নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

নবীন আনন্দ

আবদুল্লাহ আল আমিন

আবদুল্লাহ আল আমিন › বিস্তারিত পোস্টঃ

সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদবিরোধী সংগ্রামে বাংলাদেশের নাটক

০৪ ঠা অক্টোবর, ২০১৬ রাত ১১:০৬




আবদুল্লাহ আল আমিন

গত শতকের সত্তর দশকের মধ্যভাগ থেকে নব্বই দশকের প্রারম্ভ পর্যন্ত সামরিক স্বৈরশাসকদের শাসনামলে, যখন মানুষ তার মনের কথাগুলো বলতে পারছিল না, দুঃশাসনের বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রকাশের পথ খুঁজে পাচ্ছিল না, সারা দেশকে যখন এক শ্বাসরুদ্ধকর কারাগারে পরিণত করা হয়েছিল, তখন কবিতা ও নাটকের মঞ্চ হয়ে উঠেছিল প্রতিবাদের আলোকিত স্বর। স্বৈরশাসকের বুলেট আর বেয়নেটের হিং¯্র থাবা নিচে যখন সব কিছু স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল, তখন আমাদের নাট্যকার, নাট্যজন ও নাট্যভাবুকরা প্রচ- নিনাদে অন্যায় ও গণতন্ত্রহীনতার বিরুদ্ধে গর্জন করে উঠেছিলেন। বেইলি রোডের মহিলা সমিতির মঞ্চ থেকে নাটক বেরিয়ে এসেছিল রাজপথে - সহ¯্র জনতার গগনবিদারী মিছিলে, দুর্মর স্লোগানে। নাটক, মুক্তনাটক ও পথনাটকের সংলাপের তরঙ্গ-বিভঙ্গে প্রবলভাবে উচ্চারিত হয়েছিল বাংলাদেশের মানুষের মনের কথা। সেদিন নাটকই মানুষকে জাগিয়ে রেখেছিল বৃক্ষের মতো, ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তায় যূথবদ্ধ করে রেখেছিল ধর্ম-বর্ণ, ধনী-নির্ধন নির্বিশেষে সব মানুষকে, দুঃশাসনের বিরুদ্ধে জনতাকে ক্রমাগতভাবে প্রস্তুত করেছিল চূড়ান্ত যুদ্ধে অবতীর্ণ হবার জন্যে। লোকপ্রিয় এই শিল্পমাধ্যমটি সেদিন আর বিনোদনের লাস্যময়ী কোন বিষয় হয়ে থাকেনি, হয়ে উঠেছিল সমাজ পরিবর্তনের শাণিত হাতিয়ারে। সেই হাতিয়ার হাতে নিয়ে আমরা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলাম রক্তপিপাসু অন্ধ-অপশক্তির বিরুদ্ধে। গণতন্ত্র, মানবিকতা, জীবন-জীবিকা ও অস্তিত্বের প্রয়োজনে, সেদিন নাটককে আমরা কমিটমেন্টে পরিণত করেছিলাম। আত্মঅহমিকায়দীর্ণ, নিঃসঙ্গ, জনবিচ্ছিন্ন সামরিক জান্তার পতনের পদধ্বনি শুনেছিলাম নাট্যজনদের মঞ্চ ও রাজপথকাঁপানো অভিনয়শৈলী ও সংলাপ থেকে।
সৃষ্টিশীল নাট্যজনদের নাটকের সংলাপের মাধ্যমে আমরা সেদিন প্রস্তুত হয়েছিলাম অনাগত ভবিষ্যতের জন্যে, শিখে নিয়েছিলাম কী করে শত্রু-মিত্র, ন্যায়-অন্যায়, শুভ-অশুভ সনাক্ত করতে হয়। আবার আমরা নতুন করে ইতিহাসের পাঠ গ্রহণ করলাম, বলা যেতে পারে জীবনপাঠ, ঐতিহ্যপাঠ, মনুষ্যধর্মপাঠ এবং শিল্পপাঠ। শিল্পের বরপুত্ররা স্মৃতিকাতর ও আবেগমথিত হয়ে উদ্যমী হলেন নাটকের মাধ্যমে যাত্রা,কবিগান, আলকাপ, একদিল, মনসা-ভাসান, বেহুলা-ভানুমতীর পুনর্নির্মাণে। সমাজ-সংস্কৃতি, রাজনীতির গভীরে নতুন করে প্রোথিত হল অসাম্প্রদায়িকতা, মানবিকতা, সাম্য- মৈত্রী, একতার স্বপ্নবীজ। সামরিক স্বৈরশাসকদের দুঃশাসনের প্রতিক্রিয়া যেন অলৌকিকভাবে আমাদের জন্যে হয়ে উঠলো দৈবের আশীর্বাদ, স্বপ্ন রচনার কালপর্ব। আর এভাবেই একই সঙ্গে হিন্দু মুসলমান ও পাশ্চাত্য আবহ , লোকপুরান, মিথ, কিংবদন্তি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের মিলিত ঝরনা ধারায় ¯œাত হয়ে বেড়ে উঠবার অভূতপূর্ব সুযোগ হল আমাদের। নতুন প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আমাদের লেখক, কবি, নাট্যজনেরা ফিরে গেলেন নদীবাহিত পলিমাটির কাছাকাছি,সুখ-দুঃখ মথিত জীবনের কাছাকাছি। নতুন আঙ্গিকের নতুন নতুন নাটক বের হতে লাগলো সৈয়দ শামসুল হক, সেলিম আল দীন, জিয়া হায়দার, মোমতাজউদ্দীন আহমেদ, আবদুল্লাহ আল মামুন, মামুনর রশীদ, এস এম সোলায়মান-এর ক্ষুরধার কলম থেকে। আর অপেক্ষাকৃত তরুণদের মধ্যে ছিলেন আব্দুল্লাহেল মাহমুদ, মান্নান হীরা, সাজেদুল আউয়াল, সালাম সাকলাইন প্রমুখ যারা বাংলাদেশের নাটককে করলেন আরও সমৃদ্ধ, আরও ইতিহাস-ঘনিষ্ঠ। মুক্তিযুদ্ধোত্তরকালের সেই নাট্যযাত্রায় সঙ্গী হয়েছিলেন আতাউর রহমান, আলী যাকের, আবুল হায়াত, সারা যাকের, নাসিরউদ্দীন ইউসুফ, মামুনর রশীদ, আসাদুজ্জামান-নূর, রামেন্দু মজুমদার, ফেরদৌসী মজুমদার, তারিক আনাম, নিমা রহমান প্রমুেখর মতো প্রতিভাবান নির্দেশক ও নাট্যজনরা যারা তাদের সাংগাঠনিক দক্ষতা, দরদ শ্রম, স্বেদ ঘাম, মেধা মনন ও অভিনয়দক্ষতা দিয়ে একে একে করতে লাগলেন সেই সব কালোত্তীর্ণ নাটকের সফল মঞ্চায়ন। বিরূদ্ধ পরিবেশের মধ্যেও তাদের সবার মধ্যে যেন সৃষ্টিশীলতার জোয়ার উপচে উঠেছিল। গড়ে উঠতে থাকে নাগরিক, থিয়েটার, ঢাকা থিয়েটার, আরণ্যক, লোকনাট্য দল, পদাতিক-এর স্বপ্রতিষ্ঠিত ও স্বনামধন্য নাট্যদল। কেবল নাটকে নয়, একই সঙ্গে কাজ চলছিল কবিতা, কথাসাহিত্য, চলচ্চিত্রসহ শিল্পকলার অন্যান্য মাধ্যমেও। গত শতকের নব্বই দশকে আমাদের কবি, শিল্পী, নাট্যজনদের বিস্ময়কর উত্থানপর্ব যেন-বা পরিণত হয়ে উঠেছিল বাঙালিত্বের মহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নে বিভোর হওয়ার প্রতীকী রেখাচিত্র। বিশেষত আশির দশকে, শিল্পের নানা মাধ্যমে যারা গভীর নিমগ্নতা নিয়ে কাজ করেছিলেন তারা অন্যকিছুকে নয়, কেবল শিল্পচর্চাকেই জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। অনেকে শিল্পচর্চা করে জীবনধারণ করেছেন, কিন্তু তা কোনোভাবেই চটুল শিল্প নয়, মগ্নচৈতন্যের দায়ে উদ্বুদ্ধ হয়ে ইতিহাস ও জীবন-ঘনিষ্ঠ শিল্পচর্চাতেই নিয়োজিত ছিলেন সেদিনের সেই নাট্যজনেরা। তাদের নিরলস শ্রম ও সৃজনস্পর্শে আমাদের মুমূর্ষু বাংলা নাটক পেয়েছিল বেড়ে ওঠার শক্ত মাটি। স্বপ্নবান শিল্পী ও সাধক হিসেবে তারা মানুষের চিন্তা ও মস্তিষ্কের গভীরে বপন করেন স্বচ্ছল, আলোকিত, সম্প্রীতি-উজ্জ্বল সমাজ-রাষ্ট্র বিনির্মাণের স্বপ্নবীজ। সত্যিই, তাদের সৃজনছোয়ায় সেদিন মানুষের স্বপ্নসমূহের অনুবাদ ত্বরান্বিত হয়েছিল । আসলে স্বপ্ন ছাড়া কোনো জাতি এগিয়ে যেতে পারে না; কবি-সব্যসাচী সৈয়দ শামসুল হকও তেমনই স্বপ্ন দেখেছিলেন বাংলাদেশ ও বাঙালির জন্যে-
‘দেখিবার অপেক্ষায় আছোঁ,/ নবান্নের পিঠার সুঘ্রাণে দ্যাশ ভরি উঠিতেছে।/ দেখিবার অপেক্ষায় আছোঁ,/ হামার গাভীন গাই অবিরাম দুধ ঢালিতেছে।/দেখিবার অপেক্ষায় আছোঁ,/ মানুষ নির্ভয় হাতে আঙিনায় ঘর তুলিতেছে।/ দেখিবার অপেক্ষায় আছোঁ,/নিশীথে কোমল স্বপ্ন মানুষের চোখে নামিতেছে।/.. সুখে দুঃখে অন্নপানে সকলেই একসাথে আছে/ সোনার বাংলার সোনা বাংলাদেশে আছে।’
কেবলই সুখস্বপ্নের ছবি তারা আঁকেননি, নিদারুণ, নিষ্করুণ বাস্তাবতা থেকে দুঃস্বপ্নের ছবিও তারা সেদিন এঁকেছিলেন। সৈয়দ হক লিখেছেন: ‘ একদা একটি দেশ ছিল বাংলাদেশ নামে, সেই দেশে মালা রূপান্তরিত হয় শেকলে এবং পিতা পরিণত হয় ক্রীতদাসে- ইতিহাসের প্রতিটি পাতায় রাজাকার তার নাম লেখে এবং সেলাই করে দেওয়া হয় দেশপ্রেমিকের চোখের পল্লব।’ তাপরও বলবো, এ মাটি ঘাতক-দালালদের নয়, অসুস্থ-বিকারগ্রস্ত ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের নয়- এ মাটি মানুষ ও মানবতার।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.