নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

নবীন আনন্দ

আবদুল্লাহ আল আমিন

আবদুল্লাহ আল আমিন › বিস্তারিত পোস্টঃ

ভাটপাড়া নীলকুঠি: সংরক্ষণ ও উন্নয়ন

০৫ ই মে, ২০১৭ রাত ১২:৫২


আবদুল্লাহ আল আমিন
(ভাটপাড়া নীলকুঠির ইতিহাস সম্পর্কে আপনার মন্তব্য প্রত্যাশা করছি।)

১৭৬৫ সালের ১২ অক্টোবর গভর্নর লর্ড ক্লাইভ সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের নিকট থেকে বাংলা, বিহার ও ওড়িশার দেওয়ানি-সনদের ফরমান লাভ করেন এবং এর ফলে বছরের ২৬ লক্ষ টাকা দানের বিনিময়ে এই তিন রাজ্যে ইস্ট ইন্ডিয়া অর্জন করে রাজস্ব আদায়ের অধিকার। ওই বছর প্রবর্তিত হয় কোম্পানি আইন আর এই আইনের আওতায় মেহেরপুরসহ অবিভক্ত নদীয়া জেলা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনভুক্ত হয়। ইস্ট কোম্পানি তার প্রশাসনিক ও ব্যবসায়িক প্রয়োজনে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে স্থায়ী প্রশাসনিক কাঠামো তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করে। তারই ধারাবাহিকতায় উনিশ শতকের প্রথমদিকে মেহেরপুরের সাহারবাটী মৌজায় কাজলা নদীর তীরে ভাটপাড়া নীলকুঠির স্থাপনা নির্মিত হয়। মেহেরপুর জেলার গাংনী উপজেলাধীন অধিকাংশ নীলকুঠি ছিল শিকারপুর কনসার্নের আওতায় আর আমঝুপি কুঠি ছিল নিশ্চিন্তপুর কনসার্নের আওতায়। শিকারপুর কনসার্নের আয়তন ছিল ২৪৯ বর্গমাইল। এই কনসার্নের সদরদপ্তর ছিল পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার করিমপুর থানাধীন শিকারপুর গ্রাম। সমগ্র বাংলাদেশে ১৮৫৯ সাল পর্যন্ত ১৪৩টি নীলখামার গড়ে ওঠে। প্রায় পাঁচশত জন নীলকর এসব খামার নিয়ন্ত্রণ করতো। বাংলায় নীল উৎপাদনের প্রায় অর্ধাংশ আসতো যশোর ও নদীয়া জেলা থেকে। সাহারবাটী ইউনিয়নের সাহারবাটী মৌজাভুক্ত নীলকরদের শোষণ, নিপীড়নের স্মৃতিবহ ভাটপাড়া নীলকুঠিটি ১৮১০ থেকে ১৮২০ সালের মধ্যবর্তী সময়ে নির্মিত হতে পারে বলে স্থানীয় ইতিহাস উঠে এসেছে। মেহেরপুর স্থানীয় ইতিহাস নিয়ে কাজ করেন, তাদের মধ্যে কেউ কেউ মনে করেন কুঠিটি ১৮৫৯ সালে নির্মিত হয়েছে। কিন্তু এ তথ্য যুক্তিযুক্ত নয়। কারণ ১৮৫৯ সালের শরৎকালে বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে নীলকরদের শোষণ ও জুলুমের বিরূদ্ধে সাধারণ কৃষকরা প্রবল আন্দোলন গড়ে তোলে যা ইতিহাসে নীলবিদ্রোহ নামে পরিচিত। ১৮৬০ সালের বসন্তকালে প্রজারা খাজনা দিতে অস্বীকৃতি জানায়। এমনকি যারা ছিল নীলকরদের খাসপ্রজা, তারাও খাজনা দিতে অসম্মতি প্রকাশ করে। এতদপ্রেক্ষিতে জিরাতি রায়তদের জমি থেকে উচ্ছেদের নোটিশ দেয়া হয় এবং রায়তরা এ নোটিশ উপেক্ষা করে। ১৮৬০ সালের মার্চ মাসে সমগ্র বাংলায় নীলবিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়ে। বিদ্রোহ সম্পর্কে বাংলার ছোটলাটের প্রেরিত তদন্তকারী তার প্রতিবেদনে বলেন:
‘ নীলচাষের বিরুদ্ধে একটি নিয়মিত লীগ গঠিত হয়েছে। হিন্দু-মুসলমান সকল প্রজা ধর্মের নামে শপথ গ্রহণ করেছে যে তারা আর নীলচাষ করবে না। কোন চাষীদের নীষচাষে বাধ্য করার চেষ্টা করলে ঢোল পিটিয়ে অন্য গ্রামের লোকদের আহবান জানানো হয় তাদের প্রতিরোধে অংশ গ্রহণের জন্য। ...বিদ্রোহীদের আক্রমণের ভয়ে অনেক সময় পুলিশও প্রজার পক্ষ অবলম্বন করেছে। (জুডিশিয়াল প্রসিডিংস,৪৩২-৪৩৫, জুন,১৮৬০।)। নীলকরদের আচরণে সরকার বিব্রতবোধ করে। নীলচাষীদের পক্ষে কেবল পুলিশরা নয়, কয়েকজন বিদেশি খ্রিস্টান মিশনারিও কাজ করতে থাকেন।
নদীয়ার নীলচাষ, নীলকুঠি ও নীলবিদ্রোহের সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য বঙ্গীয় সরকারের সেক্রেটারি মি. সিটনকারের নেতৃত্বে গঠিত হয় নীল কমিশন। ১৮৬০ সালের ১৮ মে কৃষ্ণনগরে নীল কমিশনের প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। দীর্ঘ তদন্ত ও পর্যালোচনার পর কমিশন ‘নীল ব্যবসাকে পাপজনক, ক্ষতিকারক ও ভ্রমসংকুল’ হিসেবে মন্তব্য করেন। ১৮৬০ সালে নদীয়া জেলার সবচেয়ে প্রতাপশালী নীলকর জেমস হিল নীল ব্যবসা বন্ধ করে দেন, কারণ চাষিদের দাবি মোতাবেক মূল্য প্রদান করলে নীল ব্যবসায় তেমন কোনো লাভ থাকে না। মুনাফার জন্য তিনি ভূস্বামীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। জেমস হিলের অত্যাচার ও জুলুমের বিরুদ্ধে কৃষক সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করেন মেহেরপুরের স্থানীয় জমিদার মথুরানাথ মুখোপাধ্যায় ও নবকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়। দীনবন্ধু মিত্র রচিত ‘নীলদর্পন’ নাটকের মহেশ মুখোপাধ্যায় ছিলেন জেমস হিলের মন্ত্রী। ১৮৬১ সালে নীলচাষে প্রজাদের বাধ্য করা যাবে না মর্মে আইন প্রণীত হলে নীলচাষ কমতে থাকে। তবে বিশ শতকের প্রথম প্রথম দশক পর্যন্ত মেহেরপুরের কোথাও কোথাও নীলচাষ অব্যাহত থাকে। ভাটপাড়া নীলকুঠির আওতাধীন এলাকায় বিশ শতকের প্রথম ভাগ পর্যন্ত নীলচাষ চালু ছিল বলে জনশ্রুতি রয়েছে। কোম্পানির শাসন ও নীলচাষের অবসান হলে ভাটপাড়া নীলকুঠির দায়িত্ব নেয় মেদিনীপুর কোম্পানি। কোম্পানি প্রজাদের নিকট থেকে খাজনা আদায়ের জন্য একটি কাছারিবাড়ি নির্মাণ করে। ১৯৫১ সালে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ হলে ভাটপাড়া নীলকুঠির দায়িত্ব অর্পিত হয় জেলা প্রশাসনের ওপর। ২৭ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত নীলকুঠিটি যুগপৎ নীলকরদের শোষণ-পীড়ন ও বাংলার কৃষক সমাাজের সংগ্রামী ইতিহাসের সাক্ষ্যবহন করে চলেছে। বিস্ময় জাগে, এই কুঠি থেকে বিলেতে নীল রপ্তানি হতো। কলকাতার নীল-শিল্প, নীলচাষের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের ভাগ্য ভাটপাড়ার নীলকুঠির ওপর নির্ভর করতো। নীল প্রকিয়াকরণ হাউজও তিন দশক পূর্বে অক্ষত ছিল এখানে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ থেকে জানা যায়, নীলকুঠি-প্রাঙ্গণের বৃক্ষছায়ার নীচে নীলের চারাও গজায় মাঝে মাঝে । আঠারো ও উনিশ শতকের জমিদারদের বাসভবনের আদলের সঙ্গে পাশ্চাত্য স্থাপত্যশৈলী মিশিয়ে কুঠিয়ালদের অর্থায়নে ইট, চুনসুরকি দিয়ে কুঠিবাড়িটি নির্মাণ করা হয়। এর ছাদ তৈরিতে ব্যবহৃত হয় লোহার বিম ও ইটের টালি। দোতলায় ওঠার জন্য পুরোনো পদ্ধতির সিঁড়িও নির্মাণ করা হয়। স্বাধীনতার পর ( মতান্তরে: ১৯৬৭ সালে) বিএডিসির তত্ত্বাবধানে কুঠি প্রাঙ্গণে একটি উদ্যান নার্সারি চালু করা ও আম-লিচু- পেয়ারার বাগানও তৈরি করা হয়।
২০১৬ সালে কাজলা নদীবর্তী ভাটপাড়া নীলকুঠিকে ঘিরে একটি মনোরম ইকোপার্ক গড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মেহেরপুর জেলা প্রশাসন। এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে নিজ স্কন্ধে তুলে নিয়ে মেহেরপুরের জেলা প্রশাসক পরিমল সিংহ গাংনী উপজেলার মানুষকে কৃতজ্ঞতার বন্ধনে আবদ্ধ করেছেন। সাহারবাটী গ্রামের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে সাহারবাটী, ভাটপাড়া তথা গাংনীবাসীর পক্ষ থেকে তাকে প্রাণঢালা অভিনন্দন। ইকোপার্ক গড়ার ক্ষেত্রে মেহেরপুর-২ আসনের মাননীয় সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা মকবুল হোসেন দান অপরিসীম, তাকেও শুভেচ্ছা জানাই। মেহেরপুর জেলা ওয়ার্কার্স পার্টির উদ্যোগে ২৩ ফেব্রুয়ারি গাংনী ফুটবল মাঠে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় গাংনীর জনগণের দাবির প্রেক্ষিতে বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মাননীয় মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন ভাটপাড়া নীলকুঠি উন্নয়নে প্রতিশ্্রতি প্রদান করেন। ২৭ এপ্রিল গাংনীতে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ-সম্মেলনে ওয়ার্কার্স পার্টিরপলিট ব্যুরোর সদস্য নুর আহমেদ বকুল বলেন, মাননীয় মন্ত্রী তার প্রতিশ্রুতির প্রেক্ষিতে ভাটপাড়া নীলকুঠির সংরক্ষণ ও আধুনিক পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার লক্ষে ৩১ লক্ষ ৫৮ হাজার ৪০৫ টাকা বরাদ্দ দিয়েছেন। ভাটপাড়া নীলকুঠির সংরক্ষণ ও উন্নয়নে যারা কাজ করছেন তাদের সবার প্রতি প্রাণঢালা শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। ইকোপার্ক লাগোয়া কাজলা শুকিয়ে গেছে, সারা বছরই পানি থাকে না। অথচ এক সময় জল থৈথৈ করতো। এটি খননের উদ্যোগ গ্রহণ করা- এখন সময়ের দাবি। শুকনো গাঙ কাজলা নদীতে চাই উথাল-পাথাল ঢেউ। ইকোপার্ক হবে অথচ কাজলার বুকে ঢেউ জাগবে না- এটা হতে পারে ? পর্যটনশিল্পের উন্নয়নের স্বার্থেই কাজলা খনন আবশ্যক। আমাদের প্রত্যাশা, জল টলমল কাজলা নদী তীরবর্তী ঐতিহাসিক ভাটপাড়া নীলকুঠি ঘিরে গড়ে উঠুক একটি আধুনিকমানের ইকোপার্ক



মন্তব্য ১ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ০৫ ই মে, ২০১৭ সকাল ৭:৫১

ডঃ এম এ আলী বলেছেন: ধন্যবাদ ভাটপাড়া নীলকুঠির মুল্যবান তথ্য জানা গেল পোষ্টটি হতে । নীল করদের অত্যাচারের কাহিণী নিয়ে দিন বন্ধু রচনা করেছিলেন কালজয়ী নীল দর্পন নামে একটি নাটক , যা দেশ বিদেশে মঞ্চায়ীত হয় ।
ভারত উপমহাদেশের মাটি নীল চাষের জন্য বিশেষ উপযোগী হওয়ায় বৃটিশ নীলকরেরা নীলচাষে বিপুল পুঁজি বিনিয়োগ করে। নদীয়া, যশোর, বগুড়া, রংপুর প্রভৃতি জেলায় নীলচাষ শুরু হয়। ঊনিশ শতকের শেষের দিকে নীলচাষ অর্থনৈতিক ভাবে লাভজনক না হওয়ায় কৃষকরা ধান ও পাট চাষের দিকে ঝুঁকে পড়ে। বৃটিশ নীলকরেরা অত্যাচার আর নিপীড়নের মাধম্যে নীলচাষে বাধ্য করলে আন্দোলন গড়ে ওঠে। এরই ধারাবাহিকতায় এক পর্যায়ে বাংলায় নীল চাষ বিলুপ্ত হয়।
প্রথমদিকে নীল চাষ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া অধিকারেই ছিল। ১৮৩৩ সালের সনদ আইনের ফলে তাঁদের একচেটিয়া অধিকার লোপ পায় এবং ব্রিটেন থেকে দলে দলে ইংরেজ নীলকররা বাংলায় আগমন করে ইচ্ছামত নীলের চাষ শুরু করে। তখন থেকেই কৃষকদের ওপর অত্যাচার শুরু হয়। ফলে ১৮৫৯ ফেব্রুয়ারী – মার্চ মাসে নীলচাষীরা সঙ্ঘবদ্ধভাবে নীল চাষ করতে অস্বীকৃতি জানায়। প্রথমদিকে এই আন্দোলন অহিংস ছিল, কিন্তু নীলচাষ না করার কারণে চাষীদের ওপর ভয়ানক নির্যাতন, গ্রেপ্তার শুরু হলে এ আন্দোলন সশস্ত্র বিদ্রোহে পরিণত হয়। বিষয়গুলি আপনার লিখাতে ফুটে উঠেছে আরো সুন্দরভাবে ।

আপনার এই পোষ্টের লিখা হতে আরো অনেক কিছু জানতে পারলাম ।
ভাটপাড়া নীলকুঠির একটি ছবি নীচে রেখে গেলাম



অনেক অনেক শুভেচ্ছা রইল

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.