অন্তর ও বাহিরের পরম ঐশ্বর্যের উত্তরাধিকার ও ঐতিহ্য। তার মনে হয়েছে, ‘ এত ফুল, এত পাখি, এত গান, এত সুর,এত কুঞ্জ, এত ছায়া, এত মায়া, আর কোথাও নেই। এত ধর্মবোধ--আল্লাহ ভগবানের উপাসনা, উপবাস, উৎসব আর কোথাও নেই।’ আর তাই ‘বাঙালির বাঙলা’ প্রবন্ধে তিনি বলেছেন;
“ বাঙালি যেদিন কর্মবিমুখতা, জড়ত্ব, মৃত্যু-ভয়, আলস্য, সংকীর্ণতা ত্যাগ করে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বলতে পারবে,‘ বাঙলা বাঙালির হোক’ সেদিন তারা অসাধ্য সাধন করবে। কারণ বাংলা মহামানবের মিলন তীর্থ, বাংলা নিত্য সুন্দর, নিত্য পবিত্র।”( নবযুগ ৩ বৈশাখ ১৩৪৯)
জোর দিয়েই বলতে হয় যে, নজরুল জনপ্রিয় ছিলেন, তার কালেও ছিলেন; একালেও রয়েছেন। জনপ্রিয়তার পেছনে মূল কারণ ছিল,তিনিই একমাত্র সাহিত্যিক প্রতিনিধি যার সঙ্গে সাধারণ মানুষের সখ্য সম্পর্ক ছিল এবং তাদের আবেগ বুঝতে পারতেন ,তাদের ভাষায় লিখতে ও বলতে পারতেন। গত শতকের দ্বিতীয় দশকের মাঝামাঝিতেই তার কবিতা,প্রবন্ধ ,পরে গান একেবারে আমজনতার দোরগোড়ায় পৌঁছে যায়। প্রশ্ন জাগে, কীভাবে তা সম্ভব হল? হুমায়ুন কবিরের ভাষায় বলা যায়, বাংলার বিপুল কৃষকসমাজের সঙ্গে ছিল নজরুলের গভীর আত্মীয়তা। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ও ওই কথা প্রতিধ্বনিত করে বলেন, নজরুল কৃষক পরিবারের সন্তান, সে কারণেই তাঁর রচনা এত দ্রুত কৃষকসমাজকে আচ্ছন্ন করতে পেরেছ। তাছাড়াও বাঙালির জাগরণকালে সমকাললগ্ন যুগ-প্রবর্তক কবি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেও তিনি বিপুল জনমানুষের চিত্তে স্থায়ী আসন করে নিয়েছিলেন। আজও নজরুলের সুরে স্বরে অনুষ্ঠানের প্রথম প্রদীপ জ্বলে, সব ধর্মের পার্বণে-উৎসবে আমেজ তৈরি হয়।
নজরুলের জীবনচর্যা ও সৃষ্টিবিশ্বের সবখানে রয়েছে কেবল সমন্বয় ও সম্প্রীতি ভাবনার উজ্জ্বল উপস্থিতি। তিনি তাবৎ ধর্মের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য গভীরভাবে আত্মস্থ করতে পেরেছিলেন বলেই তিনি বাঙালির প্রাণের কবি হতে পেরেছিলেন। ধর্মান্ধতা ও প্রতিক্রিয়াশীলতার দীর্ঘ ছায়ার নীচে বসেও বাঙালির এই প্রিয় কবি মরণপণ লড়াই করেছেন সাম্প্রদায়িকতা, সংকীর্ণতা এবং সংঘবদ্ধ আঁধারের বিরূদ্ধে। ‘ বিদ্রোহী’ তে নজরুল যে অভেদ সুন্দর, সাম্য প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন তা থেকে তিনি বিচ্যুত হননি আমৃত্যু। ১৯২৯ সালে ১৪ এপ্রিল ডিসেম্বর কলকাতার আলবার্ট হলে দেয়া অভিভাষণে তিনি বলেন, ‘ আমি এই দেশে, এই সমাজে জন্মেছি বলেই আমি এই দেশের এই সমাজের নই। আমি সকল দেশের, সকল মানুষের, সুন্দরের স্তবগান আমার উপাসনা। যে কুলে, যে সমাজে, যে ধর্মে, যে দেশেই জন্মগ্রহণ করি সে আমার দৈব।’
১৯৪১ সালে কলকাতা মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির রজত জয়ন্তীর উৎসবে জীবনের সবশেষ ভাষণে ঋষির মত মরমি সুরে কবি বললেন, ‘অসুন্দরের সাধনা আমার নয়। আমার আল্লাহ পরম সুন্দর। তিনি আমার কাছে নিত্য প্রিয়ঘন সুন্দর, রসঘন সুন্দর, আনন্দঘন সুন্দর।’ এই ভাষণে তিনি ঔপনিষদিক ভাবাদর্শের সঙ্গে ইসলামি মরমি ভাবনার সংশ্লেষ ঘটিয়েছেন- যেখানে নিহিত আছে নজরুলের সম্প্রীতি ভাবনার বীজমন্ত্র। ১৯২৯ ও ১৯৪১ সালের দুটি ভাষণ মূলত একই সুর ও সূত্রে গাঁথা।
অসাম্প্রদায়িক চেতনার অনন্য প্রতিভূ নজরুলকে আমরা নানা পরিচয়ে চিনি। তিনি ছিলেন বিদ্রোহী, ছিলেন প্রেমিক ও সাম্যবাদী। ‘এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণ-তুর্য’ নিয়ে বাংলা সাহিত্যে নজরুলের আত্মপ্রকাশ। সুষম, ন্যায়ানুগ, ভেদবুদ্ধিহীন, কল্যাণময় সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ছিল তার স্বপ্ন। আমাদের জাতি ও সমাজকে উজ্জীবিত ও অনুপ্রাণিত করার জন্য তাকে জীবনের নানাপর্বে নানা ভূমিকা পালন করতে হয়েছে। কখনও কবি, পত্রিকা-সম্পাদক, কখনও অভিনেতা, চলচ্চিত্রকার কিংবা সমাজ সংস্কারক হিসেবে। তবে সব কিছুর উর্ধ্বে তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক, মানবিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ মহত্তম বাঙালি কবি; যিনি বাঙালির সামগ্রিকতা, সম্প্রীতি ভাবনা, সমন্বয়বাদী ধর্মচিন্তা ধারণ করতে পেরেছিলেন। আজ চারদিকে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ও সন্ত্রাসবাদ ছড়িয়ে পড়েছে। হিংসায় উন্মত্ত, সম্প্রীতি বিরোধী এই অশুভ শক্তি পান করতে চায় কেবল রক্তের বৈভব। বিভেদের রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করতে তলোয়ার , বোমা-গ্রেনেড হাতে পথে ঘাটে, প্রান্তরে, রেস্তোঁরায়, এমনকি ঈদের ময়দান পর্যন্ত দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তারা, যে কোনো সময় দখল হয়ে যেতে পারে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। এই অন্ধ অপশক্তিকে প্রতিহত করে আমাদের প্রিয় স্বদেশকে মুক্ত, স্বাধীন ও আলোকিত রাখতে হবে। অন্ধ অপশক্তি ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী সংগ্রামে মানবিকতার উজ্জ্বল আলোয় উদ্ভাসিত কাজী নজরুল ইসলাম হতে পারেন প্রধান সহায়ক ও সারথি। তাই অসাম্প্রদায়িক, মানবিক,সুস্থ-স্বস্থ বাংলাদেশ বিনির্মাণে নজরুলচর্চা খুবই দরকার।
আবদুল্লাহ আল আমিন : লোকগবেষক ও প্রাবন্ধিক। সহযোগী অধ্যাপক, মেহেরপুর সরকারি কলেজ, মেহেরপুর।
©somewhere in net ltd.