![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আবদুল্লাহ আল আমিন
মানুষ যে অমিত সম্ভাবনার আধার, তা স্টিফেন হকিং-এর দিকে তাকালেই বোঝা যায়। এ কথা সত্য যে, আমরা সবাই প্রতিমুহূর্তে এক অনিবার্য মৃত্যুর ধুমল-কালো ছায়ার নিচে বাস করছি, মৃত্যুগাছে ফুল ফুটিয়ে কখন যে কে ঝরে পড়বে তার কোনোই নিশ্চয়তা নেই। তারপরও আমরা নানাভাবে জীবনের রূপ-রস-গন্ধ উপভোগ করি। কারণ মৃত্যুকে আমরা ভুলে থাকি, ভুলে থাকতে চাই। কিন্তু জটিলরোগে আক্রান্ত হয়ে, চোখের সামনে মৃত্যুর কালো ছায়ামূর্তিকে দণ্ডায়মান দেখে কেউ কী জীবন উপভোগ করতে পারে? পারে না। কিন্তু হকিং জীবনকে উপভোগ করতে পেরেছিলেন আর পাঁচজন স্বাভাবিক মানুষর মতো। চলৎশক্তিহীন হয়েও হীনমন্যতায় ভোগেননি। দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেও জীবনকে ভালোবাসতে পেরেছিলেন তিনি। সর্বশক্তিমান ঈশ্বরে সমর্পিত একজন প্রবল ধার্মিকও কী হকিং-এর মতো স্বাভাবিক জীবন-যাপন করতে পারবেন? সব কিছু মেনে নিয়ে তিনি কী নিঃশঙ্কচিত্তে বলতে পারবেন?- ‘এই করেছ ভালো নিঠুর হে,/ এমনি করে হৃদয়ে মোর তীব্র দাহন জ্বালো।’ রবীন্দ্রনাথ কী পারতেন? দীর্ঘ ৮১-বছরের জীবন-পরিক্রমা পার করেও কী মৃত্যুকে স্বাভাবিক চিত্তে মেনে নিতে পেরেছিলেন তিনি? রবীন্দ্রনাথ, রাসেল, পিকাসো, রামকৃষ্ণ, নেহেরু, চার্চিল কেউ-ই পারবেন না। কিন্তু হকিং পেরেছিলেন। তিনি যে কীভাবে মৃত্যুভীতি জয় করতে পেরেছিলেন সেই বিস্ময়ের ঘোর আমাদের কাটে না। তার পানে চেয়ে বিস্ময়ের ঘোর কাটতে চাই না। হয়তো জন্ম জন্মান্তরেও বিস্ময়ের ঘোর কাটবে না। বিস্ময়াভিভূত হয়ে কেবল রবীন্দ্রনাথের গানের কথা দিয়ে বলতে ইচ্ছে করে:
‘মহাবিশ্বে মহাকাশে মহাকাল মাঝে/ আমি মানব একাকী ভ্রমি বিস্ময়ে, ভ্রমি বিস্ময়ে।’
সত্যিই স্টিফেন হকিং মহাবিশ্বের এক বিস্ময়কর নক্ষত্র। নইলে যার এত আউটস্ট্যান্ডিং প্রতিভা তিনি কেন স্বল্প বয়সে চলৎশক্তি হারালেন? কেন তিনি স্বাভাবিক জীবন-যাপন করতে পারলেন না? প্রকৃতির কী নির্মম খেলা! সত্যিই বিহ্বল, হতবিহ্বল দু-ই হতে হয়। আমি বিজ্ঞানের শিক্ষক নই, তারপরও এই বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানীর প্রতি এক ধরনের টান অনুভব করি। হয়তোবা উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত বিজ্ঞান পড়েছি, তাই! এই সেলিব্রিটি পদার্থবিজ্ঞানীর বইয়ের সাথে আমার প্রথম পরিচয় ১৯৯৯-এর ফেব্রুয়ারিতে যখন মেহেরপুর সরকারি কলেজে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করি। তখন আমাদের জীবনে এক ঘোরলাগা কালপর্ব চলছে। এক ঝাঁক মেধাবী তরুণ তখন মেহেরপুর কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেছেন। তাদের মধ্যে কেউ সাহিত্য পড়ান, কেউ বিজ্ঞান, কেউবা দর্শন-রাজনীতি। কিন্তু সবাই ছিলেন বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদী ও পড়ু–য়া। চাকরি নিয়ে প্রায় সবার মাঝে এক ধরনের হতাশা কাজ করছে। তারপরও এক মহানন্দে মেতে উঠতাম আমরা ক্লাসের পরে। ঘন্টার পর ঘন্টা শিক্ষক লাউঞ্জে বসে আমাদের মধ্যে তুমুল তর্ক চলতো বিজ্ঞান, কবিতা, সাহিত্য, দর্শন,চাকরি-বাকরি, ব্যাবসা-বাণিজ্য নিয়ে । তর্ক হতো মহাবিশ্বের সীমা-পরিসীমা নিযে। কেউ কেউ প্রশ্ন করতেন, মহাবিশ্ব কোথায় থেকে এলো? মহাবিশ্ব কী কখনও সৃষ্টি হয়েছে? নাকি চিরকালই আছে নানারকম রূপান্তরের মধ্য দিয়ে? প্রকৃতির এত বৈচিত্র্য কিভাবে এলো? ‘সময়’ কী কখনও পশ্চাদগামী হবে? এই মহাবিশ্ব কেন টিকে আছে? কত রকমের প্রশ্ন! একদিন স্টিফেন হকিং-এর ‘আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’ হাতে পেয়ে চোখের সামনে টানানো পর্দাটা সরে গেল। মহাবিশ্ব সম্পর্কে নতুন করে কৌতূহল জেগে উঠলো আমার ভেতরে। বিজ্ঞান ও মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমার জ্ঞান এত স্বল্প ছিল যে, শিশুর মতো নানা প্রশ্নবাণে আমাদের তর্কসভাকে তপ্ত করে তুলতাম। হকিং-এর বই-ই আমাকে শিশুর মতো কৌতূহলী করে তুলেছিল। এটি বিজ্ঞানের বই হলেও কোনো ভারী বই নয়, জনপ্রিয় বই বলতে যা বোঝায় তেমন। লেখক হিসেবে হকিং চেয়েছিলেন এমন ধরনের-ই একটা বই লিখতে, যেটা পথেঘাটে মানুষ পড়বে। হকিং-টেক্সটা আমার পড়া হয়নি, আমার পঠিত বইটি ছিল শত্রুজিৎ দাশগুপ্তকৃত ভাষান্তর, আর প্রকাশক ছিলেন কলকাতার বাউলমন প্রকাশনের দেবব্রত ভট্টাচার্য়। দাম: ৮০ টাকা মাত্র, বাঙালি পাঠকের আর্থিক সামর্থ্যরে কথা ভেবে এই দাম নির্ধারণ করা হয়। শত্রুজিৎ দাশগুপ্ত কৃত অনুবাদ গ্রন্থটি পড়ে জানতে পারলাম, মহাবিশ্ব ক্রমাগত সম্প্রসারিত হচ্ছে। আর এই সম্প্রসারণের হার ক্রমশ বেড়েই চলেছে। আরও জানতে পারলাম যে, সম্প্রসারিত মহাবিশ্বের শুরু আছে কিন্তু শেষ নেই। মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে মহাবিশ্বের সৃষ্টি, আরেক মহাদুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে এর বিনাশ হবে , কিন্তু কালস্রোত চলতে থাকবে। জগৎ ও তার সৃষ্টি-রহস্য সম্পর্কে জানতে গিয়ে ‘আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’-এ এমন এক হকিং-এর সন্ধান পেলাম, যিনি একাধারে প্রতিভাবান বিজ্ঞানী ও তীব্র রসবোধসম্পন্ন লেখক। তার কাছে মহাবিশ্ব যেন এক পরিহাসময় ঠাট্টা। তার বইয়ের পাতায় পাতায় ঈশ্বর আছেন। কিন্তু সে ঈশ্বর ইহুদি বা খ্রিস্টান ধর্মের ঈশ্বর নন। দর্শনের ঈশ্বর নন। তিনি যে ঈশ্বরের কথা বলেছেন, সে ঈশ্বর আসলে বিজ্ঞানের‘নৈর্ব্যক্তিক ঈশ্বর’। এই ঈশ্বরের আসলে করার মতো কিছু নেই। আসলে পদার্থবিদ্যা ও গণিতের সমীকরণ প্রয়োগ করে ঈশ্বর বা স্রষ্টার তালাস পাওয়া যায় না। তাই তিনিও অসীম করুণাঘন, মহামহিম ঈশ্বরের সন্ধান পাননি। অসীমের উপলব্ধি ও ঈশ্বরের মন বোঝার জন্য ফিলোজফি ও মেটাফিজিক্স জানা দরকার। দর্শনকে তিনি মৃত বিষয় বলেছেন, তারপরও দার্শনিক উপলব্ধি দিয়ে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘ আমি বলছি না যে, ঈশ্বরের অস্তিত্ব নেই।এই পৃথিবীতে আছি বলেই মানুষ ঈশ্বরকে স্মরণ করে। এটা এক ধরনের ব্যক্তিগত সম্পর্কের মতো। তবু আমি মনে করি ব্যক্তিগত সম্পর্কের চেয়ে পদার্থবিদ্যার সূত্রমতে ঈশ্বর অস্তিত্বহীন।’
©somewhere in net ltd.