![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ক্লাশ ফাইভে পড়ি। বয়স আর কতই বা হবে- ১০ কি ১১ বছর। এই বয়সে সারাদিন হৈহুল্লোর করার কথা, ঘোরাঘুরি করার কথা, মাঠে খেলাধুলা করার কথা, হাসিঠাট্টা করে দিন পার করার কথা, সন্ধ্যায় মায়ের বকুনি খেয়ে পড়তে বসার কথা কিন্তু আফসোস, আমি সেই সুযোগটা পাই নি। নিয়তি আমাকে এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত করেছে। অভাবের তাড়নায় এই বয়সেই বাস্তবতার মুখোমুখি হতে শিখেছি। আমি বুঝেছি দিনমজুর বাবার পক্ষে হয়তো বিনা বেতনে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেওয়া সম্ভব কিন্তু খাতা কলম কিনে দেওয়াটা একপ্রকার বিলাসিতা। স্কুল থেকে ফিরে এসেই ইট ভাঙ্গতে চলে যেতাম। বিনিময়ে সপ্তাহ শেষে পেতাম ১০ - ১৫ টাকার মত। ছোট একটা মানুষ, কতটুকুই বা ইট ভাঙ্গতে পারি। তবুও এতে করে যদি বাবার উপর চাপটা একটু কমে। ইট ভাঙ্গতে বসে পাড়ার ছেলেদের খেলতে যাওয়ার দিকে আফসোসের চোখে তাকিয়ে থাকতাম আর নিজের ভাগ্যকে দোষারোপ করতাম। এর বেশি কী-ই বা করার ছিলো আমার। গরীবের সব আশা পূরণ হতে নেই। আফসোসই গরীবের একমাত্র সম্বল।
কোন অনুষ্ঠানে নতুন পোষাক পড়বো এটা ভাবতেই পারতাম না। তিন-চার বছর আগের ট্রাঙ্কে রাখা শার্টটাই নতুন আমেজে পড়তাম আর ছেড়া সেন্ডেলটা মুচির কাছ থেকে সেলাই করে যত্ন করে রেখে দিতাম বিশেষ দিন পড়বো বলে। সবার পায়ে জুতো দেখে আামরও আফসোস হতো, “ইশশ, যদি আমিও জুতা পড়তে পারতাম” জানতাম জুতা পড়তে চাওয়াটা কুজোর চিৎ হয়ে শোয়ার ইচ্ছার মতই। আফসোসই গরীবের একমাত্র সম্বল। তবুও “কত্তোদিন পরে পায়ে সেন্ডেল পড়বো, ভাবতেই মনটা নেচে উঠতো।
এমনি করে খেয়ে-পড়ে, কাজ করে ক্লাস এইট পাশ করলাম। বাবার পক্ষে পড়াশোনার খরচ চালানো অসম্ভব হয়ে পড়লো। তাই চলে গেলাম হোস্টেলে, যেখানে কাজের বিনিময়ে থাকা-খাওয়া ও পড়াশোনার ব্যবস্থা করা হয়। মাটি কাটা থেকে শুরু করে এমন কোন কাজ নেই যা আমাদের দিয়ে করানো হতো না। কষ্ট হলেও মুখ বুজে সহ্য করতাম। না করলে যে খাওয়া পাবো না, আর থাকতেও দিবে না। বাড়ির কথা, মায়ের কথা, বোনের কথা খুব মনে পড়তো, একটি ছোট বাচ্চার নিরব কষ্টের সাক্ষী একমাত্র তার বালিশ, যার মধ্যে রয়েছে চোখের এক একটি অশ্রুর ফোটার দাগ।
শার্টের নিচের বোতামটা ছিলো না, কেউ যেন না বুঝতে পারে তাই বেল্ট ছাড়াই শার্ট ইন করে স্কুলে যেতাম। অনেকে দেখে হাসতো, কিন্তু গরীবের অপমান বোধ থাকতে নেই। একচিলতে হাসি দিয়ে সব সহ্য করতাম। একদিন মা হাত খরচের জন্য ২০ টাকা দিতে চাইলো, আমি নেই নি, কারণ আমি জনতাম, আমার এই হাত খরচের টাকাটার জন্য বাড়িতে একবেলা লবন-ভাত খেয়ে পাড় করবে সবাই। তাই হাসি মুখে বলেছিলাম, “গত মাসেই তো ১০ টাকা দিয়েছিলে, ওইটাই আছে এখনো, এই টাকা লাগবে না।” হোস্টেল লাইফে আফসোস হতো, ইশশ, যদি ভালো একটা শার্ট পেতাম, যদি বেশি কাজ না করতে হতো, একটু স্বাধীনভাবে যদি ঘুরতে পারতাম। একটু বেশি সময় যদি খেলতে পারতাম। কিন্তু কিছুই করার নেই। বেঁচে থাকতে হলে হোস্টেলে থাকতে হবে, আর হোস্টেলে থাকতে হলে বন্দী হয়েই থাকতে হবে। আফসোসই গরীবের একমাত্র সম্বল।
ঢাকায় এসে ভার্সিটিতে ভর্তি হলাম। জব করার কারণে ক্লাসে বেশি যাওয়া হয় না। ফ্রেন্ডদের হ্যাং আউট দেখে আফসোস হতো, ফেসবুকে সহপাঠীদের পার্টিতে মজা করার ফটো দেখে আফসোস হতো, কর্মস্থলে যাওয়ার সময় অন্যদের আড্ডা দিতে দেখলে আফসোস হতো। মাঝে মাঝে ক্লাসমেটরা আমাকেও খাওয়ানোর কথা বলতো, কিন্তু আমি প্রত্যাখ্যান করতাম। এর জন্য আমাকে খ্যাত, আনস্মার্ট জাতীয় অনেক কথাই শুনতে হয়েছে। ওরা বলুক, এই খ্যাত হয়ে থেকেই অল্প অল্প জমানো টাকা দিয়ে যখন মায়ের হাতে একটি অল্পদামি শাড়ী, বাবাকে পাঞ্জাবী আর বোনকে ফ্রক কিনে দিলাম, তখন আমার পরিবারে যে আনন্দটা বিরাজ করেছিলো, তা আমি কোটি টাকা দিয়েও কোথাও পেতাম না। সেদিন ময়ের চোখে দেখেছিলাম আনন্দের অশ্রু, বাবার বুকে ছেলেকে নিয়ে গর্ব আর দেখেছিলাম বোনের উল্লাস। সেদিন প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, জীবনে অনেক বড় হয়ে, ভালো চাকরী করে বাবা-মায়ের কষ্ট লাঘব করবো।
আজ আমি অনেক বড় চাকরি করি। বেতন ভালো, বাড়ি আছে গাড়ি আছে কিন্তু যাদেরকে সুখে রাখবো বলে আমার সারা জীবনের প্রচেষ্টা, তারাই নেই্। ছেলের কামাই করা টাকায় ভাত খেতে পারলো না, সুন্দর পোশাকে তাদের একমাত্র ছেলেকে দেখে যেতে পারলো না। ছেলের টাকায় পড়তে পারলো না কিছুই। আমারও আফসোস রয়ে গেল- তাদের কষ্টের অবসান ঘটাতে পারলাম না, সুখের আলো দেখাতে পারলাম না, প্রতিষ্ঠিত ছেলের ভালোবাসা দেখাতে পারলাম না। আজ বুঝতে পারলাম, আফসোস শুধু গরীবের জন্যই নয়। একটা সময় মা-বাবা ছিলো কিন্তু টাকা-পয়সা ছিলো না, আজ আমার সব আছে কিন্তু বাবা-মা নেই-সুখ নেই। জীবনের সব আশা কখনো একসাথে পূরণ হয় না, অনেকটা অর্থনীতির সুযোগ ব্যায়ের মত। একটা পেলে আরেকটা হারাতে হয় বা বিসর্জন দিতে হয়। জীবনে আফসোসই একমাত্র সম্বল।
বিঃদ্রঃ সব চরিত্র কাল্পনিক।
১২ ই নভেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৫:১৪
দিগন্ত জর্জ বলেছেন: এই ব্লগের পাঠক আমি অনেক দিন থেকেই, আজই প্রথম সদস্য হলাম আর লেখা পোস্ট করলাম। আপনার মন্তব্যের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।
২| ১৯ শে নভেম্বর, ২০১৫ সকাল ৮:১০
সাবুজ বলেছেন: ভালো
©somewhere in net ltd.
১|
১২ ই নভেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৪:১৫
কাবিল বলেছেন: গল্প ভাল হইছে। আমিতো বাস্তবই ভাবছিলাম। তবে এমন ঘটনা আমাদের সমাজে আছে।
ব্লগে স্বাগতম।