নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

নবীন আনন্দ

আবদুল্লাহ আল আমিন

আবদুল্লাহ আল আমিন › বিস্তারিত পোস্টঃ

ভাটপাড়ায় নীলকরদের আগমন

০১ লা আগস্ট, ২০১৭ বিকাল ৩:০৪



আবদুল্লাহ আল আমিন



নদীয়া জেলার নীলকরদের সর্ববৃহৎ প্রতিষ্ঠান ‘বেঙ্গল ইন্ডিগো কোম্পানি’র বজরাটি যখন ভাটপাড়া ঘাটে ভিড়ছে তখন দুপুর গড়িয়ে অপরাহ্ণ প্রায়। বজরায় দোর্দন্ডপ্রতাপশালী কুঠিয়াল জেমস হিলসও আছেন। তিনি নদীয়া জেলার সবচেয়ে বড় নীলকর। ১৮১০ খ্রিস্টাব্দে তিনি চুয়াডাঙ্গার নিশ্চিন্তপুর কনসার্ন কেনেন ফ্রেডারিক অ্যাসকল নামের এক বণিকের কাছ থেকে। অ্যাসকল সাহেব বেশ উদার মানুষ, তিনি রেশম ব্যবসা পছন্দ করতেন। কাসিমবাজার নবাব এস্টেটের নিকট থেকে পত্তনি বন্দোবস্ত সূত্রে সম্পত্তি লাভ করে রেশম ব্যবসা আরম্ভ করেন বেশ জোরেসোরে এবং নিশ্চিন্তপুরে একটি বাণিজ্যিক কুঠিবাড়িও স্থাপন করেছিলেন। কিন্তু রেশম ব্যবসায় তার তেমন মুনাফা হল না। তাই অনেকটা বাধ্য হয়ে, কুঠিটি হিলস সাহেবের নিকট বিক্রি করে দিলেন। জেমস হিলস বেশ ধুরন্ধর, বিষয়বুদ্ধিসম্পন্ন। ব্যবসা ছাড়া কিছুই বোঝেন না। ১৮১৫ সালে জেমস হিলস নিশ্চিন্তপুরে একটি কারখানা স্থাপন করেন। নদীয়া জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে তার ১১ টি ফ্যাক্টরি আছে। নিশ্চিন্তপুর কনসার্নের আওতায় কার্পাসডাঙ্গা, ভালাইপুর,পুড়োপাড়া ও ছয়ঘরিয়ায় তিনি নীলকুঠি স্থাপন করেছেন। লোকনাথপুর, জয়রামপুর, মেমনগর, পীতাম্বরপুরেও নীলচাষ আরম্ভ করেছেন নিশ্চিন্তপুর সদর থেকে। এবার তিনি কাজলাপাড়ের গ্রাম ভাটপাড়া, আমঝুপি, শ্যামপুর ও বাহাদুরপুরে কুঠি স্থাপন করবেন। শরতকাল- আশ্বিনের আকাশে একটুও মেঘ নেই, চারদিকে যেন রোদ ঝলমল করছে। গত কয়েকদিন ছিল মুষলধারে বৃষ্টি, সারাদিন আকাশের মুখ বিষণœ, কিন্তু আজ ভোরের আলো ফোটার আগেই আকাশের সব মেঘ যেন নিরুদ্দেশগামী বলাকা। মনে হচ্ছে যেন, সুনীল আকাশ জুড়ে আজ উৎসবের ঝলমলে রঙ। সেই রঙ ছড়িয়ে পড়েছে গাছপালা, লতাগুল্ম ও প্রকৃতিতে। জেমস হিলস বেশ খোশ মেজাজে আছেন আজ। ক্লান্তি কিংবা দিবানিদ্রা তাকে কাহিল করতে পারেনি। দীর্ঘযাত্রায় মনের গহীনে জাগেনি ভয়-শঙ্কা কিংবা উদ্বেগ। কত যে নদী-নালা, খালবিল পেরিয়ে এখানে আসতে হয় হিসেব মেলানো বেশ ভার! কৃষ্ণনগর থেকে গ্রামটি বেশ দূরে। হাঁটাপথে আসার জো নেই। কলকাতা থেকে এখানে আসার পথ হিসেবে বেছে নেন মাথাভাঙা, ভৈরব এবং কাজলা নদী। রেনেলের মানচিত্র দেখেই তারা যাত্রাপথ নির্ধারণ করেছেন। রেনেল ১৭৭১ সালে নদী জরিপ করেন এবং ১৭৮০ সালে প্রকাশ করেন তার মানচিত্র। কলকাতা থেকে নদীয়া জেলার এই ছোট গ্রামটিতে আসতে পার হতে হয়েছে শত শত গ্রাম, জনপদ, হাটবাজার,শ্মশানভূমি ও লোকালয়। নদীর দু ধারে ছবির মতো ছোট ছোট গ্রামগঞ্জ, কোথাও লোকালয়, আ¤্রকুঞ্জ, কোথাও নিবিড় বাঁশঝাড়, আবার কোথাও শূন্যপ্রান্তর। সবকিছুই তাদের কাছে ছবির মতো মনে হয়েছে। আশ্বিনের শিরশিরে বাতাসে কেঁপে কেঁপে উঠছে বজরার সবাই, তারপরও সবার চোখেমুখে বিস্ময়মাখানো আনন্দ ও মুগ্ধতা। জেমস হিলস ও তার সঙ্গীরা যখন ভাটপাড়া ঘাটে নামছেন, তখন তাদের শ্বেতবর্ণ শরীরে শরতের শ্বেতশুভ্র রোদ্দুরের ঝাপটা পড়েছে, বুকে বিন্দু বিন্দু ঘাম, কিন্তু চোখে মুখে সাহসমিশ্রিত স্বাভাবিকতা ও আত্মপ্রত্যয়ের ছাপ।

জেমস হিলসের বজরাটি বেশ বড়সড়। যেখানেই যান, সঙ্গে থাকে নায়েব, গোমস্তা, বন্দুকধারী প্রহরী, পাইক-পেয়াদা-বরকন্দাজ, পরিচারক-পরিচারিকাসহ বিশাল বহর। গায়িকা-বাঈজি-নর্তকীরাও তার সঙ্গিনী হয় কখনোও কখনো। তার হাতে থাকে সুরার পাত্র কিংবা আলবোলার নল। হিলস সাহেব জন্মসূত্রে বৃটিশ হলেও বাংলা ও কিছু কিছু সংস্কৃত শিখে নিয়েছেন ইতোমধ্যে। আজ তার সঙ্গে গায়িকা কিংবা নর্তকীরা নেই। আজ তিনি সম্পূর্ণ নিমগ্ন ব্যবসায়িক চিন্তায়। তিনি এ অঞ্চলে এসেছেন নীলকুঠি স্থাপনের এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব নিয়ে। বজরা থেকে নামামাত্রই এক শ সদস্যের একটি সুশৃঙ্খল দল তাকে অভ্যর্থনা জানালো। এরা মেহেরপুর, সাহারবাটী, আমঝুপি, শ্যামপুর, নওপাড়া ও বাহাদুরপুর থেকে এসেছেন। এদের কেউ এসেছেন পদব্রজে কেউবা ঘোড়ায় চড়ে। নদীর ঘাট থেকে অনতিদূরে একটি টগবগে লাল ঘোড়া, তাতে উপবিষ্ট লোকটির বেশভূষা দেখলে বোঝা যায়, ইনি এদের দলপতি। লোকটির নাম গৌরীপ্রসন্ন মৈত্র, জাতে ব্রাহ্মণ জমিদার কৃষ্ণনাথ কুমারের নায়েব। কৃষ্ণনাথের পিতা হরিনাথ কুমার মেহেরপুরের সবচেয়ে বড় জমিদার ছিলেন। হরিনাথ বাবু জমিদারি পান নাটোরের রাণী ভবানীর নিকট থেকে। সম্প্রতি হরিনাথ বাবু পরলোক গমন করেছেন। পিতার একমাত্র উত্তরসূরী হিসেবে কৃষ্ণনাথ এখন মেহেরপুরের জমিদার, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাকে রাজা উপাধিতে ভুষিত করেছে। রাজা কৃষ্ণনাথ জেমস হিলের সম্মানে পাঠিয়েছেন গৌরবর্ণের এক সুপুরুষ এই নায়েব মহাশয়কে। তিনি মজলিসি স্বভাবের মানুষ, নাচগান ভালবাসেন। মফস্বলের ছোট জমিদারের নায়েব হলেও তার ভাবসাব কলকাতার জমিদারদের মতন। কলকাতা এখন নতুন যুগের কনকপদ্ম। ১৭৯৩ সালে কর্ণওয়ালিস চিরস্থায়ী বন্দোবস্তো চালু করার পর থেকে কলকাতার জৌলুশ বাড়ছে। পুরাতন জমিদারদের হটিয়ে নতুন জমিদার শ্রেণি গড়ে উঠছে। পলাশীর প্রান্তরে নবাবি আমলের সমাপ্তি ঘটেছে, শুরু হয়েছে ইংরেজদের নবাবি আমল। চলছে ইংরেজ নবাব ও তাদের দেওয়ান, সরকার, মুনশি ও বেনিয়াদেরস্বর্ণযুগ। এই দেওয়ান ও বেনিয়ানরাই এখন কলকাতার প্রাণপুরুষ এবং ইংরেজ নবাবদের পথপ্রদর্শক ও ফিলোজফার। অষ্টাদশ শতকের মধ্যপাদ থেকে উনিশ শতকের প্রারম্ভ পর্যন্ত বাংলায় যারা ধনী ও সম্ভ্রান্ত হয়েছেন, তারা অধিকাংশই এই দেওয়ান, বেনিয়ান, সরকার ও মুনশিদের বংশধর। শোভাবাজারের জমিদার মহারাজা নবকৃষ্ণ লর্ড ক্লাইভের দেওয়ান ছিলেন। পাইকপাড়ার রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা গঙ্গাগোবিন্দ সিংহ ছিলেন হেস্টিংস আমলের বোর্ড অব রেভিন্যুর দেওয়ান। ঠাকুর পরিবারের দর্পনারায়ণ ঠাকুর, জোড়াসাঁকোর সিংহ পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা শান্তিরাম সিংহ ছিলেন কোম্পানি আমলের দেওয়ান এবং ঘোষ পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা রামলোচন ছিলেন হেস্টিংসের সরকার। পলাশী যুদ্ধের পর অর্ধ শতাব্দী জুড়ে ছিল এদের ছিল প্রবল প্রতাপ। এরা শিক্ষাদীক্ষায় তেমন অগ্রগামী ছিলেন না। তারপরও এরাই ছিলেন অস্তমিত মধ্যযুগের শেষ প্রতিনিধি। নদীয়া ও যশোরের বিস্তীর্ণ জনপদে যখন বেঙ্গল ইন্ডিগো কোম্পানির নীলকররা নীলকুঠি স্থাপনের চেষ্টা চালাচ্ছেন, তখন চলছে উনিশ শতকের দ্বিতীয় দশক। কলকাতায় শুরু হয়েছে নব জাগরণ। ইতোমধ্যে ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ (১৮০০ খ্রি.) প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের পিতামহ চব্বিশ পরগণার কালেক্টর ও নিমকের দেওয়ানগিরি করে পরিণত হয়েছেন কলকাতার অন্যতম শীর্ষস্থানীয় ধনী ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিত্বে। রাণীগঞ্জে তার কয়লাখনি, রামনগরে সুগারমিল আছে, নীলকুঠিও করেছেন। চন্দননগরের কুঠিবাড়িটি মোরান সাহেবের কাছ থেকে কিনে নিয়েছেন। প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘ ট্যাগোর এন্ড কোম্পানি’ ও ইউনিয়ন ব্যাংক। মাইকেল মধুসূদন দত্তের বাবা রাজনারায়ণ দত্ত তখন দেওয়ানি আদালতের বিখ্যাত উকিল। তিনিও খিদিরপুরে দোতলা বাড়ি কিনে সেখানকার সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি হিসেবে গণ্য হয়েছেন। কলকাতা দ্রুতই শহর হয়ে উঠছে। ভাগ্যের অন্বেষণে মানুষ নদীয়া, হাওড়া, হুগলী, চব্বিশ পরগণা থেকে কলকাতায় ভিড় জমাচ্ছে। কলকাতার সন্নিকটবর্তী গ্রাম্যসমাজ ভেঙে কলকাতায় বিশাল এক ধনিক ও মধ্যবিত্ত গড়ে উঠেছে। ১৮১৪ সালে রাজা রামমোহন রাধানগর ছেড়ে কলকাতার মানিকতলায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেছেন। তিনিও তেজারতি ব্যবসা আরম্ভ করেছেন। নতুন যুগের শিক্ষা প্রবর্তনের জন্য ১৮১৭ সালে বাংলার মহাপাঠশালা ‘হিন্দু কলেজ’ হল। কালকাতায় যখন নবজাগরণের আগমনী গান শোনা যাচ্ছে,তখন বাংলাদেশের বৈচিত্র্যহীন অখ্যাত গ্রাম সাহারবাটীর ভাটপাড়া, আমঝুপি, কাথুলী, রতনপুর, ভবরপাড়া, বল্লভপুর, বেতবাড়িয়া,কাজীপুর, পীরতলা, তেরাইল, ভোলারদাঁড়, জামসেদপুর, শিকারপুর, চরগোয়ালগ্রামে শোষণের স্টিম রোলার চালানোর জন্য কুঠি স্থাপনের নীলনকশা চলছে।
ভাটপাড়া কোনো অভিজাত গ্রাম নয়, তাও নীলকর জেমস হিলস গ্রামটি পছন্দ করে ফেললেন। সিদ্ধান্ত নিলেন কাজলার পাড় ঘেঁষে একটি নীলকুঠি স্থাপন করবেন। একটু এগিয়ে দেখলেন একটি শ্মশান; সেখানে চিতার আগুন এখনও জ্বলছে। ঘন্টাখানেক আগে কলেরায় মৃত একটি শিশুর সৎকার করা হয়েছে, চিতার আগুন নেভেনি। প্রতিদিনই কলেরা কিংবা ম্যালেরিয়ায় মানুষ মারা যায়। গোর-চিতা ছাড়াও কাউকে কাউকে চাপা মাটি দেয়া হয়। নদীতীরে- ঝোপঝাড় আর জঙ্গলে আকীর্ণ শ্মশানবাড়ির নিকট দাঁড়িয়েই আবার শুনতে পেলেন পাশের গ্রাম থেকে ভেসে আসছে মঙ্গলশঙ্খ আর সংকীর্তনের সুর; গ্রামটির নাম সাহারবাটী। মনটা তার চঞ্চল ছিল এতক্ষণ, কিন্তু দূর থেকে ভেসে আসা ঢোল- খোল-মৃদঙ্গের সুরের আবেশে সবকিছু প্রশান্ত হয়ে উঠলো কিছুক্ষণের জন্য। ইচ্ছে ছিল আরোও কিছুক্ষণ কাটাবেন প্রকৃতির শোভা উপভোগ করতে। কিন্তু আশ্বিন মাস, রৌদ্রের রঙ ক্রমশ বিবর্ণ হয়ে আসছে। শরতের উত্তাপ মেখে পাখিরা নীড়ে ফিরছে, রৌদ্রের উজ্জ্বল রং ফিকে হয়ে আসছে ও তীব্রতা কমছে। নদীর ধারের কাশফুলগুলি শুভ্র হতে নস্যরং হতে চলেছে, এখনই বজরায় উঠতে হবে। ভাটপাড়ায় নয়, রাতটা তারা আমঝুপির ঘাটেই কাটাবেন।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ০১ লা আগস্ট, ২০১৭ বিকাল ৩:২০

বিজন রয় বলেছেন: কোন কাহিনীর অংশ এটা?

২| ০১ লা আগস্ট, ২০১৭ বিকাল ৪:৫১

ধুতরার ফুল বলেছেন: ভালোই তো।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.