![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আবদুল্লাহ আল আমিন
তিনি সব সময় নিজেকে বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে রাখতে চেয়েছেন, এবং সফলও হয়েছেন অধিকাংশ ক্ষেত্রে। তিনি চেয়েছেন, তার ধর্মবিশ্বাস, অধ্যত্মচেতনা, রাজনৈতিক অবস্থান এমনকি জীবনচর্যা নিয়ে বিতর্ক জমে উঠুক। তিনি মজা লুটবেন ! বহুমাত্রিক চিন্তা ও বিচিত্র কর্মের মধ্য দিয়ে ফরহাদ মজহার এমন এক তর্কবিন্দুতে নিজেকে অধিষ্ঠিত করেছেন, যা রীতিমত বিস্ময়কর। তিনি তার অনুসারীদের নিকট প্রোফেটতুল্য মহামানব, অন্যদের কাছে ছদ্মবেশী শয়তান। তার পোশাক-আশাক নিয়ে যেমন বিতর্ক আছে, তেমনই তার কাব্য, নাটক, অধ্যাত্মচর্চা, রাজনীতি-ভাবনা নিয়েও তর্ক আছে। প্রথম যৌবনে তিনি নিজেকে বামপন্থী ধারা লেখক হিসেবে মেলে ধরার চেষ্টা করেন, এখন তিনি ধর্মভিত্তিক-প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির প্রথম সারির থিঙ্ক ট্যাংক, কেউ কেউ বলেন হেফাজতে ইসলামের দার্শনিক পিতা। ১৯৪৭ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ক্ষত-বিক্ষত নোয়াখালির এক শিক্ষিত ও সংস্কৃতিবান পরিবারে জন্ম নেয়া ফরহাদ মজহার একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক, সমাজতত্ত্ববিদ, প্রকৃতিপ্রেমী, ভাবুক, রাজনৈতিক ভাষ্যকার; তারপরও কবি হিসেবেই তিনি বিপুলভাবে স্বীকৃত ও সমাদৃত। তিনি সাক্ষাৎকারে বলেছেন,‘ কবি কৃষ্ণদাস কবিরাজ আমার আদর্শ। আমি তার মতো কবি ও দার্শনিক হতে চেয়েছি। কিন্তু কিভাবে সেটা সম্ভব তার মীমাংসা আমি আজো করে উঠতে পারিনি। সেই যোগ্যতাও আমার নাই।’ তার কবিতা ষাটের দশকে বাংলা সাহিত্যকে দিয়েছে অনির্বচনীয় প্রকাশের বাক্সময় দ্যুতি। যতদূর জানা যায়, ক্লাস এইটে পড়ার সময় বৈষ্ণব কবিতার অনুকরণে তিনি প্রথম কাবতা রচনা করেন। সেই কবিতার পঙক্তিমালা, হয়তো কবি এখন নিজেও মনে করতে পারেন না, তবে সেখানে বিরহ-কাতর রাধিকার মর্মবেদনার কথা ছিল- অনেকটা রবীন্দ্রনাথের ‘ভানুসিংহের পদাবলীর’ ধাঁচে। তারপর কলেজ জীবনে পরিচিত হন বিষ্ণু দে ও জীবনানন্দ দাশ তথা তিরিশি কবিদের কবিতার সঙ্গে। কিন্তু সেই কবিতা তাকে তেমন ধরে রাখতে পারেনি, সেখান থেকে বেরিয়ে তিনি ভিন্ন ভাষাভঙ্গিতে লেখার চেষ্টা করেন। ১৯৭২ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম কবিতাগ্রন্থ ‘ খোকন এবং তার প্রতিপুরুষ’। এই গ্রন্থের কবিতাগুলো মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা থেকে লেখা। তবে এসব কবিতায় চড়া স্বর নেই, শ্লোগান নেই; আছে কেবল মুক্তিযুদ্ধের ভাবগত বা দার্শনিক দিক ধরবার প্রবল আকুতি। দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘ত্রিভঙ্গের তিনটি জ্যামিতি’র নুহ এবং তার নভোজাহাজ, লালন ফকির, অহঙ্কার, সিংহষাঁড় প্রভৃতি কবিতায় তিনি অসাধারণ সব রূপক ব্যবহার করেছেন। প্রথম কাব্যগ্রন্থে তিনি ইসলামি পুরাণের ব্যবহার করেননি, কিন্তু দ্বিতীয় গ্রন্থ থেকে তিনি ধাবিত হয়েছেন ইসলামি পুরাণের দিকে। তবে, তিনি বলেছেন, ইসলামি পুরাণের ব্যবহার তিনি সজ্ঞানে করেননি। বাংলা ভাষাকে প্রাণবন্ত করার জন্যে এটা করেছেন হয়তো। এই গ্রন্থের‘ ত্রিভঙ্গ’ তিনি ইসলামি পুরানের নন, তিনি স্বয়ং কৃষ্ণ। তিনি বাঁশি বাজার সময় শরীরকে তিন ভাঁজ করে ফেলতেন বলে তার আরেক নাম ত্রিভঙ্গ। এ সময় ফরহাদ মজহার মনে করতেন, রাজনৈতিক পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় প্রবুদ্ধ হয়ে কবি হিসেবে কাজ করতে হবে। ইসলামি পুরাণ ও বাংলাদেশের গণমানুষের ইসলামি-অনুপ্রাণিত ভাব ও ভাষা এবং রাজনীতির বিপরীতে দাঁড়িয়ে লোকপুরাণ আত্মস্থ করে কবিতা রচনাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছেন। চৈতন্যদেব, নিত্যানন্দ ও অদ্বৈতাচার্য দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে লালন সাঁই পর্যন্ত যে ভাব ও ভাষা যা ‘নদীয়ার ভাব’ তথা গৌড়ীয় বৈষ্ণবীয় ভাব নামে পরিচিত , সেই ভাব সমুদ্রে অবগাহন করার চেষ্টা করেছেন তিনি । তিনি পুলকিত হয়েছেন এই ভেবে যে, তাকে নতুন করে পুরানো চাকা খুঁজতে হবে না। লালন ও নদীয়ার ভাবের মধ্যে ডুব দিতে পারলেই ইসলামের অন্তর্নিহিত শক্তি ও অরূপ রতনের সন্ধান পাওয়া সম্ভব হবে। সত্যিই কী তা-ই ? লালন কী কেবল ইসলামের মর্মকথা থেকে ভাবরস নিয়েছেন ? নদীয়ার ভাবরসের মধ্যে ইসলামের কী-বা আছে ? গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু কিংবা লালন কী সনাতন ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম থেকে কী রস নেননি ? তাহলে ইসলাম বোঝার জন্যে লালনের কাছে কেন ? লালন সম্পর্কে তিনি ‘লালন ফকির’ কবিতার মধ্যে বলতে চেয়েছেন :
তুমি আমার গুরু তুমি লালন ফকির/ এবং আমি লালন করছি তোমার দেহ/ পুষছি তোমার দৃষ্টি, তোমার দেহতত্ত্ব/ অচিন পাখি, নভোজাহাজ, / নিখিল থেকে নিচ্ছি তুকে দেহের খাতায় / চারটে সময় চারটে ঘড়ির/ যেন সময় ফস্কে না যায়/ যেন আমি কাঁটায় কাটায় বলতে পারি- / ‘ আমি হচ্ছি লালন ফকির’। তিনি কবি ও ভাবুক হিসেবে লালন অনুরাগী, লালনের সাধনক্ষেত্র কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় নবপ্রাণ আখড়াবাড়ি নামে একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছেন। রিচুয়ালস অনুযায়ী কুষ্টিয়ার খলিসাকু-ি গ্রামের রব ফকিরের কাছে বায়াত হয়েছেন, খিরকা নিয়েছেন কি-না জানিনা। সাধন-ভজনের জন্য সময়ে-অসময়ে সাধনসঙ্গীদের নিয়ে ছেঁউড়িয়ায় আসেন, সেখানে গান ও তত্ত্ব আলাপ হয়। বাউল রীতি অনুযায়ী সেখানে দোলপূর্ণিমা ও লালন-তিরোধান দিবস উপলক্ষে তিনি সাধুসঙ্গ করেন। নবপ্রাণ আখড়াবাড়ির অনুষ্ঠানের কিছু রীতি আছে। এখানে সাঁইজির দৈনগান বেশি পরিবেশন করার চেষ্টা থাকে। ভোরবেলায় গোষ্ঠগান ও সন্ধ্যায় দৈনগান করা হয়। সাধুসঙ্গের সূচনায় মোমবাতি ও ধূপ জ্বালানো হয়। বাউলদের মতন ফরহাদ মজহার মনে করেন, ‘রাতে গোষ্ঠ দিনে রাস, যে গাই তার সর্বনাশ।’
ভাবতে অবাক লাগে, এই মতবাদে যিনি বিশ্বাস করেন, তিনি কীভাবে, কী করে হেফাজতের পক্ষে ফতোয়া দেন। আমার প্রশ্ন, তিনি কী লালনতত্ত্ব বোঝেন ? ‘লালন ফকির’ কবিতায় তিনি বলেছেন, লালনের ঘড়িটা চতুর্মাত্রিক, লালনের ভাব বুঝতে হলে এই চারমাত্রার জ্ঞান থাকা জরুরি। ‘ ত্রিভঙ্গের তিনটি জ্যামিতি’ লেখার সময় তার মনে হয়েছে দৈর্ঘ্য প্রস্থ ও উচ্চতার ত্রিমাত্রিকতার বাইরের যে জগৎ সেই জগতের সন্ধান না পেলে লালন কিংবা নদীয়ার ভাব সমুদ্রে অবগাহন করা যাবে না। তিনি কী নদীয়ার ভাব-সমুদ্রে সাঁতার কাটতে পেরেছেন ? না-কী ‘গেড়ে গাঙের ক্ষ্যাপা ’ হয়ে হাপুর হুপুর ডুব পেড়ে বেড়াচ্ছেন ? ‘ দিন ধরে তিনের সাধন’ তত্ত্ব কপচিয়ে তিনি যা করে বেড়াচ্ছেন, তাতে বাংলার সারস্বত সমাজ লজ্জ্বা পাবে। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও পত্র-পত্রিকায় তার কীর্তিকলাপ সম্পর্কে যেসব খবর ছাপা হয়েছে সেগুলি অত্যন্ত লজ্জ্বাকর। এখন অনেকেই তাকে স্খলিত, বিবেকবর্জিত, নীতিহীন মানুষ বলে মনে করছেন। এরপরও তাকে বাংলাদেশের সংস্কৃতি ভুবনের সবচেয়ে ভাগ্যবান ব্যক্তিত্ব বলে মান্য করা যায়। কারণ তার পক্ষে হেফাজতে ইসলামের মুখপাত্র বিবৃতি দিয়েছেন, আবার সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বদরুদ্দীন উমর, আনু মুহাম্মদ, রেহনুমা আহমেদ, আসিফ নজরুলের মতো খ্যাতিমান বুদ্ধিজীবীরাও তার পক্ষাবলম্বন করে ছাফাই গেয়েছেন। সত্যিই বিচিত্র দেশ! এখানে ইসলামের নামে ভ-ামি করেও পার পাওয়া যায়, আবার মুক্তচিন্তা চর্চা ও মানবাধিকারের নামেও ফুলসেরাত পার হওয়া যায়। তিনি এক সময় কৃষ্ণদাস কবিরাজের মতো কবি ও দার্শনিক হতে চেয়েছিলেন। কৃষ্ণদাস তো বৈষ্ণব ভক্ত ছিলেন, চৈতন্যেদেবের জীবনী বর্ণনার সাথে সাথে বৈষ্ণব দর্শন ব্যাখ্যা করে রচনা করেন বিখ্যাতগ্রন্থ চৈতন্যচরিতামৃত। ফরহাদ মজহার কার চরিতামৃত রচনা করতে চান ? লালন না আল্লামা শফীর ? রাধাকৃষ্ণ তত্ত্ব বোঝানোর জন্যে কবিরাজ মহাশয় বলেছেন, ‘ লীলারস আস্বাদিতে ধরে দুইরূপ/ রাধাকৃষ্ণ ঐছে সদা একই স্বরূপ ।’ ফরহাদ মজহারের তো দুই নয়, বহুরূপ। কখনও চারু মজুমদারের চ্যালা, কখনও লালনের অবতার, কখনও ইসলামের খাদেম শফী হুজুর-বাবুনগরীর তালেব-এলেম। বাহ, ‘একই অঙ্গে এত রূপ নয়নে না হেরি।’ লালনকে তিনি নাকি মরমি মনে করেন না, মনে করেন একজন লোকায়ত সাধক যার সবকিছুর মূলে রয়েছে ইহজাগতিকতা ও অমরত্বলাভের বাসনা। তাতো তিনি মনে করবেন-ই। কারণ মজহার তো পাপ-পুণ্য মানেন না, আধ্যাত্মিকতাতেও বিশ্বাস করেন না। তিনি ‘নগদ যা পাও হাত পেতে নাও ’ নীতিতে বিশ্বাসী। দেহাত্মবাদ, সূক্ষ ভোগবাদ, ইন্দ্রিয়পরায়ণতায় তার জীবনবাদের ও বেদের মূলকথা। অমরত্ব পিয়াসী ফরহাদ মজহারের কাছে, ‘ দেহের সাধন সর্বসার’-ই শেষকথা।
©somewhere in net ltd.