নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

নবীন আনন্দ

আবদুল্লাহ আল আমিন

আবদুল্লাহ আল আমিন › বিস্তারিত পোস্টঃ

ফরহাদ মজহার ও নয়াকৃষি আন্দোলন

০৩ রা আগস্ট, ২০১৭ সকাল ১১:৪৯


আবদুল্লাহ আল আমিন



একজন লেখক, ভাবুক যদি তার সমাজ, সংস্কৃতি, রাষ্ট্র, মানুষের জীবন-জীবিকা নিয়ে যদি না ভাবেন, না লেখেন- যে সমাজ নিপীড়িত, অত্যাচারিত, শোষণে জর্জরিত-তাহলে তিনি কী নিয়ে ভাববেন, কী নিয়ে লিখবেন ? রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শরৎচন্দ্র অসাম্যে-জাতপাতে বিভক্ত, সমস্যাদীর্ণ ও দ্বন্দ্বপীড়িত সমাজ ও রাষ্ট্র নিয়ে ভেবেছেন এবং জীবৎকালে দু হাত ভরে লিখেছেন। তারা নিজ-জীবনের শোকতাপ, দুঃখ- বেদনা নিয়ে যেমন লিখেছেন, তেমনই লিখেছেন রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে। ভারতবর্ষের সামগ্রিক মুক্তির জন্যে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতন, শ্রীনিকেতন প্রতিষ্ঠা, প্রজাদের কৃষিব্যাংক স্থাপন করেন, নজরুল রাজনীতিতে যুক্ত হন। অনিঃশেষ সৃজনক্ষমতা দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের ব্রাত্য বসু ( জন্ম : ১৯৬৯) নাটক লিখছেন অনবরত, রাজনীতি নিয়ে নাড়াচাড়া করছেন, দু বার মন্ত্রী হয়েছেন। ভারতীয় লেখক অরুন্ধতী রায় সাহিত্য ছেড়ে যুক্ত হয়েছেন এস্টাবলিশমেন্ট বিরোধী প্রতিবাদী ধারার রাজনীতির সঙ্গে। রাজনীতি- ঘনিষ্ঠ কর্মকা-ে ব্যস্ত থাকার কারণে প্রথম উপন্যাস ‘দ্য গড অব স্মল থিংস’ প্রকশিত হওয়ার পর ২০ বছর কোনো ফিকশন লেখেননি। কলাকৈল্যবাদের ঘেরটোপে আটকে না থেকে সক্রিয় হন প্রতিবাদ-প্রতিরোধ-সংগ্রামে ও মানবমুক্তির লড়াইয়ে। যুক্ত হন মাওবাদী, কাশ্মীরি বিচ্ছিন্নতাবাদী, পরিবেশবাদী আন্দোলন, ভূমিহীন- দলিতদের সঙ্গে। ইরাকযুদ্ধ ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসী নীতির বিরূদ্ধেও তিনি ছিলেন উচ্চকণ্ঠ। গুজরাটের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ভূপালের গ্যাস বিস্ফোরণ, দিল্লির ছাত্র বিক্ষোভ নিয়েও কথা বলেছেন। অরুন্ধতী রায় গত আড়াই দশক ধরে ভারতের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন, যে ভারত সামন্ততান্ত্রিক, দুর্নীতিনির্ভর ও নিবর্তনবাদী। তিনি লড়ছেন সাম্প্রদায়িক শক্তির ধর্মের নামে ক্ষমতা দখলের বিরুদ্ধেও। সম্প্রতি প্রকাশিত তার দ্বিতীয় উপন্যাস ‘ দ্য মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস’ এ তিনি লেখেন : ‘ গোধূলি প্রহরে, যখন সূর্য অস্তমিত হয়েছে কিন্তু তার আভা তখনো বদলায়নি, ঠিক সে সময় পুরোনো কবরখানার বুড়ো বটগাছ থেকে এক এক করে নামতে নামতে থাকে বাদুড়ের দল। তারা ধোঁয়ার মতো ভাসতে থাকে। বাদুড় চলে গেলে ফেরে কাকের দল। তাদের গৃহে ফেরার হুটোপুটিতে অবশ্য বাদুড় অথবা সাদা-পিঠ শকুনের ফেলে যাওয়া নৈঃশব্দ পূর্ণ হয় না। লক্ষ- কোটি বছর ধরে এই সব শকুনের দল মৃতদেহের পাহাদার হিসেবে কাজ করেছে, ডিক্লোফেনাকের রাসায়নিক বিষক্রিয়ায় তারা সব মৃত। ডিক্লোফেনাক নামের এই এসপিরিন গরুদের খেতে দেওয়া হয়, দুধের উৎপাদন বাড়াতে। এই ওষুধ শকুনের ওপর কাজ করে ঠিক নার্ভ গ্যাসের মত। মৃত প্রতিটি গরু টোপ হয়ে ধরা দেয় শকুনের কাছে। গরু ক্রমশ হয়ে ওঠে দুধের কারখানা। সেখান থেকে শহুরে মানুষের জন্য তৈরি হয়ে আসে আরও বেশি বেমি আইসক্রিম, মজাদার ননি ও চকলেটমাখা বিস্কুট। আসে আমের মিল্কশেক। শকুনের গ্রীবা দীর্ঘ হয়ে ঢলে পড়ে, যেন তারা ভীষণ ক্লান্ত, জেগে থাকা অসম্ভব। তাদের ঠোঁট থেকে গলে পড়ে লালা, আর তারপর এক এক করে তারা গাছের ডাল থেকে হুমড়ি খেয়ে পড়ে, মৃত।’
অরুন্ধতী তার দ্বিতীয় উপন্যাসে রাসায়নিক দ্রব্যের বিষক্রিয়া ও এর উৎপাদনকারী বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর আগ্রাসী পুঁজির বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। তিনি আরও বলেছেন, বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর আগ্রাসী পুঁজির শিকার কেবল গবাদিপশু, বাদুড় ও শকুন নয়,সাধারণ মানুষও। ফরহাদ মজহারও দু দশক ধরে পরিবেশবাদী ও নয়া কৃষি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। পশ্চিমবঙ্গের নাট্যকার ব্রাত্য বসুর মতো মজহারেরও বাংলাদেশের রাজনীতিতে বেশ নামডাক আছে। তিনি মন্ত্রী হননি, কিন্তু রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। কবিতা, নাটক , প্রবন্ধ যা-ই লেখেন না কেন, তার ওপরে থাকে নান্দনিকতার গাঢ় রং পোস্টার সাঁটানো আর ভেতরে থাকে ধ্বংসাত্মক রাজনীতির দগদগে ঘা। তিনি কখনও অরুন্ধতী রায়, কখনও ব্রাত্য বসু হতে চান। চেক প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট মহান নাট্যকার ভাস্লাভ হ্যাভেল হতে চান কীনা, জানি না। তবে শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের কেউ গাছ-গাছালি কাটলে তিনি নীরবতা পালন করেন ! বাংলাদেশের গাছ-লতাপাতা-গুল্মের প্রতি অপরিসীম দরদ ! তিনি নৃতত্ত্ব নামে একটি কবিতা লিখেছেন। এই কবিতায় তিনি দাবি করেছেন, ‘আমি আমার আপন ইন্দ্রিয় থেকে জন্ম লাভ করি।’ নৃতত্ত্ব তার জীবনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে চলেছে বলেই হয়তো তিনি এই দাবি করতে পেরেছেন। বিশেষত, প্রাণ, কৃষি, পরিবেশ ও লৌকিক জ্ঞানের তুলনামূলক বিচারের জন্য তিনি সর্বক্ষণ নৃতত্ত্বের সঙ্গে সখ্য-সম্পর্ক বজায় রাখেন। তিনি রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ছাড়া চাষাবাদের চেষ্টা করছেন। বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর আগ্রাসী পুঁজির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ হিসেবে কৃষিক্ষেত্রে বিকশিত লোকায়ত জ্ঞান কাজে লাগানোর কথা ভাবছেন। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে, লোকায়ত জ্ঞানের সঙ্গে আধুনিক প্রাণিবিজ্ঞানের কোনো বিরোধ নেই। রাসায়নিক সার ছাড়াও আমাদের দেশীয় পদ্ধতি ব্যবহার করে কৃষিক্ষেত্রে অগ্রগতি সম্ভব। সার ও কীটনাশক ছাড়া চাষাবাদে অগ্রগতি সম্ভব কী-না তা নিয়ে বিতর্ক আছে, যেমন রয়েছে বাংলাদেশের পরিবেশবাদীদেও রাজনৈতিক অবস্থান ও কর্মকা- নিয়ে। যেমন, বিতর্ক আছে রামপাল তথা সুন্দরবন এলাকায় বিদ্যুৎকেন্দ্র কিংবা রূপপুর পারমানবিক কেন্দ্র স্থাপন নিয়ে । বিতর্ক থাকলেও পরিবেশ ও প্রকৃতি সম্পর্কে সবার একটা দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি ও রাজনৈতিক অবস্থান থাকা প্রয়োজন। প্রকৃতির উপর দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নয়া উপনিবেশবাদী শক্তি যে আগ্রাসন চালাচ্ছে, তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্য একটা রাজনৈতিক অবস্থান ও দৃষ্টিভঙ্গির থাকার দাবি দিন দিন জোরদার হচ্ছে। আপনি প্রকৃতি-পরিবেশের উপর মাতবরি করবেন, নাকি তাদের লালন-পালনের দায় নিজ স্কন্ধে তুলে নিয়ে নিজ-বিকাশ নিশ্চিত করবেন। কারণ আপনিও তো প্রকৃতি-বিচ্ছিন্ন সত্তা নন। মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্ক কেমন হওয়া দরকার- তারও একটা দার্শনিক ব্যাখ্যা প্রয়োজন বলে মজহার মনে করেন। কৃষকসমাজ ও কৃষিব্যবস্থাকে ধ্বংস করে খাদ্য-উৎপাদনের দায়িত্ব দুনিয়ার গুটিকয়েক বহুজাতিক কোম্পানির হাতে তুলে দেয়া হবে, নাকি জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য লড়াই করতে হবে, সেটা অবশ্যই একটি রাজনৈতিক প্রশ্ন। প্রগতি মানে বন,নদী খেয়ে ফেলে, কৃষিসভ্যতাকে হত্যা করে নগর প্রতিষ্ঠা- এমন ধারনাকে ফরহাদ মজহার বিপদজনক মনে করেন। নদী, বন, প্রকৃতি, জীববৈচিত্র্য, প্রাণের রক্ষা ও বিকাশের মধ্য দিয়ে তিনি এগিয়ে যেতে চান আগামীদিনের ঠিকানায়। কিন্তু বাস্তবতা কী তা পারমিট করবে ? ‘নৃতত্ত্ব’ কবিতায় তিনি নিজেকে নিজ-ইন্দ্রিয় থেকে পুনর্নির্মাণের যে তাগিদ অনুভব করেছেন, তা কী সম্ভব ? সেই শান্ত সামগান, সন্ধ্যা¯œান কী ফিরে আনা সম্ভব ? রবীন্দ্রনাথ নবযুগের চালক না হয়ে, ব্রজের রাখাল বালক হতে চেয়েছিলেন । সেটা এই বহুজাতিক কোম্পানির আগ্রাসী পুঁজি-নিয়ন্ত্রিত বিশ্বায়িত দুনিয়ায় ইউটোপিয় নয় কী ? পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থা, সা¤্রাজ্যবাদ থেকে আধুনিক মানুষের জীবন-জীবিকাকে কী কেউ আলাদা করতে পারবে ? নবপ্রাণ আখড়াবাড়িতে বসে লালনতত্ত্ব নিয়ে ‘সাঁইজির দৈনগান’ লেখা যেতে পারে। কিংবা ‘রক্তের দাগ মুছে রবীন্দ্রপাঠ’ লিখে রবীন্দ্রনাথকে হিন্দু হিসেবে দাঁড় করিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের পাশাপাশি পা-িত্য জাহির করা সম্ভব, প্রেসক্লাবে দাঁড়িয়ে মানাধিকারের কথা বলে জঙ্গিবাদ উসকিয়ে দেয়াও সম্ভব, কেবল সম্ভব নয় ফাঁপাবুলি দিয়ে সতের কোটির বিশাল জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। লালনতত্ত্বের আলোকে জাত-সিফাত, নাফি-এজবাত, সাকার-নিরকার নিয়ে কথা বলা আর কৃষিবিজ্ঞানের বিপুল জ্ঞানতত্ত্বকে এক বিন্দুতে মিলিয়ে দেখা ঠিক না। ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, পুরাণ, আখ্যানের ভেতরে অনেক মানবিক বিষয় রয়েছে এবং এসবের পুনরুদ্ধার জরুরি বলে মনে করি। ফরহাদ মজহারও মনে করেন। কিন্তু এসব নিয়ে হিপোক্র্যাসি করা কিংবা রজত- লোভী বৈশ্যের আচরণ করা কী উচিৎ ?

মন্তব্য ১ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ০৩ রা আগস্ট, ২০১৭ দুপুর ১:১১

ব্লগ সার্চম্যান বলেছেন: ভালো লাগল আপনার কথাগুলো ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.