![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আবদুল্লাহ আল আমিন
আপনারা কাসেম বিন আবুবাকার-কে চেনেন ? হয়তো চেনেন, হয়তোবা চেনেন না। বাংলাদেশের সোশ্যাল মিডিয়ায় যারা সক্রিয় তাদের অনেকেই হয়তোবা কাসেম বিন আবুবাকারকে আবিষ্কার করে ফেলেছেন ইতোমধ্যে। পশ্চিমা গণমাধ্যম, বিশেষত ব্রিটেনের ডেইলি মেইল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইয়াহু নিউজ, মধ্যপ্রাচ্যের আরব নিউজ, পাকিস্তানের দ্য ডন, ফ্রান্সের এএফপি, বিবিসি বাংলাসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে এই অখ্যাত ঔপন্যাসিককের পাঠকপ্রিয়তা নিয়ে তুমুল আলোচনার ঝড় বইয়ে যাচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যম তাকে নিয়ে প্রতিবেদন ছেপেছে ফলাও করে। সেসব প্রতিবেদনে কাসেমকে বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তার উপন্যাসকে বলা হচ্ছে ইসলামি উপন্যাস। তার উপন্যাসে থাকছে কোরআন-হাদিসের আলোকে তরুণ-তরুণীর প্রেম-বিরহ, রোম্যান্টিসিজম। লেখক নিজে তার উপন্যাসকে ইসলামি বলতে নারাজ, তার রচিত উপন্যাসে উঠে আসা সবকিছু ইসলামসম্মত নয় বলে পাঠকরা মনে করেন। তার উপন্যাসের নায়ক বা নায়িকারা ইসলামমনস্ক, ধর্মভীরু। তারা তাদের সঙ্গীকে ইসলামের আলোকে সুপথে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে। অথবা নায়িকা নায়ককে নামায পড়ার কথা বলে, ইসলামের বিধিবিধান মেনে চলতে বলে। অবশেষে জীবনে সাফল্য আসে, দীর্ঘ বিরহের পর নায়ক-নায়িকার মধ্যে মিলন হয়। লেখক কাসেমবিন আবুবাকার মনে করেন, ইসলাম বিয়ের আগে প্রেম সমর্থন করে না, তারপরও প্রেম-ভালবাসা আটকে রাখা যাবে না, এটা কোনো না কোনোভাবে হয়ে যায়। তবে এটাকে শালীনতার মধ্যে রাখা উচিৎ। তিনিও তার উপন্যাসে প্রেম-ভালবাসাকে ইসলামের শালীনতার মধ্যে রাখার চেষ্টা করেছেন। লেখকের ইসলাম সম্পর্কিত জ্ঞান ও তার লেখার সাহিত্যমান নিয়ে পাঠকদের মধ্যে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন। তা তুলতেই পারেন। তবে কদিন ধরে বিশ্বমিডিয়ায় তার পাঠকপ্রিয়তা নিয়ে যে- আলোচনার ঝড় বইয়ে যাচ্ছে, তা রীতিমত বিস্ময়কর। বাংলাদেশের মূলধারার প্রকাশকরা যেখানে এই লেখকের কোনো বই-ই ছাপায়নি, এমনকি তার কোনো উপন্যাস নিয়ে সাহিত্য-সাময়িকীতে কোনো নিবন্ধ বেরোয়নি। তারপরও তার রচিত অধিকাংশ উপন্যাস বেস্ট সেলার। তার প্রথম উপন্যাস ফুটন্ত গোলাপ (১৯৭৮) এর অফিসিয়াল সংস্করণ হয়েছে ত্রিশটিরও বেশি। লাখ লাখ কপি বিক্রি হয়েছে বইটির। ‘বিলম্বিত বাসর’, ‘বিদায় বেলায়’, ‘অবাঞ্ছিত উইল’, ‘বাসর রাত’,‘ প্রেমের পরশ’, ‘বিদেশী মেম’, ‘সংসার’, ‘শবনম’, ‘প্রেম ও বিরহ’, ‘তোমারই জন্য’ প্রভৃতি গ্রন্থ বিপুল পাঠকপ্রিয়তা পেয়ে ধন্য হয়েছে। কোন নিগূঢ় রহস্য লুকিয়ে আছে তার লেখার অতলান্তে ? কেন তার উপন্যাস এত জনপ্রিয়?
কাসেম বিন আবুবাকারের জন্ম পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া জেলায় এক শিক্ষিত পরিবারে। শৈশব- কৈশোর কেটেছে হাওড়াতেই। হাওড়া বোর্ডের অধীনে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করার পর কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু ইন্টারমিডিয়েট পাস করার পূর্বেই একাডেমিক শিক্ষার পরিসমাপ্তি ঘটে। ছোটবেলা থেকেই বইপড়ার ঝোঁক ছিল। নজিবর রহমানের আনোয়ারা ও সালেহা উপন্যাসদ্বয় পড়ে দারুণভাবে মুগ্ধ হন এবং মনের ভেতর জেগে ওঠে লেখক হবার বাসনা। ফুরফুরা শরীফের পিরের ভক্ত এই লেখক স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে পাকিস্তান আমলেই বাংলাদেশে আসেন। এখন তিনি ঢাকার মুগদায় একটি লাইব্রেরি দেখাশুনা করেন ছেলে মনিরুল ইসলাম খানের সঙ্গে। তার লেখালেখির সূচনা গত শতকের সত্তর দশকের প্রারম্ভে মল্লিকা ব্রাদার্সে কাজ করার সময়। ‘ মোল্লার বই চলে না’ এই অজুহাতে তার প্রথম বই প্রকাশ হতে কেটে যায় আট বছর। ১৯৭০-সালে রচিত ‘ফুটন্ত গোলাপ’ প্রকাশিত হয় ১৯৭৮-এ সাহিত্যমালা থেকে। এরপর তাকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি, প্রথম বই-ই তাকে কিংবদন্তিতুল্য জনপ্রিয় লেখকে পরিণত করে। এখনো মেয়েরা নিজের রক্ত দিয়ে তাকে প্রেমপত্র লেখে। কেউ কেউ তাকে বিয়ে করতেও পাগল। বোরকাপরা রমনীরা অটোগ্রাফ নিতে তার ঢাকার বইয়ের দোকানে ছুটে আসে। পাঠকদের কাছ থেকে প্রতিদিন পান ঝুড়িভর্তি চিঠি। ভক্তকুলের এমন অম্ল-মধুর জ্বালায় বয়োবৃদ্ধ এই লেখক শ্লাঘা অনুভব করেন।
দেশে তার প্রচুর বই বিক্রি হলেও সাহিত্যিক হিসেবে কেউ সেভাবে তাকে চেনে না, এমন কী মহল্লার লোকও তাকে কম চেনে। মূলধারার গণমাধ্যমে তিনি সেভাবে ফোকাসড নন। কিন্তু কদিন ধরে বিশ্বমিডিয়ায় তাকে নিয়ে আলোচনা চলছে। কোনো কোনো মিডিয়া তাকে এতদিন কেন আবিষ্কার করতে পারেনি, এ দীনতায় বিস্মিত এবং খানিকটা ক্ষুব্ধ হয়েছে। মূলধারার মিডিয়ায় উপেক্ষিত, সোশ্যাল মিডিয়ায় সমালোচিত এই লেখক জানান, কেবল যশ-খ্যাতি, লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠা-প্রাপ্তির জন্য তিনি লেখেন না। ফেসবুকে তার সম্পর্কে মন্তব্য শুনে তিনি বলেছেন, আমি যেমন চেয়েছিলাম, তাই-ই পেয়েছি। তিনি কী চেয়েছিলেন ? তিনি চেয়েছিলেন, তার লেখার মাধ্যমে ইসলামি শিক্ষা-সংস্কৃতি, জীবনাচরণ তরুণ-তরুণীদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে। পাপের পথ থেকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে, ইসলামি বিধি-বিধান সবার মাঝে পৌছে দিতেই তার শতাধিক গ্রন্থ রচনা। মল্লিকা ব্রাদার্সে চাকুরিকালে বিভিন্ন গল্প-উপন্যাস পড়তে গিয়ে তার মনে হয়েছে, এগুলোতে মুসলিম চেতনা, ঐতিহ্য, মূল্যবোধ নেই বললেই চলে। তাই তিনি অত্যন্ত সচেতনভাবে প্রেমভিত্তিক গল্প-উপন্যাস- এর মাধ্যমে ইসলামকে ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে কলম হাতে তুলে নেন। উপন্যাসের প্রধান অনুষঙ্গ হিসেবে বেছে নিলেন প্রেম, প্রেমকেই ব্যবহার করলেন বাহন হিসেবে । আর এভাবেই তিনি ইসলামের বার্তা পৌছে দিলেন বহু মানুষের দুয়ারে।
কাসেম বিন আবুবাকার এখন সবচেয়ে জনপ্রিয় সাহিত্যিক। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের কাছে তার উপন্যাস সমাদৃত হয়েছে। যদিও গল্প-কবিতার শিল্পমূল্য বা সাহিত্যমান জনপ্রিয়তার নিরিখে বিচার্য নয়। তারপরও কথা থেকে যায়, সাহিত্য যেহেতু জীবনেরই বিম্বিতরূপ এবং জীবনকে প্রতিনিধিত্ব করে, তাহলে কী ধরে নেব কাসেমের উপন্যাস বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের জীবনের প্রতিনিধিত্ব করছে ? বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মনের ভাষা কাসেমের উপন্যাস বা ফিকশনে প্রতিফলিত হয়েছে ? কোনটা সাহিত্য, কোনটা সাহিত্য নয়, এ বিষয়ে ভিন্ন মতপ্রকাশের সুযোগ আছে, কিন্তু চূড়ান্ত কথা বলার বোধ হয় সুযোগ নেই। কাসেম বিন আবুবাকারের উপন্যাস এবং তার জনপ্রিয়তা বাংলাদেশের জনগণের সাংস্কৃতিক চরিত্র, রাজনীতির গতিবিধি ও সমাজের পরিবর্তনশীলতা অনুধাবন করতে সাহায্য করবে। কয়েক দশক আগেও বাংলাদেশের জনমানুষের চিন্তা- চেতনা, মনস্তত্ত্ব, জীবনাচরণের ভিত্তি ছিল ধর্মীয় উদারতা ও অসাম্প্রদায়িকতা। জনপরিম-লের ভাব-ভাষা ও জীবনাচরণের ভিত্তি- উদারতা, মানবিকতা, সমন্বয়বাদিতা যারা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন তারা জনপ্রিয় হয়েছিলেন। জনপরিম-লের মনের ভাষা অনুবাদ করতে পেরেছিলেন বলেই শরৎচন্দ্র ও নজরুল তাদের সমকালে জনপ্রিয় হয়েছিলেন। নাগরিক মধ্যবিত্ত থেকে উঠে আসা তরুণ-তরুণীদের মনের ভাব অনুবাদ করতে পেরেছিলেন বলে হুমায়ুন আহমেদ এক সময় সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক ছিলেন। যারা জনপরিসর ও সমাজতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করেন, তারা একটি বিষয় লক্ষ্য করে থাকবেন যে, বাংলাদেশের জনসমাজ গত কয়েক দশক ধরে ইসলামি কট্টরপন্থার দিকে ধাবিত হচ্ছে, অথবা ইসলামি ব্যবস্থা তৈরির প্রক্রিয়া ক্রমশ জোরদার হচ্ছে। মানুষ পরিবর্তিত হচ্ছে, পরিবর্তিত হচ্ছে তার পোশাক-আশাক, অবয়ব, ধ্যান-ধারণা-বিশ্বাস। এ কারণেই বোধ হয়, লোকরঞ্জনবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নতুন করে সম্পর্ক স্থাপন করলেন হেফাজতে ইসলামের সাথে। কেউ এটাকে আপস বলছেন, আবার কেউ বলছেন রাজনৈতিক কৌশল। কিন্তু আমি বলি, আমাদের সমাজের এক বিপুল জনগোষ্ঠীর অবস্থান ও অস্তিত্বকে স্বীকার করে নেয়া, যদিও আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক সংস্কৃতির সঙ্গে হেফাজতের মতাদর্শ বিরোধপূর্র্ণ। তবে এসব নিয়ে সমাজে তর্ক-বিতর্ক চলমান রয়েছে। আর তর্কটাও থাকা দরকার, তর্ক না থাকলে তো সমাজ, সংস্কৃতি, সভ্যতা কোনোকিছুই এগোবে না , সব কিছু স্থবির হয়ে পড়বে।
কাসেম বিন আবুবাকারের উপন্যাস বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের অনুভূতি ফুটে উঠেছে। এসব ফিকশন বা উপন্যাস এদেশের জনমানুষের ইসলামিক সেনসিবিলিটিতে সুড়সুড়িতে দিতে ভূমিকা রাখবে বলে মনে হয়। সমাজে বিদ্যমান বহুমাত্রিক ভাবনার পরিধি সংকুচিত করবে, সংখ্যালঘুর প্রতি সংখ্যাগুরুর বিদ্বেষ বৃদ্ধি করবে, ইসলামের রাজনীতিকীকরণে প্রেরণা যোগাবে। ইসলাম তখন আর ধর্ম হিসেবে অধ্যাত্মচর্চার মধ্যে পরিসীমিত থাকবে না, হয়ে উঠবে পলিটিক্যাল মতাদর্শ। জনমানুষের মধ্যে যে-পরিবর্তনগুলো ঘটছে তার সহনশীল বিশ্লেষণ দরকার । এই বিশ্লেষণটা হওয়া দরকার নির্মোহভাবে, মিডিয়ার বর্ণচ্ছটার বাইরে বসে। হয়তো এ পরিবর্তনটা আমাদের সেক্যুলারপন্থিদের কাছে ইতিবাচক বলে মনে হবে না। তারপরও ভাবতে হবে, আমাদের জনগণ কেন এবং কীভাবে উদারনৈতিকতা থেকে কট্টরপন্থার দিকে ধাবিত হচ্ছে ? এসব বোঝার জন্য কেবল কাসেম বিন আবুবাকারের উপন্যাস একমাত্র দিক নয়, আরোও অনেকদিক আছে যেগুলোর ওপর নজর দেয়া দরকার।
©somewhere in net ltd.