![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
বাস থেকে নামতেই টিপটিপ করে বৃষ্টি শুরু হল।প্রথমে গুড়ি গুড়ি,তারপর ইলশে গুড়ি তারপর হঠাতই আকাশ বাতাস ঝাপিয়ে বড় বড় ফোঁটায় ঝড়তে শুরু করল প্রবল শ্রাবন ধারা।নিলয় তাড়াতাড়ি একটা চায়ের দোকানের ছাউনি তলে আশ্রয় নিলো।বাড়ি যেতে যেতে হাটাপথে আরও বিশ থেকে পঁচিশ মিনিটের মামলা।সঙ্গে ছাতা নেই।এই বৃষ্টিতে হেটে যাবার কোন প্রশ্নই ওঠে না।একসময় তীব্র বৃষ্টিতে খোলা প্রান্তরে ঘুরে বেড়াতে ভাল লাগত।সেইসব দিনকাল অতীত হয়েছে।এখন আর ভাল লাগে না।
নিলয় চিন্তিত মুখে রাস্তার দিকে তাকালো।যদি কোনো রিক্সা পাওয়া যায়!কিন্তু রিক্সাওয়ালাদেরও বোধহয় আজ যাত্রী তোলায় খুব একটা আগ্রহ নেই।অনেকেই ছাউনি তলায় দাড়িয়ে আয়েশ করে সিগারেট টানছে।তাদের বিরক্ত করার কোন মানেই হয় না।বৃষ্টির ছাঁট এসে নিলয়ের চোখেমুখে লাগছে।হঠাতই তার মনটা উদাস হয়ে গেল।মনের কোনে উঁকি দিচ্ছে রবীন্দ্রনাথ-
“এমন দিনে তারে বলা যায়
এমন ঘনঘোর বরিষায়”
নিলয়ের মনটা হঠাতই অদ্ভুত বিষাদময়তায় আক্রান্ত হলো।এমন ঘন শ্রাবন ধারাই পারে মানুষের মনে এরূপ চেতনার সৃষ্টি করতে।প্রকৃতি অকৃপন ভাবে তাকে সেই ক্ষমতা দিয়েছে।নিলয়ের হঠাৎ করেই নিবৃতাকে মনে পরে যায়।মিষ্টি একটা মেয়ে।সারাক্ষনই সবার সাথে এটানাহয় ওটা নিয়ে মজা করছে।কখনও হঠাৎ করেই করেই গম্ভীর হয়ে যাচ্ছে।কারো সাথেই কথা বলছে না।বাধ্য হয়ে নিলয়কেই যেতে হচ্ছে তার অজানা অভিমান ভাঙাতে।তার প্রক্রিয়াও অদ্ভুত।একের পর এক কবিতা আবৃত্তি করে তার মান ভাঙাতে হচ্ছে।নিলয় ঠিক জানে যখন নিবৃতাকে অনুরোধ করে একটা গান শোনা যাবে তখনই বুঝতে হবে তার মন ভালো হয়েছে।তাই নিলয় কোনো গান না শোনা পর্যন্ত নিবৃতার কাছ ছাড়তো না।গান শুনে, তার মন ভালো হওয়ার নিশ্চয়তা নিয়ে তবেই নিলয়ের অন্য কোথাও যাওয়া।
নিবৃতা গান খুব ভালো গাইতো,বিশেষ করে রবীন্দ্রসঙ্গীত।নিলয়ের সাথে নিবৃতার পরিচয়ইতো এই রবীন্দ্রসঙ্গীত দিয়ে!বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষে পড়ার সময়ই এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সে প্রথম খেয়াল করে নিবৃতাকে।সবুজের মাঝে হলুদ ফোটার শাড়ী পরিহীতা,বড় খোপায় বেলীফুলের মালা জড়িয়ে রখা সেই কিন্নরকন্ঠীর রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনে নিলয় সেদিন প্রায় একপ্রকার মুগ্ধই হয়ে যায়।তারও সেদিন কবিতা আবৃত্তি ছিল।অনুষ্ঠান শেষে সে যখন ভাবছে মেয়েটিকে তার গানের জন্য ধন্যবাদ দেবে তখনই পেছন থেকে নারী কন্ঠ ঝনঝনিয়ে উঠল-
-বাহ্,খুব ভাল আবৃত্তি করেন তো আপনি।
নিলয় পেছনে ফিরে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে দেখতে পায় সেই মেয়েটি।বিস্ময় কেটে যেতেই সে বলল
-কিন্তু আপনার মতো সুরের মুর্ছনাতো তুলতে পারি না।
-আরেব্বাস,ভাল কথার পিঠে কথা বলতে পারেন তো!আর আমাকে আপনি করে বলছেন কেন?আমিতো আপনার জুনিয়ার।
মেয়েটি তরল হাসিতে ভেঙ্গে পড়ে।আর নিলয় অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।হঠাৎ হাসি থামিয়ে বলল ডান হাতটা নিলয়ের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল
-আমি নিবৃতা।অনার্স দ্বিতীয় বর্ষ,বাংলা বিভাগ।
মধ্যবিত্ত পরিবারে কঠোর অনুসাশনের মধ্যে বড় হওয়া,ছেলেদের স্কুল ও কলেজে পড়ার কারনে নিলয় কখনই মেয়েদের সাথে তেমন স্বাভাবিক হতে পারে না।সে অবাক লজ্জিত দৃষ্টিতে নিবৃতার বাড়ানো হাতের দিকে চেয়ে রইল।
-ওমা আপনি দেখি হাতও বাড়াতে জানেন না।মাইন্ড করলেন নাকি।
নিবৃতা হাসতে হাসতে বলল।নিলয় কোন কথা না বলে দ্বিধা ভেঙে নিবৃতার হাতে হাত মেলাল এবং অবাক হয়ে আবিস্কার করল তার সব দ্বিধা কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে।নিবৃতার হাতটিকে হঠাৎ করেই তার খুব আপন মনে হতে থাকে।
সেই থেকে শুরু তাদের পরিচিত পথ চলা।এরপর কেউই আর পেছন ফিরে তাকায়নি।আর ধীরে ধীরে পরিচয়টাও যেন একটা স্পষ্ট সম্পর্কে রূপ নিল অনেকটা তাদের অজান্তেই।তাই এক পড়ন্ত বিকেলে নিলয় যখন নিবৃতাকে একতোড়া বিভিন্ন রঙের গোলাপ নিবেদন করে তার বাকী জীবনের সঙ্গী হিসেবে নিবৃতাকে পাওয়ার আকাঙ্খা প্রকাশ করল তখন সে হঠাৎ করেই খানিকটা গম্ভীর হয়ে গেল।নিলয়ও গেল ভয় পেয়ে।তবে কি এতদিন যা ভেবে এসেছে তার সবই ভ্রান্তি?কিন্তু খানিক পরেই মুখ টিপে হেসে ফুলগুলো নিয়ে হাটতে লাগল নিবৃতা।নিলয় তার পাশাপাশি হাটতে হাটতে ভয়ে ভয়ে বলল
-কই কিছু বললে না যে।
নিবৃতা চট করে দাড়িয়ে গেল।নিলয়ের চোখে চোখ রেখে বলল
-কারও জীবনে চলার সঙ্গী হতে হলে তার সমস্ত অনুভূতির ভাগীদার হতে হয়।তার মাঝে নিজেদের জন্য কিছু অনন্যসাধারন অনুভূতির সৃষ্টি করতে হয়।যা হয় অমূল্য।যার রেশ রয়ে যায় চিরকাল।তোমায় কথা দিচ্ছি,সারাটাজীবন তোমার সব অনুভূতির একান্ত ভাগীদার হয়ে থাকব।
পড়ন্ত বিকেলের শেষ আভায় নিবৃতাকে সেদিন ইন্দ্রানীর মতো লাগছিলো।ওর হাতে হাত রেখে অস্তায়মান সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নিলয়ের কাছে জীবনটাকে সেদিন খুব পরিপূর্ন লেগেছিলো।তাকিয়ে দেখতে পেল নিবৃতা কাঁদছে।থামাতে গিয়েও থামাল না সে।কান্নাতেও যে ওকে দারুন লাগছিলো।
প্রতিদিনই নিবৃতার সাথে দেখা করবার আকুলতা,তাকে সাথে নিয়ে বেড়াতে যাওয়া,হাতে হাত আর চোখে চোখ রেখে গল্প করা,সপ্নীল চোখে দুজনে মিলে আকাশের নীল সাদা ক্যানভাসে মেঘের আঁকিবুঁকি আঁকা সবকিছু মিলিয়ে নিলয়ের জন্য এক স্বপ্নময় সময় ছিলো সেটি।নিবৃতাকে নিয়ে বৃষ্টিবিলাস করতে করতে বা খোলা মাঠে বসে আকাশের তারা গুনতে গুনতে বা নরম জোছনার আলোয় নিবৃতার গান শুনতে শুনতে কতবার তার মনে হয়েছে,বাহ!জীবনটাতো চমৎকার।
কিন্তু হঠাৎ করেই একদিন সব ওলটপালট হয়ে গেল।নিবৃতা গ্রামে তার মামাবাড়ি যাবা আগের দিন নিলয়ের সাথে দেখা করতে এসেছিলো।তিন চার দিনের মাঝেই ফিরে আসবে এমন প্রতিশ্রুতি দিয়ে সে সেদিন নিলয়কে অনেকক্ষন জড়িয়ে ধরে রেখেছিলো।কিন্তু তার পরদিনই নিলয়ের মোবাইলে কল এলো একটি অপরিচিত নাম্বার থেকে।রিসিভ করতেই অপর প্রান্তে শোনা গেল কাঁপা কাঁপা এক নারীর কন্ঠ,
-হ্যালো নিলয় ভাই।আমি নিবৃতার বান্ধবী শিরিন বলছি।আপনি তাড়াতাড়ি একটু অ্যাপোলো হসপিটালে আসুন।নিবৃতা বাস অ্যাক্সিডেন্ট করেছে।ওর অবস্থা বেশী ভাল নয়।হ্যালো হ্যালো…
নিলয়ের কিছুক্ষন সময় লাগলো বুঝতে।যখন বুঝতে পারলো তখন মনে হলো কেউ ওর কানে গরম সীসা ধেলে ওকে বধির করে দিয়েছে,চোরাকাঁটা দিয়ে চোখ তুলে নিয়েছে।সে কিছু শুনতে পাচ্ছে না,কিছু দেখতে পাচ্ছে না।ওর চারদিক ভীষনভাবে দুলে উঠল।সবকিছু স্থবির।শুধু মনে হলো ভেতর থেকে কেউ বলছে,”সারাজীবন তোমার অনুভূতিগুলোর একান্ত ভাগীদার হয়ে থাকব”।
নিবৃতা মারা গেল সেদিন রাত আটটায়।মৃত্যুর ঠিক কিছুক্ষন আগে নিবৃতার জ্ঞান ফিরেছিলো।একলা কেবিনে নিলয় যখন উদভ্রান্তের মতো নিবৃতার দকে ছুটে গিয়েছে তখন নিবৃতা তার দিকে চেয়ে স্নিগ্ধ একটা হাসি দিল।তারপর ধীরে ধীরে বলল।
-দ্যাখো আমি কি ভাগ্যবতী।জীবনের শেষকটা দিন তোমার মত মানুষের সাথে কাটিয়েছি।
নিলয় তখন চিৎকার করে বলছিলো তোমার কিচ্ছু হবে না।সব ঠিক হয়ে যাবে।প্রত্যুত্তরে নিবৃতা বলল
-তোমার কাছে খুব বড় একটা সত্য গোপন করেছি।আমাকে ক্ষমা করে দিয়ো।ব্রেন ক্যান্সারে এমনিতেই নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছিলাম আমি।যাবার সময়টা একটু তরান্বিত হলো মাত্র।আমার জন্য সারাটা জীবন নষ্ট করোনা।ভালো দেখে একজন জীবনসঙ্গী খুজে নিও।তার মাঝে আমাকে খুঁজো না।তাকে ভালবাসতে পারলেই বুঝবে যে আমাকে তুমি সত্যিকার অর্থেই ভালবেসেছিলে।আর আমি আমার কথা রাখব।জীবনের শেষ কটা দিন তোমার সাথে খুব সুন্দর ভাবে কাটিয়েছি।তোমাকে দেয়া কথা মতো তোমার সারাজীবনের সকল অনুভূতির একান্ত ভাগীদার হয়ে থাকব আমি।মৃত্যুর ওপার থেকে।তারাদের রাজ্য থেকে আমার ভালবাসার মানুষটাকে আমি খুব সুখী দেখতে চাই।খুব সুখী।
সেদিন নিলয়ের বুকে মাথা রেখেই শুরু হয়েছিলো নিবৃতার মৃত্যু পরবর্তী জগতের অনির্দিষ্ট যাত্রা।নিলয়ের হঠাৎ মনে হলো যেন নিবৃতার দেহ থেকে তীব্র শিউলী ফুলের ঘ্রান ভেসে আসছে।কোথাও কেউ নেই।শুধু সে আর নিবৃতা।শুধুই নিঃসার শূন্যতা।
-ভাইজান যাইবেন নি কুনোহানে?
রি্সাওয়ালার কথায় নিলয়ের চমক ভাঙলো।বৃষ্টি ধরে এসেছে।এবার যাওয়া যেতে পারে।ঠিকানার কথা বলে ভাড়া ঠিক করে নিলয় রিক্সায় চড়ে বসল।আর মোবাইলটাও বেজে উঠল তখনই।রিসিভ করতেই,
-কি ব্যাপার।এতো দেরী করছো কেন?রাতে যে আমাকে আর নিবৃতাকে নিয়ে বাইরে খেতে যাবে তা কি ভুলে গেলে?
-আরে বৃষ্টিতে আটকে…
-আমি কিছু শুনবো না।দশ মিনিটের মাঝে বাসায় এসো।
-যাহ কেটে দিলো।
হ্যা।নিলয় বিয়ে করেছে।অদ্রিতা নামের যে অভিমানী মেয়েটিকে বিয়ে করেছে সেও তাকে মনেপ্রানে ভালবাসে।কোন এক মাতাল হাওয়া বয়ে যাওয়া অলস দুপুরে যখন নিলয় প্রবল আবেগে তার হাতে হাত রাখে,তখন মনে হয় দূর থেকে কেউ একজন হাসিমুখে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে।নিলয় চোখ তুলতেই দেখতে পায় সেটি নিবৃতা।
-বলেছিলাম না সারাজীবন তোমার অনুভূতিগুলোর একান্ত ভাগীদার হয়ে থাকব।
নিলয়ের চোখ আদ্র হয়ে ওঠে।তার প্রিয়তমা স্ত্রী সেই আদ্র চোখের ভাষা বুঝতে পারে কিনা কে জানে।
আর হ্যা,নিলয় আর অদ্রিতার একটি ফুটফুটে মেয়েও আছে।তার বয়স এখন পাঁচ বছর চলছে।নিলয় তার মেয়র নাম রেখেছে নিবৃতা।নিলয় নিবৃতার ছোটবেলার ছবি দেখেছিলো।সে মাঝে মাঝেই লক্ষ্য করে সেই ছবির সাথে তার মেয়ে নিবৃতার চেহারার বিস্ময়কর মিল।
নিলয় প্রকৃতির এই রহস্যময়তার কারন খুজতে যায় না।সে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে খেলাধূলারত তার ছোট্ট সোনামনি নিবৃতা রাজকন্যার দিকে।
২৬ শে জুন, ২০১৫ দুপুর ২:৩০
সাফিউল ইসলাম দিপ্ত বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ ভাই।ব্লগে স্বাগতম।
©somewhere in net ltd.
১|
২৬ শে জুন, ২০১৫ সকাল ৯:৩৪
সনজিম বলেছেন: অন্যন্য সুন্দর